আমি জয়নুল আবেদিন।গ্রাম বাংলার মাটিতে বেড়ে উঠা এক ধানের শীষ। বাংলার মাটি, বাতাশ আমাকে প্রতি মুহূতে মনে করিয়ে দেয় আমি এই বাংলার সন্তান।
আমার কাছে বাংলার মাটি, সবুজ সমারোহ, বাংলার খেটে খাওয়া মানুষকে খুব ভাল লাগে।তাই, আমি তাদের সুখ-দুক্ষের কথা ফুটিয়ে তুলি আমার তুলির আচড় দিয়ে।আমার আকতে খুব ভাল লাগে। তাই, আমি একে যাই। আর দশজনের মত আমারও আশা আমার এই চিত্র কমের মধ্য দিয়ে আমি বেচে থাকব এই বাংলার বুকে।
আমার জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তত্কালীন পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে। শৈশবের অধিকাংশ সময়ই আমার কাটে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। এই নদই ছিল আমার সকল কাজের অনুপ্রেরণা।
আমার বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং মা জয়নাবুন্নেছা।
১৯৩৩ সালে আমি কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে অধ্যয়ন শেষে আমি স্কুলের ফ্যাকাল্টিতে যোগ দেই ।
১৯৪৬ সালে জাহানারা বেগমের সাথে আমার বিবাহ হয়। আমার তিন পুত্র ৷ আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন (টুটুল) স্থপতি৷ দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন (টুকুন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে এম.এ এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন (মিতু) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ প্রকৌশল বিদ্যায় স্নাতক৷
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, নবান্ন, জলোচ্ছ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ, ঘাটের পথে গাঁয়ের বধূরা, ম্যাডোনা-১৩৫০, মইটানা, গুনটানা, ঝড়, বিদ্রোহী, মনপুরা-৭০, সাঁওতাল কন্যা, মাছ ধরে ঘরে ফেরার ছবি আমার সেরা এ শিল্পকর্ম।
‘মনপুরা ৭০’
দেশের দক্ষিণে উপকূলবর্তী চর ‘মনপুরা’; যা শান্ত, সবুজ এক বনানী। ১৯৭০ সালের প্রলংয়করী ঘূর্ণিঝড় এ দ্বীপে আঘাত হানে। লক্ষাধিক লোকা মারা যায় সে ঝড়ের তাণ্ডবে। এ এক প্রকৃতির নির্মম, নিষ্ঠুর ইতিহাস।
তুলির আচড়ে আমি ফুটিয়ে তুলি প্রকৃতির সেই নির্মম আচরন। প্রচণ্ড ঢেউয়ের দাপটে তীরে উঠে আসা মৃত গবাদিপশু, নারী-পুরুষ, শিশুর মিছিল। এ যেন সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী শ্বাসরুদ্ধকর মুহর্ত। প্রকৃতির তাণ্ডবে বেঁচে যাওয়া এক মানুষ হাঁটুমুড়ে বসে আছে-জীবন্মৃত, অসাড়।
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে আমি নিজ চোখে অবলোকন করি।তারপর আমি মুক্তিযোদ্ধাদের উতসাহিত করার জন্য একে যাই একের পর এক ছবি।
আমার আকা ছবি নিয়ে এক সাংবাদিকের বিব্রিতি ছিল এরকম “কালি ও ওয়াশে মুক্তিযোদ্ধা শিরোনামে একদল মুক্তিযোদ্ধার সম্মুখে চলার গতির যে উদ্দামতা এবং সামষ্টিক ঐকতানের রূপ দেখিয়েছিলেন, তা অসাধারণ। অন্য ছবিতে কাদামাটি ঠেলে গতি ও আক্রমণের ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে চলেছে মুক্তিযোদ্ধার দল। সে সময়ের প্রেক্ষাপট তিনি তুলে ধরেছেন ‘কয়েদী’ শিরোনামে। বুট পায়ে আর রাইফেলের বাঁট মাটিতে ঠেকিয়ে প্রহরী, পেছনে কাঁটাতার, মানুষ। ‘বুটের পা’ শিরোনামে বুটের তলায় পিষ্ট হতে যাওয়া মানুষের দল-আমাদের ওপর অত্যাচারের বীভৎস রূপ। তবে খানসেনাদের কলসি কাঁখে চলা বাংলার শাশ্বত নারীদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি-এ যেন সুন্দরের বিরুদ্ধে নরপিশাচদের আস্ফালন সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাস। শিল্পীর তুলিতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা কতটা বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে জ্যান্তরূপে আবির্ভূত হতে পারে, তা জয়নুলের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিগুলো না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।“
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ
দেশ মুক্ত হল।কিন্তু দুর্ভিক্ষ আমাদের গ্রাস করে নিল। চারিদিকে হাহাকার। মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্চে। আমি সাধারন মানুষ।তাই, আমি সেই দুক্ষের দিনগুলোর কথা তুলে ধরি তুলির আচড়ে। তাই, সেদি আমি একেছিলাম হাড় কঙ্কালসার মা ও শিশু, রাস্তায় ভিক্ষুকের মিছিল, খাদ্যের হাহাকার ।
মা ও শিশু
‘গাভি ও বাছুর’ শিরোনামে পরম স্নেহের বন্ধনে বাছুর তা মা গাভির দুধের বাঁটে মুখ দিয়েছে। হাঁটুপানিতে মা কলসি কাঁখে হাঁটছে; সঙ্গে তার কাপড় ধরে আছে ছোট্ট শিশু। মায়ের সন্তানের জন্য ভালবাষা, কিভাবে আমি একেছিলাম সেসব সুন্দর ছবি?
নদী, নারী
স্টিমার ও নদী। নদীতীরের গ্রাম, কলসি কাঁখে নারীর দল, নদীর কিনারে কেউ বা জল তুলেছে, কেউ বা জলভরা কলসি কাঁখে একটু আলাপে মত্ত, কারও চোখে বা হাসির দেখা, কেউ বা উঠে যাচ্ছে পথে, পেছনে গাছপালা সারি সারি, মেঠোপথে, খড়ের গাদা, ছনের ঘর, কাদামাটি-এ যেন নদী ও নারীর অসামান্য রূপ।
নারীর প্রসাধন
‘প্রসাধন’ শিরোনামে আমার দুটো চমৎকার স্কেচ রয়েছে। প্রথমটি এক নারী অন্য নারীর চুলে তেল দিচ্ছে, মাথায় বিলি কেটে কেটে আর দুজনেই গল্পে মত্ত। অন্যটিতে এক নারী দাওয়ায় বসে নিজে নিজে চুলে বিলি কেটে প্রসাধনী দিচ্ছে।
কৃষক ও মৎস্য শিকারি তথা শ্রম-ঘনিষ্ঠতাঃ
বাংলাদেশের সে সময়ের অন্যতম পেশা কৃষিকাজ ও মৎস্য শিকার। একজন কৃষক যখন ক্ষেতে ধান কেটে কাঁচি হাতে পেশিবহুল পা ফেলে দাঁড়ান, জেলেদের দল যখন উৎসবের মেজাজে মাছ ধরতে পদযাত্রা করে, স্বর্ণকার যখন নিবিষ্ট মনে স্বর্ণের কারুকাজে ব্যস্ত এবং পাশে তার ছেলে বই পড়ায় একনিষ্ঠ। লাঠির দুই মাথায় ধানের মুঠি বেঁধে কাঁধে নিয়ে চলেন বাংলার শ্রম-সংগ্রামী কৃষক তখন সবাইকে আমার ছবির ইশারায় নিয়ে যাই সেই গ্রামে, যাদের ঘামে-শ্রমে গড়ে উঠেছে তিলে তিলে আমাদের গ্রাম।
সাঁওতাল জাতি
আমি আমার জীবনের কিছুটা সময় বাংলার আদিবাসী সমাজ সাঁওতাল পাড়ায় কাটিয়েছি। সাঁওতালদের দুমকা গ্রামের মেঠোপথ, শস্য বহন করছে সাঁওতাল পুরুষ, শিকারের নেশায় মত্ত তরুণ সাঁওতাল শিকারি, শিশু কাঁধে মাথায় বোঝা নিয়ে চলা সাঁওতাল নারী, সাঁওতাল মা ও শিশু এক বিশিষ্ট রূপ পেয়েছে আমার রং ও রেখায়।
নৌকা
নৌকা বাংলার মানুষের আদিমতম বাহন। বিক্ষুব্ধ ঝড়ের কবলে ঘাটে বাঁধা নৌকার উথাল-পাতাল রূপ। নদীর মাঝি যখন তার হাতের টানে বৈঠা বায়, যখন দাঁড় টানে; এই নৌকা যখন নৌকাবাইচের জন্য রণসজ্জায় সজ্জিত হয়, তখন তা যেন এক আশ্চর্য শিল্পঘনিষ্ঠ বিশিষ্ট রূপের আ্তপ্রকাশ।
বিদেশ-বিভুঁই
আমি যখন যেখানে যাই,আমার রঙ তুলি নিয়ে সেখানে যাই। তাই আমার কলম স্কেচে আঁকা জাপানি নারীকে আমরা দেখতে পাই ঐতিহ্যবাহী পোশাকে, পাখা হাতে বিশেষ ঢঙে।
দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে আমি ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করি।দেখুন আমার কবর।আমার জন্য দোয়া করবেন।
সবার কাছে আমার একটাই আশা আমরা যেন আমাদের অতীতকে না ভুলি।অতীতের সাহাজ্জে আগামির দিনে এগিয়ে যাই।
আমি কলকাতাকে ধন্নবাদ দিতে চাই, কারন, তার লেখা দেখে আমি এই ধরনের টিউন লিখলাম।
আমি সাবিহা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 98 টি টিউন ও 753 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
খুব সাধারন একটি মানুষ।সারাদিন কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকি।মুভি দেখি,ব্লগ এ ব্লগ এ ঘুরাঘুরি করি।পড়ালেখা করতে বরাবরই ভয় লাগে। আর ফেসবুক এ একটা পেজ খুলেছি।যারা সময় পাবেন একটু ঢু মেরে আসবেন।
টিউনটি পড়লাম! তবে সাবিহা আপু একটা কথা বলি সবাই কলকাতা ভাই হলে তো সমস্যা ! তাই না?
তার স্টাইল তাকে নিয়ে থাকতে দিন নাহয়