সায়েন্স ফিকশন-৩: প্রোগ্রাম রিকোভারী

গভীর রাত। ঘড়ির কাটা তিনটে ছুঁই ছুঁই করছে। বিখ্যাত ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ.বি গ্রুপ অব ইন্ড্রাষ্ট্রিজ-এর জেনারেল ম্যানেজারের অফিস কক্ষ। চারিদিকের নিস্তব্ধতা ছাড়িয়ে কী-বোর্ডের খটখট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কম্পিউটার স্ক্রীনের আলো কিছুটা হলেও ঘরের অন্ধকার দূর করেছে। কম্পিউটারের কী-বোর্ডের উপর প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার মি. আমানের হাতের আঙুলগুলো। উদভ্রান্তের মতো শুধু বাটন টিপেই চলেছেন তিনি। আশে পাশে কোন দিকেই খেয়াল নেই তার। এতো রাতে কম্পিউটারে কি যেন খুঁজছেন তিনি, কিন্তু পাচ্ছেন না। এয়ারকন্ডিশন রুমের ভেতরেও তিনি দরদর করে ঘামছেন।

ঘামে কপালের সাথে চুলগুলো লেপ্টে আছে। সমস্ত শরীর ভিজে শার্টটা চুপ চুপ করছে। কপাল থেকে ঘাম চোখের মধ্যে চলে আসায় চোখে ঝাঁপসা দেখছেন। চোখ পিট পিট করছে কিন্তু হাত দিয়ে ঘাম মোছার মতো সময় টুকুও যেন তার নেই। চিবুক গড়িয়ে এক ফোটা ঘাম কী-বোর্ডের উপর পড়লো। কম্পিউটার স্ক্রীনের উপর ঝুকে র‌য়েছেন তিনি। ঘামে তার হাত চট্‌চটে হয়ে পিছলে যাচ্ছে। কিন্তু সে দিকে তার কোন খেয়ালই নেই। তিনি এখন কম্পিউটারে একটি গুরুত্বপর্ণ ফাইল খোঁজায় ব্যস্ত। যে ফাইলের উপর নির্ভর করছে তার স্ত্রী ও কন্যার জীবন। এই ফাইলটি যদি তিনি ওদেরকে না দেন তবে ওরা বলেছে, তার স্ত্রী ও কন্যাকে ওরা মেরে ফেলবে। মি. আমানের ধারণা ওরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রতিষ্ঠানের লোক। এই ফাইলে তার অফিসের ব্যবসা সঙ্ক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। এটি ওদের হাতে চলে গেলে এই প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি নিরুপায়। প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে হলেও তিনি নিজ স্ত্রী-কন্যাকে বাঁচাতে চান। নইলে যে ওরা তাদেরকে মেরে ফেলবে। সব কিছুর বিনিময়ে হলেও তিনি ফিরে পেতে চান তার স্ত্রী-কন্যাকে। কিন্তু তিনি কপি করবেন কি! তিনি তো ফাইলটিই খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি তো ঠিক ড্রাইভেই খুঁজছেন। তবে পাচ্ছেন না কেন?

কিছুদিন পর...

মি. আমান মুষড়ে পরেছেন। তিনি ওদেরকে বাঁচাতে পারেন নি। তিনি তো সমস্ত ন্যয়-নীতি বিসর্জন দিয়ে ওদেরকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নি। কম্পিউটারের ভাইরাস তার অফিসের কম্পিউটারে সমস্ত প্রোগ্রাম নষ্ট করে দিয়েছিল। সামান্য কিছু ক্ষুদ্র প্রোগ্রামের কাছে তিনি পরাজিত হলেন। তার বেঁচে থাকার সব আশা-ভরসা তো শেষ হয়ে গেছে। এখন কি নিয়ে বাঁচবেন তিনি! যাদেরকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাদেরকে তো তিনি বাঁচাতেই পারেন নি।

দশ বছর পর...

ফয়সালের এই যন্ত্রটি আবিষ্কারে তার বস্‌ কেন যেন খুশি হতে পারেননি। এই যন্ত্রটি আবিষ্কারের ফলে সমস্ত কম্পিউটার ব্যবহারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যেখানে মহাখুশি সেখানে কেন তার বস্‌ খুশি হতে পারছেন না! ফয়সাল যেন কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। ফয়সাল যে যন্ত্রটি আবষ্কার করেছে এটি কম্পিউটারের সমস্ত প্রোগ্রামকে যে কোন ভাইরাস থেকে রক্ষা করবে। ভাইরাস যদি কম্পিউটারের সমস্ত প্রোগ্রামকে মুছে দেয়, তবুও কোন ক্ষতি নেই। ফয়সালের এই যন্ত্রটি চব্বিশ ঘন্টা পর্যন্ত সব ডাটা বা এর ইমেজ সংরক্ষন করতে সক্ষম। যন্ত্রটি কম্পিউটারে কানেক্ট থাকা অবস্থায় কোন ভাইরাস যদি কম্পিউটারে আক্রমণ করে তবে যন্ত্রটি সয়ংক্রিয়ভাবে এর আক্রান্ত ডাটা এর মধ্যে কপি করতে থাকে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যন্ত্রটিকে অন্য আরেকটি কম্পিউটারের সাথে সংযোগ করলে সকল ডাটা প্রায় অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া যাবে। এতে আগের কম্পিউটারের ভাইরাস আক্রান্ত করলেও কোন কম্পিউটার ব্যবহারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অন্য কোন কম্পিউটারে তার সমস্ত ডাটা ফিরে পাবেন শুধু মাত্র এই যন্ত্রটির সাহায্যেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ফয়সালেকে খুব ভাবিয়ে তুলছে। অন্যান্য সবাই যখন এই যন্ত্রটির আবিষ্কারে মহাখুশি, তখন মি. আমান কেন নিশ্চুপ হয়ে আছেন। তিনি আগে যেমন ব্যবহার করতেন, তেমনটা আজকাল করছেন না। ফয়সাল তার আচরণে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখতে পারছে। বিষয়টি ফয়সালের কাছে মোটেই পরিষ্কার হচ্ছেনা।

এ.বি গ্রুপ অব ইন্ড্রাষ্ট্রিজ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্বে আছেন বর্তমানে মি. আমান। ফয়সাল হলো তার প্রিয় ছাত্র এবং সহকারী। ফয়সালের বয়স মাত্র পঁচিশ বছর। কিন্তু বয়স কম হলে কী হবে, তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা অনেক তীক্ষ্ণ। সে হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রাংশ আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। এবার অন্যান্য সবাই খুশি হলেও মি. আমান যেন খুশি হতে পারছেন না।

ফয়সালের উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্য মি. আমান তাকে খুব পছন্দ করেন। তাই অফিসের অন্যান্য কর্মচারীর মতো তিনি তাকে কর্মচারী ভাবেন না। তিনি তাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন। কেউ কোন যন্ত্র আবিষ্কার করলে তাকে নিজ থেকেই পুরষ্কৃত করেন। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফয়সাল যেন তার দশ বছর আগের পুরোনো ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে। মি. আমান তার স্ত্রী-কন্যাকে তথা তার ব্যর্থতাকে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফয়সালের কারণে সেই সব স্মৃতিগুলো তাকে নতুন করে কাঁদাচ্ছে। তাই তিনি ফয়সালকে সহ্য করতে পারছেন না। এই আবিষ্কারটা যদি দশ বছর আগে হতো তাহলে কী তিনি তার স্ত্রী-কন্যাকে হারাতেন? তিন বছর বয়সের মেয়েটিও এতোদিনে অনেক বড় হতো। কিন্তু এখন তো তিনি তাদের ফিরে পাবেন না। তাই মি. আমান তার আবিষ্কারে মোটেও খুশি হতে পারছেন না। তিনি যেন স্বার্থপরের মতো ফয়সালকে সহ্য করতে পারছেন না।

হঠাৎ করে টেবিলে রাখা ছবির ফ্রেমটির দিকে মি. আমানের নজর পরলো। তিন বছরের সেই মেয়েটি যেন তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মি. আমানের চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরে পরছে। তার ছোট্ট মেয়েটি যেন তাকে বলছে-

“বাবা, তুমি কাঁদছো কেন? তোমার তো কাঁদলে চলবে না। তোমার মত সমস্যায় পরে তো কেউ আর তাদের সন্তানকে হারায় না। তোমার তো এখন হাসবার দিন। একটু হাসো না বাবা... প্লিজ একটু হাসো... প্রাণ খুলে চিৎকার করে হাসো”।

মি. আমান প্রচন্ড শব্দ করে হাসতে লাগলেন-

“হা...হা... হা...”

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার নব আস্তে করে ঘুরে গেল। ফয়সাল রুমে প্রবেশ করল। প্রবেশ করতেই তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তার বস্‌ টেবিলে রাখা ফ্রেমটির দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড চিৎকার করে পাগলের মতো হাসছেন। কোন দিকেই তার কোন খেয়াল নেই। ফয়সাল যে রুমে প্রবেশ করেছে সেটিও তিনি লক্ষ্য করেননি। তিনি হেসেই চলেছেন। তার চোখের কণার অশ্রু দিয়ে যেন এক-একটি কষ্ট বৃষ্টির পানির মতো ঝরে পড়ছে। ফয়সাল ভাষাজ্ঞানহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ফয়সাল বুঝতে পারল, এ হাসি সুখের নয়, এ হাসি প্রচণ্ড কষ্টের। কতটা কষ্ট পেলে একজন মানুষ এতটা চিৎকার করে হাসতে পারে তা ফয়সালের জানা নেই। মি. আমানের কষ্টগুলো যেন হাসির ফোয়ারা বেয়ে বেড়িয়ে আসতে লাগলো।

(বিঃদ্রঃ- পূর্বে  ই-পৃথিবী’র মার্চ'২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত ''Click Here'')

Level 0

আমি এন.সি.। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 46 টি টিউন ও 208 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

Level 0

এটাও ভাল হয়েছে।

[ আপনাকে একটা পরামর্ষ দিতে চাই যদি নেন; আপনার সাইটে আমি মাঝে মাঝে যাই। বলার অপেক্ষা রাখেনা, খুবই সুন্দর হয়েছে। চমৎকার একটা থিমও এড করেছেন। শুনতে ভালই লাগে। তবে আমার পরামর্ষ হল আপনার ঐটা হল টেকনোলজির ব্লগ। ঐ খানে ঐ থিমটা আমার কাছে একটু বেমানান মনেহয়। পাইরেটস অব দ্যা কেরাবিয়ান ছবিটার কথা মনে পড়ে যায়। তাই আপনি যদি Yanni, Kitaro, Kenny G, Armik, Chris Spheeris বা এই ধরনের আরো অনেক Musician এর কোন একটা বেছে নেন যেটা শুনতেও ভাল লাগবে এবং ব্লগের সাবজেক্টের সাথেও মানিয়ে যাবে তাহলে মনেহয় আরো ভালো হয় ]

    ধন্যবাদ… আপনার পরামর্শ বিশেষ বিবেচনায় থাকল।

অসাধারন লাগল। 😀

বেশ ভালো হয়েছে 🙂