আজকে মহান গায়ক আর নায়ক কিশোরদার জন্মদিন উপলক্ষে গুগল এর ডুডলে কিংদবন্তি কিশোর কুমারের ছবি দেওয়া হয়েছে। আজ যে এ মহান শিল্পীর ৮৫তম জন্মদিন। চলেন তবে ওনার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক কিছু তথ্য।
কিশোর কুমার মোট আটবার ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার পেয়েছেন ।
কিশোর কুমার গাঙ্গুলি (আগস্ট ৪, ১৯২৯ – অক্টোবর ১৩, ১৯৮৭) একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি গায়ক এবং নায়ক। অসাধারণ প্রতিভাশালী এই মানুষটি ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্লেব্যাক গায়কদের অন্যতম। সাধারণত গায়ক হিসাবে তাঁকে দেখা হলেও তিনি হিন্দি সিনেমা জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতাও ছিলেন। তাঁর অভিনীত বিখ্যাত কয়েকটি কমেডি সিনেমার মধ্যে রয়েছে বাপ রে বাপ (১৯৫৫), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), হাফ টিকিট (১৯৬২), পড়োশন (১৯৬৮), হাঙ্গামা (১৯৭১), পেয়ার দিবানা (১৯৭৩), বাড়তি কা নাম দাড়ি (১৯৭৪)। এছাড়া অন্যান্য সিনেমার ভিতর রয়েছে – নোকরি, বন্দী, দূর গগণ কি ছাঁও মে, দূর কা রাহি প্রভৃতি। এছাড়া কিশোর কুমার নানা সময়ে সফলভাবে গীতিকার, সুরকার, প্রযোজক, পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকারের ভূমিকা পালন করেছেন।
ছোটবেলা
কিশোর কুমার মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়াতে এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি ছিলেন একজন উকিল। তাঁর মার নাম ছিল গৌরী দেবী। কিশোর কুমারের ছোটবেলায় নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলি। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সবথেকে বড় ছিলেন অশোক কুমার তারপর সীতা দেবী। তারপর অনুপ কুমার আর অনুপ কুমারের থেকে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন কিশোর কুমার।
কিশোরের শৈশবকালীন সময়েই তাঁর বড়দা অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অশোক কুমার বোম্বেতে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে বড় সাফল্য পান। এই সফলতা ছোট্ট কিশোরের উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই কিশোর বিখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের একজন বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সায়গলের গানগুলো অনুকরণ করতেন বা নকল করে গাইতেন। এছাড়াও তাঁর বাড়ির লোক তাঁকে দাদা অশোক কুমারের বিখ্যাত গান “মেঁ বন কে পঞ্ছী বন বন কে” বার বার গাইতে বলতেন। অশোক কুমারের সাফল্যের পর কিশোরের আরেক দাদা অনুপ কুমারও বোম্বের হিন্দি সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন।
পঞ্চাশের দশকের সাফল্য
কিশোর কুমারের অভিনয় খুব একটা পছন্দ ছিল না। তিনি গান গাইতেই চাইতেন। কিন্তু তাঁর গানের কোন ধরাবাঁধা শিক্ষা ছিল না। দাদা অশোক কুমারের ফিল্ম জগতে অনেক পরিচিতি থাকার ফলে কিশোর বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান কিন্তু সেগুলিতে দর্শকদের মনে তেমন সাড়া জাগাতে পারেননি। তবে এই সিনেমাগুলোয় তিনি গান গাইবার সুযোগ পেতেন। এই প্রাথমিক অবস্থায় তিনি কুন্দন লাল সায়গলের নকল করে গাইতেন। পরে শচীন দেব বর্মনের পরমর্শে তিনি নিজের গাইবার কায়দা পাল্টান এবং এমন এক গাইবার কায়দা উদ্ভাবন করেন যা সেই সময়ের অপর প্রধান দুই গায়ক মহম্মদ রফি এবং মুকেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য ছিল গলাকে ভেঙে গান গাওয়া যা আগে কখনও শোনা যায়নি। তবে এই কায়দা খুবই জনপ্রিয় হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কমেডি নায়ক হিসাবে জনপ্রিয় হন। তাঁর অভিনয়ের কায়দা ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই সময়ের প্রবল জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাশালী তিন নায়ক - রাজ কাপুর, দেব আনন্দ এবং দিলীপ কুমার বলিউড শাসন করা সত্ত্বেও কিশোর কুমার নিজের এক পৃথক জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি ছিলেন এক প্রবল ব্যস্ত, সফল নায়ক এবং গায়ক। এছাড়াও তিনি সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করতে লাগেন। শচীনদেব বর্মন ছাড়াও আরেক সুরকার যিনি কিশোরের সঙ্গীত প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি হলেন খেমচাঁদ প্রকাশ। খেমচাঁদ প্রকাশের সুর জিদ্দি সিনেমার গান গেয়ে কিশোর গায়ক হিসাবে পায়ের নিচে মাটি পান। এছাড়া অন্যান্য সুরকার যেমন রবি এবং দুই বিশিষ্ট গীতিকার - মজরু সুলতানপুরি ও শৈলেন্দ্র কিশোরের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এই সময়ের তাঁর গায়ক হিসাবে অন্যতম সিনেমাগুলোর মধ্যে আছে পেয়িং গেস্ট (১৯৫৭), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), তিন দেবিয়াঁ।
ষাটের দশকের ব্যর্থতা
ষাটের দশকের শুরু থেকেই কিশোরের ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা ঘনিয়ে আসে। কিশোরের অধিকাংশ সিনেমাই ব্যবসায়িকভাবে অসফল হয়। এবং এই সময়ের কিশোরের খুব কম গানই আছে মনে রাখার মত। মুনিমজি (১৯৬২), গাইড (১৯৬৫) এবং জুয়েল থিফ (১৯৬৭) ছাড়া মনে রাখার মত বেশি গানও তিনি গাননি। ১৯৬৬ সালে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শচীনদেব বর্মনের পুত্র রাহুল দেব বর্মনের। তাঁর প্রথম সুপারহিট সিনেমা তিসরি মঞ্জিলে কিশোর কোন গান গাননি। কিন্তু ১৯৬৮ সালে 'পড়শন' সিনেমায় রাহুলের সুরে কিশোর বেশ কয়েকটি হিট গান গেয়েছেন।
সাফল্যের হাতছানি
১৯৬৯ সালে শক্তি সামন্ত'র আরাধনা শুভমুক্তি পায়। এই সিনেমার নায়ক ছিলেন নবাগত রাজেশ খান্না। রাজেশ খান্নার জন্য এই সিনেমায় কিশোর তিনটি গান গেয়েছিলেন - ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে -আর দুটি হোলো- রূপ তেরা মস্তানা এবং ‘মেরে সপনো কি রানী’। তিনটি গানই বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং কিশোর কুমারের সঙ্গীতজীবনকে আবার উপরে উঠিয়ে দেয়। এই সিনেমায় রূপ তেরা মস্তানা গানের জন্য কিশোর প্রথম বার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান।
পরবর্তী বছরগুলোতে কিশোর গায়ক হিসাবে ব্যাপক সাফল্যতা লাভ করেন। সে সময়ে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত সব নায়ক যেমন রাজেশ খান্না, শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, রণধীর কাপুর, সঞ্জীবকুমার এবং দেব আনন্দের গলায় তিনি গান গান। এই সময়ে শচীন দেব বর্মন এবং রাহুল দেব বর্মনের সুরে তিনি প্রচুর কালজয়ী গান গেয়েছেন। রাহুল দেব বর্মনের সুরে তিনি বম্বে টু গোঁয়া সিনেমাতে প্রথমবারের জন্য অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের 'অভিমান' সিনেমার জন্য তাঁর গানগুলি সুপারহিট হয়। এরফলে পরবর্তী মেগাস্টার অমিতাভের নেপথ্য গায়ক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কিশোরের এই সাফল্যের পরে বলিউডের অন্য সুরকারেরাও তাঁকে নিজেদের প্রধান গায়ক হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য করে। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল জুটি। গীতিকার আনন্দ বক্সী সুরকার লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল এবং কিশোরকুমার জুটি বেশ কিছু রাজেশ খান্নার সিনেমার জন্য অনবদ্য সঙ্গীত উপহার দেন। যেমন দাগ, রোটি, হাথি মেরে সাথি। লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলালের সুরেই কিশোর ও মোহাম্মদ রফি একসাথে গান করেন এবং কিশোর ও লতা মঙ্গেশকরের বেশ কিছু ভাল ডুয়েট গান তৈরি হয়।
কিশোর কুমার এবং সুরকার কল্যাণজী-আনন্দজী জুটিও বেশ কিছু হিট গান উপহার দেন। যেমন ধর্মাত্মা, লাওয়ারিস, কাবিলা, জনি মেরা নাম, ডন, কাগজ, সফর, মুকাদ্দর কা সিকন্দর প্রভৃতি সিনেমার গান। সত্তর এবং আশির দশক জুড়ে কিশোরের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। নতুন অল্পবয়েসি নায়ক যেমন ঋষি কাপুর এবং সঞ্জয় দত্তের জন্যও তিনি সফল গান উপহার দেন। রাহুলদেব বর্মনের সুরেই যে তিনি সবথেকে বেশী হিট গান করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাহুল এবং কিশোর জুটির কিছু অনবদ্য সিনেমার নাম হল শোলে, ওয়ারান্ট, হীরা পান্না, শরীফ বদমাশ, আঁধি, রকি, দ্য বার্নিং ট্রেন, আপকি কসম, আপনা দেশ, ধরম করম, টক্কর, সীতা আউর গীতা, জোশিলা, কসমে ভাদে, রামপুর কা লক্ষ্মণ, কালিয়া, গোলমাল প্রভৃতি। নতুন সুরকার যেমন রাজেশ রোশন এবং বাপী লাহিড়ী'র সুরেও তিনি বেশ কিছু হিট গান গেয়েছেন। রাজেশ রোশনের সুরে দো অর দো পাঁচ, দুসর আদমি, মনপসন্দ, এবং বাপ্পী লাহিড়ী'র সুরে নমক হালাল এবং শরাবী সিনেমার গান উল্লেখযোগ্য। তাঁর পুরো কেরিয়ারে কিশোর আটবার শ্রেষ্ঠ গায়কের ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান।
কিশোর কুমার চারবার বিয়ে করেছেন। রুমা গুহ ঠাকুরতা (১৯৫০-১৯৫৮), মধুবালা (১৯৬০-১৯৬৯), যোগিতা বালী (১৯৭৫-১৯৭৮) এবং লীনা চন্দাভারকর (১৯৮০-১৯৮৭)। কিশোরের প্রথম পুত্র (রুমা গুহ ঠাকুরতার সাথে) অমিত কুমার একজন বিখ্যাত গায়ক।যোগিতা বালি কে পরে মিঠুন চক্রবর্তী বিবাহ করেন। তিনি তাঁর বাবার মত সাফল্য না পেলেও বেশ কিছু হিট গান উপহার দিয়েছেন। কিশোরের ছোট ছেলে সুমিত কুমার (লীনা চন্দাভারকরের সাথে) একজন গায়ক হবার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
১৯৮৭ সালের ১৩ই অক্টোবর এই মহান শিল্পীর মৃত্যু ঘটে।
তথ্যসুত্র-উইকিপেডিয়া
আমি Ripa das। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 15 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
ধন্যবাদ !