খুব সুন্দর একটি ভোর। নাদিম এখনও ঘুমিয়ে আছে। গতকাল একটু রাত করেই ঘুমিয়েছে সে। নাদিম মাইক্রসফটের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। সে থাকে ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে। ঘড়িতে ৭টা বাজে, ঠিক এমন সময় নাদিমের PDA (Personal Digital Assistant) টি তাকে ঘুম থেকে জাগালো। PDA টি তাকে সুপ্রভাত জানলো তারপর একে একে জানিয়ে দিল আজকের কাজ গুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজটি হলো সকাল ১১টায় মাইক্রসফটের চেয়ারম্যানের সাথে তার মিটিং রয়েছে ওয়াশিংটন ডিসিতে। নাদিম ভাবলো হাতে কিছু সময় এখনও আছে। তাই দ্রুত নাস্তা সেরে বেরিয়ে পরলো ঢাকার নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্যে। কিছু কেনাকাটা করতে।
কি পাঠক, ধাঁধায় পরে গেলেন ? নিশ্চয় ভাবছেন এতো রীতিমত গাঁজাখুরি ব্যাপার। যার আজ সকাল ১১টায় মাইক্রসফটের চেয়ারম্যানের সাথে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে মিটিং রয়েছে সে আজই সকালে আবার ঢাকার নিউ মার্কেটে সপিং এ যায় কিভাবে? আবার যে মাইক্রসফটে নিয়মিত কাজ করে, সে ঢাকার ধানমন্ডির বাড়িতে কি করে থাকে? নাহ্ একেবারেই অসম্ভব তাই না? হ্যাঁ বর্তমান সময়ে অসম্ভব কিন্তু আমি বলছি ভবিষ্যতের কথা। যখন লক্ষ লক্ষ মাইল দূরুত্ব পারি দেয়া যাবে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে। আর এ অসম্ভব কাজটিকে সম্ভব করবে কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশন নামে নতুন এক টেকনলজি। চলুন পাঠক এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে নাদিমের গল্পটা আগে শেষ করি ।
নাদিম নিউ মার্কেট থেকে সপিং করে ফিরলো ঠিক ১০টায়। ফ্রেস হয়ে ১০:২৮ মিনিটে নাদিম তার রুমে এসে, বিশেষ একটি চেম্বারে ঢুকে তার দরজা টি বন্ধ করে দিল। একটি কি-বোর্ড এ দ্রুত কয়েকটা নাম্বার টাইপ করলো। তারপর আর একটি সুইচ চাপতেই চেম্বারের ভিতরটা উজ্জল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। কয়েক মুহূর্ত পরে নাদিম কে দেখা গেল মাইক্রসফটের অফিসের একই রকম একটি চেম্বারে। দরজা খুলে সে বেরিয়ে আসলো। তারপর ঠিক ১১টায় নাদিম মিটিংএ বসলো। একটি কর্মব্যাস্ত দিন কাটালো নাদিম। বিকেল ৫টায় সে আবার একই ভাবে তার ধানমন্ডির বাসায় ফিরে এলো।
আসলে অনেক আগেই হলিউডের মুভি গুলোতে কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশন এর ব্যাবহার শুরু হয়ে গেছে। হলিউডের সুপার হিট মুভি ‘স্টার ট্রেক’- এ অনেকেই ব্যাপারটা দেখ থাকবেন। ঐ মুভিতে দেখানো হয় কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশন এর মধ্যমে যে কোন জড় বা জীব বস্তুকে যে কোন স্থানে আলোর বেগে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কল্প বিজ্ঞানের কথাতো অনেক হলো। এবার দেখি বর্তমান সময়ের বিজ্ঞান কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশন সম্পর্কে কি বলে। পদার্থ বিজ্ঞানের একটি মৌলিক শাখা হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স যার জন্ম বিশ শতকের প্রথম দিকে। একক অণুর স্তরে যে সব ঘটনা ঘটে তা ব্যাখ্যা করাই কোয়ান্টাম মেকানিকস এর কাজ । এ শাখার সবচেয়ে মৌলিক এবং জটিল কিছু বিষয় নিয়েই কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশনের ধারনা গড়ে উঠেছে। গত শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা কয়েকটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন- যার মাধ্যমে কোয়ামন্টাম মেকানিকস এর মৌলিক এবং অদ্ভুত কিছু সূত্রের বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এ সূত্র গুলোর সাহায্যেই কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশনের সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠেছে। তাই এখন আর কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশনকে নিছক সায়েন্স ফিকশন বলা যাবে না। বিজ্ঞানীরা কোয়ামন্টাম টেলিপোর্টেশনের কয়েকটি কাল্পনিক মডেলও ইতমধ্যে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। প্রথম মডেলটি অনেকটা এ রকম- একটি বিশেষ স্ক্যানার প্রথমে যে বস্তু কে অন্য স্থানে পাঠানো হবে তাকে স্ক্যানিং করবে। স্ক্যানিং এর মাধ্যমে বস্তুর প্রয়োজনীয় তথ্য বা ডাটা সংগ্রহ করবে। প্রাপ্ত ডাটা গুলোকে ট্রান্সমিটারের সাহায্যে নির্দষ্ট একটি রিসিভিং ষ্টেশনে পাঠিয়ে দেয়া হবে। রিসিভিং ষ্টেশন প্রাপ্ত ডাটা গুলোকে বিন্যস্ত করে মূল বস্তুটির একটি অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করবে। মডেলটি আসলে যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে কিন্তু মোটেই তত সহজ নয়।
২য় মডেলটি তৈরি করা হয়েছে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর একটি সূত্রের উপর ভিত্তি করে। আইনস্টাইনের মতে বস্তু কে শক্তিতে বা শক্তিকে বস্তুতে রূপান্তর করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বস্তুকে প্রথমে বিদ্যুত্ শক্তিতে রূপন্তর করা হবে। রূপান্তরিত শক্তি বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে অন্য স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে বেতার তরঙ্গকে প্রথমে বিদ্যুত্ শক্তিতে এবং বিদ্যুত্ শক্তিকে বস্তুতে রূপান্তর করা হবে।
আসলে উপরের দু’টি মডেলই কাল্পনিক। বাস্তবে বস্তুর টেলিপোর্টেশন করা এখন সম্ভব হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপরে আশাবাদী। কারন ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সিটিটিউট অব টেকনলজির বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে খুব জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আলোর ফোটনের (আলোর ক্ষুদ্রতম কনা) টেলিপোর্টেশন করতে পেরেছেন। তবে একশ ভাগ সফল টেলিপোর্টেশন করার জন্য বিজ্ঞানীদের আরও আনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম বাধাটি হলো বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব। এ তত্ত্বে বলা হয়েছে “কোন বস্তু একই সময় অন্য কোন বস্তুর পূর্ন অবস্থান ও ভরবেগ সম্পুর্ন নির্ভূল ভাবে নির্নয় করতে পরে না”। আবার কোন বস্তুর প্রতিটি অনুর ইলেকট্রনের অবস্থা এবং গতিবেগ নির্নয় করা হলে তাতে ভূল হবার সম্ভবনাই বেশি থাকে। তাই কোন বস্তুর পূর্ন কোয়ান্টাম অবস্থা ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব। অথচ বস্তুর টেলিপোর্টেশন করতে হলে বস্তুটির সঠিক কোয়ান্টাম অবস্থা ব্যাখ্যা করা জরুরী। তার পরেও বিজ্ঞানীরা জড় বস্তুর টেলিপোর্টেশনের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। কিন্তু সমস্যা হলো প্রাণীদের নিয়ে তারা শ্বাস নেয় তাপ বিকিরন করে আর তাদের রয়েছে স্মৃতি শক্তি। তাই প্রাণীদের টেলিপোর্টেশন করা আসলেই সম্ভব হবে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনও জানে না।
টেলিপোর্টেশনের মাধ্যম হিসেবে এখও বেতার তরঙ্গ ছাড়া অন্য কোন মাধ্যম এর কথা ভাবাও সম্ভব হয়নি কারন এখন পর্যন্ত যোগাযোগের সর্বশেষ মাধ্যম হচ্ছে বেতার তরঙ্গ বা রেডিও ওয়েভ। কিন্তু বেতার তরঙ্গের রয়েছে নানা সিমাবদ্ধতা। রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে একসাথে খুব বেশি পরিমান ডাটা বা ত্তথ্য প্রেরন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে প্রেরিত ত্তথ্য শতভাগ অবিকৃত নাও থাকেত পারে। তাছাড়া রেডিও ওয়েভের গতি আলোর গতির সমান (এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল / সেকেন্ড) তাই রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে কখনই এর চাইতে বেশি গতিতে ত্তথ্য আদান প্রদান সম্ভব নয়। যদিও রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে টেলিপোর্টেশন করা সম্ভব হয়। তাহলেও আমাদের সবচাইতে কাছের নক্ষত্রটিতে পৌছতে সময় লাগবে এক লক্ষ বছরেরও বেশি সময়। আর বিশাল মহাবিশ্ব এ দূরত্ব এবং সময় নিতান্তই সমান্য। তাই বিজ্ঞানীরা টেলিপোর্টেশনের জন্য নতুন কোন মাধ্যমের কথা ভাবছেন। যে মাধ্যমের সহায্য আলোর চেয়েও বেশি গতিতে একটি বস্তুর পরিপূর্ন ত্তথ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো সম্ভব হবে। যদিও বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতে এ মহাবিশ্বে আলোর গতিই সবচেয়ে বেশি এবং কোন ভাবেই এ গতি অতিক্রম করা সম্ভব নয়।
এতক্ষন তো টেলিপোর্টেশনের নানা দিক জানলেন। এবার তাহলে চলুন দেখি সকল বাধা অতিক্রম করে যদি টেলিপোর্টেশন সম্ভব হয় তাহলে মানব জীবনে এর প্রভাব কেমন হবে? টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে মানুষ দূরত্বকে করবে জয়। অর্থাত্ কোটি কোটি মাইল দূরত্ব মানুষ কয়েক সেকেন্ড বা তারও কম সময়ে অতিক্রম করবে। আর এর প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। মানুষ তখন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত জয় করে ছুটবে মহাবিশ্বে নতুন বাসস্থানের সন্ধানে। মঙ্গল গ্রহ বা শনির উপগ্রহ “টাইটান” তো তখন ন্যানো সেকেন্ডের দূরত্ব। মানুষ তখন আবিষ্কার করবে মহাবিশ্বের নতুন আবাসস্থান। সে সময় আমদের সবার প্রিয় পৃথিবীর রূপটা কি রকম হতেপারে চলুন দেখি। পৃথিবীতে তখন যানবাহন চলাচলের কোন রাস্তা চোখে পরবে না। কারন মানুষ যাতায়েতের জন্য ব্যাবহার করবে টেলিপোর্টেশন টেকনলজী। দূষন মুক্ত থাকবে আমাদে গ্রহ কারন কলকারখানা গুলো থাকবে অন্য কোন দূরের গ্রহে এবং পৃথিবী হয়তো হবে সম্পুর্ন আবাসিক এলাকা । অন্য গ্রহে তৈরি করা দ্রব্য আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে। যোগাযোগের জন্য তখন চিঠি, ফেক্স, ই-মেইল এমন কি মোবাইল ফোনেরও আর প্রয়োজন হবে না। মানুষ নিজেই সেকেন্ডের মধ্যে চলে যেতে পারবে যেখানে প্রয়োজন। তখন মোবাইল সেটের পরিবর্তে সবার হাতে থাকবে পোর্টেবল টেলিপোর্টেশন ডিভাইস। মানুষ যেকোন সময় যেকোন স্থানে যেতে পরবে ইচ্ছে মত। আসলে টেলিপোর্টেশন টেকনলজী মানব সভ্যতায় আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। যা এখন কল্পনা করাও কঠিন। তবে সায়েন্স ফিকশন ছবির টেলিপোর্টেশন টেকনলজী বাস্তবে করতে হলে আরও অনেক সময় এর প্রয়োজন। কারন সফল টেলিপোর্টেশন সম্পন্ন করতে হলে বর্তমান বিজ্ঞানের অনেক তত্ত্বই পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু একটি তত্ত্ব পরিবর্তন করা মোটেও সহজ কাজ নয়। তাই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন কি ভাবে এসব বাধা দূর করে টেলিপোর্টেশন করা যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে বর্তমানে বিজ্ঞানীদের যে প্রযুক্তি রয়েছে তা দিয়ে আলোর কনার মত অতি ক্ষুদ্র কোন বস্তুকে টেলিপোর্ট করা সম্ভব হতেপারে।
তবে এটা ঠিক যত বাধাই থাকুক মানুষ এক দিন ঠিকই যে কোন বস্তু সফল টেলিপোর্টেশন করতে পারবে। তবে সে দিনে জন্য মানুষকে হয়তো আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
Teleportation Setup
আরও জনতে এখানে দেখুন
আমি আকাশছোঁয়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 15 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 23 টি টিউন ও 80 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করতাম। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিশেষকরে ইলেক্ট্রনিক্সের প্রতি ছিলো আলাদা একটা ভালোবাসা। ইলেক্ট্রনিক্সের কোন খেলনা পেলে তা না খুলে দেখা পর্যন্ত মনে শান্তি পেতাম না। কেমন করে কাজ করে এগুলো এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো মাথায়। বাসার টর্চলাইট থেকে শুরু করে বড়ভাইয়ের ক্যালকুলেটর কোন কিছুই...
নয়া টেকনলজি(যদিও কাল্পনিক)
জানানোর জন্য ধন্যবাদ