আমি একটা ডাক্তারের গল্প জানি।
একবার এক ডাক্তার ভিজিট নেবার সময় লক্ষ করলেন টাকার মধ্যে অনেক খুচরা টাকা। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সত্যি করে বলুন তো টাকাগুলো কোথায় পেয়েছেন? গরীব রোগীটি বলেছিল, মাটির ব্যাংকে টাকাগুলো জমিয়েছিলাম। আসার সময় ভেঙে নিয়ে এসেছি। সেদিন ডাক্তারটি তার ভিজিট নেননি। উল্টো লোকটির হাতে 500 টাকা দিয়েছিলেন ওষুধ কেনার জন্য।
গল্পটি বলার সময় ডাক্তারটির চোখটা ছিল অশ্রুসজল আর বক্তব্য ছিল, ঐ দিন আমি ঐ লোকটার কাছ থেকে টাকা নিলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করতেন না। এটা একটা সত্য ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা শুনলে আমরা মুগ্ধ হই। উদার হবার ইচ্ছা জাগে। এই ডাক্তারটা কিন্তু মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হয়েছে। M.B.B.S ডাক্তার।
এবার আসা যাক আজকের একুশে টিভির খবরের একটা রিপোর্টে।
রিপোর্টে দেখানো হয়েছে এক M.B.B.S ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে দুটো অতিরিক্ত ওষুধের নাম লিখেছেন যেগুলো তার চেম্বারের ফার্মেসি ব্যতীত অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। শেষে দেখা গেল, ঐ দুটো ওষুধ অন্যভাবে তৈরি যেগুলো আসলে শরীরের কোনো কাজেই লাগে না। শুধু শুধু রোগীদের বাড়তি টাকা খরচ করে কিনতে হচ্ছিল।
এই দুটো ঘটনার দুজনেই ডাক্তার অথচ তাদের কর্মকান্ড দুই রকমের, দুই বিপরীত রকমের। শুধু এটা ডাক্তারিতেই না। ইঞ্জিনিয়ারদেরও আমরা রডের পরিবর্তে আমরা বাঁশ দিতে দেখেছি। ফল বিক্রেতাদেরও আমরা চরম মাত্রায় ফরমালিন ব্যবহার করতে দেখেছি। মুরগীকে সিসাযুক্ত খাবার খাওয়াতে দেখেছি যেগুলো সিদ্ধ করার পরও অক্ষত থাকে। কারখানায় এখন দুই নম্বর ডিম তৈরি করা হয় তা আমরা অনেকেই জানি না। এ ধরনের বহু উদাহরণ দেয়া যাবে।
তাদের লক্ষ কিন্তু একটা। Profit বাড়ানো। কিন্তু এরা Quality'র কথা কেউই মাথায় রাখছে না। বরং এসব কাজের একটা অপরটিকে উৎসাহিত করছে। কারণ, ডাক্তারটিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, কতজন কত খারাপ কাজ করতেছে, সে তুলনায় এতো কিছুই না।তার মানে তিনি তার কাজের জন্য অনুতপ্ত নন।বলা হচ্ছে আমাদের সচেতন হতে হবে। কিন্তু আমরা কেন সচেতন হচ্ছি না? আমাদের সচেতন না হবার কারণ-
সাইকোলজিক্যাল (মনোবিজ্ঞানভিত্তিক) জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের অভাব:
আমাদের দেশে প্রথমত সাইকোলজিক্যাল জ্ঞানের অভাব, দ্বিতীয়ত, এই জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগেরও অভাব।
উদাহরণস্বরুপ-
উন্নত দেশের উন্নত কল-কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের জন্যও একজন করে মনোবিজ্ঞানী নিযুক্ত থাকে। যেমনটা থাকে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটার, ফুটবলারদের জন্য। শ্রমিকদের জন্য মনোবিজ্ঞানী নিযুক্তের কারণ যাতে শ্রমিকরা পণ্যটি বিরক্তি নিয়ে তৈরি না করে। তাদেরকে মোটিভেশনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে পোশাকটি আপনি নিজের জন্য তৈরি করছেন। তাই আপনাকে মনোযোগের সাথে কাজ করতে হবে। আর এজন্যই বিদেশী পণ্যের কোয়ালিটি দেখে আমরা আশ্চর্য হই।
আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো সুযোগই নেই। আমরা বিশ্বাসই করে থাকি যে মনোবিজ্ঞানী শুধুমাত্র পাবনা’র পাগলদের জন্য আর মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের জন্য। আসলে আমরা এটার প্রয়োগ ঘটাতে পারি না।
নৈতিক শিক্ষাগুলো আমাদের কাজে লাগেনা একটা কারণে। আমাদের শুধু শিক্ষাটাই দেয়া হয় এ ব্যাপারে ব্যবহারিক কোনো কিছু করানো বা শেখানো হয় না। এই কারণে আমরা একজনের অপরাধ থেকে অপরজন উৎসাহিত হই।
দেখুন আপনার দিকে বা আপনার স্বার্থের দিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কারন কী? তাদের বোঝানো হচ্ছে না যে এটা দেশের ক্ষতি। আমার আপনার ক্ষতি। এটা প্রতারণা।
আজকে সাইকোলজির চর্চা নেই বলে পাবলিক ভার্সিটিগুলোতে এই সাবজেক্টে কোনো শিক্ষার্থীই ইচ্ছাকৃতভাবে ভর্তি হয় না। কোথাও চান্স না পেলে তবেই তাকে এই সাবজেক্টে পড়তে হয়। পড়ুয়া শিক্ষার্থীটাকেও বি.সি.এস ছাড়া কেউ কোনো সম্ভাবনার কথা বলে না। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। অথচ দেখুন, এই সাইকোলজিকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি National Geographic চ্যানেলে প্রচার করা হয় ‘BRAIN GAMES’ নামের একটি অনুষ্ঠান যেটা দেখলে আপনি চিন্তা করতে পারবেন। চিন্তা করা শিখতে পারবেন।
আজ দেশে বিজ্ঞান মেলা হয়, প্রযুক্তি মেলা হয়। অথচ সাইকোলজি যে মনো’বিজ্ঞান’ সেকথা আমরা ভুলেই যাই। এটা নিয়ে কোনো মেলা হয় না। কোনো বড় ফলাও করে প্রচার করা সম্মেলনও হয় না।
একবার এক লোকের একটি আঙুলের ব্যথা কিছুতেই ভাল হয় না। অনেক ওষুধেও যখন কাজ হলো না, তখন তিনি একজন সাইকিয়াটিস্টের কাছে গেলেন। তিনি সব শুনে বললেন, আজ থেকে ব্যথাযুক্ত আঙুলের কথা চিন্তা করবেন না। চিন্তা করবেন ভাল থাকা আঙুলগুলো নিয়ে। এভাবে মোটিভেট করলেন যে, আপনি চিন্তা করবেন যে, বাহ! আপনার হাতের বেশিরভাগ আঙুলগুলোই ভাল আছে। এটা ভেবে আনন্দিত হবার চেষ্টা করবেন। একমাসের মধ্যে দেখা গেল লোকটার আঙুলের ব্যথা ভাল হয়ে গেছে।
হ্যাঁ। সাইকোলজি এভাবেই কাজ করে। এটি আপনার পরিবারের অশান্তি কমাতে পারে। আপনার আচরণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। মানুষে মানুষে হানাহানি কমাতে পারে। পূর্ব-সচেতনতায় পরকীয়া পর্যন্ত রোধ করতে পারে। আপনার লক্ষ্যকে সফল করার জন্য আপনাকে উদ্যোগী করে তুলতে পারে, আপনাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে পারে।
সাইকোলজি একটা ডাক্তারকে রোগীর বিষয়ে চিন্তা করে তাকে উদার করে তুলতে পারে। একজন ইঞ্জিনিয়ারকেও সেফটি সম্পর্কে সচেতন রাখতে পারে। একজন ফল বিক্রেতাকে ফলমালিন প্রয়োগের মাত্রা ও ফলাফল সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে মোটিভেট করতে পারে।
সাইকোলজি হলো মানুষের মনকে সঠিকপথে পরিচালনা করার একটা মেশিন।
মিডিয়া: সচেতন করার অন্যতম ভূমিকা রাখে মিডিয়া। যেমন টেলিভিশন। অথচ আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলে সচেতনতামূলক প্রতিবেদন খুব কমই দেখানো হয়। এগুলোর সংখ্যা এতই সীমিত যে অহেতুক বিজ্ঞাপনের ভীড়ে সেগুলো খুব ভালভাবে চাপা পড়ে যায়। আর চ্যানেলগুলোর এখন বিজ্ঞাপনের নতুন নতুন খাতও তৈরি হচ্ছে।
যেমনঃ অনেক চ্যানেলেই সংবাদ শিরোনামের পরপরই একটা ডায়াপার পড়া বাচ্চার আবির্ভাব হয় বিজ্ঞাপনের নিমিত্তে। তারপর বিস্তারিত খবর।
অপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন: আপনি জানেন যে দোকানে RFL এর চেয়ার পাওয়া যাবে, সে দোকানে RFL এর ঝুড়ি বা গামলাও পাওয়া যাবে। আলাদাভাবে বিজ্ঞাপন তৈরির কী দরকার? এটার বদলে সচেতনতামূলক কিছু প্রচার করলেও ভাল হতো।
দীর্ঘক্ষণের বিজ্ঞাপন: কিছু ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন কয়েক মিনিট যাবতও দেখেছি। পরবর্তীতে এগুলো কেটে ছোট করা হয়। অথচ এই মূল্যবান সময়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্য কিছু প্রচার করা যেত।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে। আমরা কেউই আমাদের হাতে মরতে চাই না।
ফেইসবুকে আমি: Mamun Mehedee
আমি মামুন মেহেদী। Civil Engineer, The Builders, Bogra। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 92 টি টিউন ও 360 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 12 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি আপনার অবহেলিত ও অপ্রকাশিত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
সুন্দর হয়েছে… অনেক ভালো লাগল…