পৃথিবীর সবচাইতে বড় আর্টিস্টও হিমশিম খেয়ে যায়, যখন তাদের কোন অব্জেক্টের তিন-আয়তন বিশিষ্ট মডেল আর্ট করতে বলা হয়। যাই হোক, অনেক সময় এরা ছবি দেখে বা স্কেচ দেখে, আর্ট করার অনেক ভালো আইডিয়া পেয়ে যায়। তবে আজকের কম্পিউটার গ্রাফিক্সের যুগে ৩ডি মডেল তৈরি করা তেমন একটা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু আপনি যদি কোন সিরিয়াস বিজনেসের মধ্যে থাকেন, এবং আপনার নতুন প্রোডাক্টের প্রোটোটাইপ আপনার ক্লায়েন্টে দেখাতে চান, সেটা অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে দাড়াতে পারে।
আজকাল শুধু কম্পিউটার স্ক্রীনে মডেল দেখানে হয়না, ক্লায়েন্টরা এমন কিছু চায়, যেটা হাতে ছোঁয়া যায়, প্রোডাক্টটির সম্পর্কে আগেই বিসদ ধারণা পাওয়া যায়। এর জন্য হয়তো সেইম মেশিনে আপনাকে প্রোটোটাইপ তৈরি করতে হবে, সবচাইতে ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাড়াতে পারে, মডেলটি তৈরি করবেন কোন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে? ধন্যবাদ দিন ৩ডি প্রিন্টিং টেকনোলজিকে—যেটি অনেকটা আপনার কালির প্রিন্টারের মতো কাজ করে, আর ম্যাটেরিয়ালের স্তরের উপর স্তর ফেলে যেকোনো ৩ডি অবজেক্ট মডেল প্রিন্ট করতে পারে, আর এতে বেঁচে যেতে পারে আপনার ব্যবসার ১০ গুন টাকা।
এই টিউন থেকে জানবো, কিভাবে ৩ডি প্রিন্টার কাজ করে, এটি দ্বারা আপনি কি কি প্রিন্ট করতে পারবেন আর ৩ডি প্রিন্টার না থেকেও আপনি কিভাবে ৩ডি অবজেক্ট প্রিন্ট করবেন। তো স্থিরভাবে নিশ্বাস নিন, আর টিউনটি পড়তে আরম্ভ করে দিন।
৩ডি প্রিন্টার অনেকটা আপনার কালির প্রিন্টারের মতোই কাজ করে, যেটা কম্পিউটার সফটওয়্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ৩ডি প্রিন্ট করার পূর্বে, প্রথমে ঐ অবজেক্টির ৩ডি স্ক্যানিং করতে হয়। যদি কম্পিউটার ডিজাইন করা ৩ডি মডেল হয়, সেক্ষেত্রে স্ক্যানিং এর প্রয়োজন পরে না।
অনেক টাইপের ৩ডি স্ক্যানার থাকে, তার মধ্যে লেজার টাইপ সবচাইতে কমন। প্রথমে বিভিন্ন দিক থেকে লেজার বীম ছুঁড়ে মেরে অবজেক্টটির ৩দিনের গভীরতা, আয়তন, কোথায় কতোটুকু উঁচু হয়ে আছে, বা কোথায় কতোটুকু ভেতরে আছে, সেটা মেপে নেওয়া হয়। লেজার বীম, অবজেক্টের গায়ে ধাক্কা লেগে আবার স্ক্যানারের কাছে ফিরে গেলে, স্ক্যানার সবকিছু পরিমাপ করে ফেলে। অনেক টাইপের স্ক্যানারে আবার অনেক ক্যামেরা লাগানো থাকে, সেই ক্যামেরা গুলো অব্জেক্টির সকল ৩ডি তথ্য গুলো ক্যাপচার করে এবং প্রিন্টিং এর জন্য প্রসেস করা হয়।
এবার আসে ৩ডি প্রিন্টিং এর পালা, ৩ডি প্রিন্টারে কোন কালি ব্যবহৃত হয়? সাধারণ কালির প্রিন্টারে তরল কালি এবং লেজার প্রিন্টারে সলিড পাউডার ব্যবহৃত হয়, কিন্ত ৩ডি প্রিন্টারে যেহেতু কোন কাগজে প্রিন্ট করে না, এটি অবজেক্ট প্রিন্ট করে, তাই কালির বদলে এখানে ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়। প্ল্যাস্টিককে একদিক থেকে ৩ডি প্রিন্টারের কালি বলতে পারেন, কারণ এটাই সেই ম্যাটেরিয়াল যা ৩ডি প্রিন্টিং সম্পূর্ণ করে। ৩ডি প্রিন্টারের একটি অত্যন্ত সরু নজেল থাকে, যেটা সম্পূর্ণ কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই নজেল দিয়ে গলিত প্ল্যাস্টিক বেড় হয়ে আসে এবং কম্পিউটার প্রোগ্রাম অনুসারে নজেলটি সরানোরা করে প্ল্যাস্টিকের স্তরের উপর স্তর প্রিন্ট করতে থাকে, এভাবে একসময় সম্পূর্ণ অবজেক্টটির মডেল তৈরি হয়ে যায়। ৩ডি প্রিন্টারে সাধারণত থার্মো প্ল্যাস্টিক ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ গরমে প্ল্যাস্টিকটি গলে নরম হয়ে যায় এবং ঠাণ্ডা করে সেটি আবার সলিড হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ৩ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে কি কি প্রিন্ট করা সম্ভব? —আপনার কল্পনার সবকিছুই এ দ্বারা প্রিন্ট করা সম্ভব হবে। যেমনটা সাধারণ প্রিন্টারে যেকোনো কাগজে যেকোনো ছবি প্রিন্ট করা সম্ভব। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আপনি যে অবজেক্টটি প্রিন্ট করতে চাচ্ছেন, সেটা কোন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে প্রিন্ট করতে চান, সেই ম্যাটেরিয়াল কতোটা প্রিন্টিং এ উপযুক্ত। যদিও ৩ডি প্রিন্টার আজকের কোন প্রযুক্তি নয়, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি আমাদের মাঝে মজুদ রয়েছে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর হলো এর ব্যবহার করা শুরু হয়েছে।
মেডিক্যাল জগতে এই ৩ডি প্রিন্টারের রয়েছে ব্যাপক পরিমানের ব্যবহার। আর সত্যি বলতে আপনার বিশ্বাসই হবে না, ৩ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল হার্ট, আর্টিফিশিয়াল স্কিন, আর্টিফিশিয়াল, হাত, পেশি ইত্যাদি প্রিন্ট করা সম্ভব। তাছাড়া এই প্রিন্টার ব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল টিস্যু, কোষ, ইত্যাদি সবকিছু প্রিন্ট করা সম্ভব।
উড়োজাহাজ তৈরি এবং ডিজাইন করা প্রচণ্ড ব্যয়বহুল কাজ—সেখানে কোন ভুল করার কোন সুযোগ নেই। সামান্য ভুলে কয়েক মিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যাই হোক কম্পিউটার মডেল থেকে এর গঠন প্রণালীর অনেক তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু উইন্ড ট্যানেল টেস্টিং এর জন্য হুবহু প্রোটোটাইপ প্রয়োজনীয়, আর এখানেই রয়েছে ৩ডি প্রিন্টারের কাজ। মিলিটারি হাইলি কাস্টম প্লেন গুলো তৈরি করার আগে এর প্রোটোটাইপ তৈরি করা আবশ্যক হয়।
মিলিটারি প্লেনের প্রোটোটাইপ, কিংবা মহাকাশ রকেটের প্রোটোটাইপ তৈরি না করে, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি আর কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করেও এই কাজ গুলো করা যায়। এখনতো আবার এসেছে অগমেন্টেড রিয়্যালিটি, আপনার চারপাশের মধ্যেই আপনার কল্পনার বা মডেল করা অবজেক্ট গুলো ভার্চুয়ালি তৈরি করতে পারবেন। তাহলে ৩ডি প্রিন্টিং এর দরকার কি? দেখুন আমরা মানুসেরা সবকিছু নিজে হাতে ছুঁয়ে দেখতে চাই, আমাদের চোখের সাথে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটাকে সত্য ভাবতে চাই। আর এই জন্যই কল্পনার ফিজিক্যাল অবজেক্ট তৈরি করা প্রয়োজনীয় হয়ে পরে।
নিজের যেকোনো কাস্টম প্রোডাক্ট প্রিন্ট করা—এটাই হচ্ছে ৩ডি প্রিন্টিং এর নেক্সট লেভেল। আজকাল বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাবার অডার করার আগেই এর ৩ডি মডেল দেখে নিতে পারেন, খাবারটি ফিজিক্যালি কেমন হবে। গহনা, ফ্যাশনওয়্যার অনেক আগেই ৩ডি প্রিন্টিং করা শুরু হয়েছে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে অনেক গ্যাজেটের এখন ৩ডি প্রিন্টারের মাধ্যমে প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়। আর ভবিষ্যতে ৩ডি প্রিন্টিং টেকনোলজিকে আরো উন্নত করা সম্ভব হলে, আরো ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে রিয়াল টাইপের প্রোডাক্ট প্রিন্ট করা সম্ভব হবে। সাথে প্রোডাক্ট কাস্টমাইজেশন অনেক বেড়ে যাবে।
হতে পারে আপনি স্মল বিজনেস শুরু করেছেন এবং জাস্ট কিছু প্রিন্টিং টেস্ট করতে চান আর ৩ডি প্রিন্টারে টাকা ইনভেস্ট আগেই করতে চাচ্ছেন না। যদিও আজকে ৩ডি প্রিন্টারের দাম অনেক কমে গিয়েছে, কিন্তু তারপরেও বড় প্রিন্টার গুলো প্রচণ্ড দামী। তাহলে কিভাবে প্রিন্টার না কিনেই ৩ডি অবজেক্ট প্রিন্ট করবেন? খুব সহজ!
যেমনটা বাজারের প্রিন্টার থেকে আপনার প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট গুলোকে প্রিন্ট করেন, ঠিক তেমনি অনেক অনলাইন সার্ভিস রয়েছে, যারা আপনার মডেল প্রিন্ট করে আপনার কাছ পর্যন্ত পৌছিয়ে দেবে। উন্নত দেশ গুলো যেমন ইউএসএ তে, অনেক সার্ভিস সেন্টার রয়েছে, যারা আপনার মডেল প্রিন্ট করতে আপনাকে সাহায্য করবে, কিন্তু আপনি অনেক ওয়েবসাইটের সাহায্য নিয়েও এই কাজটি করতে পারেন।
Shapeways নামক একটি ওয়েবসাইট এবং আরো অনেক ওয়েবসাইট রয়েছে, যারা আপনাকে আপনার মডেল আপলোড করার সুবিধা প্রদান করে অথবা তাদের ওয়েবসাইটে মজুদ থাকা মডেল থেকে আপনাকে প্রিন্ট করার সুবিধা প্রদান করে থাকে। তারা তাদের ৩ডি প্রিন্টারে আপনার মডেলটি প্রিন্ট করবে এবং আপনার কাছে মেইল করে দেবে। যদি আপনি আজীব আজীব মডেল প্রিন্ট করতে চান, সেক্ষেত্রে আপনার খরচ বেড়ে যেতে পারে। আর আপনার যদি সচরাচর প্রিন্টিং প্রয়োজনীয় হয়, তাহলে একটি প্রিন্টার কিনে ফেলায় ভালো হবে।
৩ডি প্রিন্টিং সত্যিই অনেক কুল আইডিয়া। ভবিষ্যতে এর কদর আরো বাড়বে এই ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়না আপনার পার্সোনাল ভাবে ৩ডি প্রিন্টার কেনার কোন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আপনার যদি কোন মডেল তৈরি করতে হয়, সেখানে অনলাইন সার্ভিস গ্রহন করতে পারেন।
যদি আপনি বিজনেস শুরু করতে চাচ্ছেন আর আপনার ক্লায়েন্টকে প্রোটোটাইপ দেখাতে হবে, সেক্ষেত্রে এই প্রিন্টারে টাকা ইনভেস্ট করতে পারেন। আশা করি, এই টিউনটি আপনার অনেক উপকারে এসেছে, আপনি অনেক অজানা তথ্য গুলো জানতে পারলেন। যেকোনো প্রশ্ন বা মতামতে অবশ্যই আমাকে নিচে টিউমেন্ট করে জানাতে পারেন।
আমি তাহমিদ বোরহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 177 টি টিউন ও 680 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 43 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি তাহমিদ বোরহান। টেক নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালোবাসি। টেকটিউন্স সহ নিজের কিছু টেক ব্লগ লিখি। TecHubs ব্লগ এবং TecHubs TV ইউটিউব চ্যানেল হলো আমার প্যাশন, তাই এখানে কিছু অসাধারণ করারই চেষ্টা করি!
অনেক কিছু জানলাম, আপনার পোস্ট গুলো অনেক ভালো হয়।