“আপনি আবার এসেছেন!”
টেবিলের ওপর থরে থরে সাজান কাগজের স্তুপ থেকে অল্প মুখ তুলে চরম বিরক্তির সঙ্গে বললেন শুভম বাবু। বিখ্যাত “রহস্যময় বিজ্ঞান জগৎ” পত্রিকার একাধারে মালিক এবং একমাত্র সম্পাদক। গতমাসে এই পত্রিকার বিক্রি দশহাজার কপি পেরিয়েছে।
“হ্যাঁ স্যার, আবার এসেছি। এবারে আপনার পছন্দমতো লেখা কল্প বিজ্ঞানের গল্প। সাসপেন্স, ক্রাইম – থ্রিলার। চমকে যাবেন স্যার!” বিনিত কন্ঠে দেবাশ্যিস এর উত্তর।
দেবাশ্যিস ওনার আসল নাম নয়। আসল নাম ডক্টর দেবাশ্যিস মন্ডল। নামজাদা এক জাতীয় গবেষণাগারের বিজ্ঞানী। পেশাদার বিজ্ঞানী – সখের লেখক। ওনার ধারণা ওনার নামটা যথেষ্ট আধুনিক আর স্মার্ট নয়। তাই ছদ্ম নামে বিখ্যাত হবার প্রচেষ্টা।
“দেবাশ্যিস বাবু, আপনাকে আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সুগার কোটেড্ ঐসব বিজ্ঞানের হাবিজাবি কল্পবিজ্ঞনের গল্প বলে আমি চালাতে পারবো না। কেউ পড়বে না ঐসব। ‘রহস্যময় বিজ্ঞান জগত’ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলো পড়ে দেখেছেন? যুগোপযোগী আধুনিক গল্প। বাজারে খায়।
‘রাব্বির স্বীকারোক্তি – তেমনি একটি গল্প স্যার। একবার পড়ে দেখুন। এটাই আমার শেষ অনুরোধ। পছন্দ না হলে আর কখনো আমার গল্প পড়তে বলব বা স্যার। এটাই শেষ বার”। .
“অসম্ভব!” দৃঢ় উক্তি শুভম বাবুর। “আমি এখন শারদ সংখ্যার জন্য গল্প সংগ্রহ করছি। হাতে মোটেই সময় নেই। ওসব হাবিজাবি পড়ার মত সময় নেই আমার। আপনি এখন আসতে পারেন”। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত তুলে বিদায় জানান তিনি।
এবার ধীরে ধীরে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করে দেবাশ্যিস বাবুর। প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর ইগোয় লাগে। .
“রাখুন মশাই আপনার শারদ সংগ্রহ। যত সব বোগাস্ গল্প। বিজ্ঞানের নাম – গন্ধও নেই সেসব গল্প্বে। মহাকাশে শূন্যে বিচরণ করতে করতে গুলির লড়াই। শুঁড়ওয়ালা প্রাণীদের ইলেকট্রনিক বার্তা বিনিময়। এর পরেতো সমুদ্রের জল নদী বেয়ে পাহাড়ে উঠে যাবে। এসব কল্প বিজ্ঞানের গল্প নয়, বলুন অপবিজ্ঞানের গল্প”। .
চলে যেতে যেতে ধীর গলায় বলে গেলেন “বিজ্ঞানকে অশ্রদ্ধা! এই বিজ্ঞান দিয়েই সায়েস্তা করব আপনাকে একদিন। দেখে নেবেন”।
বেরিয়ে যান দেবাশ্যিস বাবু ওরফে ডঃ দেবাশ্যিস মন্ডল।
এই হল আমাদের আখ্যানের উপক্রমণিকা।
দেবাশ্যিস বাবুর ঠান্ডা হুমকির জবাবে শুভম বাবু ঠিক কি বলেছিলেন আমাদের জানা নেই। এটাও জানা নেই হুমকির পরেও শুভমবাবু তাঁর শারদ সংকলনের কাজে মন লাগাতে পেরেছিলেন কিনা। তবে এটাও ঠিক যে দেবাশ্যিস বাবুদের মতো গোবেচারা ধরনের মানুষের হুমকিতে শুভম বাবুদের মতো পোড় খাওয়া সম্পাদকের খুব একটা হেলদোল হবার কথা নয়।
দিন যায়, রাত যায়, পরপর ‘রহস্যময় বিজ্ঞান জগতে’র নতুন নতুন ঝলমলে সংখ্যাগুলো বইএর দোকান আর নিউজষ্ট্যান্ড আলো করে রাখে। বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ, আলোচনা, বিশ্লেষণ – বিখ্যাত সব মানুষজনকে দিয়ে লেখানো। ‘রহস্যময় বিজ্ঞান জগতে’র সব থেকে আকর্ষণীয় বিভাগ ‘কল্প বিজ্ঞানের আসর’ সব থেকে জনপ্রিয়।
কিছু কিছু স্বভাব নিন্দুক বিজ্ঞানীদের অপ্রিয় সমালোচনাকে কেই বা পাত্তা দেয়!
অন্যদিনের মতো সেদিনও শুভম বাবু সকালে অফিসে ঢুকে প্রথমেই সেদিনের চিঠিপত্র নিয়ে বসলেন। রাফির ধারাবাহিক গল্পটির এই সংখ্যার কিস্তি এখনো আসেনি। রাফির মতো নামি লেখককে খুব একটা তাগাদা দেওয়া যায় না। সেটা ওনারও বোঝা উচিৎ। কিন্তু দুঃখের কথা এটাই যে উনি তা বোঝেন না। ধারাবাহিকের কিস্তি জমা দেবার ব্যাপারে উনি প্রচন্ড অনিয়মিত। খামের চেহারাগুলো দেখে মনে হচ্ছে এবারও আসেনি। অথচ টাকার ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ রাফি। মাসের দশ তারিখের মধ্যে চেক যেতেই হবে।
আজকের ডাকের প্রায় পুরোটাই আবর্জনা। কিছু চিঠি পত্র, একটা আনকোরা নতুন লেখকের গল্পের পান্ডুলিপি যেটা শুভম বাবু না পড়েই ফেরত দেবেন। এদের উচ্চাকাঙ্খা দেখে তার অবাক লাগে। .
আগে ছোটখাটো পত্রিকায় লিখে নাম কর। তারপর ‘রহস্যময় বিজ্ঞান জগত’ পত্রিকায় লেখা পাঠা। এক লাফে গাছে ওঠার শখ!
এইসব নতুন লেখকের গল্প অবশ্য শুভম বাবুর কাজেও লেগে যায়। থিমটা মোটামুটি ভাল থাকলে সেই আইডিয়াটা হাতিয়ে ভাল গল্প তৈরি করা যায়। একবার এই ছোক্রার লেখাটা পড়ে নেওয়াই ভালো।
ডাকের মধ্য থেকে বেরুল একটা রঙিন খাম। ছিঁড়ে দেখেন একটি ততোধিক রঙীন কার্ড। রঙিন অর্থহীন অথবা দুর্বোধ্য ছবি। অনেকটা আধুনিক দুর্বোধ্য চিত্রকলার মত। মানে বোঝা যাক আর নাই যাক, ছবিটা কিন্তু রঙের বাহারে অত্যন্ত চিত্তাকার্ষক। চোখের পলক পড়ে না। খালি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওনার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। যেন শান্তির সাগরে নিমজ্জিত। ঘোর লেগেছে চোখে মনে। সারা শরীর যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে। ঘোর কাটল নিঝুর ডাকে।
“স্যার, আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে”। নিঝুর ডাকে সম্বিত ফেরে শুভমের।
নিঝু একটি ছোট ছেলে। শুভম বাবুর দপ্তরে ফাই ফরমাস খাটে। তার সঙ্গে লেখকদের বাড়ি যাওয়া, প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সব কাজ তার। এক কথায়, শুভম বাবুর দপ্তরের সর্বেসর্বা।
শুভম বাবু নিঝুকে খুব স্নেহও করেন।
সম্বিত ফিরতে চায়ের কাপে চুমুক দেন শুভম। চায়ের পরেই ওনার একটা সিগারেট খাওয়া চাই।
উঠে গিয়ে ঘরের বাইরে করিডোরে যান তিনি। একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে চাপেন। লাইটার বার করে জ্বালাবার আগেই ওনার মন অপরাধবোধে সংকুচিত হয়ে যায়।
কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? সিগারেট খাবার ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ‘রহস্যময় বিজ্ঞান জগত’ পত্রিকায় নিজেই লিখেছিলেন সুদীর্ঘ প্রবন্ধ। প্রচুর তত্ত্ব এবং তথ্য সমেত। সেই প্রবন্ধের জন্য অসংখ্য সাধুবাদও পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে। শুভা, ওনার স্ত্রী, (গল্পের স্বার্থে ধার করা নাম) ওনাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছেন সিগারেট না খাবার জন্য। গভীর বিশ্বাসে শুভা জানেন শুভম সিগারেট খান না। এই বিশ্বাসের মর্যাদা উনি রাখেন নি। .
আত্মগ্লানিতে ভরপুর হয়ে ওঠে তার মন।
সিগারেট না জ্বালিয়েই তিনি ফেলে দিলেন। সিগারেটের পুরো প্যাকেটটাই ফেলে দিলেন তিনি। প্রিয়জনের কাছে অবিশ্বাসী হওয়া মহাপাপ। পায়ে পায়ে ফিরে আসেন নিজের চেম্বারে। .
ছবিটা বড্ড টানছে। আবার চোখ মেলেন ছবিটার ওপর। এত চমৎকার রঙের বাহার যে সম্ভব সেটাই জানা ছিল না তাঁর।
হঠাৎ কতগুলো জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে। কি আশ্চর্য! পত্রিকার বিক্রি বর্তমানে প্রায় কুড়ি হাজার। অথচ কাগজে কলমে দেখানো হচ্ছে দশ হাজার। কেন হচ্ছে?
ডাক পড়ে রিশাদ বাবুর। রিশাদ বাবু এসে সামনের চেয়ারে বসতেই সেই মোক্ষম প্রশ্নটি করেন শুভম। .
“রিশাদ বাবু, পত্রিকার বর্তমান বিক্রি কত কপি?”
“ব্ল্যাক না হোয়াইট্ স্যার?”
“মানে?”
রিশাদ বাবু এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলেন না।
“মানে – কাগজে কলমে দশ হাজার কিন্তু আসল বিক্রি কুড়ি ছাড়িয়েছে গত মাসে। “
শুভম বাবু অবাক! “কাগজে কলমে দশ আর আসলে কুড়ি – এর মানে?”
এবারে অবাক হবার পালা রিশাদ বাবুর, শুভ বাবুর মুখে এই প্রশ্ন বিশ্বের নবতম আশ্চর্য! ওনার নির্দেশেই তো এই ব্যবস্থা। লেখকদের কম পারিশ্রমিক আর ট্যাক্স ফাঁকি। এই জন্যই এই ব্যবস্থা। এটাও অত্যন্ত সাধারণ পদ্ধতি। সবাই জানে। হয়ত সরকারও জানে।
তবুও ফের ব্যাখ্যা করলেন রিশাদ বাবু। শুভমের এবার আশ্চর্য হবার পালা।
“না না – এ হয় না। এ তো ঘোরতর অন্যায়। আমরা একটা মহৎ উদ্দেশ্যে পত্রিকা প্রকাশ করি। তাতে চুরি জোচ্চুরির স্থান কোথায়? এক্ষুনি আপনি সক্কলকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিন আমাদের ভুলের কথা। আর হিসাব কষে সবার বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দিন। সরকারের ট্যাক্স সমেত”।
রিশাদ বাবু হতচকিত।
(চলবে – ২য় পর্বে সমাপ্তি)
আমি রেজাউল করিম রাব্বি। Founder, 5 JokeRs, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 বছর 8 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 2 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।