আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন টেকটিউনস কমিউনিটি? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। আপনারা জানেন আমি প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানি নিয়ে বিশ্লেষণ মূলক টিউন করে থাকি। টিউন গুলোতে কোম্পানির বিভিন্ন ভাল দিক খারাপ দিক, তাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, সুযোগ প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি উঠে আসে। তো আজকেও এমন একটি টিউন নিয়ে হাজির হলাম, চলুন বিভিন্ন স্মার্টফোন ব্র্যান্ডের কিছু ব্যবসায়ী কৌশল নিয়ে আলোচনা করা যাক।
আজকের প্রায় সকল জনপ্রিয় ফোন কোম্পানি গুলো যেমন Oppo, OnePLus, Huawei তাদের নতুন নতুন ব্র্যান্ড নিয়ে আসছে। এর পেছনের কারণ জানলে অবাকই হবেন।
এই যে নতুন নতুন ব্র্যান্ড বাজারে আসছে এর পেছনে একটা ব্র্যান্ড দায়ী! আর সেটা হচ্ছে শাওমি। শাওমি কোম্পানিটি ২০১১ সালে বাজারে আসার পর পুরো চাইনিজ ফোন মার্কেটে দারুণ পরিবর্তন আনে। তাদের বিজনেস মডেলটি ছিল এমন যে তারা অনলাইনে ফোন বিক্রি করবে। আর যেহেতু তারা অনলাইনে মার্কেটিং করবে সুতরাং তাদের ব্যবসায় কোন মিডল-ম্যান বা বাংলায় যদি বলি মধ্যস্থতাকারী থাকবে না এবং এতে করে তাদের ফোনের মূল্যও হবে কম।
অন্য দিকে Oppo এবং Huwaei যারা অফলাইনে বিজনেস করতো তাদের বিজনেস মার্জিন এর ৫০% দিয়ে দিতে হতো তাদের ব্যবসায়ী পার্টনারদের। আর সব দিক বিবেচনায় অফলাইনে বিজনেস করাও ছিল অনেক ব্যয়বহুল। ফলাফল স্বরূপ তারা অনলাইন বিজনেস মডেলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঠিকতে পারছিল না।
অনলাইন ফোন রিটেইলিং এ শাউমির অগ্রগতি দেখে গতানুগতিক ফোন কোম্পানি গুলোও অনলাইনে বিজনেস প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়। Oppo এবং Huawei এর মত কোম্পানিও তাদের নিজস্ব অনলাইন ফোন ব্র্যান্ড লঞ্চ করে সাথে আক্রমণাত্মক মূল্য নির্ধারণ করে দেয় এবং সেটা মোটামুটি ছিল শাওমির সেই বিজনেস মডেলের মতই।
অফলাইন এবং অনলাইন রিটেইলিং, দুইটি ব্রান্ডের বিভক্ত হয়ে যায় কারণ দুইটি মাধ্যমেই বিশাল ব্যবসায়িক ব্যবধান ছিল। অফলাইনে একটি মোবাইল বিক্রি করতে অনেক খরচ পরতো সাথে সাথে ফোনের দামও বৃদ্ধি করতে হতো। কিন্তু শাওমির অনলাইন বিজনেসের জন্য Oppo এবং Huawei এর জন্য এসব দাম সবসময় ক্ষতির হতো। তাই সব মিলিয়ে অনলাইনে ফোনের নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করা ছিল সময়ের দাবি।
Oppo এর অনলাইন ব্রান্ড হচ্ছে OnePlus আর Huawei এর অনলাইন ব্রান্ড হল Honor। অফলাইন ব্রান্ড গুলো প্রায়ই তাদের ফোন গুলোতে প্রিমিয়াম ফিচার আগেই নিয়ে আসে যেমন Oppo তাদের ফোনের সুপার ফার্স্ট চার্জার ফিচার আনে দুই বছর আগে এবং দুই বছর পরে OnePlus এর এই ফিচার দেয়া হয় Dash Charger নামে। অন্য দিকে Huawei ফোনের Duo Camera ফিচারটিও Honor এ পরে আসে। অফলাইন ফোন গুলো তাদের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রিমিয়াম মার্কেটিং করে থাকে এজন্য তাদের ফোনের দাম স্বাভাবিক ভাবেই বেশি থাকে। অন্যদিকে অনলাইন ব্র্যান্ডের এমনটি করা লাগে না। এর জন্য দামও থাকে সাধ্যের মধ্যে।
শাওমির এই বিজনেস মডেলটি Oppo এবং Huawei গ্রহণ করে শাওমির সাথে কম্পিটিশনে আসার জন্য এবং তাদের এই প্ল্যানিং সফল হয়। এবার শাওমির সাথে অনলাইনে কম্পিট করার সুযোগ অন্যদের হয়ে গেলেও শাওমির কোন পথ ছিল না যে সে অফলাইনে তাদের সাথে কম্পিটিশনে যাবে। কারণ শাউমির অফলাইনে কোন বিজনেস ছিলই না। ফলাফল হিসাবে শাওমি তাদের অনলাইন বিজনেসে চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হয়। কিন্তু অফলাইনে যে তারা এটা প্রতিহত করবে সেই সুযোগও ছিল না।
চীন, ব্রাজিল, এবং ভারতেও শাউমির বিক্রি কমে যায় অন্য দিকে Oppo এবং Huawei এর বিক্রয় আগে থেকে দ্বিগুণ হয়ে যায়।
শাওমির কোন পথ ছিল না সুতরাং তারাও অফলাইনে বিজনেস করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাকি অফলাইন ব্র্যান্ড গুলোকে কিভাবে দামের দিক থেকে বিট করা যায় সেই সুযোগ খুঁজতে থাকে। শাওমি অফলাইনে বিজনেস করার জন্য আলাদা কোন ব্যান্ড নাম নেয় নি। তারা শাওমি নামেই বাজারে আসে এবং ফোন বিক্রি শুরু করে।
শাওমি আরেকটি কাজ করে, আর সেটি হচ্ছে ফোন বিক্রির পাশাপাশি অন্য কোন মাধ্যমে আয় করার পরিকল্পনা করে। যেখানে Oppo এবং Huawei শুধু মাত্র ফোন বিক্রি করতো সেখানে শাওমি ফোন বিক্রিতে লস দিয়ে হলেও ইন্টারনেট সার্ভিস বিজনেসে মনোনিবেশ করে। ফোন বাজারে ছাড়ার পর থেকে ইউজারের ব্যবহার পর্যন্ত তাদের সাপোর্ট দিতে হয় সফটওয়্যার আপডেট রাখতে হয়৷
অনেক ফোন কোম্পানি আবার ইন্টারনেট সার্ভিস এর মাধ্যমেও অর্থ উপার্জন করে যেমন, শাওমি। শাওমি ফোন বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের চেয়ে ইন্টারনেট সার্ভিসের মাধ্যম মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। আমি আমার আগের বিশ্লেষণ মূলক টিউন গুলোতে তাদের ইন্টারনেট সার্ভিস বিজনেস নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি চাইলে দেখে নিতে পারেন। শাউমি Xiaomi তাদের ব্যবসার মুনাফা কেন ৫ পারসেন্ট এর মধ্যে সীমাবন্ধ করে দিয়েছে?
শাওমি তাদের স্টোর গুলোতে ফোনের পাশাপাশি, পাওয়ার ব্যাংক, রাইস কুকার, ইলেকট্রনিক ওয়াকার ইত্যাদি বিক্রি করা শুরু করে। শাওমির একটি দারুণ কৌশল ছিল, তারা তাদের ফোন অফলাইনে বিক্রয় করলেও তাদের দাম অনলাইনের সাথে খুব বেশি পার্থক্য করে নি। আর তাদের এই কৌশল আসলেই কাজ করে এবং তাদের সেল ১০১% বেড়ে যায়।
শাওমির ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার রুপির সেগমেন্ট ভারতে দারুণ ভাবে সফলতা পায়। যদিও একই প্রাইজের Oppo এর f সিরিজ, Samsung এর j সিরিজ, এবং নোকিয়ার নতুন 6 ফোন গুলো ছিল।
শাওমির আক্রমণাত্মক মূল্য নির্ধারণ, একই সাথে অফলাইন ও অনলাইন ব্র্যান্ড সব মিলিয়ে Redmi কে সফল করে দেয়।
OnePlus এই ক্যাটাগরিতে কোন ফোন আনে নি। তারা সবসময় তাদের ফোনের দাম বাড়িয়ে গেছে। যেমন তারা তাদের ফোনের দাম ৩০০ ডলার থেকে প্রায় 500 ডলারে নিয়ে গেছে। তারা সবসময় চেয়েছে ফোন বিক্রয়ের মাধ্যম বেশি মুনাফা করতে আর এজন্য তারা অনলাইনের পাশাপাশি ইউরোপে এবং ফিনল্যান্ডে কেরিয়ার পার্টনারশিপ গড়ে তুলে। কিছু বছর আগে তারা মিড-লেভেলের প্রাইজের মোবাইল নিয়ে আসলেও এতে তেমন সাড়া পায় নি। তাই তারা এখন প্রিমিয়াম ফ্ল্যাগশিপ ফোনের দিকে ফোকাস করছে।
শাওমি বুঝতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সফলতার জন্য তদের একই ব্র্যান্ড অফলাইন এবং অনলাইনে বাধার সৃষ্টি করতে পারে তাই তারা অনলাইনে জন্য POCO নামে বাজারে নতুন ব্র্যান্ড নিয়ে আসে। তারা এর মাধ্যমে অনলাইনে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তাদের নতুন এই ব্র্যান্ড তৈরির পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে OnePlus, কারণ তারা Samsung এর মত প্রিমিয়াম ফ্ল্যাগশিপ বানাচ্ছিল এবং তাদের ফোনের দাম বাড়াচ্ছিল। ভবিষ্যতে তা শাওমির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারতো তাই তারা আগে থেকে বাজারে POCO ব্র্যান্ড নিয়ে আসে। শাওমি যদি সব কিছু ভাল মত করতে পারে তবে Oppo এর OnePlus এর মত শাওমিও POCO এর মাধ্যমে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।
একটি কোম্পানি যখন তাদের একাধিক ব্র্যান্ড তৈরি করে তখন তারা স্বভাবতই নতুন নতুন কাস্টমার এবং নতুন মার্কেট-কে ফোকাস করতে পারে। Oppo এর কথাই ভাবুন, তারা একদিকে স্বল্প মূল্যে নিজেদের ক্যামেরা ফোন হিসাবে দাবী করছে, নিজেদেরকে ফ্যাশনেবল ফোন হিসাবে তুলে ধরছে অন্য দিকে OnePlus এর মধ্যমে অন্য এক শ্রেণীর ক্রেতাদের টার্গেট করছে। আশা করা যায় শাওমিও তাদের নতুন ব্র্যান্ড নিয়ে আরও এগিয়ে যাবে।
আশা করছি ভবিষ্যতে তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য এমন আরও ব্র্যান্ড বাজারে আসবে।
কেমন লাগল আজকেই এই টিউনটি তা অবশ্যই জানাবেন। এই টিউন পড়ে আপনার কি মনে হয় তা অবশ্যই টিউমেন্ট করুন।
পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন। আমাদের সমসাময়িক যে সংকট চলছে এর থেকে রক্ষা পেতে সবাই সচেতন থাকবেন কারণ আপনার সচেতনতাই পারে আমাদের সবাইকে খারাপ অবস্থা থেকে বাচাতে। সবাই বাসায় থাকুন আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, আল্লাহ হা-ফেজ।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।