একটা সময় হ্যাজাক বাতির ব্যাপক চাহিদা ছিল। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, যাত্রা, সার্কাস, পালাগান, হাট-বাজার, মেলাতে এই বাতির ব্যবহার হতো। এই বাতির আলোর প্রখারতা ছিল তীব্র। বলা হয় ৪০০ ওয়াটের সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতির সমপরিমাণ আলো দিতে সক্ষম এই বাতি। গ্রাম বাংলায় বিদ্যুতের প্রসার ঘটার পর এই বাতির এখন তেমন ব্যবহার নেই বললেই চলে। এখনকার প্রজম্মের অনেকেই এই বাতির নাম শোনেনি বা চোখে দেখেনি। আন্তর্জাতিকভাবে পেট্রোম্যাক্স ল্যাম্প নামেই এটার ব্যাপক পরিচিতি। কেউ কেউ এটাকে প্যারাফিন প্রেসার লন্ঠন বলে।
জার্মানের Max Graetz ১৯১০ সালে পেট্রোম্যাক্স ল্যাম্প বা হ্যাজাক বাতি আবিষ্কার করেন। তিনি স্প্রিট বাতির ওপর ভিত্তি করে এই বাতির একটা ব্রান্ড নাম দেন যেটা পরবর্তীতে ব্যাপক পরিচিতি পায়। Max Graetz (১৮৫১ – ১৯৩৭) বার্লিনের Ehrich & Graetz ফার্মের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি হ্যাজাক বাতির উন্নয়ন এবং প্রাইমারি ডিজাইন করেন। তিনি প্যারাফিন বা কেরোসিন তেল দ্বারা সৃষ্টি একটা লাইটিং সিস্টেম চেয়েছিলেন যেটা ছিল একদম নতুন একটা পণ্য। Graetz একটা প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন যেটাতে প্যারফিন থেকে গ্যাস তৈরি করা যায় এবং যাতে খুব উচ্চ caloric মান রয়েছে এবং যা খুব গরম নীল শিখা তৈরি করতে পারে। এরপর তিনি একটা চাপ বাতির ডিজাইন করেন যা বাস্পিভূত প্যারাফিন এর সঙ্গে কাজ করে। ১৯১৬ সাল থেকে এই বাতির ব্যবহার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। Petromax নামটি " পেট্রোলিয়াম এবং “Max Graetz” থেকে এসেছে।
সিলবার অথবা পিতল দিয়ে তৈরী করা হয় হ্যাজাক বাতি। এটার ওজন ২ থেকে ২.৪ কেজির মতো। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় কেরোসিন তেল অথবা প্যারাফিন। বাতির নিচের দিকে আছে তেল ধারণ করার জন্য ট্যাংকার। একটা ট্যাংকারে সর্বোচ্চ সোয়া লিটার তেল ধরে। ওপরের দিকে আছে বার্নার, মেন্টেল হোল্ডার, ভ্যাপরাইজিং চেম্বার। ট্যাংকার থেকে একটা নল যুক্ত হয়েছে ভ্যাপরাইজিং চেম্বার এর সঙ্গে। বাতিটা জ্বালানোর আগে ট্যাংকারে জ্বালানি ভরাতে হয়। সেই সঙ্গে পাম্পিং করে বায়ুর চাপ বাড়াতে হয়। বাতিটা জ্বালানোর সময় প্রথম ধাপে ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে কিছু সময় ধরে বার্নার এবং ভ্যাপরাইজিং চেম্বার গরম করতে হয়। এরপর ট্যাংকার থেকে বায়ুর চাপসহ তেল নল দিয়ে ভ্যাপরাইজিং চেম্বারে পাঠান হয়। তখন উত্তপ্ত বার্নারের সংস্পর্শে এসে এক ধরনের গ্যাস তৈরি হয় যা মেন্টেল কে জ্বালাতে সাহায্য করে। এতে করে খুব উজ্জ্বল আলো পাওয়া যায়। একটা মেন্টেল একবারই ব্যবহার করা যায়। ট্যাংকারে ভরা তেল থাকলে একটানা ৮ ঘণ্টা বাতি জ্বলে। তবে মাঝে মাঝে পাম্প করে বায়ুর চাপ বাড়াতে হয়। একবার পাম্প করা হলে একটানা তিন ঘণ্টা চলে। তবে বায়ুর চাপ কমে এলে বাতির আলো ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। কাঁচ দিয়ে ঘেরাও করা একটা খাঁচা ব্যবহার করা হয় যাতে করে বাইরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে।
বলা যায় ৯০ দশক পর্যন্ত হ্যাজাক বাতির একটা জমজমাট ব্যবসা ছিল। ৫/৬ বছর হল এই ব্যবসাটা একদম পরে গেছে। এখন কিছু জেলে, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, ক্যানভাসার এরাই সীমিত আকারে হ্যাজাক বাতি ব্যবহার করেন।
এই ব্যাপারে আমি কথা বলেছি হ্যাজাক বাতির টেকনিশিয়ান জনৈক মাহফুজ এর সঙ্গে। ৪৫ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে উনি জড়িত আছেন। ওনার দোকান বগুড়া শহরের ঝাউতলা পুকুর পাড়। ১৩ বছর বয়স থেকেই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত তিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি ছোট বেলা থেকেই ওনাকে চিনি। এর কারণ আমার বাড়ির কাছেই তাঁর দোকান। একটা সময় প্রতিদিন ৬০/৭০ টা হ্যাজাক বাতি তাঁর দোকানে আসতো মেরামতের জন্য। এ ছাড়াও ভাড়া যেত প্রতিদিন ৩০/৪০ টা। এখন কেউ আর হ্যাজাক বাতি ভাড়া নেন না। কালেভাদ্রে কেউ কেউ মেরামতের জন্য আসেন। এই ব্যবসার ভাল কোন সম্ভাবনা নেই বলে তাঁর পরিবারের কেউ এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হননি। বয়সের ভারের কারণে তিনি এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন ব্যাবসায় যেতে পারছেন না।
এই ব্যবসা পরে যাবার মূল কারণ হল ব্যাপক এলাকায় এখন বিদ্যুতায়ন হয়েছে। আগের মত লোড সেডিং নেই। তা ছাড়া প্রযুক্তির অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। সোলার প্লান্ট বসিয়ে অনেক দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যাকআপ হিসেবে মানুষ এখন আইপিএস, জেনারেটর, চার্জার বাতি ব্যবহার করে।
একটা সময় এটা যে রাজকীয় বাতি ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এটাও এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো কিছুদিন পর এই বাতি দেখার জন্য আমাদেরকে জাদুঘরে যেতে হবে।
আমি আব্দুল্লাহ আল ফারুক। Digital Marketer, Self Employed, Bogura। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 34 টি টিউন ও 20 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 23 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আমি ছোটবেলায় গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে এ বাতির অনেক ব্যবহার দেখেছি। প্রায়ই ভাবতাম কিভাবে কাজ করে এ বাতি, এতো আলো কিভাবে দেয়। সে সময় প্রযুক্তি হাতে না থাকায় জানতে পারিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ এতদিন পর আপনার টিউন দেখে সেটা মনে পড়ে গেলো এবং সেই অভুক্ত তৃষ্ণাটা মেটালাম। ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে এ বিষয়টি নিয়ে টিউন করার জন্য।