আমাদের মতো কার্বন নির্ভর জীবন বেঁচে থাকার জন্য অদ্বিতীয় শর্ত হল পানি। পানি সৃষ্টিতে এক বিস্মকর কীর্তি। জীবনকে সম্ভাব্যতার সীমায় ধরে রাখার জন্য পানির গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা দৈনন্দিন জীবনে পানির গুরুত্ব বুঝাবার জন্য একটি প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে থাকি, তা হলো - 'পানির অপর নাম জীবন'। আমরা প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ননারকম কাজে পানির ব্যবহার করে থাকি, এবং বিপুল পরিমাণ পানির অপচয়ও করি। কখনো কি ভেবেছেন আপনার-আমার অপচয়কৃত এক ফোঁটা পানির মূল্য কত অসীম, আর এই পানির সহজলভ্যতা আপনার-আমার প্রতি স্রষ্টার কত দূর্লভ আশীর্বাদ?
১৮৬৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রখ্যাত রসায়নবিদ মেন্ডেলিফ সমস্ত মৌলসমূহের ভরের সঙ্গে তাদের ধর্ম ও গুণাগুনের একটি পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ধারা ব্যাখ্যা করে একটি সারণি তৈরি করেন যা মেন্ডেলিফের পর্যাবৃত্ত সারণি (Mendelleff's Periodic Table) নামে পরিচিত। একেই পরবর্তীতে উন্নত করা হয় এবং বর্তমানে সামান্য পরিবর্তিত রূপে এটি আধুনিক পর্যাবৃত্ত সারণি (Modern Periodic Table) নামে পরিচিত। সমস্ত পৃথিবীর উন্নততর প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সংগে এ সারণির সম্পর্ক এত গভীর যেমন পানির সঙ্গে মাছের সম্পর্ক।
মৌলের ভর, ধর্ম ও গুণাগুণ অনুসারে মেন্ডেলিফ সমস্ত আবিস্কৃত মৌলসমূহকে বৈশিষ্টগত ধারাবাহিক গুণাগুণের মানে একটি ছকের উপর সাজিয়ে নিলেন। পর্যায়ক্রম ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনে ছক তৈরী করার সময় মেন্ডেলিফ তার সারণিতে কিছু কিছু ঘর শুণ্য রেখে যান এবং অত্যান্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, শূণ্যঘরসমূহের উপর-নীচ ও আগে-পরের মৌলসমূহের গুণাগুণ দেখে তিনি ঐ সব শূণ্যঘরে ভবিষ্যতে আবিস্কার হবে এমন সব মৌলসমূহের ভর, গুণাগুণ ও ধর্ম ইত্যাদি বলে দিলেন। কয়েক অব্দ যেতে না যেতেই এক এক করে ঐ সকল শূণ্যঘরগুলো পূর্ণ হতে লাগল, এবং আশ্চর্যজনক ভাবে নব আবিস্কৃত মৌল সমূহ মেন্ডেলিফের ভবিষ্যত বাণীর সাথে হুবহু মিলে গেল। বিজ্ঞানিরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলেন, সমস্ত সৃষ্টির মাঝে একটি বিশেষ ধারাবাহিকতা বিদ্যমান আর এই ধারাবাহিকতা সৃষ্টিকে এক অদৃশ্য আইনের সুকঠিন বাঁধনে শৃংখলায়িত করে রেখেছে। থমাস ডেবিস পার্কাস, রিচার্স কেমি ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটি। তিনি মেন্ডেলিফের সংশোধিত পর্যাবৃত্ত সারণিকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে - "আজকের দিনে রসায়নবিদ্গণ অজ্ঞাত নতুন যৌগিক পদার্থের বিক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে এবং এর উপাদান সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণীর জন্য তাদের কাজের সহায়ক হিসাবে এই পর্যাবৃত্ত সারণির সাহায্য গ্রহণ করে থাকেন। এই গবেষণা ও ভবিষ্যৎ বাণী সম্পর্কে তাদের সাফল্য, অজৈব বিশ্বে যে সুন্দর ক্রম ও ধারাবাহিকতা বিদ্যমান, তারই অভ্রান্ত প্রমাণ" **। আজকের বিশ্বের সমস্ত বিজ্ঞান, বিশেষতঃ রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানের সকল ছাত্রই বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেন যে, দৃশ্যজগতে পদার্থের সৃষ্টি, পরিবর্তন, নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস এক সুকঠিন দুর্লংঘ্য আইন ও শৃংখলায় বাঁধা। এই আইনকে অমান্য করার অর্থ একটি অস্বাভাবিকতার নিদর্শন বা উদাহরণ; অথচ আপনি জানেন কি যে আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই পানি এক অতি অস্বাভাবিকতার ফসল? অবস্থানগত কারনে ও মৌলদের নিজস্ব গুণাগুণের জন্য পানি কেবল চিরদিন বাস্পীয় অবস্থাতেই থাকার কথা ছিল। এই সৃষ্টিতে একমাত্র পানিই হলো আইন ভঙ্গকারী (Outlaw) যৌগ। প্রকৃতির আইনকে লঙ্ঘন না করে শুধু মান্য করার খাতিরে পানি যদি প্রকৃতির আইনকে মেনে চলত তাহলে কখনোই এই পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব হতো না। দৃশ্যতঃ এই অতিশয় স্বাভাবিক বস্তু পানি যে কত উল্লেখযোগ্যভাবে অস্বাভাবিক, তা বিজ্ঞানকে তাক লাগিয়ে দেয়! মানুষকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে দু'দন্ড ভাবিয়ে তোলে!!
আসুন আমরা পানি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। পানির আনিবক ভর ১৮। এই তথ্যটিতেই একজন বিজ্ঞানের ছাত্রের কাছে বুঝে নেয়ার জন্য যথেষ্ট যে, পানি সামান্য চাপ ও তাপেই গ্যাসে পরিণত হবে। এমোনিয়ার আনিবক ভর পানির থেকে ১ কম, তা সত্ত্বেও এমোনিয়া সাধারণ বায়ুমন্ডলীয় তাপ ও চাপে (৩০ ডিগ্রি সেঃ) তরল অবস্থা থেকে বায়বীয় অবস্থায় পরিনত হয়। পার্যাবৃত্ত সারণির অবস্থানের দিক থেকে পানির সঙ্গে অতি ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে হাইড্রোজেন সালফাইট এর, যার আনিবক ভর ৩৪। এই পদার্থটি -৫৯ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় বাস্প হয়ে যায়। পানির কাছাকাছি অন্যান্য যৌগসমূহের তুলনামূলক চিত্রটিতে একটু চোখ বুলিয়ে নিন -
হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড | +১৯.৫ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় বাস্প হয়ে যায়। |
হাইড্রোজেন ব্রোমাইড | -৬৬.৪ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় বাস্প হয়ে যায়। |
হাইড্রোজেন ক্লোরাইড | -৮৫ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় বাস্প হয়ে যায়। |
হাইড্রোজেন সায়ানাইড | +২৬ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় বাস্প হয়ে যায়। |
হাইড্রোজেন সালফাইড | -৫৯ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় বাস্প হয়ে যায়। |
আমরা দেখছি আনিবক ভরের দিকদিয়ে পানির কাছাকাছি যৌগসমূহ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিঃশেষে বাস্প হয়ে ঊরে যায়। অন্যান্য যৌগদের মত পানির উপর আনিবক ভরের ধারাবাহিকতা সমভাবে কার্যকর হওয়া সত্বেও কেন পানি সাধারণ তাপমাত্রায় বাস্প না হয়ে ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বাস্প হয় এবং এর আগে পানি তার স্বাভাবিক তরলীয় অস্তিত্ব অতি আশ্চর্যজনক ভাবে বজায় রাখে? এই বিষয়টি বিজ্ঞানীদেরকে অবাক করে দেয়। অজৈব বিশ্বে যেখানে সকলকিছু এক দুর্লংঘ নিয়ম শৃংখলার শাসন মেনে চলে, সেখানে এককভাবে পানি হঠাৎ করে কেন এই ক্রমের শাসনকে ভেঙে অস্বাভাবিকভাবে আমাদের জানা অস্তিত্ব নিয়ে বজায় থাকে? এটি ঘটে পানির হাইড্রোজেন চেইনের কারনে; অক্সিজেনের সঙ্গে হাইড্রোজেনের বিশেষ আকর্ষণের কারনে বিভিন্ন H2O অনু একত্রিত হয়ে বিরাট অনু গঠন করে। ফলে বাস্পিভূত করতে অধিক তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। এটি একটি অনন্য ধর্মী ব্যবস্থা যা শুধুমাত্র পানির যৌগ সৃষ্টিতেই প্রয়োগ করা হয়েছে। হাইড্রোজেন চেইন হলো সৃষ্টার এক সুবিশাল দয়া, যার কাছে পৃথিবীর প্রতিটি অনু-পরমাণু কৃতজ্ঞতার ঋনে আবদ্ধ।
উপরে উল্লেখিত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষন করে আমরা দেখতে পাই, পানি তার কাছাকাছি অবস্থানরত যৌগদের মত যদি শুধু নিয়ম রক্ষার খাতিরে প্রাকৃতিক নিয়মকে মেনে চলত তাহলে, আজ আমরা পানিকে যেভাবে দেখছি পানির এই তরল রূপ হত এক স্বপ্নের বিষয়, স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পৃথিবীর সকল নদী-নাল, সাগর-মহাসাগরের পানি নিঃশেষে উবে যেত। আমাদের জানা সকল উন্নতর প্রযুক্তি ব্যবহার করেও তখন তৃষ্ণা মিটাবার জন্য কয়েক ফোটা পানির যোগান দেয়া সম্ভব হতো না। থমাস ডেবিস পার্কাস তার লেখচিত্রে বিষয়টি তুলে ধরেছেন - "এমনি সাধারণ তাপমাত্রায় পানি যে তরল অবস্থাতেই বিদ্যমান থাকে, তা এমনি একটি ব্যাপার যা নাকি মানুষকে থমকে দিয়ে নির্নিমেষ ভাবিত করে তোলে"।
বিজ্ঞানের কল্যানেই আমরা জানতে পেরেছি যে, সাধারণ তাপ ও চাপে সবসময় বায়বীয় অবস্থায় থাকাই পানির সর্ব-বিশেষ গুণ হবার কথা ছিল। অথচ প্রতিপালক তাকে তরল অবস্থায় রেখে জগতের প্রতিপালন ব্যবস্থায় নিয়োজিত রেখেছেন। প্রসঙ্গতঃ আমি এখানে পবিত্র কোরআনের দুটি আয়াত উল্লেখ করতে চাই। পানি যে এই উদ্বায়ী (উবিয়া যাওয়ার ধর্ম) গুণাগুণে সৃষ্ট অথচ তাকে তরল রাখা হয়েছে, বিজ্ঞানের এই নব আবিস্কৃত বিস্ময়কর তথ্যটি কিন্তু পরিপূর্ণভাবেই কোরআন মুদ্রিত করে রেখেছে মানুষ এ তথ্যটি বুঝতে পারার দেড় হাজার বছর আগেই - "(ওহে মানুষ), ভাবিয়া দেখিয়াছ কি যদি ভূতলের সমুদয় পানির ভান্ডার উবিয়া যায়, তবে কে তোমাদের জন্য আনয়ন করিবে এই ভূবনে পানির প্রবাহ (সূরা আল মুলকঃ৩০)? আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে থাকি পরিমিত পরিমাণে অতঃপর আমি তা জমিনে সংরক্ষন করি এনং আমি তো উহা অপসারণ করিতেও সক্ষম"(সূরা আল মূ'মিনূনঃ১৮)। এই অপসারনের জন্য স্রষ্টাকে শুধু পানির হাইড্রোজেন চেইনটিকে বিলুপ্ত করলেই চলে; হয়তো কিছু সময় কিংবা একটি দিনের মধ্যেই এই পৃথিবীর পানির ভান্ডার উধাও হয়ে যাবে, এই পৃথিবীতে আর কোনদিন পানির প্রবাহ সৃষ্টি হবে না।
পানির আর একটি অপূর্ব গুণ হলো তার বিভিন্ন গুণাগুণ সম্পন্ন তিনটি ভিন্ন অবস্থা। সূর্যের উত্তাপে পানি স্ফুটনাংকের পূর্বে জলীয় বাস্পের কণা সৃষ্টি করে - এটিও একটি বাড়তি গুণ। এই প্রক্রিয়ায় তৈরী জলকণারা ক্রমে ঠান্ডা হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে এবং বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে। এই জলচক্রের কারনে স্বাভাবিক ভাবে প্রবাহিত হয় পৃথিবীর জীবন।
পানির বরফ হওয়ার ধর্ম এবং বরফ অবস্থায় এর বৈশিষ্ট, এর আর একটি অনন্য দিক। তাপমাত্রা যে সকল অঞ্চলে শূণ্যের কোঠায় পৌঁছায়, সে সকল স্থানে পানির এই বরফ হবার বিস্ময়কর ধর্মটি না থাকলে সমূদয় জলজ প্রান চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যেত। কোন কারণে সমুদ্রের নিচে বরফ জমতে শুরু করলে তা আয়তনে বৃদ্ধি পায়, ঘনত্ব কমে আসে, যার ফলে তা ভেসে ওঠে পানির উপরিতলে। পানি যখন বরফে পরিনত হতে থাকে, তখন সে বিপুল পরিমাণ তাপ বের করে দেয় (৮০ ক্যাল/সিসি)। এই সুপ্ততাপ সমুদ্রের নিচের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার এক অপরিহার্য শর্ত। এই প্রক্রিয়ায় বরফ হতে বেরিয়ে আসা তাপমাত্রা আশেপাশের পানিকে হিমাংকের উপরে থাকতে সাহায্য করে। যারফলে উপরে জমে যাওয়া বরফের আস্তরণের নিচে চলে জীবনের ধারা। পানির এই সুপ্ততাপ নিঃস্বরনের গুণটি না থাকলে মেরু অঞ্চলীয় নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর হয়ে পড়ত এক একটি আস্ত বরফের টুকরো, সংক্রমিত হয়ে পড়ত ব্যবস্থাটি পৃথিবীর অন্য সকল অঞ্চলেও। ফলাফলঃ মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে পড়ত জীবন।
------------------------------------------------------------------
** The Evidence of God in Expanding Universe.
আমি জাহিদ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 3 টি টিউন ও 40 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
ভালো Tune… চালিয়ে যান…