‘বিগ ব্যাং’, মহাবিশ্বের সূচনা, মহাবিশ্বের সব কিছুর উৎপত্তি। সকল পদার্থ ও শক্তির সৃষ্টি।
আজ থেকে প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে পরমানুর চেয়েও বহুগুন ক্ষুদ্র প্রায় শুন্য আয়তনে ঘটা একটি বিস্ফোরনের মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি।
‘বিগ ব্যাং’ এর পর সময়ের পরিক্রমায় ধাপে ধাপে এই মহাবিশ্ব বর্তমান অবস্থায় আসে। গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যলাক্সি সব কিছুর শুরু ‘বিগ ব্যাং’।
‘বিগ ব্যাং’ এর পর পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে ‘প্রথম প্রান’ সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ গঠিত হবার সময় পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা তুলে ধরা হয়েছিল প্রথম পর্বে।
আজ দ্বিতীয় পর্বে তুলে ধরা হচ্ছে পৃথিবীতে ‘আদি-প্রাণ’ নামক প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হবার পর পর্যায়ক্রমে বর্তমান মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ ‘প্রাইমেট’ এর উৎপত্তি পর্যন্ত সময়ে প্রাণের ক্রমবিকাশের ধারা।
- আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম স্থায়ী সমুদ্রের সৃষ্টি হয়। স্থায়ী সমুদ্র সৃষ্টির প্রায় ৭ লক্ষ বছর পর সমুদ্রের তলদেশে কয়েকটি প্রাথমিক উপাদান; বিগ ব্যাং এর পর সৃষ্ট প্রথম মৌল হাইড্রোজেন, নক্ষত্রে সৃষ্ট নাইট্রোজেন, কার্বন এবং অক্সিজেন মিলে তৈরী করে পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা। DNA, যে সর্পিলাকার আণুবীক্ষণিক গঠনে লুকিয়ে আছে প্রাণের রহস্য। এটি ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম মহাবিপ্লব।
এরপর DNA থেকে কালক্রমে তৈরী হল প্রথম অনুজীব, ব্যাকটেরিয়া। যেটি শুধু তখন নয় এখনো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের দেহ সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার চেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যাকটেরিয়ার একটা ‘চিড়িয়াখানা’। - এরপর প্রায় একশ কোটি বছর পৃথিবী শুধুমাত্র নানা ধরনের অনুজীবের দখলে ছিল।
- প্রায় ২৫০ কোটি বছর পূর্বে কিছু ‘বিশেষ’ ব্যাকটেরিয়া সূর্য থেকে আসা শক্তি ব্যবহার করে জীবন ধারন করা শুরু করল। জীবন ধারনের এ প্রক্রিয়ায় তারা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ন বর্জ্য পদার্থটি উৎপাদন ও নিঃসরণ শুরু করল, যার নাম ‘অক্সিজেন’। সুতরাং আমরা এখন যে অক্সিজেনের সাহায্য বেচে আছি তা আমাদের আদি-প্রাণের উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছুই নয়।
সেসময় সমুদ্রের পানি ছিল প্রচুর লৌহ উপাদানে পরিপুর্ন। ব্যাকটেরিয়া নির্গত অক্সিজেন লৌহ উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করে তৈরী করে ভারি ধাতব-অক্সাইড যা থিতিয়ে জমা হয় সমুদ্র তলদেশে। শত কোটি বছর ধরে জমতে থাকা অক্সাইডের স্তর তৈরী করে লোহার বিশাল সংগ্রহশালা যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উত্থিত হয়ে এখন আমাদের কাছে “লোহার খনি” নামে পরিচিত। আপনার কলমের নিব থেকে শুরু করে জুতার পেরেক পর্যন্ত যত স্থানে লোহা রয়েছে তার সবার প্রাথমিক অবস্থান ও রুপান্তর একই।
পানিতে থাকা সকল অসম্পৃক্ত লৌহ উপাদান যখন অক্সাইডে পরিনত হল তখন অক্সিজেন মিশতে থাকল সমূদ্রের পানিতে। সমুদ্রের পানি অক্সিজেনে পূর্ন হবার পর অতিরিক্ত অক্সিজেন উঠে এল সমুদ্র পৃষ্ঠ ছেড়ে বায়ুমন্ডলে, বায়ুমন্ডল পূর্ন হল পর্যাপ্ত অক্সিজেনে। - এরপর ঘটল প্রাণের গুরুত্বপূর্ন ও বৃহৎ একটি উত্থান। কিছু ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন থেকে শক্তি সংগ্রহ করে বেচে থাকার কায়দা রপ্ত করল, যাতে পূর্বের যেকোন পদ্ধতি থেকে প্রায় ২০ গুন দক্ষতার সাথে শক্তির ব্যবহার করা গেল।
অক্সিজেন থেকে শক্তি সংগ্রহ করে বেচে থাকার ফলে তাদের জৈবিক পরিবর্তন পরিবর্ধন ঘটতে থাকল আরো দ্রূত। একাধিক অনুজীব মিলে তৈরী করতে থাকল আরো ক্রমান্বয়ে জটিল থেকে জটিলতর জৈবিক প্রাণ। - পরবর্তী দু’শ কোটি বছর এভাবেই চলল প্রাণের জটিল থেকে জটিলতর, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর, আর এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবে রুপান্তর হবার প্রক্রিয়া।
পৃথিবীর উপরিপৃষ্টে জেগে উঠতে থাকল দীপ আর বিস্তৃত হল স্থলভূমি। পৃথিবীর বাহ্যিক অংশ পেল যেমনটি আজ আমরা দেখি তার কাছাকাছি একটা রুপ।
সমুদ্রের পানিতে বাড়তে থাকল জীব বৈচিত্র। সৃষ্টি হল অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বহুকোষী উদ্ভিদ ও প্রাণী। এই সময়ের সর্বশেষ তিন কোটি বছরে সবচেয়ে বেশি পরিমানে বিবর্তিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জলজ প্রাণী। - বর্তমান সময় থেকে প্রায় ৫০ কোটি বছর পূর্বে সমূদ্রে বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হল প্রথম কাঁটাযুক্ত দেহাভ্যন্তর বিশিষ্ট মাছ। এদেরকেই বলা যায় আমাদের সর্বপ্রথম ‘পূর্বপুরুষ’ যাদের মধ্যে প্রথমবারের মত ছিল বর্তমান জীবের মত দেহাংশ এবং দাতবিশিষ্ট চোয়াল সহ মুখ।
প্রাণী ও উদ্ভিদ বিবর্তিত হতে থাকল আরো নতুন বৈশিষ্ট সম্পন্ন ও জটিল ক্ষমতা সম্পন্ন জীবে।
এর মধ্যেই পৃথিবীর বায়ুমন্ডলস্থ অক্সিজেনের একটা অংশ বায়ুমন্ডলের উপরিভাগে তৈরী করল ‘ওজন’ গ্যাসের আস্তরন যা তখন থেকে এখন পর্যন্ত এমনকি ভবিষ্যতেও রক্ষা করে চলবে প্রাণের গতিধারাকে; মহাজাগতিক ও সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর রশ্মি ও বিকিরনের প্রভাব থেকে।
‘ওজন’ স্তর তৈরীর পূর্ব পর্যন্ত প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কেবল সমূদ্রের তলদেশের পানিতে। এরপর তা স্থলভূমি তে উঠে আসার পরিবেশ পেল। প্রথমে পানির তলার উদ্ভিদরা বিবর্তিত হয়ে স্থলে বাচার উপযুক্ত হয়ে উঠে আসল স্থলজ পৃথিবীতে। শিকরের সাহায্যে পানি আর সূর্যালোকের শক্তিতে বেচে থাকার শক্তি সংগ্রহ করতে থাকল। প্রথমবারের মত উদ্ভিদের প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত হল পৃথিবী। - প্রায় চল্লিশ কোটি বছর পূর্বে জলজ প্রাণীর একটি অংশ বিবর্তিত হয়ে উভচর প্রাণীর সৃষ্টি করল যা পানি ছেড়ে উঠে এল মাটিতে। সূচনা হল সমগ্র পৃথিবীতে চলমান প্রাণের বিচরন।
প্রাথমিক উভচরদের, বর্তমান ব্যাঙ্গের ডিমের মত পানিতে ডিম ছেড়ে বংশবৃদ্ধি করতে হত। তা না হলে সে ডিম স্থলে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যেত। এটি ছিল তাদের সমুদ্র ছেড়েও দূরে না যেতে পারার একটি কারন।
বিবর্তন এ সমস্যার সমাধান এনে দিল একদল উভচরের জন্য। তারা সম্পুর্ন নতুন গঠনের ডিম দিতে শুরু করল যেটা শক্ত খোলসে আবৃত কিন্তু তার ভেতরে প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় ‘সমুদ্রের আদ্রতা’। এই বিবর্তন এধরনের উভচর থেকে কালক্রমে বিবর্তিত হল সরীসৃপ। - স্থলে উদ্ভিদের শুরু থেকে প্রায় ত্রিশ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত উদ্ভিদ মারা যাবার পর মাটিতে মিশে যায়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মাটির নিচে জমা হতে থাকে যা বর্তমানে আমরা কয়লা হিসাবে উত্তোলন করছি।
- প্রায় ২৫ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে বয়ে যায় এক ভয়াবহ দূর্যোগ। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আগ্নেয়গিরির উদগীরন শুরু হয় দানবিক আকারে। বায়ুমন্ডলের অনেকাংশ ভরে ওঠে জীবনের জন্য ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইডে। পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশের অধিক প্রজাতির জীব মারা যায় এই দূর্যোগে। একে বলা হয় ‘পার্মিয়ন গনবিলুপ্তি’।
এরপর আরো কিছু গনবিলুপ্তি সংগঠিত হয়েছে পৃথিবীতে যাতে প্রচুর প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে নতুন প্রজাতির প্রাণীর উদ্ভব ঘটে। - পার্মিয়ন গনবিলুপ্তির পর আরো কয়েকটি গন বিলুপ্তি কাটিয়ে উদ্ভব হয় ‘ডাইনোসর’। উৎপত্তির পর প্রায় ১৬ কোটি বছর পৃথিবী শাসন করে নানা জাতি-প্রজাতিতে বিভক্ত ডাইনোসরের দল। এসময় পৃথিবীতে প্রথম সৃষ্টি হয় কঠিন কান্ড বিশিষ্ট উদ্ভিদের বনভূমি।
এসময় চাঁদ সৃষ্টির প্রায় ৪২৫ কোটি বছর পর চাঁদের আকর্ষন পৃথিবীর আহ্নিক গতি নির্দিষ্ট করে ২৪ ঘন্টার দিবারাত্রি নির্ধারন করে। - ডাইনোসর যুগের শুরুতে পৃথিবীর স্থলভাগ একত্রিত অবস্থায় ছিল। ডাইনোসর যুগের মাঝামাঝি অংশে এসে স্থলভাগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকল। স্থলভাগ সমুদ্র দ্বারা পরিবেশটিত হয়ে কয়েকটি সুবৃহৎ দ্বীপের মত অংশ বিভক্ত হল। আফ্রিকা থেকে দক্ষিন আমেরিকার অংশ আলাদা হল। মাঝখানে চলে এল আটলান্টিক মহাসাগর।
এভাবেই চলল ডাইনোসর যুগের ১৬ কোটি বছর। ডাইনোসরের যুগে ডাইনোসরের প্রতিপত্তির দাপটে অন্য কোন বড় প্রাণীর উদ্ভব হতে না পারলেও সৃষ্টি হল নানা প্রজাতির ছোট ছোট স্তন্যপায়ী জীব। এগুলো আকারে ডাইনোসরের তুলনায় ইদুরের মত ছোট হওয়ার ডাইনোসরের প্রভাব এদের উপর তেমন একটা পড়েনি। এতে এরা বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে বিবর্তিত হয়। - প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর পূর্বে, প্রায় ৬ মাইল চওড়া একটি গ্রহানুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ ঘটে। এতে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ সারা পৃথিবীর আকাশে ছড়িয়ে পরে। সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে থাকা ৫০ পাউন্ডের চেয়ে বেশি ওজনের সকল জীবের বিলুপ্তি ঘটে। ডাইনোসরদের ১৬ কোটি বছরের শাসন শেষ হয় পৃথিবীর বুকে।
- পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হবার পর বেশি সময় নেয়নি ছোট স্তন্যপায়ীদের বড় আকারে বিবর্তিত হতে।
৫ কোটি বছর পূর্বে প্রথম বিবর্তিত হয় ‘প্রাইমেট’ যা আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ। যাদের দেহগঠনের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায় আমাদের দেহ গঠন। এসময় বিবর্তনের ধারায় তারা পায় পাচ আঙ্গুলের নমনীয় হাত যার সাহায্যে কোন কিছুকে ভালভাবে আকড়ে ধরা যায়, আর পায় উন্নত দৃষ্টির চোখ যা আরো বিবর্তিত হয়ে আরো প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন চোখের ‘প্রাইমেট’ এর উদ্ভব হয়।
দ্বিতীয় পর্বে এই বিষয়টি শেষ করার কথা থাকলেও সহজবোধ্য ভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে একাধিক বাক্য ব্যবহার করে কিছু কিছু অংশ লেখা হয়েছে। তাতে বেশ বড় পরিসরে চলে গিয়েছে এর বিষয়বস্তু। তাই এটিকে এই পর্বে শেষ না করে আরো কয়েকটি পর্ব আকারে শেষ করা হবে।
এই পর্বে ‘প্রথম প্রাণ’ এর উৎপত্তি থেকে প্রথম ‘প্রাইমেট’ এর উত্থান পর্যন্ত প্রাণের বিবর্তন ও উত্থান-পতন নিয়ে আলোচিত হল। পরবর্তি পর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ ‘প্রাইমেট’ দের উত্থানের পর তাদের বিবর্তন ও পরবর্তি সময়ের ঘটনাবলির উল্লেখ থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ-
১. মহাকাশে কী ঘটছে – আবদুল্লাহ আল-মুতী
২. http://www.history.com
সবাইকে ধন্যবাদ।
বিঃদ্রঃ - টিউনের প্রতিটি অংশ উল্লেখিত সূত্র থেকে সংগৃহীত। টিউনের কোন অংশে কোন প্রকার তথ্যগত ত্রুটি, অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অন্য যেকোন বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ভুল অবতারনা থাকলে সেটিকে যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রমান, প্রামাণ্য দলিল বা নির্ভরযোগ্য সূত্রের সাপেক্ষে ধরিয়ে দিলে তা সানন্দে সংশোধন করা হবে।
বিজ্ঞান তত্ত্ব, তথ্য, যুক্তি, প্রমান ও পর্যবেক্ষনগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাই কারও কোন ব্যক্তিগত, জাতিগত বা সামষ্টিক "বিশ্বাসের" পরিপন্থি কিছু থাকার জন্য সেটিকে ভুল বলে আখ্যায়িত করা হলে তা গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। এধরনের কারনে একে ভুল বলে কোন টিউমেন্ট করা হলে টেকটিউনসের নীতিমালা ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে টিউমেন্টের কোন উত্তর না দিয়েই তা অপসারন করা হবে।
ধন্যবাদ।অনেক কিছু জানলাম