আজ যে একুশে ফেব্রুয়ারি—এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সন্দেহ আছে এ দিনটার পরিচয় নিয়ে। আজ কি শহীদ দিবস, না ভাষা দিবস, নাকি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস? এর কোন পরিচয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য?
এককথায় এসব উত্তর দেওয়া অসম্ভব। তার কারণ, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব, ৬২ বছর ধরে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে ঠিকই, কিন্তু এ দিনের পরিচয় আগাগোড়া একই ছিল না, অথবা এর তাৎপর্যও চিরদিন অভিন্ন ছিল না। নানা সময়ে এ দিনটাকে একেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
১৯৫২ সালের ২১ এবং তার পরের দিন—২২ ফেব্রুয়ারি—ভাষার দাবিতে ঢাকা শহরে রক্তপাতের যে ঘটনা ঘটেছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং একেবারে নজিরবিহীন। পৃথিবীর অন্য কোথাও তখন পর্যন্ত বিশেষ একটি ভাষাকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে এ রকম আবেগপূর্ণ আন্দোলন হয়নি; গুলি করে মানুষ মেরে সে আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টাও হয়নি। (পরে হয়েছে।) কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না, একুশের আন্দোলনের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল একটাই—দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদাদানের দাবি আদায় করা। রাজনীতিকেরা সে আন্দোলনের নেতৃত্বও দেননি, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্ররা। সে জন্যই ‘ভাষা আন্দোলন গোড়াতে অরাজনৈতিক আন্দোলন ছিল’—এ কথা বললে খুব একটা ভুল হবে না। আমার ধারণা, বায়ান্নর আন্দোলনের ঠিক পরে ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করলে এ আন্দোলন দানা বাঁধত না, ক্রমেই শক্তিশালী হয়েও উঠত না। এমনকি এ আন্দোলনের পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে যা যা ঘটেছিল, তা-ও ঘটত কি না, সন্দেহ হয়।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আকস্মিক রক্তপাতের পরের দিন আন্দোলনের প্রতি কেবল ছাত্রদের নয়, সাধারণ মানুষেরও ব্যাপক সমর্থন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই জনসমর্থন সত্ত্বেও আন্দোলনটা তখনকার মতো সীমাবদ্ধ ছিল প্রধানত ঢাকা শহরের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে। তা থেকে সরকার যদি মনে করে থাকে যে একবার ঢাকার আন্দোলনে ভাটা পড়লে ভবিষ্যতে এ আন্দোলন আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে না, তাহলে অবাক হওয়ার কারণ নেই। সে জন্যই, সরকার সমঝোতার পথ ধরে সমস্যার সমাধান করতে চায়নি, বরং এই আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্রনেতাকে আটক করে। এই পদক্ষেপে খানিকটা সাফল্যও এসেছিল। কারণ, পুলিশের ধরপাকড়ের ফলে ছাত্রদের মূল আন্দোলন তখনকার মতো স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি ছাত্রদের ভালোবাসা ক্ষীণ হয়নি অথবা তাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও তাঁরা ভুলে যাননি, তা বোঝা যায় পরের বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি। সে দিনটি আসার আগেই ছাত্ররা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করার, তাতে সরকারের তরফ থেকে বাধা যতটাই আসুক না কেন। মনে হয়, সে পর্যায়ে এ দিনটিকে কী নামে ডাকা হবে, তা নিয়ে একটা দ্বিধা ছিল। প্রথম দিকে সাধারণভাবে একে চিহ্নিত করা হয়েছিল স্রেফ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যেমন তাঁর গানে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বলেছিলেন। পরের বছর হাসান হাফিজুর রহমানও তাঁর সংকলনের নাম দিয়েছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারি।
শহীদ দিবস নামটা তখনো জনপ্রিয় হয়নি, তবে ‘শহীদ’ কথাটার ব্যবহার প্রথম লক্ষ করি ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। যেখানে ছাত্রদের ওপর প্রথম গুলি চলেছিল, সেখানে ছাত্ররা নিজেদের হাতে যে মিনার নির্মাণ করেছিলেন নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে, তার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন ‘শহীদ মিনার’। সেই থেকে ভাষা আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিরা পরিচিত হন শহীদ হিসেবে এবং একুশে ফেব্রুয়ারির নামও হয় শহীদ দিবস। ১৯৫২-৫৩ সালে বাংলা ভাষার প্রতি গোটা প্রদেশের জনগণের মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল, তা ছিল ঘুমন্ত অবস্থায়। শুরুতে সরকার এটা ঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। অনুমান করতে পারেনি যে বরফের বলের মতো এ আন্দোলন ক্রমাগত ছোট থেকে বড় হতে থাকবে এবং ঢাকার সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়বে গোটা প্রদেশে। বোধ হয়, ছাত্ররাও ভাবেননি তাঁদের এ আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষ এমন প্রবল সমর্থন দেখাবে। তাঁরা নিজেরাও বোধ হয় ভাবতে পারেননি যে অল্প কয়েকটি ইট দিয়ে তাঁরা যে প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন, একদিন তা বিশাল সৌধে পরিণত হবে।
সরকার এ আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝতে পারেনি বলেই এর পরও বাংলার দাবিকে ঠেকিয়ে রাখার এবং বাংলার বদলে উর্দুকে প্রচলিত করার নানা রকমের ফন্দি আঁটছিল। এসবের মধ্যে ছিল সরকারের প্রাত্যহিক কাজের ভাষায়, যেমন মুদ্রা ও নোট, পোস্টকার্ড ও খাম, মানি অর্ডার ফরম এবং সরকারি অন্য কাগজপত্রে ইংরেজির সঙ্গে উর্দু ব্যবহার করা, কিন্তু বাংলা ব্যবহার না করা; আরবি অথবা ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ; রেডিও এবং মাহে নও-এর মতো সরকারি মাধ্যম ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি করা; কখনো পাঠ্যপুস্তকে পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দান; রবীন্দ্রনাথের নাম মুছে ফেলে ইকবালের নাম ব্যবহার করা ইত্যাদি। কিন্তু এসব সরকারি অপকৌশল বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালিদের ভালোবাসায় ঘাটতি ঘটাতে পারেনি, উর্দুর প্রতি ভালোবাসাও সৃষ্টি করতে পারেনি।
মনে হয়, বাংলা ভাষার প্রতি জনগণের ভালোবাসা কত গভীর এবং এর প্রতি আবেগ কত জোরালো, তা বুঝতে পারলে সরকার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। বাংলা ভাষার প্রতি জনগণের আন্তরিক ভালোবাসাকে ব্যবহার করার যে কৌশল সরকার নিতে পারেনি, সেই কৌশলই পরের বছর ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কাজে লাগিয়েছিল সম্মিলিত বিরোধী দল (যুক্তফ্রন্ট)।
এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রায় একতরফাভাবে বিজয়ী হয়েছিল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার পরিচিত হয়েছিল একুশ দফা নামে। আর, এই একুশ দফার মধ্যে একাধিক দফা ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্যের চর্চা সম্পর্কে। অর্থাৎ নির্বাচনে বিজয়ের জন্য যুক্তফ্রন্ট বাংলা ভাষার প্রতি জনগণের ভালোবাসা এবং আবেগ কাজে লাগিয়েছিল। বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্টের জাতীয়তাবাদী সরকার বেশি দিন টিকে থাকেনি, কিন্তু বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ১৯৫৬ সালে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিও সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছিল। তা ছাড়া, শহীদ মিনারও বড় করে নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৫৮ সালে।
অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তার কারণ, বাংলা যা পেয়েছিল, তা হলো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নিতান্ত কাগুজে স্বীকৃতি। উর্দু যেমন ইংরেজির পাশাপাশি সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে অগ্রাধিকার লাভ করেছিল, সে অধিকার তার বজায় থাকলই; তার পাশে বাংলা তার ন্যায্য অধিকার আদায় করে নিতে পারেনি।
কিন্তু সরকারি মহলে বাংলা যতই অবহেলিত হোক বা ষড়যন্ত্রের শিকার হোক, এ ভাষার প্রতি তত দিনে সত্যিকার ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল শিক্ষিত-অশিক্ষিত তাবৎ মানুষের মনে। আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল নানাভাবে। যেমন বাংলায় সন্তানদের নাম রাখা, বাড়ির নাম রাখা, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলামের মতো বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের জন্মদিন উদ্যাপন করা, নববর্ষ ও ঋতু উৎসব পালন করা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতি তথা বাংলা গান শোনা, গাড়ির নম্বর এবং দোকানের নামফলক বাংলায় লেখা ধীরে ধীরে ফ্যাশনে পরিণত হচ্ছিল। এসব সাংস্কৃতিক প্রবণতার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন-সম্পর্কিত যেসব দাবি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময়ে উত্থাপিত হয়েছিল, সেসবও তত দিনে জোরালো হয়ে উঠেছিল। সর্বোপরি, যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক মনোভাবের জন্ম দিয়েছিল এবং এ মনোভাব তার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ লাভ করেছিল একুশের আন্দোলন এবং একুশের প্রতীক শহীদ মিনার থেকে। শহীদ মিনার পরিণত হয়েছিল সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক আন্দোলনের শপথমঞ্চে।
আগেই বলেছি, প্রথমে ভাষা আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান। কয়েক বছরের মধ্যে সে মর্যাদা লাভও করেছিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় ফল ফলেছিল অন্য পথে। অচিরেই ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানকে ঠেলে দিয়েছিল, যে উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল, তার উল্টো পথে। মনে রাখা দরকার, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মীয় রাজনীতির ফলে—দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি ছিল অমুসলমান। তা সত্ত্বেও রাজনীতিকদের নীলনকশা অনুযায়ী পূর্ব বাংলা হওয়ার কথা ছিল মুসলমানের স্বাধীন স্বদেশভূমি। পাকিস্তানের নেতাদের হয়তো স্বপ্ন ছিল দেশের সিকিভাগ অমুসলমান জনগোষ্ঠীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশত্যাগ করানোর। ১৯৫০ সালের হিন্দুবিরোধী দাঙ্গা থেকে এর পরোক্ষ প্রমাণও মেলে। হিন্দু তাড়ানোর উল্টো পিঠে ছিল মুসলমানের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানো—উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে এবং তথাকথিত মুসলমানি বাংলা শিখিয়ে বাঙালি মুসলমানকেও সাচ্চা পাকিস্তানিতে পরিণত করার। পরের দশকে আইয়ুব খান এই পরিকল্পিত মুসলমানি বাংলাকে নাম দিয়েছিলেন পাকিস্তানি ভাষা।
কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি মুসলমান উর্দু মেশানো বাংলাকে গ্রহণ না করে সাত-আট শ বছর ধরে যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য রচিত হয়েছিল, সেই বিশুদ্ধ বাংলার চর্চা করতে আরম্ভ করল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তাদের গর্বের বস্তুতে পরিণত হলো। যে রবীন্দ্রনাথ তথা অমুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের সম্পর্কে মুসলমানের মনে একধরনের দূরত্ব-বোধ ছিল, নিজেদের বলে মনে না করার বোধ ছিল, ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে তা দ্রুত পাল্টে যেতে আরম্ভ করল। কবি-সাহিত্যিকেরা কোন ধর্মাবলম্বী, তার চেয়ে প্রাধান্য লাভ করল বাঙালি হিসেবে তাঁদের পরিচয়। এভাবে ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে একটা জোরালো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার জন্ম দিল। তার সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো যুক্ত হয়ে জন্ম নিল সেই আন্দোলন, যাকে এক কথায় বলতে পারি: বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
মোটকথা, ১৯৫২ সালে যেভাবে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এবং তার যে সীমিত লক্ষ্য ছিল, পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে তা অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছিল। তখন আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল না, বরং তখন তার সাধনা হলো বাঙালিয়ানা অর্জনের। চিন্তায়, চেতনায়, চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে, খাদ্যে-গৃহসজ্জায় ও সামাজিক উৎসবে—সর্বত্রই কম-বেশি বাঙালিয়ানার ছাপ পড়তে আরম্ভ করল। সেই সঙ্গে রাজনীতির অঙ্গনে জোরদার হতে থাকল পূর্ব বাংলার সমানাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের লড়াকু দাবি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সংক্ষেপে এই ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির পরিচয়—তার নাম একটাই—শহীদ দিবস; আর তার লক্ষ্য: একুশের শহীদদের স্মরণ করা এবং সেই সঙ্গে বাঙালিয়ানার চর্চা করা এবং স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি অনুপ্রেরণা লাভ করা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ দিনটির নাম নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তার একটা কারণ, ‘শহীদ’ কথাটার অর্থ তত দিনে সম্প্রসারিত হয়েছিল। শহীদ বললে তখন আর কেবল ভাষা আন্দোলনের সময়ে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের বোঝাত না, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে যে কয়েক লাখ লোক নিহত হয়েছিলেন, তাঁদেরও বোঝাত। সে জন্য, ‘শহীদ দিবস’ বললে যে একুশে ফেব্রুয়ারিকেই বোঝাবে—এমন নিশ্চয়তা ছিল না। তা ছাড়া, এর সঙ্গে রাজনীতির হাওয়া কোন দিকে বইছিল, তারও যোগ ছিল।
আমার সামনে সংবাদপত্রের পুরোনো ফাইল নেই, কাজেই সঠিকভাবে বলতে পারছি না। কিন্তু সাধারণ ধারণা থেকে আমার মনে হয়: উত্তর-মুজিব আমলে বাঙালিয়ানায় যখন ভাটা পড়ে এবং তার জায়গায় দেখা দেয় সাম্প্রদায়িকতার প্রবল বন্যা, ‘শহীদ দিবস’ নামটা নিয়ে ষড়যন্ত্র দেখা দেয় তখন থেকে। শহীদ দিবসের বদলে তখন থেকে সরকারি উদ্যোগে ‘ভাষা দিবস’ কথাটা চালু করার সজ্ঞান প্রয়াস চালানো হয়। সেই সঙ্গে সযত্ন প্রচেষ্টা চালানো হয় শহীদ দিবসের অসাম্প্রদায়িক বাঙালিয়ানার স্পিরিট মুছে ফেলার। এটা শুরু হয় ফৌজি-রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলে আর তা অব্যাহত থাকে ফৌজি-রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলেও। অব্যাহত থাকে বললে আসলে সম্পূর্ণ সত্যটা বলা হয় না—আসলে জিয়ার থেকে এক ধাপ এগিয়ে যান এরশাদ। একুশের বাঙালিয়ানা এবং অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে তিনি শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। শহীদ দিবস, যা কি না অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল প্রতীক, তাকে উৎসাহ দেওয়ার বদলে ভাষা আন্দোলনে যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের ‘আত্মার সদ্গতির জন্য’ এরশাদ ইসলামি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অসাম্প্রদায়িকতার অন্য যেসব প্রতীক ছিল, সেসবের ওপরও খড়্গের আঘাত নেমে আসে। শহীদ দিবসের লক্ষ্যও বদলে যায় অনেকাংশে।
একুশের নাম নিয়ে আরেকবার সংশয় দেখা দেয় নব্বইয়ের দশকের শেষে ইউনেসকো যখন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বলে ঘোষণা দেয়। কানাডাবাসী দুজন বাঙালি—আবদুস সালাম আর রফিকুল ইসলাম—ইউনেসকোর কাছে প্রস্তাব করেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। এরপর বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাব দিলে ইউনেসকো তা মেনে নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এ দিনের নাম-তারিখ আর উদ্দেশ্য নিয়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত থেকে আমাদের অনেকের মনে হয়েছিল যে এ বুঝি সারা পৃথিবীতে আমাদের শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। সুতরাং আমরা আমাদের শহীদ দিবস কথাটা বর্জন করে তাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে শনাক্ত করলাম।
আসলে, এ দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণ করার সময়ে ইউনেসকো যে যুক্তি দিয়েছিল, তা হলো পৃথিবীর বহু লোকই নিজেদের মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন নয়। সুতরাং বছরে কোনো একটি দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে মাতৃভাষাকে স্মরণ করলে তা মাতৃভাষা চর্চা করার প্রতি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলবে। আর, একুশে ফেব্রুয়ারি যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানে মাতৃভাষার দাবিতে প্রথম রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছিল, সে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটাকেই নির্বাচন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
এরপর বাংলাদেশের অনেকেই শহীদ দিবসের বদলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে বেশি মর্যাদাপূর্ণ বলে গণ্য করেন। কিন্তু আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে পালন করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে নয়, বরং আমাদের নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের স্মরণে। আর, ‘মোদের গরব, মোদের আশা’, আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা জানানোর জন্য। মাতৃভাষার প্রতি সচেতনতা ও ভালোবাসা আমাদের আছে অফুরন্ত পরিমাণে। তাই আমাদের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিতান্তই অবান্তর। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, সেটা আমাদের গর্বের বিষয়।
বরকত-সালাম-রফিক নিহত হয়েছিলেন অর্ধশতাব্দীরও আগে। তারপর এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একুশের মূল লক্ষ্য হারিয়ে গেছে। বদলে গেছে একুশে পালনের স্পিরিটও। যখন পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, তত দিন এ দিনের সঙ্গে বাংলা ভাষা নিয়ে যে ভালোবাসা ও গর্ববোধ, দেশপ্রেম এবং পবিত্র-গাম্ভীর্য জড়িত ছিল, স্বাধীনতার পর থেকে তার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। শহীদ দিবস এখন উৎসবের দিন। তাকে আমরা আনন্দ ও আড়ম্বরের সঙ্গে স্মরণ করি, কিন্তু সে আর আমাদের আগের মতো অনুপ্রাণিত অথবা উদ্দীপ্ত করে না। প্রতিজ্ঞা ও সংকল্প নিতে প্রেরণা জোগায় না। কেবল তা-ই নয়, তরুণদের অনেকে জানেনও না একুশের ইতিহাস। অনেকে শহীদ দিবসকে মনে করেন স্বাধীনতা দিবস বলে। সন্দেহ নেই, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তাই বলে একুশে আমাদের স্বাধীনতা দিবস নয়। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, স্বাধীনতাও আমরা লাভ করেছি, কিন্তু একুশের সব লক্ষ্য আমরা অর্জন করিনি। এ দিনের ইতিহাস আমাদের ভালো করে জানা উচিত। এবং বাংলা ভাষা ও ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িকতা অর্জনের প্রতি আমাদের আরও নিষ্ঠা থাকা উচিত।
সংগৃহীত
মূল লেখকঃ গোলাম মুরশিদ
দেখে নিতে পারেন ‘আমার লক্ষ্য’ এর অন্যান্য টিউনসঃ
আমি Md_Nadim_Hossain। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 21 টি টিউন ও 63 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কথাগুলো একেবারে নির্ভেজাল সত্যি। এতে চিন্তার খোরাক রয়েছে। যদি সংগৃহীত লেখা তবুও পোষ্ট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি পড়ে নিজের মাঝে চেতনা জাগ্রত হয়।