আজ় করিমের বাবা-মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। সে তার বাবা-মায়ের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিয়ে ফিরে আসছিল; তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হঠাত রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের পাশের বিশাল ডিজিটাল সাইনবোর্ডে লাল কালিতে ভেসে উঠলো, “কিছুক্ষনের মধ্যেই একটি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হবে, সবাইকে নিরাপদ জায়গায় ফিরে যেতে বলা হচ্ছে”। প্রতি দশ সেকেন্ড পরপর তীব্র কর্কশ ধ্বনিতে সতর্কীকরণ এলার্মটি বেজে উঠছে। করিমের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। তবে তা আনন্দের হাসি নয়, অবজ্ঞার হাসি, ঘৃ্নার ঠুনকো হাসি। যুদ্ধ!
এই একটি শব্দই গত কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষের আকাংখিত শব্দে পরিণত হয়েছে। চ্যাসিনিয়া গ্যালাক্সির এই “সিমুলা” নামক গ্রহের মানুষের কাছে যে ব্যাপারটি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে তা হলো যুদ্ধ।
সতর্কীকরণ এলার্ম শুনে মানুষের মধ্যে এদিক-ওদিক ছুটোছুটির হিড়িক পরে যায়। জনগনের কলাহল চরম পর্যায়ে রূপ নেয়। অনেকের মতো করিমও বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাস্ত হয়। কিন্তু হঠাত ভিড়ের মধ্য থেকে একটি আর্তচিতকার শোনা যায়। “থাকবে না, থাকবে না, সিমলাও থাকবে না। ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমনটা হয়েছিল পৃথিবী। যাক! ধ্বংস হয়ে যাক! মিশে যাক সবকিছু”। কথাগুলোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা ঝরে পরছিল তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। এ কথায় ধরণের করিমের কোন প্রতিক্রিয়া হয়না। কিন্তু এবারের কথাটি শুনে করিম থমকে দাঁড়ালো। কারণ কথাটির মাঝে একটি বিশেষ শব্দ আছে- “পৃথিবী”।
করিম তার চাচা রফিক সাহেবের কাছে শুনেছে, তার আদি পূর্বপুরুষেরা নাকি পৃথিবী নামক কোন একটি গ্রহে বাস করতো। করিম পৃথিবী দেখেনি তবে তার কম্পিউটারে পৃথিবীর একটি বহু পুরানো ছবি এবং বেশকিছু তথ্য লোড করা আছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, করিমের জন্ম কিন্তু পৃথিবীতেই। অথচ পৃথিবীর নাম শুনতেই করিম শিউরে উঠে। তার মনে পরে যায় চাচার কথাগুলো।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশ বছর আগের কথা। তখন করিমের জন্মই হয়নি। তার চাচা ১৯০ বছরের যুবক। তখন পৃথিবী কেবল উন্নতির সোপানে পা রেখেছিল। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাজে লাগিয়ে তখন মানুষের আয়ু কয়েকশ বছর বাড়িয়ে নেয়া হয়েছিল। আর এখন তো মানুষের আয়ু কয়েক হাজার বছর। বলতে গেলে মানুষ তখন অমরত্বের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
মানুষের আয়ু বাড়ার কারণে মৃত্যুহার কমে গিয়েছিল। এর এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পৃথিবীর জনসংখ্যা স্বাভাবিক জনসংখ্যার চেয়ে শশগুণ বেড়ে গিয়েছিল। দেখা দিতে লাগলো চরম গ্রীণ-হাউজ ইফেক্ট, দুর্ভিক্ষসহ হাজারো নান ধরণের সমস্যা। এদিকে জনসংখ্যাও কমছে না। সমস্যা চরম আকার ধারণ করলো। ঠিক এ সময়ে সবার মনে চলে এল, তারা বুঝতে পারলো, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যুদ্ধ ছাড়া কোন বিকল্প উপায় নেই। জনসংখ্যা কমানোই সাবলীলভাবে বেঁচে থাকার এক সহজ ও সর্বোত্তম পন্থা। কাজেই, মানুষ আবার বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।
প্রগৈতিহাসিক কালের এক বিজ্ঞানী ডারউইনের মতবাদ যেন সবার মনে শব্দমূল হয়ে গিয়েছিল- “কেবল উপযুক্তরাই টিকে থাকবে, বাকিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে”। ডারউইনের মতবাদকে মহাসত্য মেনে নিয়ে মানুষেরা উপযুক্ত হয়ে টিকে থাকার জন্য প্রবল আক্রোশে একে অন্যের উপর ঝঁপিয়ে পরলো। ব্যাস, এক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর জনসংখ্যা স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিন্তু এ অবস্থাও বেশিদিন থাকলো না। পূর্বের অবস্থা যথারীতি ফিরে এল। এভাবে বারবার যুদ্ধের ফলে পৃথিবী এমন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো যা সীমাহীন। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল তেজষ্ক্রিয়তা, পথে ঘাটে সর্বত্র ধ্বংসস্তপ, গাছের চিহ্ন মাত্র নেই, পানির চরম সংকট নেই। চারিদিকে ধুধু মরুভূমি আর হঠাত হঠাত এসিড বৃষ্টি। চারিদেকে শুধু শূণ্যতা এবন হাহাকার। করিমের বাবা-মাও সে যুদ্ধে মারা যান। অবশ্য এর কিছু দিন আগেই হাসানের জন্ম হয়। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সে তার চাচা রফিক সাহেবের কাছে ছিল।
এসব থেকে মানুষ রক্ষা পেতে মহাবিশ্বের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ালো। একটি নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। প্রায় দু’শ বছর পরেই তারা সন্ধান পেল “সিমালা” নামের গ্রহটির। এটি অবিকল পৃথিবীর মতো। কিন্তু পৃথিবীর চেয়ে কয়েকগুণ। সন্ধান পাওয়ার পর-পরই মানুষজন এটিতে আস্তে শুরু করলো। তারা গ্রহটিতে বসবাস শুরু করলো। অপরপক্ষে পৃথিবী পরে থাকলো একটি নিঃসংগ ধূসর গ্রহ হিসেবে। রফিক সাহেবও ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। করিমের বাবা-মায়ের কবর কিন্তু পৃথিবীতেই রয়ে গেছে। কিন্তু করিম কবরের কাছে গেলে একটি অজানা প্রশান্তি পায়। তাই মাঝে মাঝে সে এখানে আসে।
হঠাত করিম তন্দ্রা ফিরে পেল। একটি সামরিক রোবট তাকে নিরাপদ জায়াগায় ফিরে যেতে তাগাদা দিচ্ছে। কিন্তু করিমের যেন এ ব্যাপারে কোন হুশ নেই। হঠাত কোন এক জায়গায় একটি বোমার বিশাল বিষ্ফোরণ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। তার কিছু আলোকছটা করিম আন্দাজ করতে পারলো। তবে কি পৃথিবীর অভিশাপ লেগেছে এই গ্রহটির উপরে? এই গ্রহটির ভাগ্যেও কি নেমে আসবে সেই একই নির্মম পরিণতি, যেমনটা হয়েছিল “পৃথিবী”-র? করিম আস্তে আস্তে পথ চলতে শুরু করলো। সামরিক রোবটটি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো- একটি ছেলে ল্যাম্পপোস্টের নিচ দিয়ে হেটে চলেছে একটি অনিশ্চিত ও অভিশপ্ত ঠিকানার উদ্দ্যশ্যে।
(বিঃদ্রঃ- পূর্বে “আইটি রিভিউ”-র আগস্ট’২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত)
আমি এন.সি.। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 46 টি টিউন ও 208 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আপনার লিখা গল্প সত্যিই ভাল! 🙂