বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট

ইন্টারনেট প্রসারের ফলে রাস্তায় মানুষের ভ্রমন চাহিদা কমে যায়, ফলে যানজটও কমে। কারণ, এখন কোন একটা তথ্য (পরীক্ষার ফলাফল, নোটিশ) জানতে সেই প্রতিষ্ঠানে না গিয়েই নেটে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও করেছে দ্রুততর। তবে তা সত্বেও রাস্তার যানজট কিন্তু পুরাপুরি কমছে না। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলেতে রাস্তার ক্রমবর্ধমান যানজট কমানোর জন্য তাই নিত্য নতুন গবেষণা চলছে। এরই একটা হল বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (Bus Rapid Transit) বা BRT। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহরে এটা চালু করা হয়েছে সফলতার সাথে। আমাদের সরকারও, বিশেষত ঢাকায়, এটা চালু করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আসুন জেনে নেয়া যাক বিআরটি জিনিষটা কী?

যানজট বা যাতায়ত ব্যবস্থাপনায় বাস সবসময়ই প্রাইভেট কারের চেয়ে বেশি আদরনীয় কারণ, একই সংখ্যাক যাত্রী বহন করার জন্য যতগুলো বাস লাগে সেগুলোর বদলে কার ব্যবহার করলে তা অনেক বেশি রাস্তা দখল করে যানজট বাড়ায়। যেমন: ১২০ জন যাত্রী বহন করতে ৩০টা কার কিংবা ৩টা বাস লাগবে। ৩০টা প্রাইভেট কারের চেয়ে ৩টা বাস রাস্তায় এবং পার্কিংএ অনেক কম জায়গা নেয়। এছাড়া জ্বালানী খরচের কথা চিন্তা করলেও ৩০টা কারের চেয়ে ৩টা বাসে চলাচল করা সাশ্রয়ী। তাই সীমাবদ্ধ আকারের রাস্তা দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা পেতে/দিতে ট্রাফিক ম্যানেজারগণ প্রাইভেট কারের বদলে বেশি বেশি বাস চান। এছাড়া একটা পাবলিক বাস সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরা সময়েই যাত্রী বহন করে। কিন্তু প্রাইভেট কার দুই বা তিন ট্রিপ দেয় আর বাকী সময়ে রাস্তার জায়গা দখল করে থেমে থাকে (পার্কিং)।

কিন্তু ট্রাফিক ম্যানেজার চাইলেই তো হবে না। বাসে খরচ অনেক কম হলেও সেটাই বাসে চড়ার জন্য যথেষ্ট ভাল কারণ নয়। আরো অনেক কারণেই মানুষ বাসে না চড়ে অধিক খরচ করে প্রাইভেট কার ব্যবহার করে। সময়মত বাস না পাওয়ার সমস্যা যেমন রয়েছে (অপ্রতুলতা), তেমনি সাধারণ বাসে যাতায়ত কম আরামদায়ক (গরম, ধূলাবালি), সময়ও অনেকসময় বেশি লাগে। বাস আকারে বড় হওয়াতে এটা প্রাইভেট কারের মত সহজে এঁকে বেঁকে বিভিন্ন বাঁধা পার হয়ে দ্রুত যেতে পারে না। মানুষ প্রাইভেট কার বাদ দিয়ে বাসে চড়তে আগ্রহ পাবে যখন এটা দিয়ে আরামে এবং দ্রুততর গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে।

এমন যদি হত, যে আমি সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডে গেলাম এবং টিকিট কেটে অপেক্ষায় থাকলাম। লাইনে প্রায় ১০ জনের পেছনে দাঁড়াতে হল। ৫ মিনিটের মধ্যে বাস আসলো। হুড়হুড় করে সকলে গাড়িতে উঠলাম। বাস এসে থামা থেকে আমাদের নিয়ে আবার চলতে শুরু করার পুরা ঘটনাটায় সর্বমোট ৩০ সেকেন্ড সময় লাগলো। বাসটা এয়ার কন্ডিশনড, কোনরকম ঘাম, ধুলাবালি নাই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, এটা কোন জ্যামে পড়ছে না, সিগনালেও এটাকে আগে ছেড়ে দিচ্ছে। রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকলেও বাসটা এর জন্য নির্দিষ্ট করা আলাদা লেন দিয়ে সমস্ত জ্যামকে পাশ কাটিয়ে সাবলিলভাবে চলে আসলো। মিরপুর থেকে মতিঝিল আসতে ৩০ মিনিট লাগলো। বাসা থেকে বের হয়ে স্ট্যান্ডে আসা, টিকিট কাটা, অপেক্ষা, বাস ভ্রমন, বাস স্ট্যান্ড থেকে অফিসে আসা সব মিলিয়ে আমার ৫৫ মিনিট সময় লাগলো। ওদিকে আমার বন্ধু একই পথ জ্যাম ঠেলে প্রাইভেট কারে আসতে প্রায় সোয়া এক ঘন্টা লাগলো।

হ্যাঁ ভাই, মেট্রো রেলের এই রকম সুবিধা বাসেও পাওয়া সম্ভব, আর এটা মেট্রো রেলের চেয়ে কম খরচেই করা যায়। পৃথিবীর অনেকগুলো বড় শহরে এই পদ্ধতি দারুন কাজে দিয়েছে। মেট্রোরেলের নাম অনেক জায়গাতেই এমআরটি বা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট - আর এই নাম থেকেই এই পদ্ধতির নাম হয়েছে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি।

বিআরটি সিস্টেমে ব্যবহৃত বাসগুলি প্রচলিত বাসের চেয়ে একটু অন্যরকম হয়।

  • প্রথমত, এগুলোর দরজা থাকে বাসের মাঝখানে। দরজার বৈশিষ্ট হল সাধারণ বাসের মত এটার দরজায় কোন সিড়ি নাই। বাসের মেঝে রাস্তা থেকে যথেষ্ট উঁচুতে থাকায় বাসগুলো ট্রেনের মতই এর নির্দিষ্ট স্টপেজে একটা প্লাটফর্ম ঘেষে দাঁড়ায়। স্টপেজের প্লাটফর্ম আর বাসের মেঝে এক লেভেলে থাকাতে বাসের সিড়ি দরকার হয় না, আর এর ফলে খুব কম সময়ে ও কম কষ্টে যাত্রীরা এটাতে উঠা নামা করতে পারে।
  • প্লাটফর্ম থেকে বাসে উঠতে মানে প্রবেশ করতে হয়। এজন্য কোন রকম উঁচু বা নিচু সিড়ি পার হতে হয় না। বাসের দরজা আর প্লাটফর্ম এমনভাবে সমন্বিত থাকে যে হুইলচেয়ারে করেও যে কোন লোককে এটাতে তোলা যাবে।
  • এই বাসের আরেকটি জরুরী বৈশিষ্ট হল এগুলো এয়ার কন্ডিশনড হতে হয়। কারণ আরামদায়ক আর সহজ না হলে মানুষ প্রাইভেট কার বাদ দিয়ে এটাতে ভ্রমন করতে তেমন একটা উৎসাহ পাবে না।
  • সময় বাঁচানোর জন্য বাসের মধ্যে টিকিট কাটার ব্যবস্থা থাকে না। কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে হয়।
  • আরেকটি জরুরী বৈশিষ্ট হল, বিআরটি বাসের জন্য রাস্তার মধ্যেই আলাদা করে দেয়া লেন থাকে। ফলে এই বাসগুলো রাস্তার অন্য গাড়িদের সাথে দেখা সাক্ষাত ছাড়াই দ্রুত যেতে পারে। ফলে রাস্তার অন্যান্য গাড়ির চেয়ে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তবে এটা বাধ্যতামূলক কিছু নয়। কোনো কোনো শহরে আলাদা সুড়ঙ্গ করে সেটাতে ট্রেন না করে বিআরটি করা হয়েছে
  • এর ঘন ঘন স্টপেজ থাকে না।
  • ট্রাফিক সিগনালে এই বাসগুলো অগ্রাধিকার পায়। অনেকক্ষেত্রে রাস্তার ক্রসিংগুলোতে শুধু এই বাসের লেনগুলোর জন্য ফ্লাইওভার করে দেয়া হয়।

যেহেতু এই বাসের আলাদা লেন থাকে তাই আসা ও যাওয়ার লেনগুলো রাস্তার মাঝের দিকে হলে সেটা সুবিধাজনক হয়। সেক্ষেত্রে প্লাটফর্ম হয় রাস্তার মাঝামাঝি ডিভাইডারের জায়গায়। ফলে এই বাসগুলোর দরজা উল্টা দিকে হয়। যাত্রীদেরকে ফুটওভার ব্রীজ দিয়ে এই স্থানে আসতে হয়।

এবার এই ধরণের সিস্টেম ও বাসের কিছু ছবি দেখুন:

চীনের একটা শহরের স্কেচ, রাস্তার মাঝে বিআরটি আলাদা লেনে হলে স্টপেজগুলো এমন হতে পারে (স্কেচ সূত্র:http://www.lifeofguangzhou.com)

ব্রাজিলের ইকো সিটি কুরিতিবা: দরজা আর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানের জায়গাটা লক্ষ্য করুন। (ছবি: উইকিপিডিয়া)। এখানে সাধারণ বাসের মত দুইপাশে আলাদা প্লাটফর্ম।

জাকার্তা (ইন্দোনেশিয়া) (ছবি: উইকিপিডিয়া)

বোগোটা, কলম্বিয়া (ছবি:http://urbanplacesandspaces.blogspot.com ) আহা জ্যাম এড়িয়ে বাসে আগে যাওয়া যায়।

সিয়াটলে মেট্রোর মত টানেল বা সুড়ঙ্গে ট্রেন না করে বিআরটি করেছে। (ছবি উইকিপিডিয়া)

প্লাটফর্ম আর দরজা হবে এক লেভেলে এমন: (সূত্র: http://transitmy.org/)

বাস বলে কি আর ট্রেনের আমেজ পাওয়া যাবে না? ব্যবহার করুন আর্টিকুলেটেড বাস। (সূত্র:http://nexus.umn.edu/Courses/Cases/CE5212/F2008/CS3/CS3.html )

বিআরটি সিস্টেম প্রায় মেট্রো রেলের মতই। তবে এটা তৈরী করতে অত বড় কোনো আয়োজনের দরকার হয় না। তাই এটা বানাতে মেট্রোর মত অত বাজেট দরকার হয় না। পিক আওয়ার আর অফ পিক আওয়ারে প্রয়োজনমাফিক বাসের সংখ্যা কমানো বাড়ানো যায় বলে এটা অফপিক আওয়ারে মেট্রোর মত খালি যেতে হয় না। আর ট্রামের মত এটা আলাদা কোন সিস্টেম না বলে প্রচলিত লোকবল দিয়েই বাসগুলো এবং রাস্তাগুলো দেখাশোনা (মেইনটেনেন্স) করানো যায়। লাইট রেইলের চেয়েও বিআরটির খরচ কম। যুক্তরাস্ট্রের একটা সরকারী গবেষণামতে  বাসের রাস্তা বানাতে প্রতি মাইলে ১৩.৫ মিলিয়ন ডলার লাগে যেখানে লাইট রেইল লাইন বানাতে খরচ ৩৪.৮ মিলিয়ন ডলার/মাইল। তবে সাধারণ হিসাব হল: বিআরটি প্রতি মাইলে - ২লক্ষ থেকে ৫.৫ কোটি ডলার আর লাইট রেইলে সেটা ১.২৪ কোটি থেকে ১১.৮৮ কোটি ডলার। (সূত্র: উইকিপিডিয়া - http://en.wikipedia.org/wiki/Bus_rapid_transit)

বিআরটি সিস্টেমটা ট্রাফিক সমস্যার খুব ভাল সমাধান বলে বিশ্বের অনেক বড় শহরে এটা গড়ে উঠছে। কতগুলো শহরে চালু আছে সেগুলোর নাম লিখলে এই ব্লগের আকার ৩গুন হয়ে যাবে। কৌতুহলী হল উইকিপিডিয়ার লিস্টটা দেখে আসতে পারেন (http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_bus_rapid_transit_systems)।

ঢাকায় গাজীপুর থেকে উত্তরা পরীক্ষামূলক ভাবে বিআরটি করার কথা শুনেছিলাম কোন একটা টক শো তে। ওটা কি আদৌ হবে কি না কে জানে। তবে কোন দুষ্টু জানি উইকিপিডিয়ার লিস্টে বাংলাদেশের নামও ঢুকিয়ে রেখেছে!

পেপার পত্রিকা তেমন পড়া হয়না বলে পোস্ট লেখার আগে এই রিপোর্টগুলো চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো:

জনকন্ঠ: ১০-জুলাই-২০১১ গাজীপুর থেকে সদরঘাট বাস পৌঁছাবে আধা ঘন্টায়

কালের কন্ঠ ২৩-জানুয়ারী-২০১০ আসছে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট

অনলাইন মিডিয়া সার্ভিস: ২৫-জুন-২০১১ এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট চালু হচ্ছে

বাংলার চোখ ২৮-সেপ্টেম্বর-২০১০? রাজধানীর যানজট কমাতে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ

দেশের খবর ১১-এপ্রিল-২০১১ রাজধানীর যানজট নিরসনে নতুন উদ্যোগ বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট

পূর্বপ্রকাশ: পরিবেশ প্রকৌশলীর প্যাচাল, সচলায়তন

সংশ্লিষ্ট আরেকটি পরিপূরক পোস্ট: সচলায়তন - ঢাকায় নির্মিতব্য উড়াল সড়ক কি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে?

Level 0

আমি শামীম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 15 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 36 টি টিউন ও 449 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

গুগল আমার সম্পর্কে জানে, কাজেই জানতে চাইলে আমার নাম বা ইউজার নামটা দিয়ে গুগল করুন ... :D


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

Level 0

অশাধারন……
আমাদের দেশটা একদিন এইরকম হবে, ভাবলেই কেমন সুখ সুখ লাগে……….

    @Mahfuz: আগামী ৩ বছরের মধ্যেই হবে বলে ঘোষনা দেখলাম পেপারে।