বিচিত্র আমাদের এই জগত | কতরকমের প্রাণী এই জগতে | কতরকমের স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর, পাখি | সমস্ত প্রাণীরই মস্তিস্ক আছে | কিন্তু এদের সবার থেকে আলাদা মানুষের মস্তিস্ক | অবশ্য মানুষের মস্তিস্ক সবচেয়ে বড় আকারের নয়, কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে এর সমকক্ষ কেউ নেই | অন্যান্য প্রানীদের মস্তিস্কের সাথে মানুষের মস্তিস্কের প্রধান পার্থক্য হলো কল্পনা, কথা বলার ক্ষমতা এবং বিভিন্ন রকমের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতায় |
কত ধরনের কাজই না করে মানব-মস্তিস্ক :
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, হৃদস্পন্দন এর হার, শ্বাসকার্য |
দেখে, শুনে, ছুঁয়ে, স্পর্শ করে, স্বাদ নিয়ে মানুষ কতরকমের তথ্য আহরণ করে | মস্তিস্ক সেই সমস্ত তথ্য গ্রহণ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করে |
মানুষের হাঁটা, চলা, দৌড়ানো, কথা বলা, শোয়া, বসা এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে |
চিন্তা, চেতনা, নানারকমের আবেগ এর আধার এটি |
এতসব প্রভূত পরিমান কাজ নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয় সাধন করে মানুষের মস্তিস্ক, যেটির আকার ছোট একটি ফুলকপির মতই ! কি করে সম্ভব এত স্বল্প পরিসরে এত ব্যাপ্তি ? কি করে করে মস্তিস্ক এসব ?
এই ফুলকপির মতো দেখতে কুঁচকানো মস্তিস্ক, যাকে আমরা চলতি কোথায় ঘিলু বলি এবং তার সাথে সুষুম্নাকান্ড এবং তাদের সংশ্লিষ্ট স্নায়ুতন্ত্র; এগুলো মিলেই তৈরী করেছে অবিশ্বাস্য রকমের জটিল এবং নিরবিচ্ছিন্ন এই Information Processing System | যাকে বলা হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম (Central Nervous System) | আমাদের সমস্ত সচেতন, এমনকি অসচেতন ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রনের আধার এটি |
নিউরনের গঠন
এবার একটু ভেতরে ঢোকা যাক | জানা যাক ব্রেন তথা কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্র এর ভেতরের প্রাথমিক গঠন কিরকম এবং সেগুলো কিভাবে কোন কাজগুলো করে |
শরীরের গঠন মূলক একক হলো কোষ | অর্থাৎ, বাড়ি তৈরী হয় যেমন একটা একটা ইঁট দিয়ে | যেকোনো প্রাণী শরীর তৈরী তেমনি কোষ দিয়ে | কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্র এর গঠন মূলক একক ও হলো কোষ | তবে শরীরের অন্যান্য অংশের কোষের সাথে এর একটু পার্থক্য আছে | এমনিতে গঠনগত দিক থেকে বা চারিত্রিক দিক থেকে তেমন কোনো পার্থক্য নেই কিন্তু আচার আচরণের দিক থেকে অনেক তফাৎ আছে এদের সাধারণ কোষের সাথে | এদের বিশেষ ধরনের তড়িত-রাসায়নিক সংবহনতাই এদের আলাদা করে তুলেছে শরীরের অন্য কোষের থেকে | তাই স্নায়ুকোষের নাম আলাদাই দেয়া হয়েছে যাকে বলা হয় নিউরন (Neuron) |
১০০০০০০০০০০০ টি নিউরন দিয়ে তৈরী হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্র !! এই নিউরন গুলো তড়িত রাসায়নিক সংকেত আহরণ এবং সংবহন করতে সক্ষম | এই ক্ষমতার জন্যই এরা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ তৈরী করে একটি নিরবিচ্ছিন্ন এবং একক সংশ্লেষণ কেন্দ্র তৈরী করতে সক্ষম হয় |
নিউরনের কোন অংশ কি কাজ করে সেটা জানার আগে জেনে নি, এর কি কি অংশ আছে |
নিউরন ৩টি প্রাথমিক অংশ দিয়ে তৈরী :
সেল বডি (Cell Body) বা সমা (Soma) : এটি নিউরনের প্রধান অংশ | এর মধ্যেই থাকে নিউক্লিয়াস(Nucleus), এন্ডপ্লাসমিক রেটিকিউলাম(Endoplasmic Reticulum), রাইবোজম(Ribosome) | এটিই নিউরনের প্রধান অংশ | সেল বডি নষ্ট হয়ে গেলে নিউরনের মৃত্যু ঘটে |
এক্সন(Axon) : সেল বডি থেকে বেরোনো লেজ এর মতো অংশটাকে বলা হয় এক্সন | এই অংশটা নিউরনের "ইলেকট্রিক্যাল তার" এর মতো কাজ করে | অর্থাৎ, এর মধ্যে দিয়েই ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সংকেত আসা যাওয়া করে | কারেন্ট এর তারের ওপর যেমন রবারের আবরণ দেয়া থাকে ইনসুলেশন এর জন্য, এর ওপরেও তেমনি একটা আবরণ দেয়া থাকে যাকে বলা হয় মায়েলীন শিথ(Myelin Seath) | মায়েলীন শিথ অবশ্য রবারের তৈরী নয় ! এটি তৈরী হয় ফ্যাট আর প্রোটিন দিয়ে | আর এর কাজ ইনসুলেশন করাও নয় | এর কাজ হলো এক্সনের মধ্যে দিয়ে ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সংকেত এর আনাগোনা দ্রুত করা | সব ধরনের কোষের এক্সনে অবশ্য মায়েলীন শিথ থাকেনা | যেসব নিউরনের এক্সন অনেকটা লম্বা হয়, তাদের ওপরেই এই আবরণ থাকে |
ডেনড্রাইটস(Dendrites) : শিকড় এর মতো দেখতে এই অংশটি নিউরনগুলোর একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখতে সাহায্য করে | এটি এক্সনের শেষে বা সেল বডির গায়েও থাকতে পারে |
এ তো গেল নিউরনের বিভিন্ন অংশের সংক্ষিপ্ত পরিচয় |
এবার দেখা যাক কতরকমের নিউরন হয় |
নিউরনের প্রকারভেদ
আকারভেদে নিউরন নানারকমের হয় | যেমন আমাদের আঙ্গুলের ডগায় যে সেনসরি নিউরন থাকে সেগুলোর এক্সন বাহু পর্যন্ত লম্বা হয়, আবার মস্তিস্কের ভেতরে যেসব নিউরন হয় তাদের দৈর্ঘ্য মাত্র কয়েক মিলিমিটার পর্যন্ত হয় | তবে নিউরনের প্রকারভেদ করা হয় সাধারণত ওগুলোর কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ কোনটা কি কাজ করে |
কার্যভেদে নিউরনের প্রকারভেদ নিম্নরূপ :
সেনসরি নিউরনস(Sensory Neurons) : শরীরের বাইরের অংশ (যেমন ত্বক) থেকে উদ্দীপনা বা সংকেত বহন করে নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রে |
মোটর নিউরনস(Motor Neurons) : এর কাজ সেনসরি নিউরনস এর ঠিক উল্টো | এরা কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্র থেকে আদেশমূলক সংকেত বহন করে নিয়ে যায় শরীরের বাহ্যিক অংশে, যেমন পেশী, ত্বক, গ্ল্যান্ড ইত্যাদি |
ইন্টারনিউরনস(Interneurons) : এর কাজ অন্যান্য নিউরনের মধ্যে যোগাযোগকারী হিসাবে কাজ করা | এদের দেখা যায় ব্রেন আর সুষুম্নাকান্ডের অংশে |
এইসমস্ত নিউরন মিলে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রয়োজন মতো বিভিন্ন রকমের নেটওয়ার্ক বানায় - ছোট, বড়, সরল, জটিল - বিভিন্ন গঠনের নেটওয়ার্ক |
এইসব নেটওয়ার্কের মধ্যে সবচেয়ে সরল ধরনের হলো (Monosynaptic Reflex Pathway) | ছোটবেলার জীবনবিজ্ঞান বইতে পড়া সেই পরীক্ষার কথা মনে আছে তো? হাঁটু ঝুলিয়ে রেখে মালাইচাকির ঠিক নিচের বিশেষ জায়গায় শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করলে হাঁটুটা আপনাআপনি ঝাঁকুনি মেরে ওঠে | এই পুরো ব্যাপারটাই পরিচালনা করে সেনসরি নিউরনস আর মোটর নিউরনস দিয়ে তৈরী একটা মোনোসিনাপটিক রিফ্লেক্স পাথওয়ে |
যখনই ওই শক্ত বস্তুর আঘাত ঠিক ঠিক জায়গাতে লাগে, ওখানের রিসেপ্টর(Receptor) ওই উদ্দীপনা সংগ্রহ করে পাঠায় সেনসরি নিউরনস এ | আর সেনসরি নিউরনস ওটাকে পাঠায় সুষুম্নাকান্ডে | সুষুম্নাকান্ডেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে এর প্রতিক্রিয়াতে শরীর কি করবে | সেই সিদ্ধান্ত তড়িত রাসায়নিক সংকেত হিসাবে পাঠানো হয় মোটর নিউরনস এ | এবার মোটর নিউরন উপযুক্ত পেশীকে নির্দেশ দেয়, যাতে সেটা উদ্দীপ্ত হয়ে সংকুচিত হয় এবং তার ফলেই পা টা ঝাঁকুনি মেরে ওঠে |
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো; এই পুরো প্রক্রিয়াতে মানুষের মস্তিস্ক একটু অংশগ্রহন করেনা বা বলা উচিত যে অংশগ্রহন করার দরকারই পড়েনা | সুষুম্নাকান্ডই এই "সামান্য" ব্যাপারটা পরিচালনা করতে সক্ষম | আসলে ঐখানে ওরকম করে আঘাত করলে যে হাঁটুটা ঝাঁকুনি মেরে উঠতে হবে, সেটার নির্দেশ আগে থেকেই "হার্ড-ওয়্যার্ড" করা আছে, যার ফলে মস্তিষ্কের মতো উন্নত জিনিস ক্ষয় করতে হয়না এই সামান্য সিদ্ধান্ত নিতে |
শরীরের আরো অনেক জায়গাতে এরকম "হার্ড-ওয়্যার্ড" রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া আছে, যেগুলো সম্পন্ন করতে ব্রেইন এর হস্তক্ষেপ এর দরকার পড়েনা | কিন্তু এরপর যখন জটিল হতে থাকে পরিস্থিতি তখন নিউরনের "সার্কিট" আরো জটিল হয়; তখন মঞ্চে নামে মস্তিস্ক |
মস্তিস্কের অংশগুলো
এবার দেখা যাক ব্রেইন এর প্রধান আর প্রাথমিক অংশগুলো কি কি |
খুব ছোট এবং সরল শারীরবৃত্তীয় গঠনের যেসব প্রাণী তাদের ব্রেইন তো দূরের কথা, কেন্দ্রীয় কোনো স্নায়ুতন্ত্রও থাকেনা | তাদের স্নায়ুতন্ত্র বলতে যা থাকে তা হলো মানুষের হাঁটু ঝাঁকুনির মতো অতি সরল কিছু in-built " রিফ্লেক্স পাথ" এর নেটওয়ার্ক | উদাহরণ হিসাবে চ্যাপ্টাকৃমি বা নিম্নশ্রেনীর অমেরুদণ্ডি প্রানিদের কথা বলা যায় | এদের সারা শরীরে আছে এলেমেলোভাবে সংলগ্ন আর অনির্দিষ্টভাবে সংযুক্ত কিছু নিউরনের সরল নেটওয়ার্ক |
কিছু কিছু অমেরুদণ্ডি প্রাণী যেমন চিংড়ি মাছেদের সামান্য উন্নত ব্যবস্থা থাকে | এদের সারা শরীরকে কয়েকটি প্রধান কাল্পনিক অংশে বিভক্ত করে (ছবিটা দেখলে আরো পরিস্কার হবে), প্রত্যেকটা অংশের জন্য নিযুক্ত থাকে গুচ্ছাকারে সন্নিবিষ্ট কিছু "নিউরোনাল সেল বডি" র বিন্যাস | এই গুচ্ছাকার বিন্যাসকে বলা হয় গ্যাংলিয়া | প্রত্যেকটা গ্যাংলিয়া, তার সংশ্লিষ্ট অংশের নিউরাল নেটওয়ার্ককে পরিচালনা করে | গ্যাংলিয়াগুলোর একে অন্যের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই |
এদের থেকে উন্নততর প্রাণীদের এই গ্যাংলিয়াগুলো পরস্পর যোগাযোগ তৈরী করে উদ্ভব করেছে সরল মস্তিস্কের |
যেসব প্রাণীর ব্রেইন আছে তাদের ব্রেইনের নিম্নোক্ত অংশগুলো থাকবেই :
ব্রেইন স্টেম(Brain Stem) : মেডুলা(Medulla), পনস(Pons), মিড-ব্রেইন(Mid Brain) নিয়ে তৈরী অংশটাকে বলা হয় ব্রেইন স্টেম | মেডুলাটা আদতে হলো সুষুম্নাকান্ডের অপরের ভাগের স্ফিত অংশমাত্র | নিম্নপ্রজাতির প্রাণীর ক্ষেত্রে অবশ্য পনস বা মিড ব্রেইন থাকেনা |
ব্রেইন স্টেম মূলত রিফ্লেক্স একশন অর্থাৎ প্রতিবর্ত ক্রিয়া, বিভিন্ন ধরনের স্বয়ংক্রিয় কাজ (হৃদস্পন্দনের হার, রক্তচাপ), বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন, আন্ত্রিক কার্যকলাপ (হজম, মুত্রত্যাগ) পরিচালনা করে |
সেরেবেলাম(Cerebellum) : অবস্থান, দিক, মাত্র ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য এনালিসিস করে প্রাণীর ভারসাম্য বজায় রাখতে তথা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঠিক সঞ্চালনা পরিচালনা করে |
হাইপোথ্যালামাস(Hypothalamus) আর পিটুইটারি গ্ল্যান্ড(Pituitary Gland) : এরা অন্ত্রের কার্য, শরীরের তাপমাত্রা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে | এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারগত আচরণও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, যেমন: খাদ্যগ্রহণ, পানীয়গ্রহণ, যৌনতা, আগ্রাসী মনোভাব, আনন্দ |
সেরেব্রাম(Cerebrum) : একে সেরেব্রাল কর্টেক্স বা শুধু কর্টেক্সও বলা হয় | ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই অংশের কাজ হলো শরীরের ইন্দ্রিয়গুলো থেকে তথ্য আহরণ করে সেই অনুযায়ী মোটর নিউরনগুলোর কাজের সূত্রপাত ঘটানো, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতি-ধারণ এবং চিন্তাশক্তি নামক জটিল প্রক্রিয়ার পরিচালন |
আশ্চর্যরকমের একটা প্রক্রিয়া হলো এই 'চিন্তা' | কিভাবে এই প্রক্রিয়াটা সংঘটিত হয় মস্তিস্কের অভ্যন্তরে ? দেখা যাক |
নিম্নশ্রেনীর প্রাণীরা, যেমন সরীসৃপ, পাখি, উভচর, জলচর; এরা প্রতিদিনের জীবনে অনেক আপাত জটিল কাজ করে থাকে | খাদ্য আহরণ, প্রজনন, ঘুমানো, আত্মরক্ষা ইত্যাদি | কিন্তু এই গুলো এরা কিন্তু সচেতন ভাবে করেনা | এগুলো এদের instinct বা প্রবৃত্তি | এবং এইসব প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান; কারণ মানুষ ও প্রাণী | কিন্তু ভাবনা, চিন্তা, গবেষণা এইসব প্রক্রিয়াগুলোর জন্ম মস্তিস্কের কোন রহস্যময় অঞ্চলে ?
সেটা জানার জন্য আগে জেনে নেই যে দৈনন্দিন এইসব প্রবৃত্তিমূলক কাজ (instinctual process) প্রানীদের দিয়ে করিয়ে নেয় মস্তিস্কের কোন অঞ্চলগুলো |
মস্তিস্কের নিম্নভাগ
প্রথমেই আসা যাক মস্তিস্কের নিম্নাঞ্চলের দিকে |
মেডুলা(Medulla) : মস্তিস্কের অভিযোজনের প্রথম থেকেই থাকা এই অংশটি রক্তের চাপ, নিঃশ্বাস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে | এছাড়া বিভিন্ন সংবেদী অঙ্গ থেকে আসা সংকেতগুলো মস্তিস্কের উর্ধাংশে সংবহন করতে সাহায্য করে |
পনস(Pons) : এটি চলন এবং অবস্থান সম্পর্কিত সংকেতগুলো সেরিবেলাম থেকে কর্টেক্স এ বহন করে | এছাড়াও শ্বাস-প্রশ্বাস, স্বাদগ্রহণ, নিদ্রা এইসব কাজগুলো পরিচালনাতে সাহায্য করে |
মিডব্রেইন(Mid Brain) : এই অংশটি মস্তিস্কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য অংশগুলোকে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখতে সাহায্য করে | এছাড়াও এটি চোখের নড়াচড়া, শ্রবণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে | এর মধ্যে একটা অংশ থাকে যার নাম সাবট্যানশিয়া নিগ্রা (Subtantia Nigra) | এটি কোনকারনে ক্ষতিগ্রস্থ হলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়াতে কাঁপুনি চলে আসে | তখন সেটাকে পার্কিস্ন্সনস ডিজিজ বলে | বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী এই রোগের শিকার |
থ্যালামাস(Thalamus) : বিভিন্ন সংবেদী অঙ্গ থেকে আসা সংকেতগুলোকে গ্রহণ করে বিচার করে যে ওই সংকেতগুলোর কোনটা কর্টেক্স এর কোন অঞ্চলে যাওয়া উচিত | সেই অনুসারে তাদের ঠিক ঠিক জায়গাতে পৌঁছাতে সাহায্য করে |
হাইপথ্যালামাস(Hypothalamus) : এই অংশটি পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে | আর পিটুইটারি থেকে
নিঃসৃত হরমোন যৌন প্রজনন, খাদ্য / পানীয় গ্রহণ, বৃদ্ধি, স্তন্যপায়ীদের দুধ তৈরী ইত্যাদি নিয়ন্ত্রন করে | এছাড়া হাইপথালামাসের আরেকটি ভীষণ জরুরি কাজ হলো ব্যবহার বা আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ | এমনকি শরীরের যে Biological Clock থাকে; যার কারণে দিন-রাত্রের আলো ও আঁধারের প্রভাবে প্রাণীরা ঘুমায় ও জাগে সেটাকেও নিয়ন্ত্রন করে এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশটি |
ভারসাম্য রক্ষায় মস্তিস্ক
এই অংশগুলোর মধ্যে আলাদা করে সেরেবেলাম সম্পর্কে একটু না বললেই নয় | কারণ প্রানিদেহের ভারসাম্য রক্ষার মতো অসাধারণ ও জটিল কাজটি সুসম্পন্ন করে এ |
একে চলতি কথায় ইংরেজিতে Little Brain বলা হয় | এরকম নামকরণের কারণ এটি মস্তিস্কের ২য় বৃহত্তম অংশ এবং মূল মস্তিস্কের মতই এর মধ্যেও অনেক ভাঁজ ও খাঁজ থাকে |
সুষুম্নাকান্ড থেকে আসা সংবেদী সংকেত, কর্টেক্স / বেসাল গ্যাংলিয়া থেকে মোটর ইনপুট, ভেস্টিবিউলার সিস্টেম থেকে থেকে আসা অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য; এই সমস্ত কিছু আহরণ করে প্রানিদেহের ভারসাম্য রাখার বা পারিপার্শ্বিকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া করানোর প্রক্রিয়াটা সুসম্পন্ন করে থাকে |
ধরা যাক, আমরা আমাদের সামনের কম্পিউটারের মনিটরটা ছুঁতে চাইছি | খুব সুন্দর ভাবে ছুঁয়ে ফেলতে পারি আমরা সেটা | চোখ থেকে এবং ভেস্টিবিউলার সিস্টেম থেকে পাওয়া তথ্য গুলো আহরণ করে মস্তিস্ক এমনভাবে আদেশ দেয় হাতের পেশীকে কে খুব মসৃনভাবে হাতটা এগিয়ে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলে মনিটরটাকে | কোনো কারণে সেরেবেলাম ক্ষতিগ্রস্থ হলে হাতের মোশনটা আর মসৃন থাকতনা; কেঁপে কেঁপে এগোত | কারণ তখন কর্টেক্স হাতের পেশীকে কাটা কাটা আদেশ পাঠাত মনিটরের দিকে এগোনোর জন্য | ওই কাটা কাটা আদেশগুলোকে মসৃন করার কাজটাও সেরেবেলাম করে |
এছাড়াও মানুষের ভাষার মসৃনতাও রক্ষা করে সেরেবেলাম | কারণ শব্দ উচ্চারণ করার জন্য ঠোঁটের এবং গলার পেশীর নিঁখুত চলনের প্রয়োজন হয় |
মস্তিস্কের উপরের দিকের গঠন
এবার দেখা যাক মস্তিস্কের উপরের দিকের গঠন |
অপরের অংশটাকে বলা হয় সেরেব্রাল কর্টেক্স | এটি মস্তিস্কের সর্ববৃহৎ অংশ | এর বহির্ভাগ তৈরী গ্রে ম্যাটার (Grey Matter) দিয়ে আর অন্তর্ভাগ তৈরী হোয়াইট ম্যাটার (White Matter) দিয়ে |
মস্তিস্কের ক্ষেত্রফল মোটামুটি ২৩৩ থেকে ৪৬৫ বর্গইঞ্চির মধ্যে অর্থাৎ খবরের কাগজের ১টা থেকে ২টা পাতা পাতলে যতটা জায়গা নেবে | করোটি বা খুলির ঐটুকু জায়গার মধ্যে তাহলে কি করে থাকে পুরো মস্তিস্ক ? স্থান সংকুলানের জন্য তাই কর্টেক্স কুঁচকে-মুঁচকে থাকে | সঙ্গত কারণেই তাই কর্টেক্স এ প্রচুর ভাঁজ অর্থাৎ fold ও খাঁজ অর্থাৎ groove থাকে | এই ভাঁজগুলোকে জাইরি(Gyri) এবং খাঁজগুলোকে সালসি(Sulci) বলে | এরকম কয়েকটা বড় বড় খাঁজ (Sulci) দিয়ে পুরো সেরেব্রাল কর্টেক্সটা কয়েকটি প্রধান অংশে ভাগ করা | এই ভাগ গুলোর আলাদা আলাদা কাজ আছে |
সর্বোপরি, একটা বড় খাঁজ দিয়ে পুরো মস্তিস্কটা দুটো আলাদা প্রধান ভাগ বা গোলার্ধে বিভক্ত করা | যদি মাথার ঠিক ওপর থেকে দেখা যেত তাহলে এই ব্যাপারটা পরিস্কার দেখা যায় | এই দুটো গোলার্ধের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে কর্পাস ক্যালোসাম (Corpus Callosum) নামের একটা অংশ, যেটা তৈরী হোয়াইট ম্যাটার দিয়ে |
যেমন ভাবে কোনো বাড়ির ভেতরে ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং করা থাকে ঠিক তেমনি ভাবে মস্তিস্কের এই সমস্ত অংশও সংযুক্ত থাকে সংকেত আদান প্রদানের জন্য | পার্থক্য এটাই যে, এইক্ষেত্রে সংযোগ রক্ষা করে নিউরনগুলো |
বড় বড় খাঁজ দিয়ে মস্তিস্কের যে বিভিন্ন অঞ্চল বিভক্ত হয়েছে, সেগুলোর কাজ ও গঠন সম্পর্কে একটু জানা যাক:
প্যারাইটাল লোব(Parietal Lobe) : সুষুম্নাকান্ড থেকে আসা নিউরন সমৃদ্ধ প্রচুর তন্তুর মতো জিনিস হাইপোথ্যালামাসের মধ্যে দিয়ে ঢুকে প্যারাইটাল লোব এর বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্ত থাকে | এরা শরীরের বিভিন্ন অংশের বহিঃত্বকের " ম্যাপ " গঠন করে | এই ম্যাপের সাহায্যেই এই প্যারাইটাল লোব বহিঃত্বক থেকে আসা চাপ, স্পর্শ, ব্যথা ইত্যাদি সংবেদন সংশ্লেষ করে এবং সেই অনুযায়ী শরীরের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলোকে আদেশ প্রদান করে |
প্যারাইটাল লোব এর পেছনের দিকে ওয়ের্নিকেস এরিয়া (Wernicke's Area) | ভাষা সংক্রান্ত শ্রবণ-দর্শন সংকেত সংশ্লেষণে এর গুরুত্ব অপরিসীম | এটি ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেনসরি এফেসিয়া (Sensory Aphasia) নামের রোগ হয় | এই রোগগ্রস্থ ব্যক্তি ভাষা বুঝতে পারেনা কিন্তু দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণ করতে পারে মুখে |
ফ্রন্টাল লোব (Frontal Lobe) : এই অংশটি মানুষের চিন্তা, বোধ, মনন ইত্যাদি জিনিসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে | চলন, গমন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া ইত্যাদি কাজগুলোকে বলা হয় মোটর ফাংশন (Motor Function) | এই মোটর ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রন্টাল লোবের একদম পেছনের দিকে অর্থাৎ প্যারাইটাল লোব এর সীমানার কাছে থাকা মোটর সেন্টার(Motor Center) | প্যারাইটাল লোব এর সোমাটোসেনসরি (SomatoSensory) অংশ থেকে মোটর সংকেত আহরণ করে ফ্রন্টাল লোব এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মোটর ফাংশনের সূচনা করে |
এর মধ্যেও শরীরের বিভিন্ন অংশের মোটর ম্যাপ থাকে |
ফ্রন্টাল লোবের বাম দিকে ব্রোকাস এরিয়া (Broca's Area) বলে একটা অংশ থাকে | এটি ভাষা বা শব্দ উচ্চারণের জন্য প্রয়োজনীয় মোটর ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে | কোনো মানুষের এটি ক্ষতিগ্রস্থ হলে মোটর এফেসিয়া (Motor Aphasia) রোগ হয় | এই রোগ হলে সেনসরি এফেসিয়া রোগের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে | এতে মানুষটি ভাষা বা শব্দ বুঝতে পারে ঠিকই কিন্তু কোনো শব্দ উপযুক্ত কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনা |
অক্সিপিটাল লোব(Occipital Lobe) : এই অংশটি চোখ থেকে আসা দৃশ্য-সংকেতকে সরাসরি গ্রহণ ও সংশ্লেষ করে | এই সংকেতকে এরপর প্যারাইটাল লোব এর ওয়ের্নিকেস এরিয়া আর ফ্রন্টাল লোব এর মোটর সেন্টারে সংযুক্ত করে | আরেকটা যে জরুরি কাজ এটা করে; রেটিনার ওপর বাইরের জগতের যে উল্টো ছবি পড়ে সেটাকে ঠিকঠাক করার কাজ |
টেম্পোরাল লোব(Temporal Lobe) : অক্সিপিটাল লোব এর কাজের সাথে এর মিল আছে | এটি কান থেকে শব্দ-সংকেত গ্রহণ করে সংযুক্ত করে প্যারাইটাল লোব এর ওয়ের্নিকেস এরিয়া আর ফ্রন্টাল লোব এর মোটর সেন্টারে |
টেম্পোরাল লোবের ভেতরে থাকা বেসাল গ্যাংলিয়া (Basal Ganglia) নামের অংশটি সেরিবেলামের সাথে একসাথে কাজ করে শরীরের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম সঞ্চালনকে (যেমন আঙ্গুলের ডগা দিয়ে কিছু ছোঁয়া) পরিচালনা করে |
এর ভেতরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো লিম্বিক সিস্টেম (Limbic System) | সিন্গুলেট জাইরাস(Cingulate Gyrus), কর্পাস ক্যালোসাম(Corpus Callosum), ম্যামিলারী বডি(Mammillary Body), অলফ্যাক্টরি ট্র্যাক্ট(Olfactory Tract), এমিগডালা(Amygdala) এবং হিপ্পোক্যাম্পাস(Hippocampus) অংশ গুলোকে একত্রে লিম্বিক সিস্টেম বলা হয় |
মানুষের স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি পরিচালনা করে হিপ্পোক্যাম্পাস|
এমিগডালা মানুষের সামাজিক ও যৌন আচরণ এবং অন্যান্য আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে |
ইনসুলা(Insula) নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে যেটি ব্রেইন স্টেম এর স্বয়ংক্রিয় কাজগুলোর ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে | উদাহরন হিসাবে বলা যায়, যখন আমরা কোনো কারণে নিজে থেকেই নিঃশ্বাস বন্ধ করি তখন ইনসুলা থেকে সংকেত প্রবাহ গিয়ে মেডুলার শ্বাস কেন্দ্রকে চাপা দিয়ে দেয় | এছাড়া ইনসুলা স্বাদ-সংকেতও সংশ্লেষ করে | এটি টেম্পোরাল আর ফ্রন্টাল লোবকেও আলাদা করে |
সুরক্ষা ব্যবস্থা
এবার এই জটিল এবং উন্নত প্রসেসিং সিস্টেম টা চোট-আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য কি ব্যবস্থা আছে শরীরে সেটা একটু দেখা যাক |
আমাদের মস্তিস্ক এবং সুষুম্নাকান্ড ঢাকা থাকে মেনিনজেস(Meninges) নামের সহনশীল একধরনের পর্দাসদৃশ আবরণ দিয়ে, যাতে ঐসব গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি নরম অঙ্গ গুলো মেরুদন্ডের হাড় বা খুলির শক্ত আবরণের সাথে ঘষা থেকে বাঁচে | এই সুরক্ষা অধিকতর নিশ্চিত করার জন্য খুলি ও সুষুম্নাকান্ডের ভেতরটা সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড(CerebroSpinal Fluid) দিয়ে পূর্ণ থাকে | ঘিলু ও সুষুম্নাকাণ্ড আসলে ওই ফ্লুইডের মধ্যে ভাসতে থাকে | এই সুরক্ষা তরলটি নিরন্তর তৈরী হতে থাকে মস্তিস্কের মধ্যে থাকা করোয়েড প্লেক্সাস টিস্যু (Choroid Plexus Tissue) দ্বারা | তৈরী হয়ে এটি মস্তিস্ক এবং সুষুম্নাকান্ডের মাঝের বিভিন্ন ফাঁকফোকর বেয়ে নামতে থাকে যথাযথ জায়গায় পৌঁছানোর জন্য |
এই সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড কে রক্তের সাথে মিশে যাওয়া থেকে বিরত রাখে ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার(Blood Brain Barrier)|
মানুষ অন্যান্য যেকোনো প্রাণীর তুলনায় দুর্বল হওয়া সত্বেও লক্ষ কোটি বছর ধরে তৈরী হওয়া এই অত্যাশ্চর্য তন্ত্রটিই মানুষকে করে তুলেছে সমগ্র প্রাণীজগতের শাসক |
এরপরের টিউনে আমরা জানব পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে এই মস্তিস্ক তথা চিন্তা ভাবনা কিভাবে আলাদা হয়ে যায় | কিভাবে একই গঠনের মস্তিস্ক আলাদা আলাদা রকম ভাবে চালনা করে পুরুষ-নারীকে | কি করে ভ্রুনকে গড়ে তোলে আলাদা দুটো যৌন অবয়ব হিসাবে |
তথ্যসুত্র HowStuffWorks
আমি অনুপ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 144 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
kub valo bro asa kori future a o amon aro info pabo. tnx agin