জম্বি স্টার্টআপ Zombie Startup কী? জম্বি স্টার্টআপ কেন তৈরি হয়?

Level 34
সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা

আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন সবাই, আশা করছি ভাল আছেন। বরাবরের মত হাজির হলার নতুন একটি টিউন নিয়ে।

বিজনেস ওয়ার্ল্ডে অনেক কিছুই হয় যেগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকে জানি না। আজকে বিজনেস ওয়ার্ল্ডের একটা দারুণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি নতুন কিছু শিখতে ও জানতে পারবেন।

আমরা জানি কোন স্টার্টআপ যখন শুরু হয় তখন এর পরিণতি দুই রকম হতে পারে, হয় এটি সফল হবে অথবা ব্যর্থ হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এই স্টার্ট-আপ এর আরেকটা পরিণতি হতে পারে আর সেটা হচ্ছে জম্বি হয়ে যাওয়া৷ একটু অদ্ভুত শুনাতে পারে তবে এটা সত্যিই কিন্তু হয়। চলুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।

জম্বি স্টার্টআপ কী?

জম্বি স্টার্টআপও (Zombie Startup) এক ধরনের স্টার্টআপ যা সফলও হচ্ছে না বা ব্যর্থ হয়ে বন্ধও হয়ে যাচ্ছে না। এটি ব্যবসায়ের এমন এক অবস্থা যার গ্রোথ হচ্ছে না এক জায়গায় আটকে আছে। এই ধরনের স্টার্টআপ গুলো শুধু মাত্র ব্যবসায় পরিচালনার খরচ গুলো বহন করতে পারে। কর্মীদের বেতন, ইন্টারেস্ট, ও অন্যান্য খরচই কেবল স্টার্টআপ গুলো পরিশোধ করতে পারে।

উন্নত অর্থনীতিতে প্রায় ৩০% থেকে ৪০% কোম্পানি জম্বি হয়ে থাকে। ধরুন একটি কোম্পানি চালাতে প্রতিমাসে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয় এবং লোণ বাবদ পে করতে হয় ১ লাখ টাকা তারমানে সর্বমোট মাসিক খরচ ১৪০০০০ টাকা৷ কিন্তু কোম্পানি প্রতি মাসে ইনকামই করছে ১৪০০০০ টাকা। এটাই হচ্ছে জম্বি স্টার্টআপ। ব্যবসায় পরিচালনার খরচ মিটানো যাচ্ছে কিন্তু কোন গ্রোথ হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে সমস্যা যেটা হয় তা হল, যখন বিজনেসে লাভ আগের মত হয় না, খরচ বেড়ে যায় তখন সেটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

জম্বি স্টার্টআপ (Zombie Startup) গুলো এমন লস ফেস করলে তারা আবার লোণ নেয়, আবার সেই লোণ এবং আগের খরচ মিটাতে কাজ করে যায়। আর এভাবেই বিজনেস গুলো জম্বি হয়ে চলতে থাকে।

জম্বি স্টার্টআপ (Zombie Startup) কেন তৈরি হয়?

জম্বি স্টার্টআপ (Zombie Startup) গুলো তৈরি হবার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল। মার্কেটে যখন কোন নতুন স্টার্টআপ তৈরি করা হয় তখন বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ভাবে অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়। ফলাফল হিসেবে মার্কেট প্রোডাক্ট ফিট হবার আগে উদ্যোক্তারা বিশাল এমাউন্ট বিনিয়োগ পেয়ে বসে। আর এত বড় বিনিয়োগ পাওয়ার ফলে অধিকাংশ ফাউন্ডাররা অলস হয়ে যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি কোম্পানি যার নাম দিলাম RT, সেটা মোট পাঁচ কোটি টাকার ফান্ডিং পেয়েছে। এখন এই কোম্পানির মাসিক খরচ ধরলাম দশ লাখ এবং প্রতিমাসে এর লস হয় এক লাখ। খেয়াল করে দেখুন এই লসের পরেও তার চলার মত কত টাকা পড়ে থাকবে। কোন কিছু না করলেও এই কোম্পানি অনেক দিন চলতে পারবে।

স্টার্টআপ গুলো এভাবে হিউজ ফান্ডিং পেয়ে যায়, কোম্পানির মালিক CEO, Founder, ট্যাগ পেয়ে পায় এবং ধীরে কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হয়। তারা ভাবে, কোম্পানির মালিক হয়ে গেছি, সুন্দর মত ব্যবসায় রান হচ্ছে আর কি লাগে।

ফান্ডিং নেয়া খারাপ কিছু না তবে বুঝে শুনে ফান্ডিং নেয়া উচিৎ। আগে বুঝতে হবে আপনার প্রোডাক্টের মার্কেট কতটুকু, উদ্যোক্তারা কেমন পরিশ্রমী তা না হলে তৈরি হবে জম্বি স্টার্টআপ।

জম্বি স্টার্টআপ (Zombie Startup) এর একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে উদ্যোক্তারা বুঝতেই পারে না তাদের স্টার্টআপ জম্বি হয়ে গেছে। তারা ভাবে খরচ চলছে, বিজনেস রান হচ্ছে সমস্যা কোথায়। বিজনেসে গ্রোথ আসছে না এই খেয়াল তাদের সব সময় থাকে না। জম্বি স্টার্টআপ এর সমস্যা হচ্ছে একটি বিজনেসে স্টেইকহোল্ডার কেবল উদ্যোক্তাই নয়, কর্মী, বিনিয়োগকারী, ভোক্তাও কিন্তু এটি বিজনেসের স্টেইকহোল্ডার।

জম্বি স্টার্টআপ (Zombie Startup) এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিনিয়োগকারীরা, তাদের টাকা নির্দিষ্ট একটি কোম্পানিতে আটকে থাকে। এই টাকা তারা সঠিক জায়গায় ইনভেস্ট করারও সুযোগ ছিল যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারতো কিন্তু জম্বিতে ইনভেস্ট করাতে তা এক জায়গাতে আটকে যায়।

উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারীদের বড় বড় স্বপ্ন দেখায়, বিনিয়োগকারী ভাবে বড় বড় ভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট, ভাল বিজনেস মডেল তারা আসলেই ভাল কিছু করবে। কিন্তু তারা বিষয়টি গভীর ভাবে এনালাইসিস করে না খোঁজ খবর নেয় না।

কোন স্টার্টআপ জম্বি (Zombie Startup) হবার আরেকটা কারণ হচ্ছে উদ্যোক্তার বৈচিত্র‍্যতা অবলম্বন করে না। যেকোনো আইডিয়া নিয়ে বিজনেস শুরু করলেই সেটা সফল হবে এই গ্যারান্টি নেই তাই প্রয়োজনে আইডিয়া চেঞ্জ করতে হয়। বিজনেস শুরু করার পর এক ভাবে কাজ না করলে অন্য পথ অবলম্বন করতে হয়। এই কাজটা অনেক উদ্যোক্তারাই করতে চায় না ফলে তাদের বিজনেসের বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থেমে যায়।

এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে কেবল যে সব কোম্পানি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে বিনিয়োগ নেয় তারাই জম্বি হয় নাকি ব্যক্তিগত ভাবে ফান্ড কালেক্ট করা কোম্পানি গুলোও এই সমস্যা ফেস করে। উত্তর হল হ্যাঁ, তারাও জম্বি হতে পারে, বিভিন্ন দেশের বিজনেস লোণ পাওয়া যায়। তো মোটা অংকের লোণ নিয়ে যখন কেউ শুধু ইন্টারেস্ট পে করে যায় তারাও জম্বিতে পরিণত হতে পারে।

কীভাবে জম্বি স্টার্টআপ এড়ানো যায়

চলুন এবার জেনে নেয়া যাক কীভাবে আপনার স্টার্টআপ জম্বি হওয়া থেকে বাঁচাবেন। বিজনেসকে এই ধরনের সমস্যা থেকে বাচাতে সব সময় লীন মেথডোলজি ফলো করা উচিৎ। লীন মেথডোলজি সাজেস্ট করে, খরচ সব সময় কম রাখা উচিৎ। ধরুন আপনি একজন ইউটিউবার, আপনার মাসিক আয় ১০ লাখ টাকা এবং এর জন্য আপনি ৮ লাখ টাকা ফিক্সড এক্সপেন্স রেখেছেন। এটা আপনার জন্য রিস্কি হতে পারে, আপনার ফিক্সড এমাউন্ট কম রাখার চেষ্টা কর‍তে হবে। আপনি যদি ভিডিও এডিটিং করার জন্য কয়েকজন এডিটর রেখে দেন এবং প্রতিমাসে তাদের খরচ হয় পাঁচ লাখ তাহলে এটা আপনার জন্য ঝুঁকি। হটাৎ করে বিজনেস লস হলে বা আগের মত আয় না হলে তাদের বেতন দিতেই কষ্ট হয়ে যাবে। আর তাই আপনি লীন মডেল ফলো করে একজন ফিক্সড এডিটর রাখতে পারেন এবং প্রয়োজনে প্রজেক্ট ভিত্তিক হায়ার করতে পারেন৷

বিজনেসের ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে প্রতিমাসে যেন মিনিমাম ১০% গ্রোথ আসে। সব সময় প্রফিটের দিকে নজর না দিয়ে কাস্টমার কি চাচ্ছে আর পাচ্ছে সেদিকে নজর দিতে হবে। যদি ১০ % গ্রোথ না করে তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার স্টার্টআপ জম্বি হয়ে গেছে। জম্বি স্টার্টআপ (Zombie Startup) থেকে যেকোনো ব্যর্থ স্টার্টআপও ভাল। কোন স্টার্টআপ ব্যর্থ হলে সেখানে মানুষ গুলো আটকে থাকে না, বিনিয়োগ আটকে থাকে না, নতুন করে মেধা ও টাকা বিনিয়োগ করা যায় কিন্তু জম্বিতে এমনটি করা যায় না।

আর এমন জম্বি স্টার্টআপ (Zombie Startup) একটি দেশের স্টার্টআপ ইকো-সিস্টেমকে নষ্ট করে দিতে পারে। বিনিয়োগকারীরা এভাবে তাদের টাকা নষ্ট হতে দেখে পরবর্তীতে কোন স্টার্ট-আপে টাকা ঢালতে চাইবে না৷ কখনো কখনো জম্বি ইউনিকর্নও তৈরি হচ্ছে। আর যখন কোন ইউনিকর্ন জম্বি হয়ে যায় তখন উদ্ভাবন বন্ধ হয়ে যায়। একই অবস্থানে থাকার ফলে কোম্পানি গুলো নতুন কিছু নিয়ে আসে না আর এভাবে পুরো ইকোসিস্টেমে প্রভাব পড়ে।

জম্বি স্টার্টআপ না হওয়ার পদক্ষেপ

এই পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব, জম্বি যাতে আমাদের স্টার্টআপ না হয় যে জন্য কোন পদক্ষেপ গুলো নেবেন।

ভ্যালিডেশন

আপনার আইডিয়া যা আছে সেটা আগে যাচাই করে দেখুন মার্কেটে সেটার চাহিদা আছে কিনা। যেকোনো আইডিয়া মাথায় আসলেই সেটা নিয়ে মাঠে নেমে গেলে হবে না। যেমন ধরুন আপনি একটি প্রোডাক্ট নিয়ে ভাবছেন, সেক্ষেত্রে প্রথমে সম্ভাব্য কাস্টরমাদের কাছে যান। তাদের সাথে আলাপ করে দেখুন তারা আগ্রহী কিনা। দেখুন প্রি-অর্ডার করে কিনা। যখন আপনি আগ্রহ দেখবেন কয়েক লাখ টাকার প্রি-অর্ডার পাবেন তখন সেই পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করুন।

বিজনেস শুরু করার পর প্রয়োজনে দাম কামাতে বা বাড়াতে পারেন যদি প্রোডাক্ট কাস্টমার দাম বাড়ানোর পরেও গ্রহণ করে তাহলে সেটা রাখতে পারেন কিন্তু কমে গেলে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারেন।

উদ্ভাবন ও টিম বিল্ড করুন

প্রতিটি বিজনেসের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব সময় নতুন কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করুন, কাস্টমারকে নতুন কিছু দেয়ার চেষ্টা করুন।

বিজনেস স্ক্যাল করার সাথে সাথে এবং উদ্ভাবনের পাশাপাশি আপনার বিজনেসের জন্য একটি শক্তিশালী টিম বিল্ড করুন। টিম মানে একশো জনের টিম না, টিম দশ জনেরও হতে পারে তবে খেয়াল রাখুন যেন সবাই কাজের হয়। প্রতি মাসে, অথবা সপ্তাহে বিজনেসের সব কিছু মনিটর করুন। নতুন কাস্টমার তৈরি করার পাশাপাশি বিদ্যমান কাস্টমার গুলোও ধরে রাখার চেষ্টা করুন। প্রতি তিন মাস পর পর আপনার বিজনেস প্যারামিটার গুলো চেক করুন। পৃথিবীতে অনেক দ্রুত এগুচ্ছে, মানুষের রুচি, চাহিদা পরিবর্তন হচ্ছে তাই নির্দিষ্ট সময় আপনার প্যারামিটার গুলো চেক করা বুঝার চেষ্টা করুন আপনি যেমন চাচ্ছিনেল তেমন চলছে কিনা সব কিছু।

মেন্টরের সাহায্য নিন

ইন্ডাস্ট্রিতে যারা স্পেশালিস্ট তাদের সাহায্য নিন। তাদের পরামর্শ নিন। ফ্রি অথবা পেইড যেকোনো ভাবে মেন্টারের পরামর্শ আপনি নিতে পারেন। মেন্টাররা আপনার থেকে অবশ্যই বেশি এবং ভাল জানবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন বিজনেস কোর্সও করতে পারেন।

বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ হতে পারে, নির্দিষ্ট উদ্যোক্তাদের অন্ধ ভাবে বিশ্বাস না করে, তার ডিগ্রি না দেখে বিজনেস আইডিয়া দেখুন, খোঁজ খবর নিন তারপর ইনভেস্ট করুন।

কর্মীদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে, যেকোনো কোম্পানিতে যুক্ত হবার আগে খোঁজ নিন এই কোম্পানিতে বিনিয়োগকারী কারা। যদি সুনামধন্য বিনিয়োগ কারী বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল হয় তাহলে ঠিক আছে, কিন্তু সেটা না হলে খোঁজ নিন বিনিয়োগ কে করেছে বা টাকা কোথা থেকে এসেছে। যদি বলে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ, আত্মীয়স্বজন থেকে টাকা নিয়েছে তাহলে সেই কোম্পানি এড়িয়ে চলুন। কোম্পানির পুরনো কর্মীদের সাথেও আলাপ করতে পারেন কথা বলতে পারেন।

সরকারেরও এই ধরনের বিজনেসের জন্য করনীয় রয়েছে। এই ধরনের বিজনেস যেন তৈরি না হতে পারে এজন্য সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারে।

শেষ কথা

কোন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করার পর সেটা খরচ মিটিয়ে চলতে থাকলেই হবে না, সময় মত স্ক্যাল করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর এর গ্রোথ আসতে হবে। আর এমনটি না হলে বিশাল বিশাল বিনিয়োগ একটি নির্দিষ্ট জায়গা আটকে যাবে এবং সকল স্টেইকহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আশাকরি জম্বি স্টার্টআপ নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা আপনি এই টিউন থেকে পেয়েছেন। আপনার স্টার্টআপও যেন জম্বি না হয় সেজন্য পরামর্শ গুলো মেনে চলতে পারেন।

আশা করছি আজকের এই পর্বটি আপনাদের কাছে ভাল লেগেছে। মতামত থাকলে অবশ্যই জানান। পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।

Level 34

আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস