সুধি পাঠক, মহাবিশের এই বিশাল চত্তরে অগণিত এই বস্তু নিলয় এক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থায় ব্যবস্থিত। আপাত দৃষ্টিতে এলোমেলে মনে হলেও সকলেই এক সুকঠিণ হিসেবের মধ্যে সুবিন্যস্থ। মহান স্রষ্টা তার সৃষ্টির সকল ক্ষেত্রেই সুকঠিণ হিসেব রক্ষা করেছেন। মহাকাশের বিশাল চত্তরে যেমন সমীকরণ বেঁধে দিয়েছেন, তেমনি কঠিন সমীকরনের আওতায় সৃষ্টি করেছেন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা; এই মহাজাগতিক বস্তু নিলয় সৃষ্টির মূল উপাদান পরমাণু,ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র মৌলিক বস্তুকণা সৃষ্টি হয়েছে অতি উন্নত সজ্জায়। তার মধ্যে অবস্থিত সুক্ষ কণিকাগুলো বিন্যস্থ হয়েছে সুষম অনুপাতে। বিজ্ঞানীগন নিবির পর্যোবেক্ষন ও জটীল পরীক্ষায় দেখেছেন যে, পরমাণু কেন্দ্রে প্রোটনের ভর অতি সুক্ষ হিসেবের দ্বারা নির্ধারণ করা হয়েছে, সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা হয়েছে এমন ভাবে যাতে তার নিজের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং মহাবিশ্ব হয় নিরাপদ। অথচ একটা মুক্ত নিউট্রন প্রোটনের চেয়ে যৎসামান্য ভারী কণা ভেঙে তৈরী করে একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন ও একটি অস্থিতিশীল প্রতিনিউট্রন কণা, যার আয়ুস্কাল হয় মাত্র ১২ মিনিট। আর এ কারণেই প্রকৃতিতে মুক্ত নিউট্রন থাকতে পারেনা। যদি কোন কারণে কোন প্রোটনের ভর ০.২% ও বৃদ্ধি পায় তবে প্রোটন হয়ে পড়বে অস্থিতিশীল কণা; এবং তা দ্রুত ভেঙে যাবে, তৈরী করবে নিউট্রন,পজিট্রন ও নিউট্রিনো বা প্রতিনউট্রন কণা সমুহ। যা প্রকৃতিতে স্বতঃসিদ্ধ।
সূধী পাঠক একবার ভেবে দেখুন,বিশ্বস্রষ্টা কিভাবে কত নিখুঁত হিসেবের মধ্যে এই ক্ষুদ্র কণাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। যিঁনি সৃষ্টি করেছেন এই মহাবিশ্বকে,তার পক্ষে প্রোটন কণার ওজন এই সমান্য মাত্রায় বাড়িয়ে দেওয়া কিন্তু খুব কঠিণ কাজ নয়; আর যদি কখনো এমনটা ঘটেই যায় তবে সর্বপ্রথম মহাবিশ্বের সকল হাইড্রোজেন পরমানুর কেন্দ্র যাবে ভেংঙে, ফলে সকল নক্ষত্রের জ্বালানী যাবে মুহুর্তে নিঃশেষ হয়ে। মহাবিশ্বের ধ্বংস হয়ে পড়বে অনিবার্যো। মহাবিশ্বের ধ্বংস কত সহজ ব্যপার; অথচ ১৫ শত কোটি বছর ধরে অবলীলায় টিকে আছে এবং বিবর্তনের ধারায় সম্প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে। তাই বলে মনে করবেননা যে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছেনা! অতি সম্প্রতি বিজ্ঞানীগণ জানতে পেরেছেন যে, মহাকাশে নক্ষত্রের জন্মকালে প্রতিনিয়ত পোটন ও নিউট্রনের ভাঙাগড়া চলছে, পদার্থ সৃষ্টির পাশাপাশি চলছে প্রতি পদার্থ সৃষ্টি যা অস্থিতিশীলতার কারণে টিকে থাকতে পারছেনা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে স্থায়ী পদার্থে। নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে এই যে ভরের পার্থক্য যা সঙ্গোপনে এই মহাবিশ্বকে রক্ষা করে চলেছে,তা কি প্রকৃতিতে আপনা আপনি হয়েছে? না কি সুনির্দিষ্ট কোন হিসেবের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি এর পিছনে কোন সুনির্দিষ্ট নকশা না থকতো তবে হয়তোবা আমাদের এই মহাবিশ্ব আতুর ঘরেই ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়ে যেত। যেখানে প্রতি নিয়ত এই অস্থিতিশীল পদার্থ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বে ভাঙাগড়ার খেলা চলছে সেখানে এই বিশাল সাম্রাজ্য টিকে থাকার পিছনে নিঃশ্চই কোন সুদক্ষ মহা প্রকৌশুলীর পরিকল্পনা রয়েছে। আর বিবর্তনের ধারায় পরমাণুর রূপান্তর কোন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাদ্যামে হচ্ছেনা,হচ্ছে কোন সুদক্ষ মহা কুশলীর নকসা অনুযায়ী।
সূধী পাঠক, এখানে একটি অত্যান্ত কৌতুহলী পশ্নের সৃষ্টি হয়েছে! তা হল, প্রকৃতিতে এই ভাঙ্গা গড়ার খেলা কেন? কেন সৃষ্টির সময়ে আবার ভাঙ্গার খেলা তারপর পুনরায় সৃষ্টিতে রূপান্তর; এ কি সৃষ্টিরই জন্যে না কি স্রষ্টার নিজের জন্যে? আমরা জানিনা কিজন্যে তবে আমরা পারিপার্শিকতার বিবেচনায় আবেগময় মন্তব্য করতে পারি যা,হতে পারে যৌক্তিক অথবা অযৌক্তিক। আমরা জানি এই মহাবিশ্বে একমাত্র স্বাধীন স্বত্ত্বা হলেন মহাবিক্রম মহান প্রভু; তিঁনি কোন নিয়মের অধীন নয়। নিয়মের মাঝে অনিয়মের চর্চাই তার স্বাধীন সার্বভৌমত্বের নির্ণায়ক। শক্তি থেকে পদার্থের সৃষ্টি হল প্রকৃতির সাধারন নিয়ম; এই নিয়মের মাঝে প্রতিপদার্থ সৃষ্টি হয়ে আবার তা ভেঙে পদার্থের উৎপাদন অনিয়মেরেই সামিল; আর এই অনিয়মের মাঝে সৃষ্টির ধারা প্রবাহ রক্ষা করে মহান প্রভু হয়তোবা তাঁর স্বাধীন ক্ষমতারই পরিচয় দিয়ে থাকেন।
প্রকৃতির সুবিণ্যস্থ বিন্যাসের আরেক উদাহরণ হল মৌলিক চার শক্তি। যার একটি হল মহাকর্ষ বল যা প্রকৃতির সুনির্দিষ্ট নীতি রক্ষা করে মহাবিশ্বকে টিকিয়ে রেখেছে আজন্মকাল ধরে। এই নীতি অনুযায়ী মহাবিশ্বের সকল পদার্থ পরস্পর পরস্পরের কেন্দ্রের দিকে টানছে। এই টানাটানি বল বস্তুর কেন্দ্রের দূরত্বের বর্গের উল্টানুপাতিক এবং ভরের সামানুপাতিক। প্রায় ৩০০ বছর আগে বিজ্ঞানী নিউটন এই সূত্রটি আবিস্কার করেন। আর এই মৌলিক শক্তিই মহাজাগতিক বস্তুনিলয়কে তাদের স্ব স্ব স্থানে ধরে রাখছে, বিচ্ছিন্ন বা বিচ্যুত হয়ে পড়ছেনা। এই মহাকর্ষ বলই চাঁদকে পৃথিবীর চারিদিকে, পৃথিবীকে সূর্যের চারিদিকে অর্থাৎ সৌর মণ্ডলের সকল সদস্যকে তাদের নিজ নিজ কক্ষ পথে সূর্যোকে প্রদক্ষিন করাচ্ছে; এমনকি ছায়াপথগুলোকে নিজ কেন্দ্রের চারিদিকে ঘুরাচ্ছে।
সূধী পাঠক,এই যে আমরা উপরে পদার্থের সুক্ষতম কণা (মৌলিক অবস্থায় যাকে বলাহয় পরমাণু) নিয়ে আলোচনা করলাম, এবার তার সম্পর্কে কিছু বৈজ্ঞানিক আলোচনা দেখি;
দার্শনিক এরিষ্টটলের বিরোধিতায় একসময় ডেমোক্রিটাসের পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার ধারনাকে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডালটন পুনরুজ্জীবিত করে বলেন, মহাবিশ্বের তাবৎ পাদার্থ অতি সূক্ষ কণাদ্বারা গঠিত, এদের নাম দিলেন এটম বা পরমাণু। তার গবেষণায় সামান্য ত্রুটি থাকার কারণে তিনি যৌগিক ও মৌলিক পদার্থকে আলাদা করতে না পারলেও তার এ্ ধারণাই পরমাণু জগতের প্রথম আলো। তিনি যে পথের সন্ধান দিয়ে গেলেন সে পথে হাঁটতে হাঁটতে বিজ্ঞানী গণ বহুদূর এগিয়ে গেলেন। তারা তাবৎ পদার্থের মৌলিক উপাদান গুলোর ক্ষুদ্রতম কণার নাম দিলেন পরমাণু আর একাদিক একই পরমাণু বা ভিন্ন জাতীয় পরমাণু মিলে গঠন করে যৌগিক পদার্থ, যার ক্ষুদ্রতম অংশকে বলা হয় অণু। শুধু নামই দিলেননা,খুঁজে বের কেরলেন অণু পরমাণুর বিষ্ময়কর গঠনশৈলী।
এই যে ক্ষুদ্রতম মৌলিক পরমাণু যাকে খালি চোখে দেখবেন দূরে থাক সাধারণ কোন অনুবীক্ষনেও দেখা যায়না,দেখতে হলে অতি উন্নত ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র,যা হালে আবিস্কৃত হয়েছে তার সাহায্যে সমান্য ভাবে দেখতে হয়, সেই পরমাণু গঠণকারী অতিসূক্ষ কণারও খোঁজ পেয়েছেন, তাদেরকে বিভিন্ন নামে নাম করণ করেছেন; বিজ্ঞানীগণ তাদের অবস্থান যে ভাবে চিত্রায়িত করেছেন তা অবশ্যই আপনাকে মুগ্ধ করে তুলবে।
সূধী পাঠক আমরা একটা মৌলিক পরমানুতে অবস্থিত কণিকাগুলোকে দেখে তাদের গঠণ রহস্য পুরো পুরি জানতে পারিনা, অনেক নাজানা রহস্য জানতে পারি বিজ্ঞানীদের পরীক্ষালব্দ ফলাফল থেকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন; কোন মৌলের পরমাণুতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী তিনটি মূল কণিকা থাকে, এদের নাম হল ১.প্রোটন, ২.নিউট্রন ও ৩. ইলেকট্রন। এই স্থায়ী কণাগুলো ছাড়াও পদার্থের মধ্যে কিছু অস্থায়ী কণা থাকে; তার সংখ্যা শতাদিক; তবে এই কণাগুলো অত্যান্ত রহস্যময়। এরা অত্যান্ত ক্ষণস্থায়ী। মৌলের জন্মকালীন সময়ে এদের উপস্থিতি দেখা গেলেও পরক্ষণেই তারা স্থায়ী কণায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে প্রধানতঃ কয়েকটির নাম হল,১.নিউট্রিনো ২.অ্যান্টি নিউট্রিনো ৩.পজিট্রন ৪, মেষন, ৫.বোসন ইত্যাদি। এছাড়াও আরও দু’টি ভারী কণা দেখা যায় যাদেরকে কম্পোজিট কণা বলা হয়,এরা হল ১.ডিউটেরন ও ২.আলফা কণা। এই অস্থায়ী কণাগুলোকে পদার্থের সাধারন অবস্থায় দেখা যায়না; বিষ্ময়কর ব্যপার হল প্রকৃতিতে পদার্থ সৃষ্টি কালীন সময়ে এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আজকের বিজ্ঞান বলছে এরা প্রতিকণারূপে সৃষ্টি হয় এবং সাধারন পদার্থকে ধ্বংস করে অর্থাৎ পদার্থের মধ্যে ভাঙন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে, এবং পুনরায় সংঘটিত হয়। সৌভাগ্যের বিষয় হল এই ভাঙাগড়ার খেলায় গড়ণ প্রক্রিয়াটিই স্থায়ীত্ব লাভ করে।
সূধী পাঠক, আমরা এই যে, স্থায়ী তিনটি কণার পরিচয় পেলাম তন্মধ্যে ইলেক্ট্রন সবচেয়ে হাল্কা,যার ভর ৯.১১x10-28 গ্রাম। এই কণাটি পরমাণুর কেন্দ্রের বাইরে গোলাকার পথে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে যার ফলে পরমাণু একটা স্ফীতাকার আকৃতি ধারণ করে। দূর্ভাগ্যের বিষয় হল এই ইলেক্ট্রনগুলো পরস্পর বিকর্ষণ করে; এই কণাগুলোর প্রত্যেকের চার্জ হল ৪.৮x১০-১০ esu; আবার সৌভাগ্যের বিষয় হল বিকর্ষণ থাকা সত্যেও কোন এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তারা পরমাণুর কেন্দ্রের চারিদিকে ঘূর্ণনরত কক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়না। আবার স্বজাতীয় বা ভিন্নজাতীয় পরমাণুর সঙ্গে রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নতুন নতুন পদার্থের অণু তৈরী করে আমাদের এই বিশ্ব জগৎকে পদার্থের সুষমায় ভরে তুলেছে। কিভাবে এবং কেন এই বৈরী বৈশিষ্ট নিয়েও ধ্বসের পরিবর্তে দৃষ্টিলভ্য অবয়ব গড়ে তোলে তার জবাব আজকের বিজ্ঞানও দিতে পারছেনা, শুধু বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে বলছে এটি প্রকৃতির নিয়ম। জেনে বুঝেও প্রমাণের অভাবে বলতে পারছেনা কোথা হতে এল এই নিয়ম। আমরা একটু আগেই দেখেছি পদার্থ সৃষ্টির সময়েই ধ্বংসের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়;তাহলে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, কিভাবে রক্ষা পায় এই দৃশ্য জগৎ?
সূধী পাঠক, আসুন, এবার দেখি পদার্থের কেন্দ্রের কি হাল অবস্থা। বিজ্ঞান বলছে পরমাণুর কেন্দ্র আরেকটি রহস্যময় সৃষ্টি। বিজ্ঞান আজও এই রহস্য বেধ করতে পারেনি। বিজ্ঞান তার যন্ত্রচোখে যেটুকু দেখছে,তার প্রেক্ষিতে যে কাঠামো তৈরী করে দেখাচ্ছে তাতে পরমাণুর কেন্দ্রটি প্রকৃতপক্ষেই রহস্যময়ভাবেই টিকে আছে। বিজ্ঞান বলছে পরমানুর কেন্দ্রে অবস্থানরত দুই প্রকারের কণার মধ্যে একটি হল প্রোটন যা ধণাত্মক বিদ্যুত দ্বারা আহিত, ফলে পরস্পর বিকর্ষণের ফলে কেন্দ্রের স্থায়িত্ব লাভ একেবারেই অসম্ভব। এছাড়াও প্রোটন থেকে সামান্য ভারী আরেক প্রকার কণা যার নাম নিউট্রন,প্রোটনের পাশাপাশি অবস্থান করে, বিজ্ঞানীরা বলছেন সম্ভবত কেন্দ্রকে স্থিতিশীল করার জন্যেই এই কণার আবির্ভাব। আমরা জানিনা; হয়তোবা বিজ্ঞানের কথাই সত্য কারণ বিজ্ঞান কখনো মিথ্যাকে নীরেট সত্য বলে দাবী করেনা। আবার বিজ্ঞানের অনুমেয় কথাও সত্যের কাছাকাছি; অবশ্য আমরা কোন বিজ্ঞানীর আবেগজড়িত অযৌক্তিক কথাকে মূল্যায়ন করবোনা। যাই হোক,বলছিলাম ধণাত্মক চার্জে আহিত কণার কথা; বিজ্ঞান পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ পেয়েছে যে, যখন কোন পরমাণুর কেন্দ্রকে ভেঙে ফেলা হয় তখন সেখান থেকে প্রচণ্ড শক্তির বিমোচন ঘটে। এই ভাঙন প্রক্রিয়াকে বলে নিউক্লিয়ার ফিসন। আর এই ভাঙ্গন প্রক্রিয়া থেকে একটা মৌলিক বিষয়ে উপনীত হওয়া যায়, তা হল পদার্থ=শক্তি; যা আধুনীক বিজ্ঞানের পথিকৃত বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন তার বিখ্যাত সূত্র e=mc2 সূত্রে দেখিয়েছেন বিজ্ঞানের আরেক চমক। তার এই সূত্র পরীক্ষাঘারে বাস্তবতা পেয়েছে। আবার বিজ্ঞানীরা এই সূত্রের উল্টো বিষয়টাকেও স্বতঃসিদ্ধের ন্যায় মেনে নিয়েছে; অর্থাৎ শক্তি থেকে পদার্থের সৃষ্টি, কিন্তু পরীক্ষাঘারে তার প্রমাণ মেলেনি। সূধী পাঠক একবারও কি মনে পড়না প্রবিত্র কোরআনের সেই মহাণ বাণী; সূরা আয যারিয়াত, আয়াত ৪৭;
وَالسَّمَاء بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ
৫১:৪৭ আমি অসীম শক্তির দ্ধারা আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমি অবশ্যই এর সম্প্রসারক!
তাহলে প্রাসঙ্গিকভাবে বলাচলে শক্তির ঘণায়ন থেকেই এই কণাগুলোর অভুদ্বয় ঘটে। বিজ্ঞানীরা বলছেন ভাঙন প্রক্রিয়ায় একটা নিউট্রন ভেঙে তৈরী তৈরী হয় প্রোটন, ইলেক্ট্রন ও নিউট্রিনো কণা;
n = p+e+নিউট্রিনো
সূধী পাঠক, অতি সম্প্রতি বিজ্ঞান আরেকটি নতুন কণিকার সন্ধান পেয়েছে,যাকে বলা হয় হিগস-বোসন কণা।এক কণা আবিস্কারের মধ্য দিয়ে কণা পদার্থ বিজ্ঞানে যুগান্তকারী বিপ্লব এসেছে। মহাবিশ্বের সৃষ্টিতাত্ত্বিক ধারণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে; একসময়ে বিজ্ঞানের ধারনা ছিল,বিগব্যাঙের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব শূণ্য এক পরিবেশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে; অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে পদার্থের কোন অস্তিত্ব ছিলনা। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান বিজ্ঞানীদের এ্ ধারনা মানতে নারাজ, কারণ তা পদার্থের মৌলিক ধর্ম বিরুদ্ধ। বিজ্ঞানীরা তখন বিগব্যাঙকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্যে মতামত পাল্টে বললেন, বিগব্যাঙ ঘটেছিল শক্তির ঘণায়ন থেকে। কিন্তু শক্তির উৎস খুঁজে না পেয়ে তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি; কারণ বস্তুবাদী বিজ্ঞানীদের মনে একটা সাধারণ অবস্থান কখনোই সৃষ্টি হয়নি, তা হল সেই শক্তির একজন যোগান দাতা; যার অবস্থান বিগব্যাঙের পূর্ব থেকেই ছিল।
ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন বোস ১৯২০ সালে প্রস্তাব করেছিলেন পদার্থের মৌলিক কণিকার মধ্যে অস্থায়ী ভারী কণিকা রয়েছে; তার এই কাল্পণিক কণার নাম দেওয়া হয়েছিল বোসণ কণা। বিজ্ঞান জগতে ঝড় উঠেছিল বটে,তবে প্রমাণের অভাবে তা আলোর মুখ দেখেনি। বহু সাধনা ও পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে ২০১৩ সালে বিশেষ করে বিজ্ঞানী হিগসের সার্থক চেষ্টায় বোসন কণা পরীক্ষা লব্দ বাবে স্বীকৃতি পায়, অস্থায়ী এই কণা আধান নিরপেক্ষ ভারী কণা, জন্মের পরক্ষণে ভেঙে অন্যাণ্ণ মৌলিক কণায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই কণা সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থা যা হতে পারে শক্তির অংশ। সম্ভবত সৃষ্টির শুরু (এক মাত্র মহান স্রষ্টাই জানেন ভাল); বলাচলে বিজ্ঞান জগৎ পরোক্ষভাবে মেনে নিল, শক্তির রূপান্তর থেকেই এই মহাবিশ্বের উন্মেষ। পবিত্র কোরআনতো এ কথাটাই বলে রেখেছে ৫১:৪৭ আয়াতে,(আমি অসীম শক্তির দ্ধারা আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমি অবশ্যই এর সম্প্রসারক);
পদার্থের গঠণকারী কণাদের যে পরিচয় পেলাম,তা আমরা খালী চোখে দেখতে না পেলেও এরা পরমাণুর মধ্যে কোন এলোমেলো অবস্থানে থাকেনা। আমরা জানি সৌরমণ্ডলে গ্রহগুলো সূর্যোকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট নিয়মে প্রদক্ষিণ করে; ঠিক এমনিতর একটা সজ্জায় পরমাণুতে কণাগুলো নিয়মিতভাবে পরমাণুর কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে। বিজ্ঞান তার পরীক্ষালব্দ ফলাফল থেকে পরমাণুর যে চিত্র চিত্রায়ন করেছে তা দেখলে সত্যিকারেই বিষ্ময়ে হতবাক হতে হয়; বিশৃঙ্খলতো নয়ই বরং সুকঠিণ সৃঙ্খলায় আবদ্ধ। পরমাণুতে অবস্থিত ইলেকট্রণ কণাগুলো ছাড়া অন্যান্ন সকল কণাগুলো এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে একটা অতি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে; ইলেকট্রণ কণিকাগুলো কেন্দ্রের বাইরে জোড়ায় জোড়ায় সুবিন্যস্থ হয়ে স্তরে স্তরে অমিয় গতিতে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে। এই গতিপথ বৃত্তাকার হলেও তা কিন্তু একতলীয় অবস্থানে নয়, ত্রিতলীয় বা গোলক আকৃতির হয়ে থাকে; আমরা জানি ইলেক্ট্রনগুলো সমধর্মী আধানে আহিত বলে একে অপরকে বিকর্ষণ করে; ফলে তাদের জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান আরেক বিষ্ময়কর বিষয়।বিজ্ঞান বলছে ইলেকট্রনগুলো সহাবস্থানের জন্য একে অপরের বিপরীত মুখি গতিতে ঘুর্ণনত রত। যাকে স্পিন বলা হয়। বিপত্তির এখানেই শেষ নয়। কেন্দ্রে রয়েছে ধণাত্মক আধান; ঘূর্ণনরত ইলেক্ট্রন গুলোকে প্রচণ্ড শক্তিতে কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করছে। ফলে ইলেক্ট্রনগুলো তাদের কক্ষপথে আর থাকতে পারছেনা। বিজ্ঞান বলছে এই সমস্যা সমাধানে ইলেক্ট্রনগুলো তাদের কক্ষপথে গতিপ্রাপ্ত হয়েছে; ফলে তাদের এই গতির কারণে যে কেন্দ্রাতিগ বল তৈরী হচ্ছে তা ইলেকট্রণের কেন্দ্রমুখী আকর্ষণ বলের সমান। ফলে ইলেক্ট্রন গুলো নিজ নিজ কক্ষে থেকে গ্রহগুলোর মত কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে। এ বিষয়টি অত্যান্ত জটীল গাণিতিক হিসেবের মধ্যে সমন্বিত হয়। সুধী পাঠক, এই যে অতি ক্ষুদ্র একটা পরমাণুর মধ্যে দুই মুখোমুখি বলের সমতা আনয়ন, তা কি স্বতস্ফূর্ত ভাবে বা আপনা আপনি হওয়া সম্ভব। আজকের বিজ্ঞান হন্যে হয়ে্েপ্রশ্নের জবাব খুঁজছে। দিব্যচোখে কোন এক প্রচ্ছন্ন মহা প্রকৌশুলীকে আন্দাজ করা যাচ্ছে কিন্তু দেখা যাচ্ছেনা। আমরা যদি পরমাণু জগতের ক্ষুদ্রতম সদস্য হাইড্রোজেন পরমাণুটিকে নিয়েও একবার ভেবে দেখি দেখতে পাবে প্রকৌশল জগতের কত নিপুণ দক্ষতার পরিচয় বয়ে বেড়াচ্ছে এই ক্ষুদ্রতম কণাটি; আমরা যতই জটীলতর কণার দিকে এগুবো ততই বিষ্ময়ে হতবাক হতে হবে, দেখতে পাবো নানা রকম জটীলতর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সজ্জিত হয়েছে এই পরমানু জগৎ, স্রষ্টায় অবিশ্বাসী বিজ্ঞনীগনও আজ বিষ্ময়ে বলতে বাধ্য হচ্ছে যে, প্রকৃতির কোন সৃষ্টিই অচিন্তিত নয়, অত্যান্ত সুচিন্তিত সুশৃঙ্খল পদ্ধতীতে সৃষ্ট হয়েছে, যেখানে নেই কোন বিশৃঙ্খলা।
সূধী পাঠক আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল প্রকৃতিতে সুশৃঙ্খল কাঠামো; তারই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পেলাম,পদার্থের সুক্ষতম কণা পরমাণুটি কোন বিশৃঙ্খল সৃষ্টি নয়, আমরা এ পর্যোন্ত পরমাণুর অভ্যান্তরে কিছু সুক্ষ কণার সন্ধান পেয়েছি, তাদের মধ্যে বৈরীতা থাকা সত্যেও কোন এক অজ্ঞাত প্রভাবে পাশাপাশি অবস্থানের কথা জেনেছি; কিন্তু তাদের মনমুগ্ধকর অবস্থানের নকসা দেখিনি; আমরা এবার প্রকৃতিতে মৌলিক কাঠামো দেখবো। বিজ্ঞানীদের ধারনা মতে এ পর্যোন্ত আবিস্কৃত পদার্থের মধ্যে হাইড্রোজেন পরমানুটিই ক্ষুদ্রতম ও মৌলিক পদার্থ। প্রকৃতিতে এই পরমানুটি মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়না; যুগল ভাবে অণুর আকৃতিতে থাকে। সূধী পাঠক এই অনু গঠণও প্রকৃতির আরেক বিষ্ময়। এই অনুটিকে লিখা হয় H2 আকারে, অর্থাৎ একটি হাইড্রোজেন গ্যাসের অণুতে দু’টি পরমাণুর সংস্থান হয়েছে। বিজ্ঞানের ধারনামতে হাইড্রোজেন পরমানু আধান নিরপেক্ষ মৌলিক পদার্থ। অথচ এই পরমানু দু’টি এক অলৌকিক আবহমণ্ডলে আধান সম্পর্কে একে অপড়কে জড়িয়ে অনু গঠন করে পদার্থের রূপ নেয়; অর্থাৎ অনুভূতির জগতে আসে। আর এই অনুটির কাঠামো এতটাই সুনিয়ন্ত্রিত গাণিতিক সঠিকতায় সুসামঞ্জস্য পূর্ণ যে, বিজ্ঞান স্তম্ভিত হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে আর বলে, প্রকৃতির নিয়মেই তারা এমন আকৃতিতে আবদ্ধ। সূধী পাঠক,বিজ্ঞান এই পরমানু জগতে ঘুরাফেরা করে যৎসামান্যই অনুধাবন করতে পেরেছে আর তারই ফলশ্রুতিতে মনব সমাজ প্রকৃতিতে সৃষ্টির কৌশল সম্পর্কে যতই জানতে পারছে ততই মুগ্ধবিষ্ময়ে হতবাক হচ্ছে। যা আমাদের চোখে এত নগণ্য ছোট্ট এক কণা,তা বিজ্ঞানের চোখে এক বিশাল সাম্রাজ্য,পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত। বিজ্ঞান বলছে এক একটা পরমানুর কেন্দ্র যেন শক্তির ভাণ্ডার,ঘূর্ণায়মান এক একটা ইলেকট্রণ যেন ক্ষুদে গ্রহ। ইলেক্ট্রন গুলোর মধ্যে যেন অনন্ত শূণ্যতা। বিজ্ঞান স্তম্ভিত হয়ে শুধু ভাবে প্রকৃতিতে কিভাবে এই বিণ্যাস সৃষ্টি হল, শুধু তাই নয়,বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা জানি পরমানুরা মৌলিক অবস্থায় স্বাধীন ভাবে ঘুরাফেরা করতে পারেনা। প্রকৃতিতে তাদের অবস্থান যৌগিক অবস্থায় রয়েছে। মৌলিক পদার্থের যৌগিক অবস্থা নিয়ে বিজ্ঞান আরও স্তম্ভিত। এই অল্প সংখ্যক মৌলিক পদার্থ যৌগিক পদার্তের যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে তা বিজ্ঞানকেও ভাবিয়ে রেখেছে,বিজ্ঞান স্তম্ভিত হয়ে শুধু ভাবছে কোন অমোঘ নিয়মে মৌলিক পদার্থগুগলোর মধ্যে এ সম্মিলন সম্ভব হচেছ। সূধী পাঠক, একটু ভাবনার মন নিয়ে তাকিয়ে দেখলেই স্তম্ভিত হয়ে ভাবেতে থাকবেন কিভাবে এবং কেন এই সাম্যাজ্য গড়ে উঠলো। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন এই সবকিছুই কোন না কোন প্রাণের প্রয়োজনে অত্যান্ত সুকৌশলে কোন এক মহা কুশলীর সুদূর পরিকল্পনায় সৃষ্টি করেছেন। আজকের বিজ্ঞান হলফ করে বলছে যে,এই সৃজনশীলতা অত্যান্ত জটীল গাণিতিক হিসেবের মধ্যে এই মনোরম কাঠামো জগৎ সৃষ্টি কোন মানবীয় অভিধার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
সূধী পাঠক আমরা উপরে যে চিত্রটি দেখলাম তা বিজ্ঞানীদের কাল্পনিক চিত্র,যা সত্যের কাছাকাছি । আমরা দেখলাম একটা হাইড্রোজেন পরমানুর কেন্দ্রে একটিমাত্র প্রোটন আর তার চারিদিকে একটিমাত্র ইলেক্ট্রন প্রচণ্ড গতিতে ঘূর্ণনরত,এই পরমানুটির কেন্দ্রে কোন নিউট্রন নেই। অতি সহজ ও সাধারণ এর দৈহিক কাঠামো। মঝার বিষয় হল প্রকৃতিতে এটিই প্রথম সৃষ্ট পরমাণু; অত্যান্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর এটিই প্রথম উৎপাদিত মৌলিক পদার্থ। আমরা সঠিকভাবে জানিনা এর জন্ম কিভাবে হয়েছিল; তবে বিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী বিগব্যাঙ থেকে সৃষ্ট ভ্রূণ মহাবিশ্বে শক্তির বিবর্তন থেকে সৃষ্টি হয় এই উপাদানটি। অর্থাৎ মহাজাগতিক বস্তুনিলয় সৃষ্টির এটিই প্রথম কাঁচামাল। বিজ্ঞান আরও বলছে নিহারীকা নামক ধূম্র কুণ্ডলী থেকে জন্ম নিয়ে নক্ষত্র গুলেতে প্রথম সৃষ্টি হয় এই হাইড্রোজেন পরমানু, যা জ্বালানীরূপে নক্ষত্রের মধ্যে জলতে থাকে। অর্থাৎ নক্ষত্রের মধ্যে চলে বিবর্তনের ধারায় রূপান্তরের পালা। ফিসন পদ্ধতিতে দুইটি হাইড্রোজেন পরমানুর কেন্দ্র মিলিত হয়ে তৈরী করে তুলনামূলক ভারী হিলিয়াম পরমানু, ফলে কিছু পরিমান শক্তি উচ্ছিষ্টরূপে বেরিয়ে আসে শক্তিরূপে, যা নক্ষত্রের মধ্যে প্রজ্বলন ঘটায় এবং এই প্রজ্বলন নক্ষতের মধ্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করে। সূরা সাবার ৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَأْتِينَا السَّاعَةُ قُلْ بَلَى وَرَبِّي لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَالِمِ الْغَيْبِ لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَلَا أَصْغَرُ مِن ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرُ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
৩৪:৩ কাফেররা বলে আমাদের উপর কেয়ামত আসবে না। বলুন কেন আসবে না? আমার পালনকর্তার শপথ-অবশ্যই আসবে। তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত। নভোমন্ডলে ও ভূ-মন্ডলে তাঁর আগোচরে নয় অণু পরিমাণ কিছু, না তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এবং না বৃহৎ-সমস্তই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।
বস্তুবাদী বিজ্ঞানীরা বলছেন,প্রকৃতিতে হাইড্রোজেন পরমাণু প্রথম সৃষ্ট মৌল, এটি সৃষ্টির জন্যে কোন স্রষ্টার প্রয়োজন হয়নি, এটি মহাজাগতিক ক্রিয়া কর্মের ফলে আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে; তারপর বিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছে সকল বস্তুনিলয়। এমতাবস্থায় আমরা যদি ধরেও নেই যে, প্রকৃতিতে হাইড্রোজেন পরমাণু স্বতস্ফূর্ততার ফসল; তাহলে একটা সরল বিষয় আমাদের সামনে পরিস্কার হয়ে আসে এই যে, প্রকৃতি তার সাধারণ নিয়মেই উৎপাদ তৈরী করতে থাকবে। ব্যতিক্রম যদি কিছু ঘটাতে হয় তবে কোন বিশেষ নির্বাচন প্রয়োজন আর তারজন্যে চাই সেই বিশেষ নির্বাচনের উদ্যোক্ততা। তা নাহলে প্রকৃতিতে শুধু হাইড্রোজেন পরমাণুই থাকতো,অন্য কোন মহাজাগতিক পদার্থ সৃষ্টি হতোনা; আমরা কিন্তু প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই সাধারণ নিয়মের ব্যাতিক্রম দেখতে পাই। তাহলে এই ব্যাতিক্রম আসে কোথাথেকে।আবার ব্যতিক্রমকে যদি সাধারণ নিয়মে ফেলি তহলে প্রকৃতির নিয়মকে সুশৃঙ্খল বলা চলেনা। বিজ্ঞান তার পরীক্ষালব্দ ফলাফল দ্বারা এমনটা স্বীকার করেনা। আমরা প্রকৃতিতে সৃষ্ট প্রথম মৌল হাইড্রোজেনের বেলায়ও এমনটা দেখতে পাই। এই অতি সরল পরমাণুটিতে আছে একটি মাত্র প্রোটন ও একটি ইলেক্ট্রণ। যৌক্তি কারণেই এর মধ্যে কোন নিউট্রনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিজ্ঞান তার পরীক্ষা পর্যোবেক্ষন থেকে বলছে যে হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যেও মাঝে মাঝে এক বা একাদিক নিউট্রন দেখা যায়,যা প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম। মনে হয় যেন কোন মহা কুশলীর স্বাধীন ক্ষমতা ও দক্ষতার পরিচয়; সাধারণ নিয়মের মাঝে ব্যতিক্রম; এমনটা প্রকৃতিতে সকল সৃষ্টির মাঝেই প্রকটভাবে দেখতে পাওয়া যায়। ফলে এমনটা বলা চলেনা যে এই প্রকৃতি, এই সৃষ্টিমালা কোন পরিকল্পনা বিহীন ভাবে সৃষ্টি হয়েছে। যদি তাই হত তবে অবশ্যই প্রকৃতিতে সৃষ্টির কোন ধারাবাহিকতা থাকতোনা; কারণ শত সহস্র উপাধানের সংমিশ্রনে সততই এলোমেলো বস্তর বিন্যাস ঘটতো। থাকতোনা কোন সুশৃঙ্খলা।একটু ভাবলেই পরিস্কার বুঝাযায়,এই নিরন্তর সৃষ্টির লহরীতে অবশ্যই নিয়ন্ত্রন থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রন বিহীন ভাবে এত সুন্দর মনলোভা কাঠামোতো সৃষ্টির বিবর্তন ঘটতোনা। নিয়ন্ত্রন ও স্বাধীন ইচ্ছার সংমিশ্রনেই প্রকৃতিতে চলছে সৃষ্টির ক্রম বা বিবর্তনের ধারা। স্বতস্ফূর্ততার অবয়বে কখনোই প্রকৃতি হয়ে উঠতোনা এত সুন্দর। বস্তবাদের প্রবর্তকরাই সৃষ্টির প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন সুশৃক্ষলা দেখে বিষ্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন এই ভেবে যে, এমনটা হয় কি করে? মানুষকে এই বিভ্রান্তির হাত থেকে মুক্তি দিতে এই বিভ্রান্তি তৈরীর বহু পূর্বেই প্রবিত্র কোরআন বলছে;
الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ
৮২:৭ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন।
فِي أَيِّ صُورَةٍ مَّا شَاء رَكَّبَكَ
৮২:৮ যিনি তোমাকে তাঁর ইচ্ছামত আকৃতিতে গঠন করেছেন।
নীচের আয়াতটি লক্ষ্য করুন; সূরা হা-মীম সেজদা,আয়াত ১১;
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاء وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ اِئْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ
৪১:১১ অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রকুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম।
قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللَّهُ يُنشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
২৯:২০ বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুর্নবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম। -সূরা আল আনকাবুত
أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ بَلْ هُمْ فِي لَبْسٍ مِّنْ خَلْقٍ جَدِيدٍ
৫০:১৫ আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি? বরং তারা নতুন সৃষ্টির ব্যাপারে সন্দেহ পোষন করেছে। -সূরা কাফ
সূধী পাঠক,মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর সর্বপ্রথম উৎপাদিত পরমাণুটির সম্মন্ধে যৎসামান্য আলোচনা দেখলাম,বিজ্ঞান এটি সম্পর্কে এ পর্যোন্ত যতটুকু জেনেছে তাতেই বহু পৃষ্টার গন্থ তৈরী হয়ে যাবে;যাইহোক আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছিনা,আমাদের লক্ষ্য হল,এ সকল সৃষ্টির পিছনে যে কোন মহা কুশলীর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে-সেই পরিচয় জানা। আমারা উদাহরণস্বরূপ হাইড্রোজেন পরমাণুর কাঠামো ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে সমান্য জানলাম। এবার আমরা একটা অতি সাধারন যৌগিক অণু সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করবো। এই যৌগটি আমাদের অতি পরিচিত,সহজলভ্য ও আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। যৌগটির পরিচিতি নাম হল ‘পানি’; পানি ছাড়া আমাদের জীবন একেবারেই অচল। এই পদার্থটিকে চেনেনা এমন কউ বোধহয় পৃথিবীতে নেই,কারণ প্রতিটা প্রাণী তার জন্ম থেকেই প্রায় ৭০ ভাগ পানি তার দেহে ধারন করে।
পানির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল তার পর্যাপ্ততা; প্রকৃতিতে এর পরিমান এতটাই বেশী যে,অন্য কোন পদার্থের সাথে আনুপাতিক সম্পর্ক অতি নগন্য। পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্র জুড়েই রয়েছে পানি। আজ বিজ্ঞানের কাছেও এ এক বিশাল প্রশ্ন; কেন এত পানির সমাগম হল, কিভাবেই বা হল। বিজ্ঞান কৌতুহলী হয়ে অনেক চিন্তভাবনা করে দেখেছে,কিভাবে এত পানির সমাগম হল। আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটির সৃষ্টি তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখাগেছে, সৃষ্টি থেকে এ পর্যোন্ত পৃথিবীতে পানি উৎপাদণের কোন পরিবেশষই সৃষ্টি হয়নি,পাচুর্যোতার কথাতো আসেইনা। বিজ্ঞান বলছে নক্ষত্র থেকে ছিটকে পরা জ্বলন্ত অগ্নি গোলকটির মধ্যে ছিল সব জ্বলন্ত হাইড্রোজেন পরমানু। এই হাইড্রোজেন পরমানুগুলোই বিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি করেছে অন্যান্য ভারী মৌল; বিজ্ঞান বলছে,পানিতে উপস্থিত অক্সিজেন মৌলটি পৃথিবীর পরিবেশে এসেছে অনেক দেরীতে। বিজ্ঞানের দাবী পৃথিবীতে প্রাথিমিক পর্যায়ের প্রাণীগুলো অক্সিজেন নির্ভর ছিলনা। অর্থাৎ প্রাণ সৃষ্টির প্রয়োজনে পাণির আগমন গঠেছে প্রাণ সৃষ্টিরও অনেক আগে। বিজ্ঞান চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা নীরিক্ষরর মাধামে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, পানি আমাদের পৃতিবীতে এসেছে বহির্জগৎ থেকে। কিন্তু তার উপযুক্ত প্রমান পাচ্ছিলনা। অতি অধুনা বিজ্ঞান মহাকাশে বরফ সমৃদ্ধ ধুমকেতুর সন্ধান পেয়েছে। বিজ্ঞান মনে করছে কোন এক সময়ে ভ্রমনকালে এই ধূমকেতুগুলো থেকেই পৃথিবীতে বরফ তথা পানির আগমন ঘটেছে। এই হল আজকর বিজ্ঞানের ধারনা- সূধী পাঠক শুনলে হয়তো অবাক হবেন, ১৪০০ বছর আগে বিজ্ঞান যখন আতুরঘরে তখনই পবিত্র কোরআন বলে রেখেছে হুবহু একই কথা; লক্ষ্য করেুন নীচের আয়াত গুলো;
أَمَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنزَلَ لَكُم مِّنَ السَّمَاء مَاء فَأَنبَتْنَا بِهِ حَدَائِقَ ذَاتَ بَهْجَةٍ مَّا كَانَ لَكُمْ أَن تُنبِتُوا شَجَرَهَا أَإِلَهٌ مَّعَ اللَّهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ يَعْدِلُونَ
২৭:৬০ বল তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে বর্ষণ করেছেন পানি; অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিই তোমাদের নেই। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তারা সত্যবিচ্যুত সম্প্রদায়। সূরা- নমল
اللَّهُ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَيَبْسُطُهُ فِي السَّمَاء كَيْفَ يَشَاء وَيَجْعَلُهُ كِسَفًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ فَإِذَا أَصَابَ بِهِ مَن يَشَاء مِنْ عِبَادِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
৩০:৪৮ তিনি আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চারিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টিধারা। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা পৌঁছান; তখন তারা আনন্দিত হয়। – সূরা- আর রূম
লক্ষ করুন আয়াত ২৭:৬০; বলা হয়েছে, ‘কে সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে বর্ষণ করেছেন পানি;’ এখানে যে বিষয়টি লক্ষনীয় তা হল নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টির পর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন; এই পানি বর্ষণ কোন ক্রমেই বৃষ্টি পতনের কথা নয়; কারণ ৩০:৪৮ আয়াতে মহান আল্লাহ মেঘমালা থেকে কিভাবে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় তার বর্ণনা দিয়েছেন। ২৭:৬০ আয়াতে মহান আল্লাহ ভূপৃষ্ঠে পানি সমাগমের কথা বলেছেন; আর ৩০:৪৮ আয়াতে বলেছেন সেই পানিকে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিরূপে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা; যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে মনোরম বাগান। ৩০:৪৮ আয়াতের দ্বিতীয় অংশে তা সুস্পষ্ট। ‘অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি’, কি বিষ্ময়কর ইঙ্গিত? এখানে পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে যে, পৃথিবী সৃষ্টির পরে তাতে মাহাকাশের অন্য কোন স্থান থেকে পানি সঞ্চার করেন। আর সেই পানির সাহায্যে আমাদের পৃথিবী প্রাণময় হয়ে উঠেছে। এই আয়াতে পানিচক্রের কথা বলা হয়নি; লক্ষ্য করুণ নীচের দু’টি আয়াতে পানিচক্রের কথা বলা হয়েছে।
وَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاء مَاء بِقَدَرٍ فَأَسْكَنَّاهُ فِي الْأَرْضِ وَإِنَّا عَلَى ذَهَابٍ بِهِ لَقَادِرُونَ
২৩:১৮ আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে থাকি পরিমাণ মত অতঃপর আমি জমিনে সংরক্ষণ করি এবং আমি তা অপসারণও করতে সক্ষম। -সূরা আল মুমিনুন
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَصْبَحَ مَاؤُكُمْ غَوْرًا فَمَن يَأْتِيكُم بِمَاء مَّعِينٍ
৬৭:৩০ বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদেরকে সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ أَنزَلَ مِنَ السَّمَاء مَاء فَسَلَكَهُ يَنَابِيعَ فِي الْأَرْضِ ثُمَّ يُخْرِجُ بِهِ زَرْعًا مُّخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَجْعَلُهُ حُطَامًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَذِكْرَى لِأُوْلِي الْأَلْبَابِ
৩৯:২১ তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর সে পানি যমীনের ঝর্ণাসমূহে প্রবাহিত করেছেন, এরপর তদ্দ্বারা বিভিন্ন রঙের ফসল উৎপন্ন করেন, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তোমরা তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। এরপর আল্লাহ তাকে খড়-কুটায় পরিণত করে দেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমানদের জন্যে উপদেশ রয়েছে।
সূধী পাঠক, আমরা উপরে পানির অণু ও তাদের সঙ্ঘবদ্ধতার কিছু চিত্র দেখলাম। পানির এই গঠণ সত্যিকারেই অত্যান্ত বিষ্ময়কর। পানি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞান নিজেও স্তম্ভিত হয়ে গেছে। তাদের ভাবতে হয়েছে, প্রকৃতিতে কিভাবে এতটা মানানসই ভাবে পানি সৃষ্টি হয়েছে। যেভাবে প্রয়োজন ছিল ঠিক যেন সেভাবেই সৃষ্টি হয়ে আছে; এতটা যুগোপযুগী হওয়ার মধ্যে নিশ্চই কোন সুক্ষ পরিকল্পনা রয়েছে এ কোন রকমেই স্বতঃস্ফূর্ততার অবদান হতে পারেনা। আর যদি বলেনও যে পানি প্রকৃতিতে স্বতস্ফূর্তভাবেই এসেছে, তবে আরেকবার ভেবে দেখুননা! আমরা জানি,বিজ্ঞানের ধারনামতেই স্বতস্ফূর্ত সৃষ্টি স্থিতিশীল নয়; সময়ের বিশাল পরিসরে তার মধ্যে আসবে বিবর্তন, তার অবয়ব রূপান্তরের ধারায় হয়তোবা অন্য কোন পদার্থে পরিবর্তীত হয়ে যাবে। আমরা জানিনা পৃথিবীতে কখন পানি এসেছে,তার সুক্ষ হিসেব বিজ্ঞানও করতে পারেনি,তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে একটা বিশাল সময়ের পরিসরেও পানির মধ্যে কোন বিবর্তন আসেনি। এই যে বিবর্তন কথাটা বলা হল তাতে হয়তো বলবেন যে,বিজ্ঞানের ভাষায় বিবর্তন হয় প্রাণী জগতে,বস্ত জগতে নয়। সূধী পাঠক কথাটি সঠিক নয়; সময়ের পরিসরে সকল বস্তুর মধ্যেই বিবর্তন ঘটে; এটা সৃষ্টিরই ধর্ম; পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সৃষ্ট বস্তুর বৈশিষ্টের মধ্যেও পরিবর্তণ আসে। তবে এই পরিবর্তণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনা, আসে সুচিন্তিত কাঠামো অনুযায়ী, যেমনটা।ব্যাবহারিক তৈজসপত্র পস্তুতকারকরা তাদের তৈরী জিনিসের মান প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করে থাকে। তবে পানির গাঠনিক কাঠামেতে যে এ পর্যোন্ত কোন পরিবর্তন আসেনি তা আমরা যথাস্থানে আলোচনা করবো। আরেকটা বিষয় লক্ষনীয় যে,প্রকৃতিতে নানা তরল পদার্থের মধ্যে পানির পর্যাপ্ততা উল্যেখযোগ্য; বিজ্ঞান বলছে এই পর্যাপ্ততা পানির প্রয়োজনের অনুপাতেই হয়েছে; যদি তাই হয়, তবে্ এবারও বলা যায় যে এই বস্তুটি প্রকৃতিতে স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি নয় কারণ প্রকৃতিতে অনুপাত নির্ণয় করার মত কোন গাণিতিক মেধার উপস্থিতি আছে বলে বিজ্ঞানও বলতে পারেনা! আর যদি ধরে নেওয়া হয় যে,তেমন কোন সত্ত্বার উপস্থিতি রয়েছে তাহলে সেই স্বত্ত্বাকেই আমাদের প্রাতঃনমস্কার। আমরা তাকেই প্রতিনিয়তঃ খুঁজে ফিরছি। পানির এই পর্যাপ্ততা আমদেরকে তার যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। আর সেজন্যে পানির সৃষ্টিকারককে আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রণাম।
পানি নিয়ে আমাদের এইযে হেলা ফেলা,এই যে তার বিপুল সমাহার,আসুননা একবার ভেবে দেখি এই পানি স্রষ্টার কত বড় উপহার! পানির মাহাত্ম দেখে আজকের বিজ্ঞানও স্তম্ভিত। বহু পরীক্ষা নীরিক্ষার পরেও বিজ্ঞান বলতে বাধ্য হচ্ছে এই অফুরন্ত পানি প্রকৃতিতে এক বিশেষ সৃষ্টি। বিজ্ঞান আজ একমত যে প্রকৃতির এই সৃষ্টি ধারা কোন বিশৃঙ্খল ব্যবস্থা নয়। সুকঠিন বিধি বিধানের মধ্যেই সৃষ্টির প্রসারতা। সুশৃঙ্খল বিশ্বজগতে সৃষ্টি বিশৃঙ্খল হতে পারেনা এটাই ভাবুকদের ধারনা; তবে কিছু কিছু আবেগপ্রবন লোকের ধারনায় এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা একটি লক্ষ্যনীয় বিষয়। যে ধারাবাহকিতার উপর নির্ভর করে পৃথিবী বিখ্যাত বিবর্তণ বাদের উণ্মেষ ঘটেছে,সৃষ্টি জগৎ আপনার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে,তা প্রকৃতির নিয়ম হতে পারেনা। সুশৃঙ্খলার মধ্যে কখনো স্বতঃস্ফূর্ততা থাকেনা; একটা সুশৃঙ্খল পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাই বিবর্তনকে নিয়ন্ত্রন করে। তদুপরি আপনি যখন কোন পরিবর্তন দেখেন তখন থমকেতো যেতেই হয়! আজকের বিজ্ঞানও তেমনি করে থমকে থমকে উঠে। যখন কোন সমাধান পায়না তখন প্রকৃতির খেয়াল বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়। আসুন দেখি পানিও তেমনি প্রকৃতির খেয়ালের কোন সৃষ্টি কি না?
পানির সৃষ্টি বিন্যাস লক্ষ্য করুন- পানির মধ্যে রয়েছে দুইটি মৌলিক পদার্থ একটি হল হাইয্রোজেন (H) অপরটি হল অক্সিজেন (O) । বিজ্ঞানীদের ভাষায় এই দুইটি মৌলিক পদার্থ রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যামে পানির সৃষ্টি করে। পরীক্ষা থেকে এও জানা যায় যে এই দুইটি মৌলকে মিশ্রিত করে আগুনের সংস্পর্শে নিলে বিক্রিয়া করে পানি উপন্ন করে। এবার দেখাযাক বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে মৌল দুইটির ভর ও ধর্ম অনুযায়ী অবস্থান কোথায়। ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে রাশিয়ান রসায়নবিদ মেন্ডেলিফের সাজানো ছকে হাইড্রোজেনের অবস্থান সর্ব প্রথমে কারণ এটি হল প্রকৃতিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমানু,যার কেন্দ্রে একটিমাত্র প্রোটন ও এর ওজন ধরা হয় ১ একক। এই প্রোটন সংখ্যার উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিণ্যাস করতে গিয়ে অক্সিজেন স্থান পেল ৮ নং শ্রেণীতে আর এর ওজন হল ১৬ একক,অর্থাৎ হাইড্রোজেনের তুলনায় ষোল গুন ভারী। এর ঠিক আগের শ্রেণীতে রয়েছে নাইট্রোজেন আর পরের শ্রেণীতে ফ্লোরিন। ধর্মের সাদৃশ্যতার কারনে অক্সিজেনের পরের পর্যায়ে স্থান পেয়েছে সালফার তারপর সেলেনিয়াম,এমনি করে রয়েছে টেলোরিয়াম,পোলনিয়াম। অপরদিকে প্রোটন সংখ্যায় হাইড্রোজেনের পরবর্তী মৌলটি হিলিয়াম একেবারে নিস্ক্রিয় পদার্থ। ধর্মের সাদৃশ্যতায় একদিকে রয়েছে লিথিয়াম,সোডিয়াম,পটাশিয়াম এদের ক্রম অপর দিকে রয়েছে ফ্লোরিন, ক্লেরিন, ব্রোমিন এর ক্রম।
এবার দেখাযাক হাইড্রোজেন যখন অক্সিজেন ও তার সমধর্মীয় মৌলের সাথে বিক্রিয়া করে যৌগ গঠন করে তখন তাদের কি কি সাদৃশ্যতা দেখা যায়। অক্সিজেন ও সালফার এর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় মিল। হাইড্রোজেন সালফারের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপন্ন করে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস যার বাস্পীভবন তাপমাত্রা -৫৯০ সেলসিয়াস। অপর দিকে হাইড্রোজেন অক্সাইড বা পানি সাধারন তাপমাত্রায় তরল পদার্থ ও এর স্ফূটনাঙ্ক ১০০ সেলসিয়াস।
এবার দেখি অক্সিজেনের নিকটাত্মীয়দের সাথে হাইড্রোজেন যৌগ গঠন করলে কি হয় তাদের বৈশিষ্ট।
হাইড্রোজেন অক্সাইড বা পানি বাস্পীভবন তাপমাত্রা ১০০ সেলসিয়াস
হাইড্রোজেন ব্রোমাইড বাস্পীভবন তাপমাত্রা -৬৬০ সেলসিয়াস
হাইড্রোজেন ক্লোরাইড ” -৮৫০ ”
যদিও পানির স্ফূটনাঙ্ক ১০০০ সেলসিয়াস তথাপি পানি যে কোন তাপমাত্রায় বাস্পীভূত হয়। এর কারন কি বিজ্ঞানীদের কাছে আছে। পানির নিকটাত্মীয় এ্যামোনিয়া হাইড্রোজেন সাইফাইড,হাইড্রোজেন ব্রোমাইড,হাইড্রোজেন ক্লোরাইড সাধারন তাপমাত্রার বহুপূর্বেই বাস্প। পানির বেলায়ও এটাই হওয়ার ছিল, সাধারন তাপমাত্রার বহু পূর্বেই পানির সকল মজুদ শেষ হয়ে এই জলে ভেজা সুন্দর পৃথিবীখানা হয়ে যেত চন্দ্রপৃষ্ঠের ন্যায় মরুভূমি। অন্য গ্রহ থেকে ভিন মানুষ দেখত চড়কা দিয়ে সূতাকাটার আরেক বুড়িকে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, কেন এই বৈষম্য? প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করে কোন্প্রয়োজনে এই ব্যতিক্রম দেখা দিল,কার ইশারায় দূর্লংঘ্য নিয়ম ভেঙ্গে গেল? বিজ্ঞানীরা বহু পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জানতে পেলেন,পানির মধ্যে বিধাতার এক বিশেষ দান লুকিয়ে আছে যার নাম হাইড্রোজেন বন্ড। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলিত হয়ে অণু গঠন করতে এর কোন ভূমিকা নেই,অথচ এর বিশাল কুদরতি ভূমিকা রয়েছে তরল পানি তৈরী করতে। শুধু তাই নয় পরে এই হাইড্রোজেন বন্ড এর আরো অনেক মাযেযা দেখতে পাবো। আপাতত এইটুকু জেনে রাখি,পানিতে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন পরমাণুতে এই নিঃস্প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পর্কটুকু প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দিয়েছে এক অপার সম্পর্ক। এই সামান্য একটা বাঁধনের কাছে আমাদের এই পৃথিবীর সমগ্র সৃষ্টিকুল ঋণের জালে আবদ্ধ।
এইযে বন্ধনের কথা বলাহল,পদার্থ সংঘঠনে বন্ধন ধিাতার দেওয়া আরেক মাযেযা। সময় সুযোগে এ নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো,আপাতত হাইড্রোজেন বন্ধন সম্পর্কে খানিকটা জেনে রাখি। তরল পানি ও জলীয়বাস্প এ দুইয়ের মধ্যে দৃশ্যত একটা পাথ্যক্য রয়েছে, একটা তরল,নানা গুণাগুণে সমৃদ্ধ,আরেকটি গ্যাসীয়, পানির মত সহজে ব্যাবহার করা যায়না; বাস্তবে এই দু’টি একই রাসায়নিক পদার্থ; শুধুমাত্র ভৌত অবস্থার হেরফের আর এই পার্থক্যের কারণ হাইড্রোজেন বন্ধন। যখন পানির অণুগুলো হাইড্রোজেন বন্ধন থেকে বিমুক্ত হয়ে যায় তখন তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস্পীয় আকার ধারন করে। এখন জানার বিষয় হল এই হাইড্রোজেন বন্ধন কিভাবে গঠিত হয়? আমাদের এই অবারিত প্রকৃতিতে অসংখ্য যৌগিক পদার্থের ছড়াছড়ি,তন্মধ্যে যেগুলোর গঠণপ্রক্রিয়ায় সংযুক্ত পরমানুগুলোর মধ্যে যথেষ্ট তড়িৎঋণাত্মকতার পার্থক্য থাকে তাদের ক্ষেত্রেতড়িৎঋণাত্মক পরমানুর আকর্ষণে সংযুক্ত অপর পরমাণুগুলোর শেয়ারকৃত ইলেকট্রণ জোড়া তার দিকে আংশিক ভাবে ঝুঁকে থাকে ফলে তড়িৎঋণাত্মক পরমাণুটিতে আংশিক ঋণাত্মক চার্জ ও অপরটিতে আংশিক ধনাত্মক চার্জ উৎপন্ন হয়। এইভাবে সমজোযী অণুটিতে দু’টি পোল বা মেরুর সৃষ্টি হয়। অণুতে এই ধরনের মেরুকরণ হলে তাকে ডাইপোল বলে। প্রতিটি ডাইপোল একের ধনাত্মক মেরু অপরের ঋণাত্মক মেরুর সাথে একটা দূর্বল আকর্ষণী শক্তিতে আবদ্ধ হয়; পরিপূর্ণ বন্ধন গঠণ করতে পারেনা। এইভাবে অণুতে অণুতে ডাইপোল জালিকা তৈরী করে। এই আকর্ষণী বন্ধনকেই বলে হাইড্রোজেন বন্ড। একই ভাবে এ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেনফ্লোরাইড যৌগে হাইড্রোজেন বন্ড উৎপন্ন হয়। এই হাইড্রোজেন বন্ড ভাঙতে প্রতি মোল যৌগের জন্য প্রয়োজন হয় ২০-৫০ কিঃ জুল শক্তি আর সমযোজী বন্ধন ভাঙতে লাগে ১০০-৯০০ কিঃ জুল। এই কারণে হাইড্রোজেন বন্ডের প্রভাবে পদার্থের ভৌত ধর্মের পরিবর্তন হলেও রাসায়নিক ধর্মের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনা। হাইড্রোজেন বন্ড সমৃদ্ধ যৌগের ভৌত ধর্মের বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। পরিবর্তন গুলি নিম্নরূপ:-
১. হাইড্রোজেন বন্ধন থাকলে পদার্থের স্ফূটনাঙ্ক বৃদ্ধি পায়- এই বন্ধনের উপস্থিতির ফলে পানির স্ফূটনাঙ্ক ১০০০ সেলসিয়াস, কিন্তু হাইড্রোজেন সালফাইডে এই বন্ধন নেই,তার স্ফূটনাঙ্ক -৬০০ সেলসিয়াস। মিথেন গ্যাসে হাইড্রোজেন বন্ধন নেই,তার স্ফূটনাঙ্ক -১৬০০ সেলসিয়াস কিন’ এ্যামোনিয়া গ্যাসে এই বন্ধন থাকায় তার স্ফূটনাঙ্ক -৩০০ সেলসিয়াস অনুরূপ ভাবে হাইড্রোজেন ফ্লোরাইডে এই বন্ধন থাকায় তার স্ফূটনাঙ্ক ২৫০ সেলসিয়াস।
২. এর প্রভাবে পদার্থের গলনাঙ্ক,বাস্পীকরণ তাপ প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়।
৩.এই বন্ধনের কারনে পানির পৃষ্টটান খুব বেশী। এই উচ্চ পৃষ্টটানের কারনে পানি গাছের মূল দিয়ে প্রবেশ করে কাণ্ডের মাধ্যামে উপড়ে উঠতে পারে,ফলে গাছ বেঁচে থাকে। আমরা সাধারনভাবেই জানি গাছ বেঁচে থাকার জন্যে পানি অত্যান্ত জরুরী। পানির এই উচ্চপৃষ্ঠটান না থাকলে হয়ত পৃথিবীতে উদ্ভিদ জন্মাতেই পারতোনা। পানির এই বিশষ গুণাগুনের কারণেণেই উদ্ভিদের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে।
সূধী পাঠক এই হাইড্রোজেন বন্ধনের আরেক চমক হল বরফ। বিধাতার কতবড় রহমত লুকিয়ে আছে এই ছোট্ট একটি দূর্বল সম্পর্কের মধ্যে তা নিম্নের আলোচনা থেকে বুঝা যাবে।
আমরা জানি পানির অণুতে একটি অক্সিজেন পরমাণু দইটি হাইড্রোজেন পরমানুর সাথে সমযোজী বন্দন দ্বারা সংযুক্ত। অপরদিকে অক্সিজেনের উচ্চ তড়িৎঋণাত্মকতার জন্যে পানির অণু ডাইপোলে পরিনত হয়,আর এই কারণেই পানির অণুগুলি হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বাধা যুক্ত হয়ে বিরাট আনবিক গুচ্ছ তৈরী করে। কিন্তু পানি যখন নিম্ন তাপমাত্রায় জমে বরফ হতে শুরু করে তখন আবার শুরু হয় হাইড্রোজেন বন্ধনীর খেলা। জমে বরফ হওয়ার সময় একাদিক আণবিক গুচ্ছের মধ্যে আড়াআড়িভাবে হাইড্রোজেন বন্ধন সৃষ্টি হয়। প্রতি ৬ টা অক্সিজেন পরমাণু হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বারা যুক্ত হয়ে ষড়কোণীয় ফাঁকা স্থান তৈরী করে। এই কাঠামোতে এক একটি অক্সিজেন পরমাণু চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে দুইটি সমযোজী ও দুইটি আড়াআড়ি হাইড্রোজেন বন্ধন তৈরী করে একটি ত্রিমাত্রিক চতুষতলকীয় কাঠামো গঠন করে। এই আড়াআড়ি হাইড্রোজেন বন্ধনের ফলে বরফের মধ্যে ষড়কোণীয় ফাঁকা স্থানগুলো তার আয়তন বৃদ্ধির মূল কারণ। এই কারণে কোন নির্দিষ্ট পরিমান পানি বরফে পরিনত হলে তা ঐ পানির চেয়ে আয়তনে বৃদ্ধি পায়। তাছড়াও দূর্বল আকর্ষণের কারণে হাইড্রোজেন বন্ধনের দৈর্ঘ সসযোজী বন্ধনের তুলনায় বেশী হওয়ায় তা বরফের আয়তন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে। এই বৃদ্ধির পরিমান শতকরা ৯.০৯%। তাই বরফ পানিতে ভাসে। আর এটাও প্রাণী জগতের জন্যে দয়াময়ের আরেক করুণা। আমরা জানি শীতপ্রধান দেশে জলাশয়ের পানি অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় জমতে শুরু করে আর তা শুরু হয় উপরের পৃষ্ঠ থেকে। আয়তন বৃদ্ধির কারণে সেই বরফ পানির উপরে ভাসতে থাকে,একসময়ে তা পুরু স্তরের সৃষ্টি করে। তখন এই স্তর তাপ নিরোধকের কাজ করে-অর্থাৎ উপরের ঠাণ্ডা বরফস্তর ভেদ করে নীচে প্রবেশ করতে পারেনা ফলে নীচের দিকে বরফ তৈরীর প্রক্রিয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সুবাদে পনির ধারনকৃত তাপে অভ্যন্তরস্ত জলজ প্রাণী ও উদ্ভিত বেঁচে থাকে দয়াময়ের অপাড় দয়ায়।
পানির আরেকটি বিশেষ গুণ হল তার প্লবতা। প্রকৃতিতে পানির ঘণত্ব এমন ভাবেই ণিরূপিত হয়েছে যে সহজলভ্য অনেক বস্তুই পানিতে ভাসে। যেমন শুকনো কাঠ বাঁশ বা তাদের দ্বারা তৈরী ভেলা বা নৌকা অনায়াশে পানিতে ভেষে থাকে যা সচল প্রাণীদের পানি পারাপারের উপযোগী। পানির আরো একটি বিশেষ পরিচয় এটি একটি উৎকৃষ্ট দ্রবক। এর সেই পোলারিটির কারনে প্রায় সমগ্র অজৈব খনিজ লবন এর মধ্যে সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হয়। আর এই সুবাদে বৃক্ষ-লতা নানাবিধ খনিজ দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে তার দেহ সৌষ্ঠব পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে তোলে। সম্ভবত পানিই প্রকৃতিতে একমাত্র পদার্থ যে পাশাপাশি তিনটি ভৌত অবস্থায় অর্থাৎ কঠিণ তরল ও বায়বীয় আকারে থাকতে পারে। আর এই অবস্থাটি হল সাধারন বায়ুমণ্ডলীয় চাপে ৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা। যার জন্যে ঐ তাপমাত্রাকে বলা হয় পানির ত্রৈধ বিন্দু। পানির এই অবস্থাটি জীবজগতের জন্য বিধাতার এক মহাকল্যাণকর দান। পানির উদ্বায়ীতা গুন সৃষ্টিকর্তার আরেক কল্যাণকর অবদানের নিদর্শন। পানি যে কোন তাপমাত্রায় বাস্পায়িত হয়। যদিও সকল তরলপদার্থই কমবেশী বাস্পায়িত হয় তবে তা সকল তাপমাত্রাই হয়না । কিন্তু পানিই একমাত্র ব্যতিক্রমী পদার্থ। পানির এই গুনাগুণের জন্যে সকল সময় বাতাসের আদ্রতা জীবকুলের জন্যে উপযোগী থাকে। সামান্য তাপ শোষন করতে পারলেই দূর্বল হাইড্রোজেন বন্ধনী গুলি ভেঙ্গে পানি বাস্পায়িত হতে পারে। এ প্রক্রিয়া অধিক নিম্ন তাপমাত্রায়ও ঘটতে পারে। দয়াময় যদি পানিকে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উদ্বায়ী করতেন, তবে তাপমাত্রর পরিবর্তনে যে চরম ভাবাপন্নতা দেখা দিত তা হত জীবকুলের জন্যে চরম হুমকি স্বরূপ। হয়তোবা বেঁচে থাকাই সম্ভব হতোনা। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে হয়তোবা শুকিয়ে যেত পানির সকল মজুত অতবা বাতাশের আদ্রতা কমে যেত শূণ্যের কোঠায়।
পানির যত গুণাগুণ নিয়ে আমরা এপর্যন্ত আলোচনা করলাম তা সবই সম্ভব হয়েছে হাইড্রোজেন বন্ধনীর জন্য। সুহৃদয় পাঠক,একবার ভেবে দেখুন, দয়াময়ের এই ক্ষুদ্র সৃষ্টি কিভাবে সৃষ্টি জগৎকে মহিমান্বিত করেছে,কত ভাবে আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ঋণের জালে! শুধুমাত্র এই সামান্য হাইড্রোজেন বন্ধণীটি ভেঙ্গে দিলে (যা তাঁর পক্ষ্যে খুবই সহজ) সমগ্র প্রকৃতিতে কি হতে পারে ভেবে দেখবেন কি? যে ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন নিম্নের আয়াতে।
وَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاء مَاء بِقَدَرٍ فَأَسْكَنَّاهُ فِي الْأَرْضِ وَإِنَّا عَلَى ذَهَابٍ بِهِ لَقَادِرُونَ
২৩:১৮‘আমি আকাশ হইতে পানি বর্ষন করি পরিমিতভাবে। অতঃপর আমি মৃত্তিকায় সংরক্ষণ করি-আমি উহাকে অপসারণ করিতেও সক্ষম।’
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَصْبَحَ مَاؤُكُمْ غَوْرًا فَمَن يَأْتِيكُم بِمَاء مَّعِينٍ
৬৭:৩০ ভাবিয়া দেখিয়াছ কি যদি ভূতলের সকল পানি অদৃশ্য হইয়া যায় তবে কে তোমাদের জন্য আনয়ন করিবে এই ভূবনে প্রবাহমান জল।’
فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
৫৫:১৬ সুতরাং তোমাদের প্রভুর কোন্অনুগ্রহকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে?
وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ
৩৬:২ ‘কোরআন মূলত মহাবিজ্ঞানময় গ্রন’।
وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنشَآتُ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ
প্রচলিত তরজমা-
৫৫:২৪ দরিয়ায় বিচরণশীল পর্বত সদৃশ্য জলযানগুলো তাঁরই নিয়ন্ত্রনাধীন।
৫৫:২৪তাহার অনুগ্রহের প্রতীক স্বরূপপ্রদর্শিত রহিয়াছে সমুদ্রের ভাসমান জলযানগুলি।’
আমরা যদি আয়াতস্থিত শব্দগুলির অর্থ লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়- وَلَهُ – এবং তারই জন্য, الْجَوَارِ – জাহাজগুলি, الْمُنشَآتُ -ভেসে আছে, الْبَحْرِ – সমুদ্রে, كَالْأَعْلَامِ -পর্বতের মত। থাহলে উক্ত আয়াতের তরজমা করা যায় -তাঁরই অনুগ্রহে পর্বতের মত জলযানগুলিও ভেসে আছে সমুদ্রে।
৩১:৩১ তোমরা কি লক্ষ্য করনা যে, আল্লাহ্র অনুগ্রহে জলযানগুলি সমুদ্রে বিচরন করে,যাহাদ্বারা তিনি তোমাদিগকে তাঁহার নিদর্শনাবলীর কিছু প্রদর্শন করেন। ইহাতে অবশ্যই নিদর্শন রহিয়াছে প্রত্যেক ধৈর্য্যশীল কৃতজ্ঞচিত্তের জন্য।’
২৫:৪৮ তিনিই স্বীয় রহমতের প্রাক্কালে বাতাসকে সুসংবাদবাহী রূপে প্রেরণ করেন। এবং আমি আকাশ থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি বর্ষণ করি।
৪২:৩৩ তিঁনি ইচ্ছা করিলে বায়ুকে স্তব্ধ করিয়া দিতে পারেন। ফলে নৌযান সমুহ নিশ্চল হইয়া পড়িবে সমুদ্রপৃষ্ট। নিশ্চই ইহাতে নিদর্শন রহিয়াছে ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যাক্তিদের জন্য।
সূধী পাঠক, মহান আল্লাহর বর্ণিত বাণী ১৪০০ বছর আগে বিজ্ঞান যখন সবে অঙ্কুরিত হয়েছে ঠিক তখন মানুষের কানে কানে প্রচার করেছে খোদ বিজ্ঞানেরই বিস্ময়কর সব তথ্য। আমরা জানিনা বিজ্ঞানকে এসকল বাণী কোন অনুপ্রেরণা দিয়েছে কিনা! তবে এ কথা নিশ্চিত বলা যায় যে, বিজ্ঞানের আবিস্কৃত কোন তথ্য পবিত্র কোরআনে সন্নিবেশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি কারণ সময়ের ব্যবধান তা হতে দেয়নি। ইতিহাস তার সাক্ষী।
সমগোত্রীয় পোস্ট সমূহঃ
আমি হৃদয় খন্দকার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 35 টি টিউন ও 60 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
তথ্য ও সূত্রের বিন্যাস সুন্দর হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি রহস্য বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার মাধ্যমেই অনুধাবন করা যায়। নিউক্লীয় পদার্থ বিদ্যা, জ্যোতিবিদ্যা, পরমাণুর গঠন প্রণালী সকলের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন তারপরও আপনার লেখাটি তাদেরও কিছুটা ভাবতে বাধ্য করবে যদি তারা ধৈর্য্য সহকারে আপনার উপস্থাপনাটি পাঠ করে। অনেক বড় তথ্যসমৃদ্ধ লেখা প্রকাশ করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।