স্বপ্ন দেখাচ্ছে ন্যানো প্রযুক্তি – ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের মুখে যে ‘ন্যানো’ শোনা যায়, সেটার মানে হলো ‘ন্যানোটেকনোলজি’ বা সংক্ষেপে ‘ন্যানোটেক’। বাংলায় বললে অতিক্ষুদ্রের যে প্রযুক্তিই তা-ই ন্যানোপ্রযুক্তি। ‘ন্যানো’ আসলে ‘ন্যানোমিটার’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ন্যানোমিটার হলো এক মিটার দৈর্ঘেøর ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ বা এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। সংখ্যার ভাষায় এক ন্যানোমিটার = ১০-৯ মিটার। ১০টি হাইড্রোজেন পরমাণু পর পর রাখলে সেটা এক ন্যানোমিটার দৈর্ঘেøর সমান হয়। বোঝাই যাচ্ছে, এই দৈর্ঘø এতই ক্ষুদ্র যে তা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়।
ন্যানোর জগৎ হলো এমন এক অতিক্ষুদ্রের জগৎ, যা থেকে ক্ষুদ্রতর কোনো কাঠামো তৈরি সম্ভব নয়। ন্যানো জগতে অণু-পরমাণু তাদের নিজস্বতা প্রদর্শন করতে পারে। অন্যদিকে অনেক অণু-পরমাণু একসঙ্গে মিলিত হয়ে নিজস্বতা হারিয়ে যখন একটা দলগত বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, তখন সেটাকে বলে ‘ম্যাক্রোওয়ার্ল্ড’।

ন্যানোটেকনোলজি সেই প্রযুক্তি, যেখানে এমন সব পদার্থ বা সিস্টেম আছে, যাদের দৈর্ঘø-প্রস্থ-বেধের অন্তত একটি মাত্রার দৈর্ঘø এক থেকে ১০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে-এমন পদ্ধতির সাহায্যে এদের ডিজাইন করা হয়, যা আণবিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সাধিত এবং এসব অংশবিশেষ আপনা থেকে বা বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে ম্যাক্রোস্কেলের কাঠামো তৈরি করতে পারে। ন্যানোপ্রযুক্তি তখনই একটা বিকশিত প্রযুক্তি হবে, যখন আণবিক স্কেলে কার্যকর ভৌত বা রাসায়নিক নিয়মগুলোর যথাযথ প্রয়োগ এবং এদের নিয়ন্ত্রণের একটা পদ্ধতিবদ্ধ রূপ দাঁড় করানো সম্ভব হবে। আশা করা যায়, এ প্রযুক্তি আয়ত্তে এলে আণবিক স্কেলে পদার্থের আশ্চর্য সব গুণাগুণ ব্যবহার করা সম্ভব হবে। মানুষের তৈরি উপকরণের বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক, আলোকীয় (অপটিক্যাল), রাসায়নিক ধর্ম অনেক উন্নত হবে। ন্যানোপ্রযুক্তির এই অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের আশাতেই আমেরিকায় ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ (এনএনআই) নামে আন্তবিভাগীয় প্রকল্পটি চালু হয়েছে। ২০০৯ সালে এর বাজেট হয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলার।

মজার বিষয়, ন্যানোপ্রযুক্তি তেমন কোনো নতুন বিষয় নয়। ব্যাপারটা দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে আপনা থেকেই ঘটছে, যেদিকে মানুষ কেবল সেদিন নজর দিতে শুরু করেছে। যে প্রযুক্তির কথা বলছি সেটা হলো, আমাদের অতিপরিচিত বায়োলজি বা জীববিজ্ঞান। বহু কোটি বছর ধরেই পৃথিবীতে অণুজীবেরা (মাইক্রোব) ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। অতিক্ষুদ্র ন্যানো আকৃতির বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আছে, যাদের সাঁতার কাটার জন্য প্রয়োজনীয় প্রপেলারও প্রকৃতি তাদের দিয়েছে। জীবনের উপাদান বিভিন্ন প্রোটিন সংশ্লেষণে, ডিএনএ ব্যবহারে, অণুজীবদের জীবনে অহরহ এই ন্যানো জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। বহু কোটি বছর ধরেই এটা চলছে। এমনকি পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পরও মানুষের নাকের ডগায় প্রকৃতি ন্যানোটেক করছে। মানুষ সেটা টের পেল এই মাত্র কয়েক বছর হলো। বর্তমান শতকে এসে মানুষ বুঝতে শিখল, প্রকৃতি যা কোটি বছর ধরে করে আসছে, সেটা কৃত্রিমভাবেও করা যায়।

বর্তমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার একটি আকর্ষণীয় বিষয় এই ন্যানোটেক। বিষয়ের দিক দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন শাখা, পদার্থবিজ্ঞান (কনডেন্সড্‌ ম্যাটার), আণবিক জীববিজ্ঞান (মলিকুলার বায়োলজি) ও রসায়নের একটা বিরাট অংশ নিয়ে আজকালকার ন্যানোটেক গবেষণা পরিচালিত হয়।

ন্যানোপ্রযুক্তির কয়েকটি আবিষ্কারের বাস্তব প্রয়োগ হয়েছে। যেমন, চৌম্বক পদার্থের মাঝখানে বেশ কয়েকটি অচৌম্বক পদার্থের স্তর (যাদের একটি স্তরের দৈর্ঘø এক ন্যানোমিটারেরও কম) স্যান্ডউইচ করে এমন একধরনের ডিস্ক-ড্রাইভ তৈরি করা হয়েছে, যার সংবেদনশীলতা পূর্ববর্তী ড্রাইভগুলোর থেকে অনেক বেশি। এতে তথ্যসঞ্চয়ের ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে গেছে।

ন্যানোটেক ব্যবহার করে নানাবিধ উপযোগী ন্যানোকাঠামো নির্মাণ সম্ভব। এর নাম ন্যানোফ্যাব্রিকেশন বা ন্যানোনির্মাণ। মাইক্রোচিপ তৈরিতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাকে বলে মাইক্রোচিপ ফ্যাব্রিকেশন। এ পদ্ধতিই ন্যানোস্কেলে প্রয়োগের নাম ন্যানোনির্মাণ। ন্যানোনির্মাণের দুই উপায়ঃ টপ ডাউন ও বটম আপ। ‘টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ’ হলো বড় জিনিস দিয়ে শুরু করে কেটেছেঁটে ইচ্ছামতো ডিজাইন সৃষ্টি করা। যেমন, ছুতোর একটা কাঠের তক্তা কেটেছেঁটে সুন্দর করে আসবাব বা অন্য কাঠের মনোহারী দ্রব্য তৈরি করে। ‘বটম আপ অ্যাপ্রোচ’ হলো নিচে থেকে ওপরে গঠন। যেমন, রাজমিস্ত্রি ইটের পর ইট গেঁথে ইমারত নির্মাণ করে। অর্থাৎ ছোট ছোট যন্ত্রাংশ জুড়ে একটা বড় কাঠামো নির্মাণ। এভাবে অনেক অণুর শৃঙ্খলাবদ্ধ সম্মেলনে গড়ে ওঠে একটি মাইক্রো-কাঠামো। কাঠামো মাইক্রো স্কেলে হলেও তার গঠনোপাদান ন্যানোস্কেলের এবং পদ্ধতির রীতিনীতিও ন্যানো জগতের। এভাবে ‘সেল্ফ অ্যাসেম্বলি’ বা স্বসজ্জিত বা স্বসমাবেশ পদ্ধতির সাহায্যে ন্যানোনির্মাণ সম্ভব।
সিলিকন-পরবর্তী ন্যানোকম্পিউটারের ধরন নিয়ে জোর গবেষণা চলছে। বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ন্যানোইলেকট্রনিকস নিয়ে গবেষণা হচ্ছেঃ ন্যানোস্কেলে ডিভাইসের গুণাবলি কেমন হবে, এদের তাপ উৎপাদনের হার কেমন হবে ইত্যাদি। আইবিএম, হিউলেট-প্যাকার্ড, ইনটেলের মতো বড় বড় কোম্পানি আজকাল ন্যানোবিষয়ক সুবৃহৎ গবেষণায় প্রচুর টাকা ঢালছে। এর কারণ কম্পিউটার চিপে ইলেকট্রনিক সার্কিটের ক্রমহ্রাসমান দৈর্ঘø। সক্রিয় ডিভাইসের আকৃতি যত ক্ষুদ্র হবে, একটি চিপে তত বেশি ডিভাইস আঁটানো সম্ভব হবে। ফলে চিপের সাইজ কমবে, খরচ কমবে, গতি বাড়বে। কিন্তু একটা ট্রানজিস্টরকে কত ছোট করা সম্ভব? এর কি কোনো সীমা আছে? আছে। ট্রানজিস্টরের গেইট-লেংথ একটা পর্যায়ের নিচে ছোট করা সম্ভব নয়। কারণ প্রচলিত মাইক্রো-ফ্যাব্রিকেশন পদ্ধতি একটা নির্দিষ্ট সীমার নিচে স্পষ্ট ফিচার-সাইজ তৈরি করতে সক্ষম নয়। তা ছাড়া ডিভাইসের আকৃতি ন্যানোমিটারের স্কেলে থাকলে কোয়ান্টাম ক্রিয়া সক্রিয় হয় বলে ডিভাইসের কর্মকাণ্ড প্রচলিত রীতিমোতাবেক আর ব্যাখ্যা করা যায় না। ম্যাক্রোস্কেলে এসব কোয়ান্টাম প্রভাব দেখা যায় না। তার কারণ হলো যখন অসংখ্য অণুর সম্মেলনে একটা ম্যাক্রোজগৎ সৃষ্টি হয়, তখন কোয়ান্টাম ক্রিয়া অস্পষ্ট হয়ে যায়। তার জায়গায় দেখা যায় গতানুগতিক বৃহৎ বস্তুর আচরণবিধি, যেটা অনেক অণুর মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার একটা গড় ফল।

ন্যানোটেকের অমিত সম্ভাবনার কথা বলা হলেও তার সবই যে বাস্তবায়িত হবে এমন কোনো কথা নেই। কারণ, ব্যাপারটা এখনো ল্যাবরেটরিতেই সীমাবদ্ধ। তার পরও কিছু বাস্তব প্রয়োগ আছে, যেখানে ন্যানোটেক অত্যন্ত সফলভাবে বস্তুর গুণাগুণ প্রভাবিত করেছে।
ন্যানোটেককে পরিণত প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে এখনো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। মানবকল্যাণে ন্যানোটেকের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশের সরকার ও গবেষণা সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও গবেষকদের মিলিত প্রয়াসে মানুষের জন্য একটি সুন্দর
ভবিষ্যৎ রচনায় ন্যানোটেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আশা করা যায়।

Prothom Alo | 09-08-09

Level 0

আমি Amin Mehedi। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 16 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 39 টি টিউন ও 218 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস