প্রিয় টিউনাররা,
আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সালাম নিবেন। কেমন আছেন আপনারা সবাই? সামান্য কিছুদিনের বিরতির পর আপনাদের কাছে ফিরে এলাম এক ভিন্নধর্মী বিষয় নিয়ে। হ্যাঁ, আজব হলেও সত্যি। আজ আমি আপনাদের সামনে এলাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অপরিহার্য বস্তু লিখনি বা কলম ও তার ইতিহাসকে নিয়ে। হাজার বছরের চলে আসা কিছু ঐতিহ্যবাহী জিনিস যা আমরা সেই প্রাচীন কাল হতে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছি। এই ঐতিহ্যবাহী জিনিস গুলি হাজার বছরের পৃথিবীর সংস্কৃতির এক একটি উপাদান। সেই সব উপাদান মানুষকে দেখিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির পথ। আজ এই আধুনিক যুগে আধুনিক পণ্যের কাছে, আধুনিক কলা কৌশলের নিকট মার খেয়ে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে এই ঐতিহ্যবাহী জিনিস গুলি। তো চলুন আর কথা না বাড়িয়ে আমাদের টিউন শুরু করি।
সংস্কৃতির আগ্রগতির পথে মানুষ প্রথমে হিসেব ধারনা এবং পরে বিনোদনের জন্য চিত্র আঁকা হতে লিপির আবিস্কার আর তারপরে মনের কথা লিপিবদ্ধ করে ফেলার জন্য কালি ও কলমের দ্বারা লেখনীর দান অপরিসীম। লিপির যে যুগযুগান্তর ধরে পরিবর্তন ঘটে চলেছে তার জন্য কলমের অবদান ফেলে দেবার মত নয়।
কলম মানে লেখনী। ইংরেজি পেন (pen) শব্দ এসেছে লেটিন শব্দ পেন্না (penna) থেকে, যার মানে হল পাখির পালক। এক কালে পালকের কলম ব্যবহার হত। কলম বা লেখনী বা পেন প্রধানত লেখালেখির কাজে ব্যবহৃত একটি উপকরণ। কলম দিয়ে কাগজ বা কোন পৃষ্ঠতলের উপরে কালি লেপনের কাজ করা হয়। এর ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের। প্রাচীন মিসরীয়রা সম্ভবত প্রথম কলম দিয়ে লেখা শুরু করে। সে সময় অবশ্য কোনো কাগজ ছিল না। তারা লিখত বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকলের ওপর। কলম হিসেবে ব্যবহার করা হতো নলখাগড়া, শর বা বেণু বাঁশের কঞ্চি অথবা ফাঁপা খণ্ড। এসব খণ্ড কলমের মতো করে কেটে সূচালো করে তা কালির মধ্যে চুবিয়ে লেখা হতো। কালিও ছিল গাছের কষ ও নানা রকম প্রাকৃতিক উপাদানে প্রস্তুত। এভাবে চলে বহু শতাব্দী। ৫ শতক থেকে কঞ্চি বা নলখাগড়ার জায়গা দখল করে পাখির পালক। রাজহাঁসের পালক ছিল সে যুগে কলম তৈরির প্রধান উপকরণ। পালককে শক্ত করে তার গোড়া বা মাথা সূক্ষ্মভাবে সূচালো করা হতো যাতে লিখতে আরাম হয়।
আদিম অবস্থায় মানুষ যখন গুহায় ভিতরে বাস করত তখন গুহার ভিতরের দেওয়ালে কোন তীক্ষ জিনিস দিয়ে ছবি আকঁত বা হিজিবিজি আকঁত যাকে। আবার অনেক সময় কোন পাতা বা শিকারের রস বা রক্ত দিয়ে আকিবুকি কাটত। তার অনেক পরে যখন সভ্যতার একটু একটু উন্মেষ ঘটল তখন কাদামাটির পাটায় বা নরম পাথরে লিখা শুরু করে, এদের মাঝে চীনে উটের লোম দিয়ে তৈরি তুলির ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
তবে সম্ভবত প্রথমে মিশরীয়রা একটা কাঠির ডগায় তামার নিবের মত কিছু একটা পরিয়ে লিখা শুরু করে। আর প্রায় হাজার চারের বছর আগে গ্রীসবাসীরা রীতিমত লিখা শুরু করে দেয়। এদের কলম তৈরি হত হাতির দাঁত বা এই জাতীয় কিছু দিয়ে। যার নাম ছিল স্টাইলস (Stylus)। সেজন্য এখনও লিখার ধরন কে "স্টাইল" (Style) বলা হয়ে থাকে। আর মধ্যযুগে কাগজের আবিস্কারের পরে পালকের কলম দিয়ে লিখা প্রচলিত হয়।
প্রাচীন কালের এমন অনেক কলমই রয়েছে যা বর্তমানে শুধুমাত্র জাদুঘরেই দেখা যায়। চলুন আমরা কিছু সেসব কলমের কথা জেনে আসি।
খাগ বা নলখাগড়া, বাঁশ ইত্যাদির একদিক সরু করে কেটে মাথাটা সূক্ষভাবে চিরে এই কলম তৈরি করা হত। এর যান্ত্রিক প্রক্রিয়া কুইলের মত। বিভিন্ন রকম খাগের কলম ব্যবহার করা হত। যেমন-
খাগ বা নলখাগড়া বন এক প্রকার গাছ, অনেকটা বাঁশের কঞ্চির মত। এক সময় এই বন গাছের দ্বারা তৈরি কলম ব্যবহার করা হত। বনের কলম কে কালীর দোয়াতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলে এটি কালি শোষণ করে নিত। এটির কাণ্ড ফাঁপা অনেকটা এখন কার বিভিন্ন রং এর খাতায় দাগ টানার জন্য যে কলম আমরা ব্যবহার করি তার ভিতরের স্পঞ্জের শিষের মত বলে সহজে কালি শুষে নিত। এর পর চলত তা দিয়ে লিখা। কালি শেষ হলে আবার চুবিয়ে নিতে হত।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। আমাদের অনেক দাদারা (৪০-৫০ বছর আগে) বাঁশের তৈরি কলম দিয়ে প্রথম লিখা শিখার হাতে খড়ি নিয়েছে। বাঁশের কঞ্চিকে ৪-৫ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে নিয়ে তার এক প্রান্ত চোখা করে তাতে কালি ভরে কলম হিসেবে ব্যবহার করা হত।
সাধারণত রাজহাঁস বা বড়সড় পাখির পালকের তৈরি কলমকে কুইল (quill) বলে। প্রায় এক হাজার ৩০০ বছর আগে অর্থাৎ ৭০০ খ্রিস্টাব্দে ব্যবহৃত হতো পাখির পালক। বসন্তের সময় পাখির ডানার শেষের দিকের পাঁচটি করে পালক তুলে নেওয়া হতো এ উদ্দেশ্যে। তবে পাখির ডান ডানার চেয়ে বাম ডানার পালক বেশি ব্যবহৃত হতো। কারণ এগুলো বাম দিক থেকে বাইরের দিকে বাঁকানো থাকে বলে ডানহাতি লেখকদের ব্যবহারের জন্য এটা বেশি সুবিধাজনক। এর জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হতো রাজহাঁসের পালক। মরাল বা রাজহংসীর পালক ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য এবং ব্যয়বহুল। নিখুঁত ছবি আঁকার জন্য এর সঙ্গে ব্যবহৃত হতো কাকের পালক। পরে এর সঙ্গে যোগ হয় পেঁচা, ঈগল, রাজপাখি, টুরকি ইত্যাদি পাখির পালক। ডিপ কলম, ঝর্ণা কলম ইত্যাদি আসার আগে কুইল ব্যবহৃত হত। পালকের ফাঁপা অংশ কালিদানি হিসেবে কাজ করত এবং কৈশিক পরিচলন প্রক্রিয়ায় কালির পরিচলন হত। মধ্যযুগে পার্চমেন্ট বা চামড়ার কাগজের উপরে কুইল দিয়ে লেখা হত। পালকের কলম বা কুইল এসে খাগের কলমকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। পালক কলমের খারাপ দিক হলো এটা এক সপ্তাহ পর পর পাল্টাতে হতো এবং এটা তৈরি করতে সময় লাগত বেশি। দামি রুপোর বা তামার কালির পাত্রের সাথে ময়ূরের কলম শোভা পেত রাজা-বাদশাদের সভায়। এ ছাড়া অফিস আদালতে ও সমাজের অভিজাত ব্যক্তি গন কর্তৃক কিছুটা শৌখিনতার প্রতীক হিসেবে কলম হিসেবে ব্যবহার করা হত পালকের কলম। এটি আর দেখা যায় না।
সাধারণত কাঠের হাতলের সাথে একটি ধাতব নিব লাগিয়ে এই কলম তৈরি করা হয়। নিবটি ঝর্ণা কলমের নিবের মতই, তবে এই কলমে কোন কালি জমা রাখার উপযোগী কালিদানি নেই এবং লেখার সময়ে বারবার এটিকে কালিতে চুবিয়ে নিতে হয়। ঝর্ণা কলমের তুলনায় এই কলমে সুবিধা হল এই কলমে ঘন কালি এবং ধাতব কালি ব্যবহার করা যায় যা ঝর্ণা কলমে জমে গিয়ে আটকে যায় অথবা মরিচা ধরে যায়। নিব কলম এখন প্রধানত অলংকরণ, ক্যালিগ্রাফি এবং কমিকস আঁকার কাজে ব্যবহার হয়।
পূর্ব এশিয়ার লিপিবিদরা ঐতিহ্যগতভাবে এ ধরনের কলম ব্যবহার করতেন। এদেরকে ব্রাশ বা বুরুশও বলা হয়। কলমের মূল দেহটি সাধারণত বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হত। এছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু দুর্লভ উপকরণ যেমন - লাল চন্দন গাছ, কাচ, হাতির দাত, সোনা, রূপা প্রভৃতিও ব্যবহার করা হত। কলমের শীর্ষভাগটি বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর (যেমনঃ বেজি, শুকর, বাঘ, মোরগ) পাখা ও লোম হতে তৈরি করা হত। এককালে চীন এবং জাপান উভয় স্থানেই নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর চুল দিয়ে এ ধরনের কলম তৈরি করার রেওয়াজ ছিল, যাদেরকে সারা জীবনের জন্য স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দেখা হত।
আধুনিক কলম আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। আধুনিক কালের প্রথম কলম আবিষ্কার হয় ইংল্যান্ডে ১৭৮০ সালে। ১৮৮৪ সালে ওয়াটারম্যান আবিস্কার করেন ফাউন্টেন পেন। তবে এর নিব তৈরিতে ব্যবহার করা হত ১৪ ক্যারেট সোনা, আর ডগা তৈরিতে লাগত ইরিডিয়াম। এরপরে ইংল্যান্ড ছাড়াও অনেক দেশও ফাউন্টেন পেন তৈরি করা শুরু করে। আর বিংশ শতাব্দীতে এসে তৈরি হয় বল পয়েন্ট পেন বা বলপেন। প্রথম আধুনিক বল পয়েন্ট আবিষ্কার হয় ১৯৮৮ সালের ৩০ অক্টোবর। জন জে লাউড নামে একজন হাঙ্গেরিয়ান সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক প্রথম কলম আবিস্কার ও ব্যবহার করেন। তবে এই কলম তৈরিতে তিনি তার ভাইয়ের সাহায্য নিয়েছিলেন যিনি পেশায় ছিলেন একজন রসায়নবিদ।
কলমের বিবর্তনে এরপর এলো ঝরনা কলম। তাতে সুবিধা ছিলো একবার কালি ভরে নিলে ৮-১০ পৃষ্ঠা একটানা লেখা যেত। তবে এখানেও সেই অসুবিধা ছিলো যে, লেখা বন্ধ করা অবস্থায় নিবের অংশ ক্লিপ দিয়ে ঢেকে না রাখলে কালি শুকিয়ে যেত। একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে বা কালিতে চুবিয়ে নিলেই আবার লেখা চালানো যেত বেশ কিছু সময় ধরে। এই কলমে পানি ভিত্তিক তরল কালি দিয়ে নিবের সাহায্যে লেখা হয়। কলমের ভেতরে কালিদানিতে থাকা কালি কৈশিক পরিচলন প্রক্রিয়ায় এবং অভিকর্ষের সাহায্যে নিবের মাধ্যমে বাইরে আসে। এই নিবে কোন নড়নক্ষম অংশ থাকে না, একটা চিকন ফাটল দিয়ে কালি বেরিয়ে আসে। ভেতরের কালিদানিতে কালি শেষ হয়ে গেলে দোয়াত থেকে আবার কালি ভরা যায়।
এই কলমে আঁশ জাতীয় পদার্থের তৈরি স্পঞ্জের মত ডগা থাকে। সবচেয়ে ছোট এবং চিকন ডগার মার্কার কলম দিয়ে কাগজের উপরে লেখা হয়। মাঝারী আকারের ডগা সমৃদ্ধ মার্কারগুলো বাচ্চাদের আঁকাআঁকির জন্য ব্যবহৃত হয়। বড় আকারের ডগার মার্কারগুলো অন্য মাধ্যমে (যেমন কার্ডবোর্ডের বাক্স বা হোয়াইটবোর্ডে) লেখার কাজে ব্যবহার হয়। উজ্জ্বল এবং স্বচ্ছ কালিসহ চওড়া ডগার মার্কার লেখা দাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এদেরকে "হাইলাইটার"ও বলা হয়। বাচ্চাদের জন্য বা হোয়াইটবোর্ডে লেখার জন্য যে মার্কারগুলো তৈরি করা হয়, সেগুলোর কালি সাধারণত অস্থায়ী ধরনের হয়। কিছু মার্কার যেগুলো প্যাকেজিং এবং চালানের বাক্সের গায়ে লেখার কাজে ব্যবহার করা হয় তাদের কালি হয় স্থায়ী।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে দেশে এক ধরনের সৌখিন কলম দেখা গেলো ‘রিফিল কলম/বলপয়েন্ট কলম’ নামে। প্রায়ই বিদেশ প্রত্যাগতরা নিয়ে আসতেন এসব কলম। এ ক্ষেত্রে অসুবিধা ছিলো বাড়তি রিফিল না থাকলে আর সেটা ব্যবহার করা যেত না। শুরু হলো এরূপ কলম ও রিফিলের আমদানি, চলল বেশ কিছুদিন। তখন একটি কলমে বার বার রিফিল পরিবর্তন করে চালানো হতো। আমাদের দেশে এরূপ কলম খুব বেশিদিন আগে তৈরি হয়নি, বলা চলে শুরু হতেই চালু হল একবার ব্যবহার উপযোগী কলম। এগুলোর রিফিলের কালি শেষ হলেই ফেলে দেয়া যায়। এসব কলমই এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কেননা এ দিয়ে লিখতে ঝামেলা নেই, চিন্তা করে বেশ কিছু সময় নিয়ে লিখলেও কালি শুকিয়ে যাওয়ার ভয় নেই, একটি কলম দিয়ে ২০-২৫ পৃষ্ঠা একনাগাড়ে কিংবা থেমে থেমে লেখা চলে। ক্লিফ দিয়ে নিব বন্ধ না থাকলেও কালি ঝরে কাগজ নষ্ট হবে না ইত্যাদি নানারকম সুবিধা। প্রযুক্তি একটু একটু করে উন্নত হয়ে বিভিন্ন বিশেষণ আগে-পিছে দিয়ে বিজ্ঞাপনের নানা রঙবেরঙের চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো কথা আমাদের নানাভাবে বিভোর করতো এরূপ কলম সম্পর্কে। এই কলমের ডগায় বা নিবে ০.৭-১.২ মি.মি. আকারের পিতল, স্টীল বা টাংস্টেন কার্বাইডের তৈরি একটি ছোট্ট শক্ত বল বা গোলক থাকে যা কলমের ভেতরে থাকা কালিকে কাগজ বা যার উপরে লেখা হচ্ছে তাতে মাখাতে সাহায্য করে। বলপয়েন্ট কলমে যে কালি ব্যবহার করা হয় তা একটু ঘন প্রকৃতির এবং তা কাগজের সংস্পর্শে আসতে না আসতেই শুকিয়ে যায়। এই নির্ভরযোগ্য কলমগুলির দামও খুব কম। ফলে সহজেই নিত্যদিনের লেখালেখির কাজে বলপয়েন্ট কলম সবচেয়ে জনপ্রিয় উপকরণ হয়ে উঠেছে।
এই কলমের ডগায়ও বলপয়েন্ট কলমের মত বল থাকে। কিন্তু এই কলমের কালি বলপয়েন্ট কলমের কালির চেয়ে পাতলা বা কম ঘন। এই কম ঘন কালি সহজেই কাগজ শুষে নিতে পারে, এবং কলমও অনেক মসৃণভাবে চলতে পারে। বলপয়েন্ট কলমের সুবিধা এবং ঝর্ণা কলমের কালির ভাবটাকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে জেল কলমের সূত্রপাত হয়েছিল। জেল কালি বিভিন্ন রঙের হয়, এমনকি ধাতব পেইন্ট ও ঝিকিমিকি রঙেরও জেল কালি পাওয়া যায়।
বহুল ব্যবহূত বলপয়েন্ট কলম এর আবিষ্কারের পেছনে যেমন অবদান রয়েছে বহু আবিষ্কারকের তেমনি এর রয়েছে দীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাসও। এই কলমের যাত্রা শুরু ১৮৮৮ সালে। সে সময় জন লাউড নামে আমেরিকার এক চামড়া ব্যবসায়ী প্রথম এক ধরনের বলপয়েন্ট কলম উদ্ভাবন করে এর স্বত্ব নেন। সেই কলমের একটি ছোট খোপে তরল কালি রাখা হতো। সেখান থেকে কালি কলমের মাথায় নেমে আসত। মাথায় লাগানো ছিল রোলার বল টিপ। ওটা কালি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করত। বলা চলে এই জন লাউডের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো বলপয়েন্ট কলমের ধারণা পায় মানুষ। যদিও স্রেফ উদ্ভাবনে আটকে থেকে এর বাণিজ্যিক উত্পাদনের দিকে মনোযোগ দেননি লাউড। আর তাই আবিষ্কারের পর তা হাতে নেওয়ার সুযোগও হয়নি সে সময়কার মানুষের। জন লাউডের এই আবিষ্কারের পরের ত্রিশ বছরে আরও ৩৫০টি বলপয়েন্ট কলমের প্যাটেন্ট আবেদন গৃহীত হলেও সেগুলোর কোনোটাই খুব একটা কার্যকর ছিল না। বরং প্রতিটি কলমের জন্যই প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিত কালি। কারণ কালি বেশি তরল হলে বলের ফাঁক দিয়ে তা চুঁইয়ে বেরিয়ে আসত। আবার কালি ঘন হলে লেখার সময় প্রয়োজনীয় পরিমাণে কালি নেমে আসত না। এ ছাড়া আবহাওয়ার তারতম্যের কারণেও কালির ঘনত্ব বেড়ে বা কমে যেত। তাই সে সব কলম কখনও ব্যাপকভাবে উত্পাদিত হয়নি। এ বাস্তবতায় বল পয়েন্টের ইতিহাসে যুক্ত হন হাঙ্গেরির জর্জ ও লেডিসলাস বিরো নামের দুই ভাই। ১৯৩৫ সালে তারা সত্যিকার অর্থে একটি উন্নতমানের বলপয়েন্ট কলম আবিষ্কার করেন এবং ১৯৪৩ সালে তারা আর্জেন্টিনায় বিশ্বের প্রথম বলপয়েন্ট কলমের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এই কলমেও থেকে যাওয়া কিছু ত্রুটি সারিয়ে সত্যিকারের কর্মক্ষম বলপয়েন্ট আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমেরিকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সিকাগোর অধিবাসী এবং পেশায় নাবিক মিল্টন রেনল্ডস আর্জেন্টিনা থেকে কয়েক ধরনের বিরো বলপয়েন্ট কলম আমেরিকায় নিয়ে আসেন এবং তার হাত ধরেই বিরো ভাইদের বানানো বলপয়েন্ট কলমের অবশিষ্ট ত্রুটিগুলো দূর হয়। আর সবদিক দিয়ে ত্রুটিমুক্ত একটি কলম প্রথম বাজারে আসে ১৯৪৫ সালে। যদিও প্রথমদিকের একেকটি বলপয়েন্টের জন্য ক্রেতাদের প্রায় সাড়ে বারো ডলারের মতো উচ্চমূল্যই পরিশোধ করতে হতো।
লেখার কাজে কলম একটি মাধ্যম। বিজ্ঞান সেখানেও তার দৃষ্টি ফেলে সৃষ্টি করে হাতলের কলমের, যা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থেকে বহুদিন কাজ চালিয়ে এসেছে। এখানে নানা অসুবিধার মধ্যে যেটা প্রকট ছিলো সেটা হল, বার বার কালিতে চুবিয়ে নিতে হত এরূপ কলম, আবার বেশ কতক্ষণ হাতের মধ্যে থাকলে কালি যেত শুকিয়ে ইত্যাদি। অনবরত ও একই ধারায় কালি বেরোনোর প্রযুক্তি কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত। আর এ ব্যবস্থা দিন দিন আরো উন্নত হচ্ছে বলেই এর জনপ্রিয়তাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রিফিলের কালি সাধারণ কালির মত পাতলা নয়, চটচটে আঠালো পদার্থ। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে উপরের বস্তু নিচের দিকে নেমে আসে, ঠিক সেই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে রিফিলের চটচটে আঠালো কালি লেখার সময় নিচের দিকে নেমে আসে। কিন্তু বাইরে আসতে বাধা দেয় একটি বলের মত গোল ধাতব পদার্থ যা থাকে সকেটের মধ্যে। লেখার সময় কলম চলতে থাকলে বলটা সকেটের মধ্যে ঘুরতে থাকে, বলের ভিতরের যে অংশে কালি থাকে লেখার সময় কালি মেখে সে অংশটা চলে আসে বাইরে। কাগজে চাপ দিলেই লেখা ফুটে উঠে, শব্দের পর শব্দ লিখছি। কলম এগিয়ে চলছে কাগজের উপরে, বলের যে-দিকে কালি লাগানো নয় তা ঘুরে এলে ভিতরে কালি মেখে ঘুরতে ঘুরতে আবার সে বাইরে চলে এলো। এভাবে সকেটের মধ্যে পুরো ব্যাপারটি চলে কোনরূপ বাধা না পেয়ে, একদম অবিরাম গতিতে। এর ফলে বলের মুখের কালি মাখানো শুকায় না। কলম চললে বল ঘুরবেই আর বল ঘুরলেই কালি আসবেই। কারণ, বাইরের মুখ ছোট বলে বল ঘুরে ভিতরে আসতেই ভিতরের মুখ কালি নিয়ে চলে এলো বাইরে। লেখা শেষ, কলম বন্ধ হলো, এর পুরো কর্মপদ্ধতি বন্ধ হলো। অর্থাৎ বলের ঘোরা-ফেরা বন্ধ হলো, কালি আসাও ব বন্ধ হলো। অর্থাৎ রিফিলের মুখ বন্ধ হলো। কালি বাইরে আসতে পারে না বলে শুকিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।
নিচে বসে উপরের দিকে লিখতে চাইলে বা বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে লিখতে চাইলে বল ঘুরবে ঠিকই, কিন্তু কালি যেহেতু নিচের দিকে রয়ে যাচ্ছে তাই কালির সাথে বলের সংযোগ হচ্ছে না বলে লেখাও সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ঝরনা কলমের মত রিফিল কলমেও লেখা সম্ভব হয় না। এটা এখনো সমস্যা রয়ে গেলো। আগামীদিনের বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে অবশ্যই ভাববেন। আমাদের আশা এ সামান্য সমস্যা দূর হবে এবং এ ক্ষেত্রে আমরা সব অবস্থাতেই লিখতে পারবো রিফিল কলম দিয়ে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে বলটি কোন শক্ত ধাতব বস্তুর সাথে ঘষা না লাগে। কেননা তাতে বলের মসৃণতা দূর হবে এবং অনবরত ঘুরে যাওয়ার প্রযুক্তি নষ্ট হবে; এ কারণেই অনেক সময় বাচ্চাদের হাতে রিফিল কলম দিলে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আর তেমন কোন অসুবিধে নেই।
আজ আর না। এবার বিদায়ের পালা এসে গেল। টিউনটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে অথবা বুঝতে যদি কোন রকম সমস্যা হয় তাহলে আমাকে টিউমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। সবার সর্বাঙ্গিন মঙ্গল কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। দেখা হবে আগামী টিউনে অন্য কোন বিষয় নিয়ে।
আমি আবু হাসান রুমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 16 টি টিউন ও 156 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।