থোরিয়াম: ভবিষ্যতের জ্বালানি, বাংলাদেশের সম্ভাবনা এবং জরিপের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি সংকট একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎস খুঁজে বের করতে বিভিন্ন দেশ নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, থোরিয়াম একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই তেজস্ক্রিয় ধাতু ভবিষ্যতের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে পারে, এবং বাংলাদেশের মতো দেশেও এর উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে।
থোরিয়াম কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
থোরিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় ধাতু, যা প্রকৃতিতে মোনাজাইট নামক খনিজ পদার্থে পাওয়া যায়। এটি ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি নিরাপদ এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। থোরিয়াম-ভিত্তিক পারমাণবিক চুল্লী ইউরেনিয়াম-ভিত্তিক চুল্লীর তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ এবং কম তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি করে। থোরিয়াম-২৩২ নিউট্রন শোষণ করে ইউরেনিয়াম-২৩৩-এ পরিণত হয়, যা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের পরিমাণ ইউরেনিয়ামের তুলনায় ৯০% কম, এবং এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ঝুঁকি কমায়।
বিশ্বে থোরিয়ামের মজুদ প্রায় ৬.৩ মিলিয়ন টন, যা ইউরেনিয়ামের তুলনায় ৩-৪ গুণ বেশি। ভারত, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং নরওয়ে থোরিয়ামের বড় মজুদ রয়েছে। ভারত ইতিমধ্যে থোরিয়াম-ভিত্তিক পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য তিন-পর্যায়ের কর্মসূচি শুরু করেছে, এবং চীন ২০২১ সালে একটি থোরিয়াম-ভিত্তিক পরীক্ষামূলক চুল্লি চালু করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে থোরিয়ামের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে খনিজ বালুর উপস্থিতি রয়েছে, যেখানে মোনাজাইট-সহ অন্যান্য খনিজ পদার্থের সন্ধান পাওয়া যায়। মোনাজাইট হলো থোরিয়ামের প্রধান উৎস। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) এর প্রাথমিক জরিপে কক্সবাজার, পটুয়াখালী এবং ভোলার উপকূলীয় বালুতে মোনাজাইটের উপস্থিতি শনাক্ত করেছে। প্রতি টন বালুতে ০.০১% থেকে ০.০৫% মোনাজাইট থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা থোরিয়ামের উল্লেখযোগ্য মজুদের ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কর্মসূচির অধীনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে, যা ইউরেনিয়াম-ভিত্তিক। তবে ভবিষ্যতে থোরিয়াম-ভিত্তিক পারমাণবিক চুল্লী ব্যবহারের সম্ভাবনা বিবেচনা করা যেতে পারে। থোরিয়াম চুল্লিগুলি উচ্চ তাপমাত্রায় কাজ করে এবং তরল লবণ (Molten Salt Reactor) বা ফ্লুইডাইজড বেড রিঅ্যাক্টর (Fluidized Bed Reactor) প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা অধিক নিরাপদ এবং দক্ষ।
থোরিয়াম জরিপের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের থোরিয়ামের খনির সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিশদ জরিপ চালানো প্রয়োজন। এই জরিপের মাধ্যমে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নির্ধারণ করা সম্ভব:
১. উপকূলীয় অঞ্চলে মোনাজাইটের পরিমাণ এবং গুণগত মান: জিএসবি-এর মাধ্যমে ভূতাত্ত্বিক জরিপ এবং খনিজ বালুর নমুনা সংগ্রহ করে থোরিয়ামের পরিমাণ নির্ণয় করা যেতে পারে।
২. খনিজ উত্তোলনের প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা: থোরিয়াম উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করা।
৩. থোরিয়াম-ভিত্তিক পারমাণবিক চুল্লীর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি: বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএইসি) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সহযোগিতায় প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।
৪. থোরিয়াম উত্তোলন এবং ব্যবহারের পরিবেশগত প্রভাব: পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) পরিচালনা করে উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা।
জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
থোরিয়াম জরিপের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. ভূতাত্ত্বিক জরিপ: বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (জিএসবি) দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশদ ভূতাত্ত্বিক জরিপ চালাতে পারে। এই জরিপের মাধ্যমে মোনাজাইট-সহ অন্যান্য খনিজ পদার্থের উপস্থিতি এবং পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব।
২. খনিজ বিশ্লেষণ: উপকূলীয় অঞ্চল থেকে সংগৃহীত খনিজ বালুর নমুনা বিশ্লেষণ করে মোনাজাইটের পরিমাণ এবং গুণগত মান নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৩. অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ: থোরিয়াম উত্তোলন এবং ব্যবহারের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য একটি বিশদ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ পরিচালনা করা যেতে পারে।
৪. পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন: থোরিয়াম উত্তোলন এবং ব্যবহারের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য একটি বিশদ পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) পরিচালনা করা যেতে পারে।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: থোরিয়াম জরিপের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। IAEA, ভারতের BARC, বা নরওয়ের Thor Energy-এর সাথে অংশীদারিত্ব গঠন করা যেতে পারে।
থোরিয়াম জরিপের সুবিধা
থোরিয়াম জরিপের মাধ্যমে নিম্নলিখিত সুবিধাগুলো অর্জন করা সম্ভব:
১. দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি: থোরিয়ামের উল্লেখযোগ্য মজুদ থাকলে, দেশ তার নিজস্ব জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে পারবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারবে।
২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: থোরিয়াম উত্তোলন এবং ব্যবহার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
৩. পরিবেশ সুরক্ষা: থোরিয়াম-ভিত্তিক পারমাণবিক চুল্লী জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় কম কার্বন নিঃসরণ করে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় সহায়তা করবে।
৪. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: থোরিয়াম জরিপ এবং ব্যবহার দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উপসংহার
থোরিয়াম ভবিষ্যতের জ্বালানি চাহিদা পূরণে একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে থোরিয়ামের উল্লেখযোগ্য মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য থোরিয়াম জরিপ চালানো অত্যন্ত জরুরি। সরকারের উচিত এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা। এছাড়াও, এই জরিপের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
থোরিয়ামের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে আমাদের আজই সঠিক পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এটি শুধু জ্বালানি নিরাপত্তাই নয়, বরং একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকেও একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে।
আমি হুসাইন বিল্লাহ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 মাস 2 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 8 টি টিউন ও 1 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।