অপরাধী শনাক্তকরণে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাব

দেশের অপরাধ জগত এবং অপরাধী নির্মূল করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে এই হয়৷ বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷ এছাড়া সহযোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়৷ ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এসিস্টেন্স বা সংক্ষেপে DANIDA -র আর্থিক সহায়তায় এই ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ল্যাবটি মূলত Multi sectoral Program Violence Against Woman Project -এর জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

ক্যারি মিডলিস ১৯৮০ সালে ডিএনএ প্রোফাইল টেকনোলজির আবিষ্কার করেন৷ এরপর নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর ডিএনএ প্রোফাইল সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যে বিচারকার্যে ব্যবহৃত হয়৷ এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে FBI অপরাধ তদন্তের কাজে ডিএনএ প্রোফাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে৷ এভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে ডিএনএ প্রোফাইল টেকনোলজি অপরাধ তদন্তে ব্যবহার হয়ে আসছে৷ দেরিতে হলেও ডেনিশ সরকারের সাহায্যে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবের মতো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এদেশে আশংকাজনক হারে ক্রমবর্ধমান নারী ও শিশু নির্যাতন কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়৷ কেননা এর মাধ্যমে আসল অপরাধীকে শনাক্ত করে আদালতের সামনে দাড় করানো যাবে৷

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে প্রতিষ্ঠিত এই ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবের প্রধান হিসাবে  তখন নিযুক্ত দেয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামানকে এবং তার অধীনে ছয়জন সায়েন্টিফিক অফিসার, দুইজন ল্যাব টেকনিশিয়ান, একজন কম্পিউটার অপারেটর ও একজন ক্লিনার৷ এই ডিএনএ প্রোফাইল ল্যাবে এক একটি ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করতে খরচ পড়বে প্রায় তিন থেকে ৪ হাজার টাকার মতো৷ ব্যয়বহুল এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে DANIDA -র অবদান মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলক হয়ে থাকবে৷ প্রতিষ্ঠিত এই ডিএনএ ল্যাবটি তিনটি অংশে বিভক্ত -

  • ১. স্ক্রিনিং ল্যাব- এই ল্যাবে ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন আলামতের গায়ে লেগে থাকা দাগ বা চিহ্ন থেকে অপরাধীর ডিএনএ পাওয়া সম্ভব কিনা অথবা আলামত জৈবিক নমুনা কিনা তা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষন করা হবে৷
  • ২. এক্সট্রাকশন ল্যাব- এই ল্যাবে স্ক্রিনিং ল্যাব থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পাঠানো হবে৷ ফলাফল পজিটিভ হলে আলামতের নমুনা থেকে ডিএনএ পৃথক করা হবে৷
  • ৩. এনালাইটিক্যাল ল্যাব- এক্সট্রাকশন ল্যাবে পৃথককৃত আলামতের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করার পর খুব অল্প পরিমান ডিএনএ পাওয়া যাবে৷ এই ল্যাবে ঐ নমুনাকে PCR করার মাধ্যমে নমুনায় ডিএনএ-র পরিমাণ বাড়ানো হবে৷ শেষে নমুনা এবং জেনেটিক এনালাইজারের সাহায্য নিয়ে অপরাধীর ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হবে৷

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা অনুযায়ী কোনো অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে ঐ অপরাধীকে শনাক্ত করতে হয়৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আসল অপরাধীকে শনাক্ত করতে না পারার কারণে বিচার কাজ একটা স্থানে এসে থেমে যায়৷ অপরাধ করার সময় ভিক্টিমের জামা-কাপড়ে অপরাধীর রক্ত, ভিক্টিমের হাত বা নখের নিচে অপরাধীর চুল বা ত্বকের কোষ লেগে থাকতে পারে৷ সেগুলোর ডিএনএ এনালাইসিস-এর মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীকে সহজেই শনাক্ত করা যায়৷ এছাড়া অনেক অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত করা গেলেও সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়৷ কেননা সনাতন ডাক্তারি পরীক্ষা অপরাধী সম্পর্কে তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে ব্যর্থ৷ কিন্তু আধুনিক এই ডিএনএ এনালাইসিস অপরাধী শনাক্তকরণের পাশাপাশি অপরাধ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রমাণ নিশ্চিত করে৷

ডিএনএ এনালাইসিস-এর মাধ্যমে সন্তানের পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা যায়৷ কেননা সন্তানের ডিএনএ অর্ধেক আসে পিতার কাছ থেকে এবং বাকি অর্ধেক আসে মায়ের কাছ থেকে৷ তাই পিতা-মাতা এবং সন্তান, এই তিনজনের জৈবিক নমুনার ডিএনএ এনালাইসিস করলে নিশ্চিতভাবে সন্তানের প্রকৃত পিতা-মাতা নির্ধারণ করা যায়৷ এর মাধ্যমে সন্তানের পিতৃত্ব নির্ণয়ের মাধ্যমে কুমারী মাতাকে স্ত্রীর মর্যাদা প্রদানসহ অবৈধ সন্তানের পিতা-মাতা এবং বৈধ-অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়৷ আর এতে নারী ও শিশুর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী নির্ণয়ে সকল প্রকার জটিলতার অবসান ঘটবে৷

আমাদের দেশে ডিএনএ ল্যাব প্রতিষ্ঠার ফলে ধর্ষকের পরিচয় নির্ণয়, সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ এবং অপরাধী শনাক্তকরণে দেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের বিড়ম্বনা, অচলাবস্থা ও হয়রানির অবসান ঘটানো যাবে অনেকাংশে৷ এধরনের ঘৃণ্য অপরাধীরা ধর্ষণ কিংবা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের সন্তানকে আর কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না৷ নারী ও শিশুর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আমাদের দেশের ফরেনসিক ল্যাবগুলোতে আধুনিক কোনো সরঞ্জাম এবং দক্ষ জনবল না থাকায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রদানে বাধাঁর সৃষ্টি হয়৷ এজন্য এই বিভাগের বিশেষজ্ঞদের অপেক্ষা করতে হয় পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টের ওপর৷  পুলিশের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই ফরেনসিক ল্যাব তাদের রিপোর্ট প্রদান করে থাকে৷ দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা গতানুগতিক নিয়মে ফরেনসিক বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রিপোর্ট আদালতের তেমন কোনো কাজে আসে না৷ ফলে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টের অভাব এবং রিপোর্ট প্রদানে বিলম্বের কারণে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ অপরাধীরা সুষ্ঠু বিচারের অভাবে খালাস পেয়ে যায়৷

অপরাধী শনাক্তকরণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট একটি আধুনিক ব্যবস্থা৷ কিন্তু এখন অপরাধীরা অপরাধের প্রমাণ এবং আলামত নষ্ট করতে নানাধরণের কৌশল অবলম্বন করে থাকে৷ ফলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পদ্ধতিও বর্তমানে অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে৷ কেননা অপরাধীরা অপরাধ করার সময় হাতে গ্লাবস কিংবা মোজা বা অন্য কোনো আবরণ পড়ে নেয়৷ আবার রুমাল দিয়ে মুছে দেয়৷ এছাড়াও প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে আজকাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট সহজেই পরিবর্তন করা যায়৷ ফলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পদ্ধতি বলা যায় অনেকাংশেই ব্যর্থ৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের স্বতন্ত্র ডিএনএ প্রোফাইল পরিবর্তনের কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার হয় নি৷ তাই ডিএনএ প্রোফাইল পরিবর্তন করে অপরাধীর পার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই৷

আমাদের দেশে অপরাধের পরিমান দিন দিন বেড়েই চলেছে৷ যেখানে সারা পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই ডিএনএ প্রোফাইল প্রযুক্তি সন্ত্রাস, অপরাধ তদন্ত, বিচার কার্যক্রমসহ সন্ত্রাসী চিহ্নিতকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে৷ তাই ডিএনএ প্রোফাইলিং প্রযুক্তির যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে আমরাও অপরাধের মাত্রা ও হার হ্রাস করতে পারি৷ প্রতিষ্ঠা করতে পারি ন্যায়বিচার ও সুশাসনভিত্তিক সমাজ৷ উন্নত বিশ্বে সঠিকভাবে আলামত সংগ্রহ করা হয়, ফলে ডিএনএ প্রোফাইলিং পদ্ধতিতে সঠিক রিপোর্ট নিশ্চিত করা যায়৷ আশা করা যায়, ডিএনএ প্রোফাইল ল্যাব প্রতিষ্ঠার ফলে আমাদের দেশের অপরাধীদের শনাক্তকরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে৷ এক্ষেত্রে পুলিশসহ নিরপত্তা বিভাগকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে৷ কেননা ঘটনাস্থল থেকে অপরাধের আলামত, ক্লু সঠিকভাবে সংগ্রহসহ সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ না করলে, ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাব কোনো কাজ কাজে আসবে না৷ এজন্য পুলিশ বিভাগে আলাদা একটি তদন্ত ইউনিট গঠন করা যেতে পারে৷ এই ইউনিটের শুধু কাজ হবে অপরাধ সংঘটনের সাথে সাথে ঘটনাস্থলে দ্রুত গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা এবং পরে তা ডিএনএ প্রোফাইল ল্যাবের কাছে পৌছে দেয়া৷

অবশ্য আমাদের দেশে পুলিশ বিভাগে একটি আলাদা তদন্ত ইউনিট গঠন করার কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তাদের কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না৷ তাই সরকারের উচিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এখুনি এই ইউনিটকে পুরোপুরি কার্যকর করে তোলা৷ পাশাপাশি ডিএনএ রিপোর্টকে কাজে লাগানোর জন্য বিচার প্রক্রিয়ায় সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন- চিকিত্‍সক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, বিচারক এবং পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা৷ আর এটা হলে ডিএনএ প্রোফাইল ল্যাব প্রতিষ্ঠার আসল গুরুত্ব ফুটে উঠবে৷ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন শুধুই যেন স্বপ্ন হয়ে না থাকে৷ অচিরেই তা যেন বাস্তব রূপ লাভ করে, সে আশাই করি।

Level 0

আমি Amin Mehedi। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 16 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 39 টি টিউন ও 218 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

খুব ভাল হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার যাতে না হয়, সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে….

খুব ভাল হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার যাতে না হয়, সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে….

খুব সুন্দর একটা tune অনেক কিছু শেখলাম

খুব ভাল একটি টিউন পড়ে অনেক না জানা তথ্য জানতে পারলাম।তবে এই ডিএনএ পরীক্ষা বা এর আনুষাঙ্গিক ব্যয় বেশ ব্যয় বহুল হলেও মনে অপারাধ দমনে বেশ কার্ষকর মনে হয়।সরকারের উচিত এই বিষয়টি আমলে নেওয়া,কেননা দেশে অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।এত সুন্দর টিউটির জন্য ধন্যবাদ।