আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন টেকটিউনস কমিউনিটি? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। বরাবরের মত আজকেও একটা প্রযুক্তি কথন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হলাম। শিরোনাম দেখে বুঝতে পেরেছেন আসলে কি নিয়ে কথা বলব।
আমরা সবাই জানি ট্রাফিক সমস্যা কত টা বড় সমস্যা আমাদের জন্য। আমাদের যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে ভেবে দেখুন চীনের মত জনবহুল একটি দেশে কি অবস্থা হতে পারে। আমরা অনেকে হয়তো জানি চীনে উবারের মত একটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি আছে এবং সেটি হচ্ছে DiDi। এটি বর্তমানে বিশ্বের বৃহৎ রাইড শেয়ারিং কোম্পানি আর এর পেছনে রয়েছে একজন নারীর অবদান। চলুন তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক সাথে সাথে জেনে নিই DiDi সম্পর্কে নানা তথ্য।
টেক বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে জিং লিউ একজন। তিনি হচ্ছেন Didi Chuxing Technology Co. কোম্পানির বর্তমান প্রেসিডেন্ট। কোম্পানিটি বিশ্বের বৃহৎ রাইড শেয়ারিং সার্ভিসদের একটি। যা গড়ে প্রতিদিন ৩০ মিলিয়নের উপরে রাইড শেয়ার দিচ্ছে যা উবার থেকে প্রায় ১০ মিলিয়ন বেশি।
DiDi ৫৬ বিলিয়ন ডলারের বিশ্বের ২য় অন্যতম স্টার্ট আপ। তবে উবারের IPO তে বিপর্যয়ের কারণে DiDi- এর ভ্যালুয়েশন (মূল্যমান) প্রশ্নবিদ্ধ হয়। DiDi বেসরকারি ভাবে প্রায় ৬০% শেয়ারের ব্যবসায় করে। বিনিয়োগকারীরা এক সময় সন্দেহ করছিল এই রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো আসলেই লাভ করতে পারবে কিনা?
তারপরও নানা প্রতিবব্ধকতা পেরিয়ে DiDi আজ অন্যতম রাইড শেয়ারিং কোম্পানি। জিং উবারকে পেছেনে ফেলে DiDi কে চীনের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানিতে পরিণত করে।
জিং লিউ ১৯৭৮ সালে চীনের বেইজিং এ এক প্রসিদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা লিউ চাং-জিও ছিলেন Lenovo এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চীনের অন্যতম প্রযুক্তি আইকন। জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পেপার এর একজন রিপোর্টার লুলা চেং বলেন, “জিং নিজেই নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে চেয়েছিল এবং তার মানুষকে বিমুগ্ধ করার দারুণ এক ব্যক্তিত্ব আছে যা সে তার বাবা থেকে পেয়েছে কারণ তার বাবাও ছিলেন চীনের জনপ্রিয় মানুষদের একজন”।
জিং কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে Harvard-এ পড়াশুনা করেন এবং ১২ বছর Goldman Sachs এর Asia investments-এর ম্যানেজমেন্টে ছিলেন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে তিনি চীনের ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের জন্য, ২ বছরের পুরনো স্টার্ট-আপ DiDi তে যোগ দেন।
জিং বলছিলেন, “আমি যখন DiDi যোগ দিলাম তখন একজন মহিলা কর্মচারী আমার সাথে দেখা করতে আশাকরি ছেড়ে দিতে চাইলো কারণ সে ছিল সন্তানসম্ভাবা। আমি তাকে বললাম তুমি এই অবস্থাতেও তো আমাদের সাথে কাজ করতে পারো? উত্তরে মহিলা বলেছিল প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা করে বাস পরিবর্তন করে অফিস করা আমাকে প্রায় শেষ করে দিচ্ছে।
জিং তার অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী কারাটের সাথে পাল্লা দিয়ে DiDi কে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে রুপান্তর করে। এবং পরবর্তীতে তারা একীভূত হয়ে যায়।
এই চুক্তির কিছু মাস পর জিং এর স্তন ক্যান্সার ধরা পরে। ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করার পরেও সে কাজে ফিরে যায়।
DiDi তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী উবারের মুখোমুখি হয় কারণ উবার তখন US-এর বড় কোম্পানি যা সারা পৃথিবীতেও ছড়িয়ে পরেছিল। জিং বলছিল, “আমাদের তিন বছর পরে এসেও উবার তাদের মার্কেট আমাদের থেকে বড় করে ফেলেছে, এবং আমরা একটু ভয়ে আছি যে এখন কি আমাদের এটা মেনে নেওয়া বা পরাজয় স্বীকার করে নেয়া উচিৎ কিনা। কিন্তু DiDi পরাজয় মেনে নেয় নি বরং জিং এবং তার কোম্পানি উবারের সাথে লড়াই করে গেছে।
দুইটি কোম্পানি একটি আরেকটিকে দমানোর জন্য বিলিয়ন এর বেশি ডিসকাউন্ট রাইড এবং দক্ষ ড্রাইভার নিয়োগ করতে থাকে। তাদের মার্কেট শেয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ছিল যে এতে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। “প্রথমত আমরা খুবই পরিশ্রম করেছিলাম এবং প্রোডাক্ট টিমকে তিন মাসের জন্য অফিসে ডেকে নিয়েছিলাম এবং তিন মাস তারা অফিসেই ঘুমিয়েছে দ্বিতীয়ত আমরা বাজারটা ধরতে পেরেছিলাম” জিং বলছিলেন।
উদাহরণ সরূপ বলা যায় চীনে বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক এবং দূষণ কমানোর জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিষেধ ছিল তাই DiDi সেখানে টেক্সি ব্যবহার করে কিন্তু উবার এই দিকটি ধরতে পারে নি। DiDi পেমেন্টের জন্য মোবাইল পেমেন্ট এর ব্যবস্থা রেখেছিল, গ্রাহকরা সহজ লেনদেন করার জন্য Ali Pay এবং WeChat pay ব্যবহার করতে পারতো এবং DiDi তার ড্রাইভারদের ভুর্তিকিও প্রদান করতো।
এক বছর পর উভয় কোম্পানি বুঝতে পারলো এবার তাদের এই ব্যয়বহুল যুদ্ধের অবসান করা উচিৎ এবং তাদের এক সাথে ব্যবসায় করা উচিৎ। অ্যাপল থেকে বিলিয়ন ডলার ফান্ডিং পাবার পর DiDi ২০১৬ সালের আগস্টে চীনে উবারকে কিনে নেয়। সেই সাথে জিং লিউ এর চুক্তির মাধ্যমে উবারও DiDi এর ছোট একটা অংশীদার হয়। আর এভাবেই চীনা বাজার থেকে উবার চলে যায় আর DiDi দেশি বাজারে পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে।
জিং, অ্যাপলের CEO টিমকুক এর সাথে দেখা করে এবং বলেন DiDi- এর লোগোও Orange কালারের আর Apple ও একটা Fruit আর এ কারণে তারা চাইলে এক সাথে অনেক ভাল কিছু করতে পারে।
২২ দিন পর অ্যাপল DiDi তে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
চীনে বারবার সফলতা পাবার পর DiDi বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা প্রতিযোগিতা শুরু করে। DiDi ল্যাটিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানে প্রবেশ করে। এখন এটি চীনের বাইরেই প্রতিদিন প্রায় ৪ মিলিয়নের বেশি রাইড দিচ্ছে। উবারের অন্যতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার Grab এবং US এর আসল প্রতিদ্বন্দ্বী Lyft এ বিনিয়োগ করার মাধ্যমে DiDi এক ধরনের প্রতিনিধি প্রতিযোগিতা যুদ্ধ শুরু করে।
DiDi এবং Uber মার্জ হবার দিকে তাদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক ছিল কিন্তু DiDi যখন Grab এবং Lyft এর সাথে স্ট্রেটিজিক এলাইয়েন্স গড়ে তুলে তখন তাদের মধ্যকার সম্পর্ক থেমে যায়। রাইড শেয়ারিং ছাড়াও Uber-এর মত DiDi-এরও ফুড ডেলিভারি, বাইক ই বাইক সার্ভিস, স্মার্ট সিটি সলিউশন, কার ইনস্যুরেন্স, এবং ড্রাইভার-লেস কারের ব্যবসায় করার মত উচ্চাকাঙ্খা ছিল। কিন্তু DiDi এর রাইড শেয়ারি সার্ভিস নিয়ে দুই জন নারী যাত্রী মারা যাবার পর এই উদ্যোগ গুলো একটি সংস্থা দ্বারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছিল। যখন হাজার হাজার যাত্রী প্রকাশ্যে তাদের DiDi এর অ্যাপ ডিলিট করে দিয়েছিল তখন কোম্পানিটির নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল।
জিং এক সাক্ষাতকারে বলেন, “যখন আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলাম, এটা ছিল কিছুটা ভয়ের দুশ্চিন্তার কারণ সেখানে আমার মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল কিন্তু যাত্রী হত্যার বিষয়টি এর চেয়েও বড় ধাক্কার কারণ। রাইড শেয়ারিং একটা কোম্পানির কাছে এই ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি বড় ধরনের ধাক্কার কারণ।
বিশাল স্টার্ট আপ নিয়ে চালু হওয়া এবং ১৩০০০ কর্মী নিয়ে সফল কোন কোম্পানি কিভাবে ২০১৮ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার লস করে এ নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। বিনিয়োগকারীরা এখন দ্বিধায় আছে এটি আসলে কি লভ্যাংশ তুলে নিতে পারবে কিনা? এবং ওই ঘটনার পর বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণের সম্মুখীন হচ্ছে।
বর্তমানে চীনে DiDi-এর সম্ভাবনা আরও ব্যাহত হতে পারে কারণ করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য সরকার বিভিন্ন শহরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জাড়ি করেছে। এখন এটাই দেখার বিষয় যে জিং লুপ কি DiDi-কে দীর্ঘ সময়ের জন্য লাভজনক কোম্পানি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে কিনা।
তো কেমন হল আজকের প্রযুক্তি কথন জানাতে ভুলবেন না সাথে সাথে DiDi সম্পর্কে আপনার কি মতামত সেটাও টিউমেন্ট এর মাধ্যমে জানিয়ে দিন।
এমন আরো টিউন নিয়মিতই আসবে তাই সাথেই থাকুন। আর সবসময়ের মত বলব ভাল থাকুন এবং করোনা থেকে সাবধানে থাকুন।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।