এই অসীম মহাবিশ্বে সূর্য এবং যে সকল মহাজাগতিক বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিন করে তাদের সকলকে নিয়ে যে জগৎ গঠিত তার নাম সৌরজগৎআর যে সকল মহাজাগতিক বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিন করছে তাদেরকে বলা হয় গ্রহ( Planet)। পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ আবার কতকগুলো জ্যোতিস্ক গ্রহগুলোকে প্রদক্ষিন করছে এদের নাম Satellite বা উপগ্রহ।চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ প্রায় ৩০ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিন করে।
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষের মনে কৌতূহল কি করে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এ প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন অভিকর্ষের দরুন চাঁদের উপর পৃথিবীর কেন্দ্রমুখী বল এর কারন। একটু সহজ ভাষায় বলি, অভিকর্ষ বল হল যে বলে পৃথিবী কোন বস্তুকে তার কেন্দ্রের দিকে টানে । যদি এই বলটা না থাকত, তাহলে চাঁদ মহাশূন্যে মিলিয়ে যেত। তাহলে চাঁদ অভিকর্ষ বলের কারনে পৃথিবীতে এসে আপতিত হচ্ছে না কেন ? কারন হল পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের প্রদক্ষিনের দরুন একটা কেন্দ্রবিমুখী বলের ( Centrifugal force) সৃষ্টি হয় যা সেই পৃথিবী কর্তৃক প্রযুক্ত কেন্দ্রমুখী বলের ( Centripetal force) সমান ও বিপরীত হওয়ায় চাঁদ সোজা না গিয়ে পৃথিবীর চারদিকে উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার পথে ঘুরছে। এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মানুষ মহাশূন্যযান তৈরি করেছে যা নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে তাকে আর্টিফিসিয়াল স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ বলে।
কৃত্রিম উপগ্রহ হলো মহাকাশে উতক্ষেপিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত উপগ্রহ।স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার খবর আমরা নিমিষেই পেয়ে যাই। স্যাটেলাইটকে রকেট বা স্পেস শাটলের কার্গো বে-এর মাধ্যমে কক্ষপথে পাঠানো হয়। পাঠানোর সময় রকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহƒত হয় ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম (আইজিএস) মেকানিজম। পৃথিবীর অভিকর্ষ পার হতে রকেটকে ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৯ মাইল ত্বরণে ছুটতে হয়। স্যাটেলাইট স্থাপনের সময় কক্ষীয় গতি ও তার জড়তার ওপর পৃথিবীর অভিকর্ষের যে প্রভাব রয়েছে, এর জন্য সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারলে স্যাটেলাইট এ অভিকর্ষের টানে ফের ভূপৃষ্ঠে চলে আসতে পারে। এ জন্য স্যাটেলাইটকে ১৫০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ হাজার মাইল গগিতে পরিভ্রমণ করানো হয়। মূলত গতিবেগ কত হবে, তা নির্ভর করে স্যাটেলাইটটি পৃথিবী থেকে কত উচ্চতায় রয়েছে, তার ওপর।পৃথিবী থেকে ২২ হাজার ২২৩ মাইল উপরে স্থাপিত স্যাটেলাইট ঘণ্টায় ৭০০ মাইল বেগে পৃথিবীকে আবর্তন করে। পৃথিবীর সঙ্গে স্যাটেলাইটও ২৪ ঘণ্টা ঘোরে। তবে ভূ-স্থির বা জিওস্টেশনারি উপগ্রহগুলো এক জায়গাতেই থাকে। এগুলো আবহাওয়া ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কাজে ব্যবহƒত হয়। পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে। সাধারণত ৮০-১ হাজার ২০০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট পাঠানো হয়। কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে স্যাটেলাইটটি কত উচ্চতায় বসবে। যেমন উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে গবেষণা, বণ্যপ্রাণীর চরে বেড়ানো পর্যক্ষেণ, অ্যাস্ট্রোনমি এবং পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার জন্য সায়েন্স স্যাটেলাইটকে বসানো হয় ৩০ হাজার থেকে ৬ হাজার মাইল উচ্চতায়। আবার গোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয় ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মাইল উচ্চতায়। এক এক ধরনের স্যাটেলাইটের বৈশিষ্ট্য ও গঠন প্রণালী একেকরকম। তবে সব স্যাটেলাইটের মধ্যেই সাধারণত কিছু মিল আছে। স্যাটেলাইটের শরীর ধাতু সংকরের ফ্রেম দিয়ে তৈরি। একে বলে বাস। এতেই স্যাটেলাইটের সব যন্ত্রপাতি থাকে। প্রত্যেক স্যাটেলাইটে থাকে সোলার সেল এবং শক্তি জমা রাখার জন্য ব্যাটারি। এর পাওয়ার সিস্টেম প্রসেসকে পৃথিবী থেকে সবসময় মনিটর করা হয়। স্যাটেলাইটে একটি অনবোর্ড কম্পিউটার থাকে যা একে নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন সিস্টেমকে মনিটর করে। স্যাটেলাইটের আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট হল এর রেডিও সিস্টেম ও অ্যান্টেনা।
সহজ ভাষায় স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন অর্থ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্যের আদান প্রদান। এই ব্যবস্থায় শূন্যে উৎক্ষেপিত বিভিন্ন প্রকার স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় অবস্থান করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করতে থাকে। তথ্যের আদান প্রদান হতে পারে স্যাটেলাইটের সাথে পৃথিবীতে স্থাপিত কোনো আর্থ স্টেশনের,কোনো ডিভাইসের অথবা একটি স্যাটেলাইটের সাথে আরেকটি স্যাটেলাইটের। অর্থাৎ সাধারনভাবে যোগাযোগ বলতে আমরা যদি প্রেরক এবং প্রাপকের মধ্যে তথ্যের আদান প্রদানকে বুঝি তবে এই দুইটির (প্রেরক এবং প্রাপক) যে কোন একটি স্যাটেলাইট হলেই সেটিকে আমরা বলি স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন।
প্রতিটি স্যাটেলাইটের জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমানা(Area) নির্ধারিত থাকে। এই সীমানার মধ্যেই স্যাটেলাইটি ফোকাস করা থাকে এবং তার কাজের পরিসীমাও এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই সীমানাকে বলা হয় ফুটপ্রিন্ট(Foot print)। আবার কিছু স্যাটেলাইট তার সিগন্যালের দিক পরিবর্তন করে কাভারেজ অঞ্চল পরিবর্তনও করতে পারে। ছবিতে বিষয়টি পরিষ্কার হবে-
মহাশূন্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করার জন্য দরকার উৎক্ষেপক মঞ্চ, স্যাটেলাইট ও একটি রকেট।স্যাটেলাইটটি বসানো হয় রকেটের নাকের ডগায় এবং জ্বালানি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসানো হয় রকেটের ভিতর। তবে উপগ্রহগুলোর উৎক্ষেপণের সময়ই পর্যাপ্ত জ্বালানি গ্রহণ করতে হয়। কিছু উপগ্রহ জ্বালানী হিসাবে সৌরশক্তি ব্যবহার করে কারন মহাকাশে রিফুয়েলিংয়ের কোন সুযোগ নেই।
পরীক্ষার সাহায্যে দেখা গেছে কোন বস্তুকে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে মুক্তিবেগে অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ১১.২ কি.মি. বেগে মহাশূন্যের দিকে নিক্ষেপ করলে সেটি আর পৃথিবীতে ফিরে আসে না আর এই মুক্তিবেগে বস্তুটিকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উপরে তুলে পৃথিবী পৃষ্ঠের সমান্তরালে এমনভাবে উৎক্ষেপ করতে হবে যেন বস্তুটি প্রতি সেকেন্ডে ৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। তাহলে বস্তুটি আর পৃথিবীতে ফিরে না এসে চাঁদের মত পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকবে। যে ডিম্বাকার পথে বস্তুটি ঘুরতে থাকবে সেই পথকে বলা হয় অরবিট বা কক্ষপথ। কিন্তু কোন বস্তুকে এত উপরে তুলে উৎক্ষেপ করা সম্ভব নয় তাছাড়া বায়ুস্তরের সাথে সংঘর্ষে এত অধিক তাপ উৎপন্ন হবে যে উপগ্রহটি পুড়ে ভষ্মীভূত হবে।তাই একটি রকেটের সাহায্যে বস্তুটিকে এত উপরে তুলে উৎক্ষেপ করা হয় আর এসময় এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।
সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে স্পুটুনিক-পিএস রকেটের সাহায্যে স্পুটুনিক-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপন করতে সক্ষম হন।এরপর যুক্তরাস্ট্রসহ অন্যান্যরাস্ট্র পাঠাতে সক্ষম হয় । এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টিরও অধিক দেশ থেকে কয়েকহাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপন করা হয়েছে তবে পৃথিবীর মাত্র ১০ টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ও নিজস্ব উৎক্ষেপনকেন্দ্র থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশগুলি হল সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৫৭), যুক্তরাস্ট্র (১৯৫৮), ফ্রান্স(১৯৬৫), জাপান(১৯৭০),চীন(১৯৭০),যুক্তরাজ্য(১৯৭১),ভারত(১৯৮০), ইসরায়েল(১৯৮৮),ইউক্রেইন(১৯৯২) ও ইরান (২০০৯)।
স্যাটেলাইটের বিভিন্ন কক্ষপথ-
মহাকাশে স্যাটেলাইটগুলো যে ডিম্বাকার পথে ঘুরতে থাকে সেই পথকে বলা হয় অরবিট বা কক্ষপথ। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনুসারে এই অরবিটকে তিনভাগে ভাগ করা যায় । ১. নিম্ন কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১২৪০ মাইল বা ২,০০০ কিলোমিটার ২. মধ্য কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২.০০০ কি.মি থেকে ৩৫,৭৮৬ কি.মি পর্যন্ত।৩. উচ্চ কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩৫,৭৮৬ কি.মি. থেকে অসীম।
প্রত্যেকটি স্যাটেলাইট ডিজাইন করা হয় ফর অ্যা স্পেসিফিক টাস্ক।
মানুষ জীবন ও ধনসম্পত্তির ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য আবহাওয়া সংক্রান্ত কতিপয় স্যাটেলাইটগুলো হারিকেন, বন্যা ও অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে আগেই সতর্কতা প্রদান করে থাকে। প্রায় সব স্যাটেলাইট মেঘের ফটোগ্রাফ গ্রহণ করে। ম্যাগনেটিক টেপে সংবাদ জমা করে এবং তারপর টেলিমিটার দিয়ে গ্রাউন্ড স্টেশনে রক্ষিত কম্পিউটারে সোজাসুজি প্রেরণ করে। পৃথিবীর ওপর সেই সময় অবস্থানকারী মেঘের প্রণালীর ছবি পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। 🙂
তথ্য সংগ্রহঃ সামহোয়্যার ইন (মিলন ভাই, মুশাসি ভাই) উইকিপিডিয়া এবং নাসা।
আমি আইটি সরদার। Web Programmer, iCode বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 9 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 261 টি টিউন ও 1750 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 22 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আমি ইমরান তপু সরদার (আইটি সরদার),পড়াশুনা করেছি কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নিয়ে; পেশা কন্টেন্ট রাইটার এবং মার্কেটার। লেখালেখি করি নেশা থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে। লেখালেখির প্রতি শৈশব থেকেই কেন জানি অন্যরকম একটা মমতা কাজ করে। আর প্রযুক্তি সেটা তো একাডেমিকভাবেই রক্তে মিশিয়ে দিয়েছে। ফলস্বরুপ এখন আমার ধ্যান, জ্ঞান, নেশা সবকিছু...
চমৎকার লিখেছেন আইটি সর্দার ভাই। আপনার টিউন পড়ে অনেক কিছুই জানতে পারলাম।