বায়োমেট্রিক কী? বায়োমেট্রিক কীভাবে কাজ করে?

প্রকাশিত
জোসস করেছেন
Level 34
সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা

আসসালামু আলাইকুম টেকটিউনস কমিউনিটি, কেমন আছেন সবাই? আশা করছি ভাল আছেন। বরাবরেই মত আজকেও চলে এসেছি নতুন টিউন নিয়ে।

প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাচ্ছে আমরা তত আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছি, বিশ্বও ডিজিটাইলাইজড হচ্ছে। আর একই সাথে আমাদের সেনসিটিভ ইনফরমেশন প্রটেক্ট করাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সিকিউরিটি হিসেবে পাসওয়ার্ড খুব বেশি কাজে দিচ্ছে না, হ্যাকাররা সহজেই পাসওয়ার্ড ক্র‍্যাক করে ফেলছে।

সিকিউরিটি ব্রিচ, আইডেন্টেকটিউনস হ্যাক ইত্যাদি এড়াতে দরকার ইউনিক সিকিউরিটি মেথড আর বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি সিস্টেম এই মেথড গুলোর মধ্যে অন্যতম। আজকের এই টিউনে আমরা আলোচনা করব বায়োমেট্রিক কী এবং কীভাবে এটিকে ভবিষ্যৎ সিকিউরিটি মেথড হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

বায়োমেট্রিক কী?

Biometric শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দ, Bio এবং Metric শব্দ থেকে এসেছে। Bio অর্থ জীবন এবং Metric শব্দের অর্থ পরিমাপ। সুতরাং বলা যায় প্রতিটি ব্যক্তির জৈবিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শনাক্ত করার পদ্ধতি এটি। হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে শুরু করে পায়ের ছাপ পর্যন্ত, দুইজন মানুষের মধ্যে কখনো মিল পাওয়া যাবে না, এমনকি যমজ হলেও না।

আর এই স্বতন্ত্রতার জন্য বায়োলজিক্যাল ক্যারেক্টার দিয়ে মানুষকে আইডেন্টিফাই করা এবং সিকিউরিটি মেথড হিসেবে এগুলো ব্যবহার করা পাসওয়ার্ড, পিন থেকেও বিশ্বাসযোগ্য। তাছাড়া বায়োমেট্রিক মেথড দ্রুত এবং সহজবোধ্য। পিন বা পাসওয়ার্ডের মত এখানে ভুলে যাবার কোন সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা এই ধরনের সিকিউরিটি হ্যাক করা প্রায় অসম্ভব।

বায়োমেট্রিক কীভাবে কাজ করে

বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশনে সিকিউরিটি স্ট্র‍্যাকচারটি কাজ করে তুলনার ভিত্তিতে। বায়োমেট্রিক সিস্টেম নির্দিষ্ট ক্যারেক্টার স্টোর করে রাখে যা সময়ের সাথে সাথ কন্সটেন্ট থাকে। যেমন ফিঙ্গার প্রিন্ট, ভয়েস, রেটিনা প্যাটার্ন, ফেসিয়াল রিকগনিশন, ইত্যাদি ডাটাবেইসে সেভ থাকে। যখন লক খুলার জন্য নির্দিষ্ট ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়া হয় তখন, সিস্টেম ডাটাবেসে থাকা ডেটা গুলোর সাথে মিলিয়ে দেখে। যদি মিলে যায় তাহলে এক্সেস পারমিশন দিয়ে দেয়া হয়।

সকল বায়োমেট্রিক সিস্টেম তিনটি ব্যাসিক কম্পোনেন্ট এর সমন্বয়ে গঠিত,

  • একটি সেন্সর বা রিডার যা ডেটা রেকর্ড করে এবং আইডেন্টিফিকেশনের জন্য বায়োমেট্রিক ফ্যাক্টর স্ক্যান করে।
  • একটি প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার যা রেকর্ড বা স্ক্যান ডেটা গুলো ডিজিটাল ফরমেটে কনভার্ট করে এবং নতুন ডেটার সাথে কম্পেয়ার করে।
  • একটি ডাটাবেস যা সকল বায়োমেট্রিক ডেটা স্টোর করে রাখে।

বায়োমেট্রিক এর ইতিহাস

বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মানুষকে আইডেন্টিফাই করা বেবিলিয়ান সভ্যতায় পাওয়া যায়। গবেষণা করে পাওয়া গেছে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বে ব্যবসায়িক লেনদেনে মাটির ট্যাবলেটে পায়ের আঙুলের ছাপ ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়াও, চতুর্দশ শতাব্দীতে চীনা বণিকরা শিশুদের হাতের তালু এবং পায়ের ছাপ দেখে তাদের শনাক্ত করতো। একই ভাবে মিশরের বনিকরাও শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নিজেদের আলাদা করতো।

প্রথম বারের মত বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন ডেভেলপ করে ১৮০০ শতকে ফ্রান্সের Alphonse Bertillon নামের এক পুলিশ অফিসার। Bertillon ক্রিমিনালদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটি আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ডেভেলপ করে। যদিও সেই সিস্টেম তখন পুরোপুরি বিশুদ্ধ ছিল না তারপরেও নাম আর ছবি দিয়ে আইডেন্টিফাই এর চেয়ে কার্যকর ছিল। আর তখন থেকেই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আইডেন্টিফাই গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে।

মডার্ন সাইন্স ব্যবহার করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা, আলাদা করা এবং তুলনা করা শুরু হয় ১৮৮০ সালের দিকে যখন Dr. Henry Faulds, নামের ব্রিটিশ চিকিৎসক, একটি রিসার্চ প্রকাশ করে এবং জানান ফিঙ্গারপ্রিন্টকে পারসোনাল আইডেন্টিফিকেশন মেথড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। Dr. Faulds একই সাথে কালি ব্যবহার করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

Sir Francis Galton নামের একজন নৃবিজ্ঞানী Dr. Faulds এর এই আবিষ্কারকে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন, তিনি ফিঙ্গারপ্রিন্টে loop, whorl, এবং arch নামে তিনটি প্যাটার্ন খুঁজে পাবার কথা জানান। এর পর ১৯০০ সালে তার বন্ধু Edward Richard Henry একটি ফিঙ্গার প্রিন্ট ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম ডেভেলপ করে এখনো ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিভিন্ন ধরনের বায়োমেট্রিক্স রয়েছে এবং অবস্থা বুঝে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হয়। চলুন কয়েক ধরনের বায়োমেট্রিক দেখে নেয়া যাক,

বিভিন্ন ধরনের বায়োমেট্রিক্স

বায়োমেট্রিক্স গুলো প্রধানত দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়,

১. ফিজিক্যাল বায়োমেট্রিক্স

নাম শুনেই বুঝা যাচ্ছে এ গুলো শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছে যেমন, হাতের তালুর ছাপ, আঙ্গুলের ছাপ, শিরার খাঁজ, আইরিশ, রেটিনা, রক্তনালীর প্যাটার্ন, এবং ভয়েস প্রিন্ট। এই বৈশিষ্ট্য গুলো স্ক্যানার দ্বারা কালেক্ট করা যায় এবং আইডেন্টিফিকেশনে ব্যবহৃত হয়।

২. আচরণগত বায়োমেট্রিক্স

প্রতিটি ব্যক্তির ইউনিক আচরণ প্যাটার্ন এবং অভ্যাস এনালাইসিস করে এটা পরিমাপ করা হয়। এই বায়োমেট্রিক্স সিস্টেমে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে আইডেন্টিফাই করতে, টাইপিং স্পীড, চলাফেরা এবং হাতের লেখাকে ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট বিষয়ে এক্সেস দিতে সেন্সর ব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়।

সিকিউরিটি হিসেবে বায়োমেট্রিক্স গুরুত্বপূর্ণ কেন?

2019 Verizon Data Breach Investigations রিপোর্ট মতে, ৮১ % ডেটা ব্রিচের মত ঘটনার জন্য পাসওয়ার্ড দায়ী। সিকিউরিটি হিসেবে বায়োমেট্রিক্স প্রযুক্তি ব্যবহারে হ্যাকিং এবং সিকিউরিটি রিস্কের পরিমাণ অনেকাংশে কমে আসে। এক্সেস পাবার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই প্রয়োজন হয় বলে এখানে হ্যাকিং এর মত ঘটনা ঘটতে পারে না।

ডিজিটাল আইডেন্টেকটিউনস সিকিউরিটি হিসেবে বায়োমেট্রিক্স খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ,

  • বায়োমেট্রিক্স অথেনটিকেশন ইউনিক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে হয় যা, যে কারো পক্ষে কপি করা কঠিন।
  • পাসওয়ার্ড বা পিন সহজেই কপি হয়ে যেতে পারে অথবা শেয়ার হয়ে যেতে পারে কিন্তু কোন ব্যক্তির বায়োমেট্রিক্স কপি হওয়া সম্ভব নয়। তবে সিকিউর থাকতে সব সময় আপটু ডেট থাকতে হবে
  • বায়োমেট্রিক্স সম্পূর্ণ ফ্রডমুক্ত কারণ হ্যাকাররা বায়োমেট্রিক্স ডেটা চুরি করে ফেললেও সিস্টেমে এক্সেস নিতে পারবে না যদি সেখানে পালস বা দেহের তাপ চেক করা হয়।
  • বায়োমেট্রিক্স এর মাধ্যমে কোন ব্যক্তি চাইলেও মাল্টিপল আইডেন্টেকটিউনস তৈরি করতে পারবে না কারণ সিস্টেমে ইতিমধ্যে একটা বায়োমেট্রিক্স ডেটা থেকে যাবে।
  • বায়োমেট্রিক্স দ্রুত এবং নির্ভেজাল। এক্সেসে দ্রুত অভিজ্ঞতা দিতেই বায়োমেট্রিক্স এর উৎপত্তি। পাসওয়ার্ড দেয়া, ভুলে যাওয়া, মনে করা এমন ঝামেলা নেই। ডেটা ম্যাচ করলেই সিস্টেমে এক্সেস নিয়ে নেয়া যায়।

কেন বিজনেসে বায়োমেট্রিক্স গুরুত্বপূর্ণ

যেসব বিজনেস সেনসিটিভ ডাটা নিয়ে কাজ করে, সে সকল বিজনেস সিকিউরিটি হিসেবে বায়োমেট্রিক্স এড করে দারুণ কিছু সুবিধা পেতে পারে যেমন,

দ্রুত প্রসেস - বায়োমেট্রিক্স এর মাধ্যমে ইউজারদের এনরুলমেন্ট এবং ভেরিফিকেশন স্বল্প সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যাবে। এছাড়াও এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রবেশ অধিকারও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

কষ্ট ইফেক্টিভনেস - বিজনেসে বায়োমেট্রিক্স ডিভাইস ইন্সটল করা এবং সিকিউরিটি এক্সেস হিসেবে ব্যবহার করা লংটার্মে প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক হতে পারে। আসছে দিন গুলোতে সব জায়গায় বায়োমেট্রিক্স সিকিউরিটি ব্যবহৃত হবে তাই আগে থেকে বায়োমেট্রিক্স ব্যবস্থা রাখার ফলে প্রতিষ্ঠানের বাড়তি খরচ এড়ানো সম্ভব হবে। তাছাড়া বায়োমেট্রিক্স সিকিউরিটি বেশ সাশ্রয়ী সিকিউরিটি ব্যবস্থা কারণ সব জায়গায় ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সর এবং অন্যান্য সেন্সর গুলো এভেইলেবল। এমনকি এই সকল ডিভাইসের তেমন স্টোরেজও দরকার হয় না।

চুরি প্রতিরোধ - সকল লেনদেন এ বায়োমেট্রিক্স সিকিউরিটি আপনার অর্থ চুরি প্রতিরোধ করতে পারে। বিজনেসের ক্ষেত্রে কাস্টমার এবং কর্মীদের এন্ট্রি এক্সেসে বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে সেনসিটিভ তথ্য পরিবর্তনে বায়োমেট্রিক্স সিকিউরিটি দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া শপলিফিটিং এর মত চুরি এড়াতে বায়োমেট্রিক্স কাজ করতে পারে।

সহজে রেকর্ড রাখা - বায়োমেট্রিক্স এর মাধ্যমে সহজে কোন ঝামেলা ছাড়াই কর্মী বা কাস্টমারদের রেকর্ড রাখা যায়। কর্মীদের প্রতিদিনের এটেনডেন্স রাখাতে বেশ কাজে আসে বায়োমেট্রিক্স

বায়োমেট্রিক্স এর ভবিষ্যৎ

বর্তমানে বিভিন্ন কাজে বায়োমেট্রিক্স ব্যবহৃত হলেও আশা করা যায় ভবিষ্যতে আরও এডভান্সড কাজে বায়োমেট্রিক্স ব্যবহৃত হবে। চলুন বায়োমেট্রিক্স এর সম্ভাব্য কিছু ব্যবহার দেখে নেয়া যাক,

মাল্টিমডাল বায়োমেট্রিক্স অথেনটিকেশন - হতে পারে ভবিষ্যতে কয়েকটা বায়োমেট্রিক্স একটা সিস্টেমে এক সাথে ব্যবহৃত হবে।

বায়োমেট্রিক্স পেমেন্ট সিস্টেম - বর্তমানে Amazon এর মত কোম্পানি গুলো তালুর নকশার মাধ্যমে দোকানে চেকিং আউট করার সুযোগ দিচ্ছে। আশা করা যায় আসছে দিন গুলোতে অন্য কোম্পানিও এটা গ্রহণ করবে এবং ওয়েটিং টাইম কমে আসবে।

ভয়েস রিকুইজিশন - ভয়েস কমান্ড বর্তমানে একটি ট্রেন্ডিং প্রযুক্তি। এখন অধিকাংশ ডিভাইসে ভয়েস কমান্ড দিয়ে কাজ করানো যায়। এখন গাড়ি টিভি আমরা ভয়েসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। বলাই যায় ভবিষ্যতে বায়োমেট্রিক্স IoT ডিভাইসের অন্যতম উপাদান হয়ে উঠতে পারে।

শেষ কথা

বায়োমেট্রিক্স সিকিউরিটি সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন কোম্পানি এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আসছে সময় গুলোতে বিভিন্ন ফ্রড, হ্যাকিং, চুরি টেকাতে দারুণ ভূমিকা পালন কর‍তে পারে এই বায়োমেট্রিক্স প্রযুক্তি। যদিও এখনো বায়োমেট্রিক্স সিকিউরিটিতে ১০০% নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না তবে আস্তে আস্তে এটার উন্নতি আমরা আশা করতেই পারি।

তো আজকে এই পর্যন্তই পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন আল্লাহ হাফেজ।

Level 34

আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস