আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন টেকটিউনস কমিউনিটি? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। বরাবরের মত হাজির হয়েছি বিশ্লেষণমূলক টিউন নিয়ে। চলুন শুরু করা যাক।
কিছুদিন আগেই আমি আপনাদের শুনিয়েছি আপনাদের নোকিয়ার আদি থেকে অন্ত। শুনিয়েছি আপনাদের টিস্যু তৈরির কোম্পানি থেকে নোকিয়া কিভাবে ফোন তৈরির কোম্পানি হয়। শুনিয়েছি কিভাবে একসময়ের পৃথিবী কাঁপানো নোকিয়া আজকে দিনে হারিয়ে গেলো।
তবে আশার কথা হচ্ছে নোকিয়া, HMD Global নিমের একটি কোম্পানি, যা নোকিয়ার কিছু কোর টিম মেম্বাররা মিলে তৈরি করে, তাদের মাধ্যমে এন্ড্রয়েডের সাথে ব্যাক করেছে। এটা যেন নোকিয়ার পুনরূজ্জীবন! কিন্তু নোকিয়ার এই পুনরূজ্জীবন কী নোকিয়াকে সেই আগে জায়গায় নিয়ে যেতে পাারবে?
আমি সব সময়ের জন্য নোকিয়া ভক্ত ছিলাম। প্রথম যখন শুনি নোকিয়া এন্ড্রয়েডের সাথে ব্যাক করছে তখন এটা নিয়ে আমি খুবই এক্সাসাইটেডও ছিলাম। অতঃপর নোকিয়া ফিরে আসলো। পর পর সবগুলো ফোন নিয়ে আইডিয়া নিলাম। কিছু কিছু দিক ভাল লাগল কিছু কিছু দিক খারাপ লাগলেও খুব একটা পাত্তা দেই নি কারণ ওই যে আমি নোকিয়া ফ্যান!
বর্তমানে আমি Nokia 9 ব্যবহার করছি আগে ব্যবহার করতাম Nokia 7। ফোনটি সব দিক থেকে আমার কাছে প্রিয় থাকলেও কিছু কিছু সমস্যা ফোনটিতে ছিলই, আজকে আমরা নোকিয়া বর্তমান সকল ফোন নিয়ে আলোচনা করব এবং এটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব কেন নোকিয়ার পুনরূজ্জীবনও বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন।
২০১৪ সালে নোকিয়া ব্র্যান্ড মাইক্রোসফটের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। এরপর ২০১৬ সালে HMD Global নামক ফিনিশ কোম্পানি নতুন করে নোকিয়াকে সাথে নিয়ে Nokia ব্র্যান্ডের ফিচার ফোন নিয়ে আসে এবং বিশ্বব্যাপী বাজারজাতকরন শুরু করে। তারা বাজার চাহিদা মাথায় রেখে অ্যান্ড্রয়েড ফোন তৈরি শুরু করে। আর এটাই ছিল নোকিয়ার পুনরূজ্জীবন।
নোকিয়া 7 যখন প্রথম বাজারে আসে এটির শুরু থেকে ব্যবহারকারীরা নানা রকম বাগ (bug) পায়। ফোনের Spotify এবং Google Map বারবার ক্রাশ করত এবং ইন্টারনেটে ফোনটি নিয়ে হাজার হাজার অভিযোগও ছিল। যেহেতু আমি নোকিয়া ফ্যান সুতরাং এগুলো আমলে নিই নি। ভেবেছি যেহেতু তারা নতুন কোম্পানি হিসাবে বাজারে এসেছে তাদের কিছু ভুল থাকতেই পারে এবং তারা খুব তাড়াতাড়ি সব গুলো বাগ ঠিক করে ফেলবে সাথে আরও ইম্প্রুভমেন্ট আসবে। সমস্যা হল, কোম্পানি বেড়েছে কিন্তু তাদের সমস্যা গুলো সমাধান তো করেই নি দিনের পর দিন আরও অভিযোগ এসেছে।
HMD Globe, কোম্পানি, যাদের মাধ্যমে নোকিয়া নতুন জীবন ফিরে পায়, তারা কিন্তু বসে থাকে নি। তারা নতুন নতুন ফোন রিলিজ দিয়েই গেছে। বর্তমানে তাদের ২২ টি স্মার্ট-ফোন আছে। ফোন গুলোতে দেশ ভিত্তিক বা ফিচার ভিত্তিক কোন শ্রেণী বিভাগ করা হয় নি। এর মাধ্যমেই বুঝা যায় যে তারা নতুন মাত্রার জটিলতা এড়ানোর মত ম্যাচিয়ুর এখনো হয় নি।
HMD Globe কোম্পানি, নোকিয়া ফোন গুলোতে তিন বছরের আপডেট একবারে দিয়ে দেয়। কিন্তু বর্তমানে ফোন গুলোর বিভিন্ন আপডেটের দরকার পরছে। যেমন কিছু দিন একটি নিউজ এসেছিল HMD নোকিয়া 8 এর আপডেট দিতে দেরি করছে, এবং নোকিয়া 7 তাদের ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি সংরক্ষণে ব্যর্থ হতে পারে যদি সঠিক সময়ে আপডেট না হয়।
এবার Nokia 9 এর দিকে আসি। ফোনটি তার ডিজাইনের জন্য এবং ৫ টি ক্যামেরার জন্য জনগণের মধ্যে দারুণ হাইপের সৃষ্টি করেছে এবং জনগণ এখন নোকিয়া গুরুত্বের সাথে দেখছে। Nokia 9 ফোনটি মিড-রেঞ্জের বাজেটের কিন্তু যদি পারফর্মেন্স এবং আপডেট এর কথা বলি তাহলে বলতে হবে ফোনটি যথেষ্ট বাগি (bug থেকে buggy)।
এটা মানতে হবে ফোনটিতে ক্যামেরা কোয়ালিটি যথেষ্ট ভাল ছিল এবং ডিজাইনের দিক থেকেও ছিল দুর্দান্ত কিন্তু সমস্যা ছিল আপডেট নিয়ে কারণ তাদের এই ফোনে বাগের পরিমান ছিল অসংখ্য। ফোনটি বাজারে রিলিজ হবার পর যে রিভিউ গুলো পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই ছিল "Don't buy it"। এর মধ্যে কিছু ছিল, আপডেট পর্যন্ত অপেক্ষা করুন তারপর কিনুন। ফোনটি বাজারে ব্যাপক সাড়া ফেলতে পারতো কিন্তু তাদের অসংখ্য বাগ এবং স্লো প্রসেসিং পারফর্মেন্স এর জন্য ব্যর্থ হয়।
নোকিয়া পুনরজনম নিয়ে আমার মত হাজার নোকিয়া ভক্তরা আশাবাদী থাকার পরেও তারা যখন একের পর এক ঝামেলাপূর্ণ ফোন বাজারে নিয়ে আসে তখন তাদের ব্র্যান্ড নেম দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ মানুষের মনে একটা ধারনার জন্ম হয় তারা হয়তো আগের সেই মোবাইল কোম্পানি নেই বা হতে পারবে না। তো ফলাফল স্বরূপ নোকিয়া এত গুলো ফোন বাজারে নিয়ে আসার পরেও তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র কিছু তৈরি করতে পারে নি।
কোম্পানিটি নিদিষ্ট কিছু ভাল মানের ফোন বাজারে না এনে একের পর এক শুধু নতুন নতুন ফোন তৈরি করে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে কোম্পানির ফোন বিক্রয়ে। প্রথম দুই বছরে ফোন বিক্রি যথেষ্ট ভাল থাকলেও তা ধরে রাখা যায় নি। ২ বছর বয়সী কোম্পানিটি ১ বছরে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ফোন বিক্রয় করার রেকর্ডও করেছিল। তারা যখন US মার্কেটে প্রবেশ করে তখন তাদের মার্কেট শেয়ার হারায় কারণ সেই মার্কেটে ইতিমধ্যে অনেক কোম্পানি ছিল এবং নোকিয়ার সেখানে ভাল কিছু করার দরকার ছিল কিন্তু তারা করতে পারে নি।
Glassdoor নামক বিখ্যাত ওয়েবসাইটে HMD Global এর স্টার্টআপ টি অনেক কারণেই সমালোচিত হয়। কোম্পানির অনেক কর্মচারী দাবী করে তাদের অনেক কাজের চাপে রাখা হচ্ছে, তাদের চাকরীচ্যুত করা হচ্ছে ইত্যাদি।
HMD Globe এর সবচেয়ে প্রভাবশালী পার্টনার FIH, যারা ফোন ম্যানুফেকচারিং এর দায়িত্বে ছিল। তারা দাবী করে ২০১৮ সালে তারা নোকিয়া ফোনের জন্য প্রায় ৩৬৮ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছে এবং এখনো তীব্র কম্পিটিশনে দারুণ চাপে আছে। আর এজন্য তারা নোকিয়া ফোন প্রস্তুতে অপারগতা প্রকাশ করে।
এই অবস্থায় নোকিয়ার কাছে দুইটি পথ খোলা। এক, তাদের ফোন মডেল বাদ দেয়া। দুই, নতুন পার্টনার খুঁজা।
FIH, Foxconn এর সাথে বিজনেস পার্টনারশিপ এ যায়। Foxconn হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইলেকট্রনিক ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি যারা প্রায় সকল বড় বড় কোম্পানির ইলেক্ট্রনিক পণ্য প্রস্তুত এর সাথে যুক্ত। আর এটা HMD এর জন্য মোটেই ভাল দিক ছিল না। এতে বুঝা যায় নোকিয়া নিজেকে স্বতন্ত্র ব্র্যান্ড হিসাবে তৈরি করতে খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
HMD বাজারে আসার পর ২০১৮ সালে Huawei এবং Xiaomi বাদে বাকি সব ফোন ব্র্যান্ড কে ফোন সাপ্লাইয়ের দিকে চাপে ফেলে দিয়েছিল। তাদের সাপ্লাই ১২৬% বৃদ্ধি পায় এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফোন সাপ্লাইয়ার হিসাবে নবম স্থানে চলে যায়।
যদিও বছরের শেষ দিকে তারা তাদের এই স্থান ধরে রাখতে পারে নি।
এবার আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে বাজারে এসেই কিভাবে তারা এটি করতে পেরেছিল? উত্তর খুবই সহজ, নোকিয়া আবার বাজারে ফিরে এসেছে এটা শুনে আমার মত হাজার হাজার নোকিয়া ভক্ত ফোন কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরেকটি কারণ ছিল উপরে বলেছি, কোম্পানিটি ভাল মানের ফোন তৈরি না করে অধিক ফোন তৈরি করছিল। অধিক ফোন প্রথম দিকে তাদের সাপ্লাই বাড়াতে পারলেও ফোনের পারফর্মেন্স এর জন্য তারা দীর্ঘমেয়াদি লাভবান হতে পারে নি।
নোকিয়া যদি তাদের আলাদা মার্কেট তৈরি করতে চায় তাহলে প্রথমেই তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু থেকে সুবিধা নেয়া বন্ধ করতে হবে। মানে হচ্ছে নোকিয়া নাম আছে সে জন্য সবাই নোকিয়া কিনবে বা ব্যবহার করবে এই ধারনা পরিহার করতে হবে। অনেক অনেক ফোন বাজারে না এনে নির্দিষ্ট কিছু ভাল ফোন নিয়ে আসতে হবে যেগুলো নিরবচ্ছিন্ন পারফর্মেন্স দিতে বাধ্য থাকবে। Nokia 9 এর মত ডিজাইনের ফোন বাজারে আনলেই হবে না সাথে সাথে এর পারফর্মেন্স নিয়ে ব্যবহারকারী সন্তুষ্ট কিনা তার খোঁজ নিতে হবে এবং নিয়মিত আপডেট এর ব্যবস্থা করতে হবে।
কেমন লাগল আজকেই এই টিউনটি তা অবশ্যই জানাবেন। এই টিউন পড়ে আপনার কি মনে হয় তা অবশ্যই টিউমেন্ট করুন।
পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন। আমাদের সমসাময়িক যে সংকট চলছে এর থেকে রক্ষা পেতে সবাই সচেতন থাকবেন কারণ আপনার সচেতনতাই পারে আমাদের সবাইকে খারাপ অবস্থা থেকে বাচাতে। সবাই বাসায় থাকুন আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, আল্লাহ হা-ফেজ।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।
অসাধারন পোস্ট, পড়ে খুব ভালো লাগলো। সেই সাথে শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।