ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৯৩০। এই স্মরণীয় দিনেই আবিস্কার হয়েছিলো প্লুটো। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পাঠ্য বইয়ে প্লুটোকে গ্রহ হিসাবেই উল্লেখ করা হতো। তখন সৌরজগতের গ্রহ ছিলো নয়টি। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৪ শে আগস্ট আইএইউ ঘোষণা দেয় যে, প্লুটো গ্রহ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না, আর তাই প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। তবে প্লুটো গ্রহ থাকবে কি থাকবে না সেই বিতর্ক এখনো শেষ হয় নি। কিছুদিন আগেও প্লুটোকে গ্রহ হিসাবে ঘোষণা দেয়া যায় কিনা – তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। কিন্তু গ্রহ হিসাবে স্বীকৃতি না পেয়ে সে বামন গ্রহ হিসাবেই স্বীকৃতি পেয়েছে ।
বিজ্ঞান আমাদের সকলের আগ্রহের একটা বিষয়। কিন্তু গনিতের ক্ষেত্রে তা না। আমি নিজেও গনিত তেমন একটা পছন্দ করি না। তবে এটা ঠিক যে বিজ্ঞানী ও গণিতবিদরা অনন্য। তাদের তুলনা হয় না। কোনো কিছু আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাদের অবদান অসামান্য। তারা কোনো বস্তুকে সরাসরি দেখা না গেলেও হিসাব নিকাশ করে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। এমন কি কোনো গ্রহের ভরটাও নির্ণয় করে ফেলতে পারেন ।
তারা তাদের লক্ষ্যবস্তুর গতিপথ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করেন, এবং তারপর নানা রকমের কঠিন গাণিতিক হিসাব করে সে বিষয়ে নিশ্চিত হন। এমনই একটা গবেষণার কথা ছোট্ট করে জানা যাক। একবার বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নিশ্চিত হলেন যে, মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মাঝে একটি গ্রহ থাকার কথা।
কিন্তু সেখানে তো কোনো গ্রহ নেই। তাহলে ব্যাপারটা কি? কোথায় গেলো সে গ্রহটা? আরো গবেষণা করে বুঝতে পারলেন যে গ্রহটি গঠিত হওয়ার সময় কোনো কারনে পরিপূর্ণ আকার গঠন করতে পারেনি। এবং এটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝের অঞ্চলে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেসে বেড়ানো উপাদান গুলোকে গ্রহাণুপুঞ্জ বলে থাকি।
১৭৮১ সালে বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেল ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করেন। যথেষ্ট হইচই শুরু হয়ে যায়। সকলে নতুন আবিষ্কৃত এ গ্রহ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারপর ইউরেনাসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা সেখানে কিছু অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করেন। কি এই অসামঞ্জস্যতা? পদার্থবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সুত্র বিশ্লেষণ করে ধারনা করেন যে, আরো একটি গ্রহ এর আশেপাশে থাকতে পারে। আর এ ধারনা থেকেই জন্ম নেয় নেপচুন নামের আরেক গ্রহ। ১৮৪৬ সালে তিনজন বিজ্ঞানী মিলিত ভাবে নেপচুন আবিষ্কার করেন। যথারীতি নেপচুনের গতিপথ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, সেখানেও কিছুটা অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। এবং ধারনা করা হয় যে আরো কোনো গ্রহ আছে যার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ নেপচুনের গতিপথকে প্রভাবিত করছে।
কিন্তু তারপর সৃষ্টি হয় আরো কিছু সমস্যার। কোন গ্রহের মহাকর্ষীয় বল নেপচুনের গতিপথকে আকর্ষণ করে? কোথায় সে গ্রহ? হারিকেন দিয়ে খোঁজার পরও সে গ্রহ ধরা দেয় না। তাই বিজ্ঞানীরা বাধ্য হয়ে সে গ্রহের নাম দেন প্লেনেট এক্স বা অজানা গ্রহ। এতো কিছু থাকতে এক্স কেনো ? কারন এক্স দিয়ে আমরা কোনো অজানা রাশি বা বস্তুকে বুঝায়। এই গ্রহ খোঁজার জন্য যিনি হাত ধুয়ে মাঠে নামেন তার নাম পার্সিভাল লোভেল/লোয়েল।
তিনি ছিলেন একাধারে একজন ব্যবসায়ী, লেখক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং খুব সম্পদশালী। তিনি এর পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন এবং এরিজোনায় ‘লোভেল অবজারভেটরি’ নামে একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে অজানা গ্রহের নাগাল পাননি। তবে তাঁর অজান্তেই ১৯১৫ সালে তাঁরা তোলা দুটি ছবিতে প্লুটোকে অস্পষ্টভাবে দেখা গেছে। ১৯১৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর প্ল্যানেট এক্সকে খোঁজার কাজের কিছুটা ভাটা পড়ে যায়।
১৯২৯ সালে প্ল্যানেট এক্সকে খোঁজার কার্যক্রম আবার নতুন মাত্রা পায়। ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। লোভেল অবজারভেটরির পরিচালকের নিকট একটি চিঠি আসে। আর চিঠিটি পাঠিয়েছিলো একজন তরুন। সে ছিলো একজন গ্রাম্য তরুন, তার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া ছিলো না। সে অর্থের অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছিলো না। অবজারভেটরির পরিচালক তরুণের আকাশ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং তাকে গ্রাম থেকে ডেকে এনে অবজারভেটরিতে চাকরী দিয়ে দেন। যেনতেন চাকরী নয়! সম্ভাব্য অবস্থানে টেলিস্কোপ তাক করে আকাশের ছবি তোলা এবং পর পর তোলা ছবিগুলো মিলিয়ে দেখে গতিময় কোনো বস্তু অর্থাৎ প্লুটোর অবস্থান নির্ণয় করাই ছিলো তার চাকরী।
সে আশ্চর্য তরুন ছিলেন ক্লাইড টমবো (Clyde Tombaugh)। লোভেল অবজারভেটরিতে পৌঁছানোর পিছনেও রয়েছে কিছু ঘটনা। টমবো ছোটবেলা থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। এর জন্য তিনি ইতিবাচক পরিবেশও পেয়েছিলেন। তার চাচার কাছে একটি টেলিস্কোপ ছিল। তিনি সে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন। এবং এক সময় নিজেই টেলিস্কোপ তৈরি করা শিখে ফেলেন। তিনি ১৯২৮ সালে একটি ৯ ইঞ্চি রিফ্লেকটর টেলিস্কোপ তৈরি করেন। এটি ছিলো তার বানানো সবচেয়ে নিখুঁত টেলিস্কোপ। এটি দিয়ে আকাশপটও পরিষ্কার দেখা যেতো।
সে বছর তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার কথা ছিল। তার সাবজেক্টটাও ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। কিন্তু জানেনই তো, ভাগ্য সহায় না থাকলে কিছুই সম্ভব হয়ে ওঠে না। শিলাবৃষ্টির কারনে তাদের পরিবারের সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। আর তখনকার দিনে একবার ফসল নষ্ট হওয়া মানে প্রায় অনাহারে মারা যাওয়া। তাই তার পরিবারের পক্ষে ক্লাইডের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগানো সম্ভব ছিলো না। তাই তিনিও মন খারাপ করে গ্রামে রয়ে গেলেন। এবং কৃষি কাজে মনোযোগ দিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারলেও তার আকাশপ্রেম মোটেও কমে যায়নি। দিনের বেলা কৃষি কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করতেন, আর রাতের বেলায় তার ব্যক্তিগত টেলিস্কোপ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন আকাশে। তিনি শখের বশেই পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহ। পর্যবেক্ষণ করতে করতে গ্রহ দুটির নিখুঁত চিত্রও একে ফেললেন। তারপর সেসব চিত্র পাঠিয়ে দিলেন লোভেল অবজারভেটরিতে। অবজারভেটরির পরিচালক তার প্রতিভা ধরতে পারেন এবং ডেকে এনে আকাশ পর্যবেক্ষণ করার চাকুরীতে বসিয়ে দেন ।
আপনি যখন আপনার শখের বিষয়টাকে চাকরী হিসাবে পাবেন, তখন আপনার কাছে কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই কাজের গতি ২০০-৩০০ গুন বেড়ে যাবে, তাই না? ক্লাইডের ক্ষেত্রেও এমন্টাই ঘটেছিলো। এটি তার প্রিয় কাজ হওয়ায় কঠিন হলেও, তার কাছে অনেক আনন্দদায়ক ছিলো। কাজটা অবশ্যই অনেক কঠিন ছিলো। কারন, সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে এমন কোনো গ্রহকে খুঁজে বের করা সহজ কথা নয়।
সে সম্ভাব্য জায়গা গুলোর দিকে টেলিস্কোপ তাক করে ছবি তুলতে লাগলো। মনে হতে পারে এ আর এমন কঠিন কী? ছবি তোলাই তো। কিন্তু যখন দেখা যাবে আকাশের ঐ অঞ্চলের প্রত্যেকটা বিন্দু ধরে ধরে ছবি তুলতে হবে তখন অবশ্যই সেটি কঠিন কাজের মাঝে পড়ে। প্রত্যেকটা বিন্দু পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলো। পরিশ্রমসাধ্য কাজ হলেও টমবো আনন্দের সাথেই তা করতে থাকে।
তিনি তার পরিশ্রমের ফল পান ১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে। তার তোলা ছবির প্রত্যেকটা বিন্দু পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেলেন যে, একটি বিন্দু সময়ের ব্যবধানে তার অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে। আর এ বিন্দুটিই ছিলো কাঙ্ক্ষিত গ্রহ প্লুটো। নতুন গ্রহটির আবিষ্কারে সারা পৃথিবীতে হৈ চৈ পড়ে যায় এবং বড় বড় সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়। ২৩ বা ২৪ বছরের ক্লাইড রাতারাতি সারা দেশে বিখ্যাত হয়ে উঠলো। কানসাস ইউনিভার্সিটি তার অবদানের জন্য তাকে স্কলারশিপ প্রদানের মাধ্যমে লেখাপড়ারও সুযোগ করে দেয়।
ক্লাইড এবং প্লুটো, দুজনই পত্রিকার হেডলাইন হয়ে গেছেন। সারা বিশ্বে এর আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু প্ল্যানেট এক্স আর কতদিন প্ল্যানেট এক্স থাকবে? সে তো এখন আর অজানা গ্রহ নয়। তাই এ নব্য আবিষ্কৃত গ্রহের নামকরণের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। নামকরণের জন্য সকলের কাছ থেকে নাম আহ্বান করা হয়। প্রায় ১ হাজারেরও বেশি নাম জমা পড়ে। সব নাম থেকে বাছাই করে নাম দেয়া হয় প্লুটো।
আর এ নামটি জমা দিয়েছিলো ১১ বছর বয়সী এক স্কুল বালিকা। সে ভাগ্যবান বালিকা ছিলো ভেনেসিয়া বার্নি। সে নামটি প্রথমে তাঁর দাদা ফ্যালকনার ম্যাডানের কাছে উত্থাপন করেন যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গ্রন্থাগারের গ্রন্থকারিক ছিলেন। ইনি আবার এই নামটি জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক হার্বার্ট হল টার্নারের কাছে হস্তান্তর করেন। লয়েল অবজারভেটরিতে এই নামটি সহ মোট তিনটি নামের মধ্য থেকে ভোটাভোটির মাধ্যমে প্লুটো নামটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
প্লুটো নামের একটি তাৎপর্য হলো এর শুরুর P ও L বর্ণদুটি যা পারসিভ লয়েলের নামের আদ্যক্ষর। তাছাড়া চিরায়ত পুরাণে প্লুটো শব্দের অর্থ অন্ধকার রাজ্যের দেবতা। প্লুটোর অবস্থান সূর্য থেকে অনেক দূরে হওয়ায় এটিও প্রায় অন্ধকারেই থাকে। তাই প্লুটো নামকরণটা ছিলো সার্থক!
মূলত নেপচুনের গতিপথকে আকর্ষণ করা শক্তিকে খুঁজতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা প্ল্যানেট এক্স বা প্লুটোকে আবিষ্কার করে ফেলেন। গ্রহটি আবিষ্কারের পর ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিন্তু আরো নানা সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ভবিষ্যৎবানী করা হয়েছিলো যে প্ল্যানেট এক্সের ভর অনেক বেশী। প্লুটোর আবিষ্কারের পর যখন এর গতিবিধি ও অস্পষ্টতাকে পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে বুঝা গেলো যে এটি কাঙ্ক্ষিত প্ল্যানেট এক্স নয়।
এটি অন্য কোনো গ্রহ। কিন্তু প্লুটোর আবিষ্কার পর এর গতিবিধি এবং অস্পষ্টতা দেখে সন্দেহ করা হলো এটি পূর্বের অনুমানকৃত প্ল্যানেট এক্স নয় বরং অন্য একটি গ্রহ। এর ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৫ ভাগের এক ভাগ। ভরও অনেক কম, পৃথিবীর ভরের ৫০০ ভাগের এক ভাগ। এর কক্ষপথ স্বাভাবিক নয়, সূর্যের চারপাশে আবর্তনের এক পর্যায়ে নেপচুনের কক্ষপথ ভেদ করে ভেতরে চলে আসে। সৌরজগতের বাইরের দিকের গ্রহগুলো গ্যাসীয়, কিন্তু এটি পাথুরে। অন্য গ্রহগুলোর কক্ষপথ মোটামুটি একটি সমতলে অবস্থান করছে কিন্তু এর কক্ষপথ কিছুটা হেলে আছে।
গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞানীরা প্লুটোর একটি উপগ্রহও আবিষ্কার করে ফেলেন। উপগ্রহের নিয়ম অনুযায়ী উপগ্রহ মূল গ্রহের চাইতে আকারে অনেক ছোট হয় এবং গ্রহের আকর্ষণের কারনে গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। কিন্তু প্লুটোর ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। হয়েছে বিপরীতটা। প্লুটোর উপগ্রহ তার আকারের প্রায় অর্ধেক, এবং এটি একটি উপগ্রহের তুলনায় অনেক বড়। উপগ্রহ যদি গ্রহের আকারের অর্ধেক হয়, তবে তো তা গ্রহের প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাবে। আকারে বড় হওয়ার কারনে ভরটাও বেশি হয়। ফলে উপগ্রহ অবাধ্য সন্তানের মতো আচরন করবে এবং মূল গ্রহের উপর প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করবে। ফলে গ্রহ তার মান সম্মান হারাবে। সবাই বলে, এ কেমন গ্রহ যে তার উপগ্রহকেই সামলাতে পারে না?
সব চেয়ে বড় ঝামেলা দেখা দেয় ২০০৫ সালে। বিজ্ঞানীরা প্লুটোর কাছাকাছি আরো একটি বস্তু দেখতে পান, যার ভর ছিলো প্লুটোর চাইতেও বেশি। বিজ্ঞানীরা একেও দশম গ্রহ হিসাবে স্বীকৃতি দেন, এবং নাম দেন এরিস। কিন্তু পরবর্তীতে একই এলাকায় আরো অনেক রকমের বস্তু খুঁজে পায় বিজ্ঞানীরা। কিন্তু গনহারে গ্রহ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করলে তো আরো বড় সমস্যা। একই কক্ষপথে এতো গুলো গ্রহ থাকলে তো মহা ঝামেলা বেধে যাবে।
এ অবস্থায় বিজ্ঞানীরা বেস চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং গ্রহের সংজ্ঞা নিরধারনের প্রয়োজন অনুভব করেন। ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (IAU) সম্মেলনে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। এখানে প্রথমে বিজ্ঞানিদের মূল্যবান ভোট গ্রহন করা হয়। তখন পর্যন্ত গ্রহ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিলো আরো ৪ টি বস্তুর – প্লুটো, এরিস, সেরেস এবং ২০০৩ ইউবি৩১৩। প্লুটোর ভর অন্য তিন নতুন গ্রহের চাইতে অনেক কম। তাই যদি প্লুটোকে গ্রহ হিসাবে ধরা হয়, তবে তাদেরকে ধরা হবে না কেনো? আর যদি তাদেরকেও ধরা হয়, তবে একই কক্ষপথে এতোগুলো গ্রহ কি করছে?
সিদ্ধান্ত হলো যে, যৌক্তিক সংজ্ঞার ভেতরে পড়লে কোনো বস্তুকে গ্রহ বলে বিবেচিত করা হবে। এর বাইরে হলে নয়। যৌক্তিক সংজ্ঞা তৈরি করা হয় এবং এ হিসেবে মোট গ্রহ হবে ৮টি। প্লুটো বাদ যায়। সাধারণ গ্রহাণু থেকে বড় কিন্তু স্বাভাবিক গ্রহ থেকে ছোট বস্তুদের ‘বামন গ্রহ’ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ফলস্বরূপ প্লুটো তার গ্রহত্ত্ব হারায়। প্লুটো, সেরেস ও এরিস বামন গ্রহ হিসেবে বিবেচ্য হবে।
২০০৬ এ ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক নির্ধারিত গ্রহ হবার শর্তগুলো হচ্ছে-
১. সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে। (প্লুটো এই শর্তে উত্তীর্ণ।)
২. যথেষ্ট ভর থাকতে হবে যেন তার অভিকর্ষীয় শক্তির মাধ্যমে নিজেকে মোটামুটি গোলাকার আকৃতি ধারণ করাতে পারে। (প্লুটো এই শর্তে অনুত্তীর্ণ।)
৩. কক্ষপথে ঘোরার সময় তার আশেপাশে শক্তিশালী প্রভাব রাখতে হবে যেন আশেপাশের জঞ্জাল বস্তুগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। (এখানেও প্লুটো অনুত্তীর্ণ।)
প্লুটো শেষ দুটি শর্ত পুরন করতে পারেনি। তাই সে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ পড়ে। অন্যান্য গ্রহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সকল গ্রহই গোল হয়। কোনো গ্রহই পিরামিড, সিলিন্ডার কিংবা ঘনকের মতো হয় না। বস্তু যখন খুব বেশি ভারী হয়ে যায়, তখন তার আকর্ষণের শক্তির তুলনায় গ্রহের উপাদানগুলো প্রবাহী বা ফ্লুইডের মতো হয়ে যায়। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর গাঠনিক উপাদানকে কঠিন পদার্থ বলে মনে হলেও পৃথিবীর শক্তিশালী আকর্ষণ সেগুলোকে অবস্থানচ্যুত করতে পারে। প্রকৃতিতে সকল বস্তুই গোলাকার হতে চায়।
মগ দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিলে দেখা যাবে সেই পানি অনেকগুলো গোলাকার ফোটা তৈরি করেছে। গ্রহগুলোও এই ধর্মের জন্য গোলাকৃতি ধারণ করে। কিন্তু গোলাকার হওয়ার জন্য প্লুটোতে যথেষ্ট ভর নেই। অন্যান্য গ্রহ যখন তাদের কক্ষপথে ঘোরে তখন মহাকর্ষীয় আকর্ষণের মাধ্যমে আশেপাশের ক্ষুদ্র বস্তুগুলোকে নিজের দিকে টেনে নেয়। ফলে কক্ষপথ হয়ে যায় জঞ্জাল মুক্ত। কিন্তু প্লুটো এ কাজ করতে না পারায় তার আশেপাশে জঞ্জাল রয়েই গেছে।
ফলস্বরূপ, প্লুটো কোনো গ্রহ নয়, এটি একটি বামন গ্রহ।
বিজ্ঞান বিজ্ঞানই। এতে যুক্তিকে মেনে নিতেই হয়। এসব ব্যাপার দাবিদাওয়া আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করা যায় না। কিন্তু আমেরিকানরা তা মানেনি। তারা আন্দোলন করেছে। তাদের দাবী ছিলো – আকৃতি কোনো ব্যাপার না, সারা জীবন একে আমরা গ্রহ হিসেবে জেনে এসেছি তাই একে গ্রহের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া হোক। কেউ কেউ বলছে- সকল আকৃতি, সকল আকার এবং সকল ধরনের কক্ষপথকেই আমরা সাপোর্ট করি। তাই প্লুটো যে অবস্থানেই থাকুক না কেন তাকে গ্রহের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হোক। আবার কেউ কেউ টিউনারে লিখেছে- এখন প্লুটোকে সরানো হয়েছে, আপনাদের পরবর্তী টার্গেট কি নেপচুন আর ইউরেনাসকে সরানো?
বিজ্ঞানের পরিবর্তনশীল। তাই পরিবর্তনকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে আবেগ ও মায়াকে ঘিরে ধরে থাকলে চলবে না। এখনো অনেক মানুষ আছেন, যারা প্লুটোকে গ্রহ হিসাবে মানেন। আমি নিজেই দেখেছি অনেককে। তারা আবেগের কারনে নয়, মূলত প্লুটো বাদ পরার ঘটনাটাই জানেন না। আজকের লেখা থেকে যদি একটি বিন্ধুও আপনারা শিখতে পারেন, তবে এটাই হবে আমার সার্থকতা। আজ এটুকুই, অন্য কোনোদিন অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হবো।
ধন্যবাদ
আবু হাসান রুমি – Abu Hasan Rumi
পূর্বে প্রকাশিত আমার ব্লগে
আমি আবু হাসান রুমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 16 টি টিউন ও 156 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
yap , SIZE DOESN’T MATTER !