মহাবিশ্বের শুরুটা কী রকম হওয়া উচিৎ ছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে আমদের এমন কোন তত্ত্বকে প্রমাণ সত্য হিসেবে আঁকড়ে ধরতে হবে যা সৃষ্টির শুরুতে, কালের শুরুতেও সঠিক ছিল। ব্যাপারটা কল্পনা করা কঠিন। মহাবিশ্বের সৃষ্টি কর্মের জন্য কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই। আর সে জন্যই আমাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাহায্য নিতে হবে। এসব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো নির্ভুল হতে পারেনা। কারণ সে কিছু ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ করে রায় দেয়। পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা তার নেই। আর সে জন্যই এসব তত্ত্বের থাকে অনেক বড় বড় সীমাবদ্ধতা। মহাবিশ্বের উৎপত্তি অনেকটা সেই প্রাচীন প্রশ্নের মত……
.
আধুনিক কাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের প্রবণতা ছিল এ ধরনের প্রশ্নকে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়ার। তারা ভাবতেন এসব মোটেও বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নয়। তারা এগুলোকে Meta Physics অথবা ধর্মের বলে আলাদা করে রাখতেন। এ প্রসঙ্গে আমরা বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যয়ারিস্টটলের নাম বিশেষভাবে আলোচনায় নিতে পারি। মহাবিশ্বের যে একটা শুরু ছিল এ কথা তিনি আদৌ পছন্দ করতেন না। তিনি এবং তাঁর মতো আরও অনেক প্রাচীন বিজ্ঞানীর তাহলে তা হবে ঐশ্বরিক ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করা। তাঁরা বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকাল রয়েছে এবং থাকবে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এ ধারণা বদলাতে থাকে। বৃটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী Stephen Hawking তার A Brief History দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।
স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ বলেন, কালের শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল একটি বিন্দু, যে বিন্দুতে ঘনত্ব ছিল অসীম এবং স্থান, কালের বক্রতাও ছিল অসীম। অর্থাৎ স্থান-কাল-ঘনত্ব-সময় সব একই বিন্দুতে ছিল। স্থান কেলের একটি সীমা থাকবে এবং বিগ ব্যাং এর ফলে তার উৎপত্তি।
পরবর্তীতে স্টিফেন হকিং এটি এভাবেও ব্যাখ্যা করেন, Big Bang এর একেবারে শুরুতেই মহাবিশ্বের আয়তন ছিল প্রায় শূন্য (শূন্যের কাছাকাছি) আর উত্তাপ ছিল অসীম। বিস্ফোরণের পরমুহূর্ত হতে এর সম্প্রসারণ ও তাপমাত্রা বিকিরণ শুরু হয়। ফলে মহাবিশ্বের আয়তন বৃ্দ্ধি পেতে থাকে।
এই প্রাথমিক অবস্থা নিয়ে Friedman একটি তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন যা পরবর্তীতে Friedman Model নামে পরিচিতি পায়। তত্ত্বটির মূলকথা ছিল, মহাবিশ্বের আকার দিগুণ হলে এর তাপমাত্রা অর্ধেক হবে। এ প্রসঙ্গে ম্যাসাচুসেটস্ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী অ্যালান গুথ বলেন, এক সেকেন্ডের সামান্য মাত্র ভগ্নাংশ কালের ভিতরে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ১,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০০ (একের পিঠে ত্রিশটি শূন্য)গুণ বেড়েছে। গুথের প্রস্তাবনা অনুসারে Big Bang-এর পর মহাবিশ্বের শুরু অত্যন্ত উত্তপ্ত কিন্তু বিশৃঙ্খল অবস্থায়। বিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর তাপমাত্রা নেমে এসেছিল প্রায় ১০০০ কোটি ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এ তাপমাত্রা সূর্য্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০০০ গুণ বেশী। হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের সময় অতিক্ষুদ্র সময়ের জন্য এটি তৈ্রি করা যায়। বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রায় একশ সেকেন্ড পর তাপমাত্রা একশ কোটি ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে নেমে আসে। সবচেয়ে উত্তপ্ত তারকাগুলির অভ্যন্তরে এই তাপমাত্রা পাওয়া যায়।
বিজ্ঞান ব্যাপারটি এমন নয় যে স্টিফেন হকিং ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা একটা তত্ত্ব দাঁড় করালেন আর আমরা চোখ কান বুঝে তা মেনে নিলাম। বিজ্ঞানীরা বলেন, যেখানে যা কিছুই ঘটুক না কেন, তার একটি কারণ থাকতে বাধ্য। কোথাও কোন কিছু অকারণে ঘটে না। নিউটন দেখলেন, পাকা ফলটি গাছ তেকে মাটিতে পড়ছে। কেন পড়ছে? এর কারণ কি? তখন পর্যন্ত কেউই জানত না। নিউটন শুধু জানতেন কোন ঘটনাই অকারণে ঘটেনা। তাই ফল পড়ার ঘটনাটির একটি কারণ থাকতে বাধ্য। তিনি সেয় কারণটির অনুসন্ধান শুরু করলেন আর সেশ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির। নিয়টন যদি ভাবতেন, ঘটনাটি এমনি এমনি হয়েছে, তাহলে নিশ্চই বিজ্ঞানের অতবড় আবিষ্কারটি হতো না। এই হলো বিজ্ঞানের মূলকথা।
১৯২৯ সালে এডুইন হাব্ল আবিষ্কার করেন যে, দূরবর্তী ছায়াপথের অপসারণ বেগ দূরত্বের সমানুপাতিক। এটিই হাবল্’স ল’ নামে পরিচিত। এর ভৌত তাৎপর্য এই যে, বিশ্ব ব্যাপক পটভূমিতে প্রসারমান। বর্তমানে যেহেতু বিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে সেহেতু সুদূর অতীতে নিশ্চই ছায়াপথের মধ্যে দুরত্ব ছিল শূন্য। অর্থাৎ সে সময় বিশ্বের ঘনত্ব ও তাপমাত্রা ছিল অসীম। এ ধরণের বিন্দুকে বলে ব্যতিক্রমী বিন্দু বা Singularity সেই ব্যতিক্রমী বিন্দুর এক প্রচন্ড বিস্ফোরণে বর্তমান বিশ্বের সৃষ্টি। উপরের কথাগুলো কি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে মহাবিশ্ব কেন প্রসারমান?
বিস্ফোরণের অবশেষ এখনো পাওয়া যায়। এটি মাইক্রোতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বা Micro wave Background Radiation এবং এর তাপমাত্রা ২.৭ কেলভিন বা -৪৫৪.৮১ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা -২৭০.৪৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড।
(এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)
যে বিন্দুর মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি তার যে একটি আস্তিত্ব ছিল তা এভাবেও বলা যায়। ধরি মহাবিশ্বে গতিশীল ছায়াপথগুলোর তথা ক্রম-প্রসারমান মহাবিশ্বের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হল। এ চলচ্চিত্রে দেখা যাবে, ছায়াপথগলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যদি এর ফিল্মটিকে উল্টোদিকে চালিয়ে দেয়া হয় তবে কি দেখা যাবে? একজন সাঁতারু স্প্রিং বোর্ড থেকে লাফ দিয়ে সুইমিং পুলে পড়ছে এ দৃশ্যের চলচ্চিত্র ধারণ করে যদি ফ্লিম উল্টো দিকে চালানো হয় তবে পর্দায় দেখা যাবে যে, মানুষটি সুইমিং পুল থেকে উল্টোভাবে বেরিয়ে এসে স্প্রিং বোর্ড-এর উপর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের কল্পিত মহাজাগতিক চলচ্চিত্রটি উল্টা দিকে চালালে দেখা যাবে ছায়াপথগুলো পরস্পরের দিকে দ্রুতবেগে ধাবমান আর সেই বিন্দুর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে।
এখন আমরা ২’টি প্রশ্নে আসতে পারি…
1. মহাবিশ্ব কেন একটা?
2. আমরা যেমন দেখছি মহাবিশ্ব সে রকম হল কেন?
দ্বিতীয়টির উত্তর Stephen Hawking এভাবে দিয়েছেন- “মহাবিশ্ব অন্যরকম হলে আমরা এখানে থাকতে পারতাম না”। সে সূত্রে প্রথমটির উত্তর এমন হতে পারে, মহাবিশ্ব একাধিক হওয়া সম্ভব ছিলনা বলেই একটি। উত্তরগলো হয়তো হালকা, কিন্তু একথা তো সত্যি যে, মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এত কম যে, এ ধরণের উত্তর দেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। এমন আরও অনেক প্রশ্ন আছে যেখানে এ ধরণের উত্তরও আমরা দিতে পারিনা…
মানুষ যা কখনও ভাবেনি, তাই সম্ভব করেছে। মানুষ কখনও ভাবেনি সে উড়তে পারবে, সে চাঁদের মাটিতে পা রাখতে পারবে, অথচ বাস্তবে তা-ই সম্ভব হয়েছে। আমরা হয়তো মুদ্রার একপিঠই দেখেছি, অন্যপিঠ কখনো দেখিনি। তাই আমরা হয়তো এখনও চূড়ান্ত সত্যকে জানিনা। একদিন নিশ্চই জানতে পারব। অবসান হবে বহু প্রতিক্ষার। [চলবে...]
আমি এন.সি.। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 13 বছর 11 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 46 টি টিউন ও 208 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
ওয়াও! ফাটাফাটি লিখেছেন! পরের পর্বের জন্য চেয়ে রইলাম 😀