বিদায় ভয়েজার!
আসলে সত্যিকার বিদায় ঘটবে হয়তো ২০৩০ সালে। কিন্তু এখনই বিদায় ঘন্টা বাজছে, একে একে কাজের বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে আরো আট বছর ঐটুকু বিদ্যুৎ বাঁচিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগযোগটুকু রাখতে পারে। তারপরও ভয়েজার ছুটবে কোটি কোটি বছরের সুদূর ভবিষ্যত ও মহাবিশ্বের দূর প্রান্তে, কিন্তু আমরা জানতে পারবোনা। সেই কবে ১৯৭৭ সালে ১৫ দিনের ব্যবধানে পর পর দুই ''অভিযাত্রী'' মহাশূন্যযান ভয়েজার- ১ এবং ভয়েজার-২ যাত্রা করেছিল স্পষ্ট মনে আছে নিজেদের দারুণ পুলকিত হবার কথা। ১৯৭৭ বছরটি বেছে নেবার একটি কারণ ছিল, ওই সময়টায় বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, ও নেপচুন এই চারটি দূর গ্রহ এমন একটি মালার আকৃতিতে সাজানো ছিল যার ফলে ভয়েজার এর একটি গ্রহের টানে তার দিকে গতি পেয়েছে, তারপর পরেরটির টানে সেটির দিকে - এমনিভাবে কাজটি অনেক সহজ হয়েছে। কারণ উদ্দেশ্যই ছিল এই দূর গ্রহ ও সেগুলোর উপগ্রহগুলোর একেবারে কাছে দিয়ে গিয়ে তাদের খুঁটিনাটি দেখা ও জানা ; এতদিন পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপ দিয়ে সামান্যই জানা গেছে। এই মালার পজিশনে আবার আসতো ১৭৫ বছর পরে, কাজেই সুযোগ হাতছাড়া করার উপায় ছিলোনা। ভয়েজার-১ বৃহস্পতি ও শনির এবং ভয়েজার-২ ইউরেনাস ও নেপচুনের জন্য একাজ খুব চমৎকার ভাবে সম্পন্ন করেছে। যেমন বৃহস্পতির জটিল মেঘের ঝড়ো হওয়া, তার উপগ্রহ ইও'র আগ্নেয়গিরি, ইউরেনাসের প্রবল চৌম্বক ক্ষেত্র এসবের খুব কাছে গিয়ে মাপজোক না করলে, ছবি ও তথ্য না পাঠালে আমরা কীভাবে জানতাম? ভয়েজার দুটি এখন সৌর জগতের সীমা ছড়িয়ে গেছে সূর্যের বিকিরণের চাপের প্রভাবহীন জায়গার তত্ত্ব তল্লাশি চালাচ্ছে যেখানে কাছের অন্য তারার প্রভাব শুরু -আমাদের থেকে ২০ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বের কোঠায় আছে। ওদেরকে বিদায় দিতে হবে যে কারণে সেই বিদ্যুৎ উৎসটি হলো প্লুটোনিয়ামের তেজষ্ক্রিয় অবক্ষয়ে সৃষ্ট উত্তাপ। বছরে একটু একটু করে তারপরিমাণ কমে এসেছে। এখন তাই মাপজোকের অধিকাংশ যন্ত্রের সুইচ অফ করে দেয়া হচ্ছে, যাতে অন্তত তার খবর পাঠাবার ট্রান্সমিটারটি আরো কটা বছর চালু রাখা যায়। তারপর আমরা তাকে হারাবো। তবে আরো একটি কারণে ৭৭ সালে আমরা পুলকিত হয়েছিলাম- ভয়েজারের প্রত্যেকটিতে একটি সোনার গ্ৰামোফোন রেকর্ডের জন্য। সোনা মানে মূল তামার রেকর্ডের ওপর এলুমিনিয়ামের নিরাপত্তা আচ্ছাদন, তার ওপর গোল্ড প্লেটিং ; সব কিছু এলুমিনিয়ামের একটি কভারের ভেতর- অসম্ভব রকমের টেকসই। ওতে সমসময়িক দুনিয়ার ও নানা মানব সমাজের অনেক শব্দ, সুর, ছবি রেকর্ড করা ছিল। এর দুটি উদ্দেশ্য ছিল। বহু হাজার বছর পরের মানুষ তাদের মহাশূন্যে ঘোরাফেরার সময় যদি কোথাও ভয়েজারকে খুঁজে পায় তাহলে ওরা ১৯৭৭ সালের একটি টাইম ক্যাপসুল পেয়ে যাবে সেদিনের অন্তরঙ্গ পরিচয় নিয়ে, পৃথিবীতে যার এতো ভালো সংরক্ষণ অসম্ভব হতো। অন্য উদ্দেশ্য হলো বুদ্ধিমান কোনো এলিয়েনের হাতে পড়লে তারা পৃথিবী ও মানুষের কথা জানতে পারবে। গ্রামোফোন রেকর্ডে দেয়ার কারণ একেবারে মৌলিক প্রযুক্তি হওয়াতে হয়তো যে কোনো এলিয়েনের পক্ষে ওসব শব্দ ছবি পুনরুদ্ধার করা সহজ হবে। সঙ্গে স্টাইলাস-পিন দেয়া আছে, কভারের ওপর ছবি এঁকে দেখানো হয়েছে রেকর্ডের ওপর স্টাইলাস কোথায় বসাতে হবে। ছবিগুলোও পাওয়া যাবে ওই শব্দ সিগন্যাল থেকেই। ৭৭ সালের এনালগ টেলিভিশনে ৫১২টি লাইনে স্ক্রিনে যেমন একটি পুরো ছবি তৈরী হয় তাও কভারে সরল ডায়াগ্রামে বোঝানো আছে। প্রত্যেক লাইনের ঘনত্ব ওজায়গায় শব্দের ওঠানামা তরঙ্গ-রেখা থেকে পাওয়া যাবে, যা অনুসরণ করলে যেকোনো প্রযুক্তিতে এমনকি হাতে এঁকে এঁকে ছবিটি পুনরুদ্ধার সম্ভব। ১০০ টি ছবির মধ্যে প্রথমটি কভারে দিয়ে দেয়া আছে ঠিক হচ্ছে কিনা বোঝার জন্য। রেকর্ড একবার ঘোরার সময় এবং প্রত্যেকটি লাইনের স্থায়িত্ব সময় পর পর খাড়া ও শোয়ানো রেখা দিয়ে (১ আর ০ এর বদলে) বাইনারি সংখ্যায় লেখা আছে। তাতে সময়ের একক হিসেবে যে হাইড্রোজেন এটমের শক্তি মাত্রা পরিবর্তনের সময় ব্যবহার করা হয়েছে তা বোঝাতে হাইড্রোজেন এটমের ডায়াগ্রাম দেয়া আছে। বুদ্ধিমান এলিয়েনের এসব মৌলিক বিজ্ঞান জানা থাকার কথা। পৃথিবীর ঠিকানাটাও কভারে জ্যোতির্বিদ্যার সরল ডায়াগ্রামে দেয়া আছে। ৭৭ সালে বিজ্ঞানীরা তখন না বলতে পারলেও এখন বলছেন রেকর্ড অন্তত পাঁচ বিলিয়ন বছর পাঠযোগ্য থাকবে, তত দিনে যদিও মানুষ বিলুপ্ত হবে, সূর্যও তখন মৃত্যুর কাছে। অবশ্য তার অনেক আগেই কোনো এলিয়েন এটি খুঁজে পাবে, আমাদের কথা জানবে খোঁজ খবর করবে, এটিই আশা। তবে এর মধ্যে শিগগির একদিন আমরা পৃথিবীর বাইরেও বসত করবো -ভয়েজার দেখিয়েছে সেটি বৃহস্পতি বা শনির কোনো কোনো উপগ্রহেও হতে পারে।
আমি অপুর্ব আহমেদ। , Matlab, chandpur। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 18 টি টিউন ও 8 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।