“পৃথিবী মোটেও গোলাকার নয়, বরং থালার মত চ্যাপ্টা ও সমতল।”
“পৃথিবী স্থির, এটি সূর্যের চারিদিকে ঘোরে না, বরং সূর্যসহ মহাবিশ্বের সকল গ্রহনক্ষত্র পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে।”
“মানুষ মোটেও চাঁদে যায়নি, বরং মহাকাশচারীদের চাঁদে অবতরণ আমেরিকার মিথ্যা অপপ্রচার।”
বিজ্ঞানের এই চরম অগ্রগতির যুগেও দুনিয়াজুড়ে অনেক শিক্ষিত মানুষ ওপরের কথাগুলো বিশ্বাস করে। শুধু বিশ্বাস করে ভুল হবে, বরং ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে তাদের এসব বিশ্বাস সঠিক ‘প্রমাণ’ করে চলেছে বিভিন্ন বইপুস্তক ও ইন্টারনেটের পাতায় পাতায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব মানুষের সংখ্যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতেও কম নয়।
পৃথিবী গোল নয়, থালার মত সমতল
সমতল পৃথিবী তত্ত্বে (Flat Earth Theory) বিশ্বাসীরা মনে করে, পৃথিবীর আকৃতি চ্যাপ্টা থালা বা চাকতির মত। তাদের ধারণা অনুসারে থালা আকৃতির পৃথিবীর কেন্দ্রে রয়েছে উত্তর মেরু এবং এর পরিধি বা চারিদিক ঘিরে আছে এন্টার্কটিকা মহাদেশের ১৫০ ফুট উঁচু বরফের দেয়াল। তাদের দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখতে নিচের ছবিটির মতঃ
সমতল পৃথিবীর ধারণায় বিশ্বাসীদের ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি নামে (ইন্টারন্যাশনাল ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি বা ইন্টারন্যাশনাল ফ্ল্যাট আর্থ রিসার্চ সোসাইটি নামেও পরিচিত) একটি সংগঠন আছে। ১৯৫৬ সালে স্যামুয়েল শ্যানটন নামে এক ইংরেজ এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নাকি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটি ও রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির ফেলো ছিলেন! ২০০৪ সাল থেকে এই সংগঠনটি সমতল পৃথিবী তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রমাণ ও প্রচারের কাজ নতুন উদ্যমে শুরু করে। ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি’র অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের লিংক হচ্ছে http://www.theflatearthsociety.org এবং এই লিংকে গিয়েও সমতল পৃথিবী তত্ত্বের সপক্ষে এদের তথ্যপ্রমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। তারা মনে করে, পৃথিবী গোলাকার, এটি বৈজ্ঞানিকভাবেই ভুল!
অথচ গোলাকার পৃথিবী (Spherical Earth) একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য। কৃত্রিম উপগ্রহ, মহাকাশযান, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এবং এমনকি চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নভোচারীদের তোলা ছবি পৃথিবীর গোলাকৃতি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে।
পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে
কিশোর বয়সে মুহম্মদ নুরুল ইসলাম নামে জনৈক প্রকৌশলীর লেখা ‘পৃথিবী নয় সূর্য ঘোরে’ নামের একটি বই পড়েছিলাম। এই বইয়ে তিনি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাহায্যে এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, পৃথিবী স্থির, এটি সূর্যের চারিদিকে ঘোরে না, বরং সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে। তাঁর মতে, পৃথিবী যদি সত্যি সত্যি ঘুরত, তবে এর ওপরের মানুষজন, জীবজন্তু, ইত্যাদি ছিটকে বাইরে উড়ে যেত এবং গাছপালা, ঘরবাড়ি, ইত্যাদি ভেংগেচুরে ধ্বংস হয়ে যেত।
পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব তত্ত্বে (Geocentric Universe Theory) বিশ্বাসীরা মনে করে, পৃথিবী অনড় এবং মহাবিশ্বের সকল গ্রহনক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এর চারিদিকে ঘুরছে। ১৯৯৯ সালের এক জরিপ অনুসারে ১৮ শতাংশ আমেরিকান মনে করে, পৃথিবী নয়, বরং সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। একইভাবে ১৯৯৬ সালে পরিচালিত জরিপ অনুসারে ১৬ শতাংশ জার্মান এবং ১৯ শতাংশ ব্রিটিশও একই ধারণা পোষণ করে। এমনকি ২০০৫ সালে পরিচালিত আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন আমেরিকানের মধ্যে একজন বিশ্বাস করে, সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে। তাদের এই বিশ্বাস মূলত খ্রীস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল-ভিত্তিক।
তবে কেবল সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বরং বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর ‘পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে’–এই তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বিদ্বান মানুষও। এরকম একটি গোষ্ঠীর ওয়েবসাইট হচ্ছে Galileo Was Wrong এবং তারা নাকি আইনস্টাইন, হাবল ও হকিংয়ের মত বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছে, পৃথিবী ঘোরে না, সূর্য ঘোরে এবং এর ওপর তারা সাড়ে এগারশ পৃষ্ঠার একটি গবেষণাগ্রন্থও বের করেছে!
অথচ আধুনিক বিজ্ঞান বলে, পৃথিবী নিজ অক্ষের চারিদিকে বিষুবরেখা বরাবর ঘন্টায় প্রায় ১০৪০ মাইল এবং নিজ কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে ঘন্টায় প্রায় ৬৭,০০০ মাইল বেগে ঘুরছে। একইভাবে সূর্য তার গ্রহ-উপগ্রহগুলোকে নিয়ে ঘন্টায় প্রায় ৫,৬০,০০০ মাইল বেগে ছুটে চলেছে এবং প্রায় ২৫ কোটি বছরে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চারিদিকে একবার ঘুরে আসছে।
মানুষের চাঁদে যাওয়া আমেরিকার কারসাজি
চাঁদে অবতরণের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে (Moon Landing Conspiracy Theory) বিশ্বাসীরা মনে করে, এপোলো নভোযানের চাঁদে অভিযান মিথ্যা, সাজানো ঘটনা (Hoax) এবং নীল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিনসহ আমেরিকার কোন নভোচারীই চাঁদে যাননি। তাদের বিশ্বাস, আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চাঁদে অবতরণের যেসব ছবি ও ভিডিও প্রচার করেছে, তা মিথ্যা এবং এতে আসলে চাঁদে নামার কোন দৃশ্য নয়, বরং হলিউডের স্টুডিওতে অভিনয়ের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ১৯৭৪ সালে বিল কেসিং নামে একজন আমেরিকান লেখক তার ‘We Never Went to the Moon’ নামক বইতে প্রথম দাবি করেন, ছয়টি এপোলো অভিযানের সবগুলোই বানোয়াট।
এরপর এ নিয়ে বহু গবেষণাধর্মী বই বেরিয়েছে, তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে এবং ওয়েবসাইট দাঁড়িয়ে গেছে। তখনকার সময়ে মহাকাশভ্রমণের প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা, চন্দ্রপৃষ্ঠ ও মহাকাশের প্রতিকূল পরিবেশ এবং চন্দ্রাভিযানের ছবি ও ভিডিওতে বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতার আলোকে অনেকেই মনে করে, চাঁদে অভিযান নিতান্তই নাসার সাজানো ঘটনা। চাঁদে অবতরণের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তারিত জানতে উইকিপিডিয়ার এই নিবন্ধটি দেখা যেতে পারে। সাম্প্রতিককালে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার ২০ শতাংশ, রাশিয়ার ২৮ শতাংশ ও ব্রিটেনের ২৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, আমেরিকার নভোচারীরা চাঁদে যায় নি।
প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও শেষ পর্যন্ত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এসব অভিযোগের জবাব দিতে বাধ্য হয় এবং চন্দ্রাভিযানের সপক্ষে তথ্যপ্রমাণসহ নাসার অফিশিয়াল বক্তব্য তুলে ধরে তাদের ওয়েবসাইটে। এপোলো অভিযানের ছবিতে বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতার অভিযোগের জবাব পাওয়া যাবে উইকিপিডিয়ার এই নিবন্ধে। অন্যদিকে নাসা ছাড়াও আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে পরিচালিত স্বতন্ত্র গবেষণা ও পরীক্ষা-নীরিক্ষায় মানুষের চাঁদে অবতরণের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে, যার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে উইকিপিডিয়ার আরেকটি নিবন্ধে। তারপরও যারা বিশ্বাস করতে চায় না, তাদের বিশ্বাস করায় কার সাধ্য!
আমি নেটপোকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 13 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 79 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আমি নেটপোকা বলছি...
কোয়ালিটি টিউন। আপনাকে ধন্যবাদ। এই টিউন পড়ার পর মহাবিশ্বের গতি নিয়ে আমার মাথায় একটা কুশংষ্কারমূলক যুক্তি এল।
আচ্ছা, সকল গতি এবং স্থিতি আপেক্ষীক। সে হিসাবে পৃথিবীর চারিদিকে মহাবিশ্ব ঘুরা আর মহাবিশ্বের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরাতো একই কথা। আর আমাদের সাপেক্ষে চিন্তা করলেতো পৃথিবী স্থির মহাবিশ্ব ঘুরছে। তাই নয়কি? 😀