আমরা প্রায়ই বলে থাকি যে আমরা সভ্য জাতি কবে হবো? এমনি এমনি একটা জাতি সভ্য হতে পারে না। এর জন্য দরকার কিছু কৃষ্টি-কালচার, কিছু চর্চা। আর সেই চর্চাগুলো হওয়া চাই বড় পরিসরে। তবেই একটা দেশে সভ্য দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আর বড় পরিসরে চর্চাগুলো তখনই সম্ভব যখন আপনি নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনবেন। যাইহোক, মূল কথায় আসা যাক।
কখনও এমন হয়েছে? ধরুন, কোনো বন্ধুর ফেইসবুক আইডি রিকোভার করতে নিয়েছেন। বন্ধুটার ফোনে কনফার্মেশান কোড এলো। লোকটা উৎসুক হয়ে ম্যাসেজটা পড়ে শেষ করার আগেই আপনি কোডটি দেখে বসিয়ে দিয়েছেন!
যদি করে থাকেন তাহলে আপনি ৭০% লোকের চেয়ে বেশি চটপটে বা দ্রুত। ইংরেজীতে যাকে বলে ‘রিফ্লেক্সিভ’। কিন্তু একবার চিন্তা করেছেন কি যে ঐ লোকটা কেনো আপনার মতো চটপটে নয়? দেখা যায় একই লেভেলে পড়াশোনা করেও আপনি অনেকের চেয়ে বেশি দ্রুত। বেশি চটপটে। এটা কেনো হয়? কীভাবে হয়? হ্যাঁ কথা বলবো এসব নিয়েই।
প্রতিনিয়তই আসছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। একটার পর আরেকটা। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। উন্নতি হচ্ছে আমাদের প্রতিটা ক্ষেত্রে। আমাদের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। তবে সত্যি কথা বলতে, শুধু প্রযুক্তির উন্নয়নে একটা দেশ ডিজিটাল হতে পারে না। সেই সাথে দরকার মনের উন্নয়ন।
আমরা যে সকল প্রযুক্তি বা জিনিসপত্র ব্যবহার করি তা হলো আমাদের বস্তুগত সংস্কৃতি। যেমন: মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস। আর আমরা যে মানুষের সাথে আমাদের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, চলাফেরা, ব্যবহার, মন-মানসিকতা, নৈতিকতা এসব রক্ষা করে চলি সেটা হলো আমাদের অবস্তুগত সংস্কৃতি।
সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, একটা সমাজের সংস্কৃতি তখনই পিছিয়ে পড়ে যখন এই বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়। একটা উদাহরণ দিলে ভালো বুঝবেন। ধরুন, একজন অশিক্ষিত রিক্সাচালককে আপনি ঢাকায় একটা পাঁচতলা বাড়ি করে দিলেন। পরদিনই কি সে সেখানে বসবাসরত অন্যান্য শিক্ষিত বাড়িওয়ালাদের মতো কথা বলতে পারবে? অথবা তাদের সাথে অ্যাডজাস্ট হয়ে চলতে পারবে?
একটি সভ্য দেশের মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, আমরা করি। তারা কম্পিউটার ব্যবহার করে, আমরাও করি। আরো অনেক বিষয়েই তাদের সাথে আমাদের মিল রয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা তাদের মতো সভ্য না। কেনো?
আপনার লাইফস্টাইল উন্নত। একজন গ্রামের সবজি বিক্রেতাকে আপনি একটা দামী স্মার্টফোন কিনে দিলেন। এতে করে কি সাথে সাথে তার জীবনযাত্রা আপনার মতো হয়ে যাবে? বলতে পারেন যে শিক্ষার অভাব। কিন্তু শুধু বই দিয়েই মানুষকে শেখানো যায় না। একটা ফোনে মানুষ যতটা না বাক্য পড়ে শেখে, তার চেয়ে বেশি শেখে আইকন দেখে। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোনটি নিয়ে। বুঝে যাবেন।
আপনার ফোনে কল্ করার আইকনের নিচে আপনার ‘Call’ লেখা পড়ার সবসময় প্রয়োজন পড়েনা। মিউজিক প্লেয়ারে ‘প্লে’ চিহ্ন দেখেই বুঝে যান এখানে টাচ করলে গান বাজবে। রাস্তায় হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলোর টয়লেটের সামনে কিছুই লেখা থাকতে হয় না। ছেলে চিহ্নিত ও মেয়ে চিহ্নিত দেখেই আপনি বুঝতে পারেন আপনাকে কোথায় যেতে হবে। রাস্তায় কোনো স্পিড ব্রেকার থাকলে কিছুদূর আগেই সেটার চিহ্ন সংবলিত সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়।
আমারতো মনে হয় এমন কোনো লোক নেই যার কাছে কোনো অল্প জানা লোক ফোনের টাইম ঠিক করার জন্য কখনও আসেনি। অর্থাৎ আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করছি ঠিকই। কিন্তু সেটা প্রযুক্তি সম্পর্কে না জেনে। প্রযুক্তি সম্পর্কে উপযুক্ত শিক্ষাটা না পেয়ে। একটা নতুন যন্ত্র হাতে নিয়ে কাজ করছি সেটা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না নিয়েই।
আপনারা একটা মুভি দেখেছেন কিনা জানি না। মুভিটির নাম The Gods Must Be Crazy II (1998)। মুভিটিতে দেখানো হয়, প্লেন থেকে ফেলে দেয়া একটা কোকাকোলা’র বোতল কীভাবে একটা সমাজের মানুষের মধ্যে বিবাদ লাগায়। বোতলটি মরুভূমিতে পেয়ে লোকটি বোতলটি বাসায় নিয়ে আসে। দেখা যায় বোতলটি তাদের অনেক উপকারে আসে। কে্উ সেটা বড় খাদ্য-দ্রব্য ভাঙার কাজে ব্যবহার করে। কেউ সেটা আবার তাদের শিকার করা পশুর চামড়া থেকে বস্ত্র তৈরি করার কাজে ব্যবহার করে সেটাতে চামড়া মসৃণ করতে। কেউ আবার বোতলের মুখে ফুঁ দিয়ে বাঁশি বাজায়। আবার সেই বোতলের আঘাতেই অনেকে আহত হয়। এভাবেই একটি বোতল নিয়ে সবার মধ্যে বিবাদ তৈরি হয়। এমতাবস্থায়, লোকটা চিন্তা করে যে একটা বোতল তাদের সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করেছে। তাই সে সেটা ফেলে দেবার জন্য পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে যাত্রা শুরু করে। এরকমই কাহিনী মুভিটার। আর অনেক হাসির। তো প্রযুক্তি আমাদের সমাজে এরকমভাবেই কিছু সমস্যা তৈরি করে। যেটার সমাধানও আমাদেরই তৈরি করতে হবে।
দেখুন, একই ফোন দিয়ে একজন কোনো সুন্দর ফটো তুলে স্মৃতি ধারণ করে। আবার সেই ফোন দিয়েই আরেকজন কাউকে মেরে তার ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করে মানুষের মনে ভয় ও ঘৃণা তৈরি করে দিচ্ছে। একইভাবে অনেকে অনেক মেয়ের জীবন নিয়েই খেলছে। এ্ই ক্যামেরা দিয়েই আমরা বিভিন্ন গ্রহের ছবি পাচ্ছি। আবার একই ক্যামেরা দিয়ে আই এস’রা তাদের ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে। তার মানে হলো, উপরে উ্ল্লেখিত জায়গাগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার হলেও বিভিন্ন মনের অবস্থার কারণে সেটা ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন দিকে। এটা কেনো হচ্ছে? এটা হচ্ছে সেই কারণে যে, আমরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমাদের নৈতিকতাটাকে ঠিক জায়গায় কাজে লাগাতে পারছি না। আর এজন্যই দরকার মনের উন্নতি।
অর্থাৎ দিনকে দিন আমরা আমাদের প্রযুক্তি ও মনের মধ্যে এভাবেই পার্থক্য তৈরি করে যাচ্ছি। যার কারণে সেই ‘ডিজিটাল’টা আর হচ্ছে না। একদমই যে হচ্ছে না, তা না। হচ্ছে। তবে সেটা সেটা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ও ক্ষুদ্র পরিসরে। পুরো দেশকে ডিজিটাল করতে হলে একই সাথে এই বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির সমান উন্নতি দরকার। তাই, ভাবনাকেও করতে হবে ডিজিটাল। তার মানে হলো চিন্তা করার দক্ষতা তৈরি করা দরকার। দরকার মনের উন্নতি। আর মনের উন্নতি তখনই হবে যখন আমরা শুধুরপ্রসারী চিন্তা করা শিখবো। চিন্তা করে সমস্যা সমাধান করা শিখবো। আর সে লক্ষ্যেই আমার এই টিউন। প্রযুক্তির সাথে মনের উন্নয়ন।
আমি আমাদের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন বস্তুগত ও অবস্তুগত বিষয় সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করবো। প্রযুক্তির কারণে মানুষের চিন্তা-কৌশলের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। কারণ, মনের উন্নতি না হলে কোনোভাবেই একটা দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। আমার এই টিউনটি শুধু প্রযুক্তির ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিকভাবে আপনাকে করে তুলতে পারে আরো দ্রুত। আরো সচেতন। আরো সংবেদী।
মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। এর প্রথম কারণটাই হলো মানুষ চিন্তা করতে পারে। শুধু চিন্তাই নয় মানুষ একটা জিনিস বা বিষয়ের ভাল-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে পারে। আর সে অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমে মানুষের নিজের একটা ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। এই ব্যক্তিত্বের কারণেই একজন মানুষ সম্মানিত হন আবার আরেকজন উপেক্ষিত হন। আর মানুষ চিন্তা করে মূলত সিদ্ধান্ত আসার জন্য, মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে চিন্তা করে ভবিষ্যতের ভালোর জন্য। তাই চিন্তা করতে জানতে হবে। বর্তমানে আমাদের সমাজে প্রচুর সমস্যা। উদাহরণস্বরুপ, নিচের কিছু বিষয়গুলো লক্ষ করুন।
কেন বর্তমান যুগের শিশুরা ছোট বয়সেই মুরুব্বিদের মতো কথা বলে? কেনো একটা মানুষ ইনট্রোভার্ট হয়? মানুষের সাথে মিশতে চায় না। কেন বর্তমানে ডিভোর্স বা ব্রেকাপের হার বেশি? কেনো মানুষ মানুষকে সহ্য করতে পারে না? কীভাবে একজনের সাথে আরেকজনের খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয়? কীভাবে একটা নতুন স্টাইল বা ফ্যাশনকে মানুষ গ্রহণ বা বর্জন করে? কেনো বিয়ের পর বাবা-মা’র সাথে কিছু সন্তানের সম্পর্কের ঘাটতি দেখা দেয়? এসবের সাথে কি প্রযুক্তির সম্পর্ক আছে? অবশ্যই আছে।
এসবগুলোই কিন্তু সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমরা চিন্তা করি খুব কম। শুধু তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করি। অথচ, বাচ্চার মুরুব্বিদের মতো কথা বলা নিয়ে বাবা-মা কিন্তু বেশ উদ্বিগ্ন থাকেন। একজন ইনট্রোভার্ট ছেলে বা মেয়ে বারবার মনে থেকে চায় এক্সট্রোভার্ট হতে। একজন শান্তিকামী মানুষ চায় দেশে ডিভোর্সের হার কমুক, ধর্ষণের হার কমুক। শুনতে ভাল লাগবে। সবাই চায় যেন কারো সাথে খারাপ সম্পর্কের অবসান ঘটে।
যে জিনিসটি একটি সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আনে সেটা হলো প্রযুক্তি। আর তাই আপনি যদি এই সামাজিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হতে না পারেন, তাহলে নতুন কোনো প্রযুক্তি গ্রহণের পর আপনি সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে পারবেন না। নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। যার তাৎক্ষণিক সমাধান আপনি পাবেন না। তাই সেসব সমস্যা তৈরি হবার আগেই যদি আপনি নিজের চিন্তা দ্বারা সেগুলোকে সহজ করে নিতে পারেন তাহলে সেটা সমস্যার সমাধান তো করবেই, ব্যক্তি হিসেবেও আপনাকে করবে সচেতন ও স্মার্ট। বছর দশেক আগেও এত বিবাহ-বিচ্ছেদ ছিলো না, ছিলো না এত ধর্ষণও।
তাই চিন্তা করা জানতে হবে। সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। সে অনুযায়ী আমাদের অভ্যাস করতে হবে। অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যাবার চেয়ে অসুখ যাতে না হয় সে জন্যই সতর্ক থাকা কি জরুরী নয়?
আজকের মতো এ পর্যন্তই। সামনে পর্বে আবারও হাজির হব নতুন নতুন চিন্তাকৌশল নিয়ে। যাতে করে আশেপাশের আর দশটা মানুষের চেয়ে আপনি হতে পারেন অধিক স্মার্ট। আর আমার এই টিউনটি ছড়িয়ে দিন তাদের কাছে যারা পড়ার জন্য টেকটিউনসে আসতে পারে না।
টিউন সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে টিউমেন্ট করুন নিচের টিউমেন্ট বক্সে। এছাড়াও আমার সাথে ফেইসবুকের মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারেন।
ফেইসবুকে আমি: Mamun Mehedee
আমি মামুন মেহেদী। Civil Engineer, The Builders, Bogra। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 92 টি টিউন ও 360 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 12 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি আপনার অবহেলিত ও অপ্রকাশিত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
ভালো লিখছেন ভাই।