সফটওয়্যার পাইরেসি সম্পর্কে আমরা পরিচিত না হলেও জেনে বা না জেনে আমরা সফটওয়্যার পাইরেসি করি। বর্তমানে আমাদের দেশে সফটওয়্যার পাইরেসি অনেক বেড়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে এটি আরও ব্যাপক এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করবে চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। অনেক বড় বড় দোকান চলছে শুধু মাত্র এই Crack, প্যাঁচ এর অপর ভিত্তি করে। এমনকি অনেকের তো প্রায় বদ্ধ ধারণাই হয়ে গেছে Crack / প্যাঁচ সফটওয়্যার এর-ই একটা অংশ, যেটা ছাড়া সফটওয়্যার চলে না। দোকানে প্রায় সকল প্রকার গেমস, সফটওয়্যার এমনকি অ্যান্টিভাইরাস এরও Crack সহ বিক্রি হয়। হায়! একবারও ভেবে দেখি না যে Crack নামের ভাইরাস দিয়ে আমি এন্টিভাইরাস অ্যাকটিভেট করলাম, আবার সেটা দিয়েই ভাইরাস তাড়াব!
সফটওয়্যার পাইরেসি বলতে বোঝায় অবৈধভাবে সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামের ব্যবহার, কপি(পুনরুৎপাদন) করা বা ডিস্ট্রিবিউট করা । ওয়ান পিসি লাইসেন্সে একাধিক পিসি চালানো, বেআইনিভাবে বন্ধুদের সাথে শেয়ার বা ভাগাভাগি করা।
কিন্তু ওয়ান পিসি লাইসেন্স কেনা তো দূরে থাক, Crackকরা লাইসেন্স দিয়েই আমরা একাধিক পিসি চালাই।আমাদের সফটওয়্যার পাইরেসি কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, হয়তোবা এতক্ষণে বুঝে গেছেন।
সহজ ভাষায়, আপনি বাসায় কোন একজন ব্যক্তিকে থাকার অনুমতি দিলেন, কিন্তু ব্যক্তিটি আরও ৪/৫ জন লোক নিয়ে আপনার বাসায় থাকল। আর আমাদের পাইরেসি এরকমঃ আপনি আপনার বাসায় কাউকে থাকার অনুমতি দিলেন না, কিন্তু ঐ ব্যক্তি আপনার অনুমতি ছাড়াই আপনার বাসায় থাকল তাও ৪/৫ জন লোক নিয়ে এসে!!
আমরা যখন কোন সফটওয়্যার ইন্সটল করি, তখন মাউস দিয়ে "Next" বাটন আর "i accept" এই দুইটা বাটনে মোটামুটি না দেখেই ক্লিক করি। কখনও কি টার্ম বা শর্ত গুল পড়ি? অনেক লাইসেন্সে থাকে সফটওয়্যার টি কপি করা বা মডিফাই করা , লাইসেন্স ছাড়া একাধিক পিসি চালানো ইত্যাদি নিষিদ্ধ। আর আপনি সেগুলো মেনে নিয়েই বা accept করেই আবার কপি, মডিফাই করছেন।ব্যাপারটা কেমন হল? আপনি মানুন আর নাই মানুন ব্যাপারটা হবে বেয়াইনি।
ধরুন, আপনি সুন্দর করে একটি বাড়ি বানালেন। চাইনিজ টাইলস , বিদেশী ফার্নিচার, আকর্ষণীও রঙ করে বাড়িটি সাজালেন। তারপর একজনকে বাড়িটি ভাড়া দিলেন। তারপর সে কি চাইলেই আপনার বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বাড়ি বানাতে পারবে? বা টাইলস ফেলে দিয়ে নতুন টাইলস লাগাবে, রঙ করবে নিজের মত করে??
না সে করতে পারবে না। কারণ আপনি তাকে তা করতে দিবেন না। তাকে কতগুলো টার্ম বা শর্ত দিবেন।সফটওয়্যার এর ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য।
একজন প্রোগ্রামার যখন কোন প্রোগ্রাম তৈরি করেন, তখন তাকে অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হয়, পরিস্রম করতে হয় । এমন না যে, প্রোগ্রামার গণ কম্পিউটারকে তাদের প্রোগ্রামিং জ্ঞান এর জাদুতে মাইক্রোফোন দিয়ে কিছু করতে বলল, আর কপিউটার তাই করল। কম্পিউটারের তো আর কোন বুদ্ধি নেই সে শুধু বঝে ০ আর ১। যাই হোক সেদিকে না যাই। প্রোগ্রামারকে প্রোগ্রাম বানিয়ে কম্পাইলার এর মাধ্যমে কম্পাইল করে কম্পিউটারকে বোঝাতে হয়। এই বাক্যটা লেখা সহজ হলেও কাজটি নিতান্তই পরিশ্রমের।আর এই পরিশ্রম এর মুল্য বা টাকাটা তার প্রাপ্য।
আপনি তাঁকে তার এই প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার রাখেন না। যদিও আমরা জেনে বা না জেনে তা করে থাকি।
বেশিরভাগ সফটওয়্যার কোম্পানি যখন কোন সফটওয়্যার রিলিজ করে, তখন সেটির দুইটি ভার্সন ছাড়ে।
১।ফ্রী ভার্সন এবং ২।প্রিমিয়াম বা প্রো ভার্সন বা ফুল ভার্সন । ফ্রী ভার্সন সাধারণত ট্রায়াল হিসেবে দেয়া হয়। মানে সফটওয়্যারটি কীরকম তা আপনি জানেন না। ২০/৩০ দিন ব্যবহার করার পর আপনার মনে হল, সফটওয়্যারটি ভাল। আপনি কিনবেন। আবার কোন কোন কোম্পানি ফ্রী ভার্সন এ কিছু কিছু ফিচার লক করে রাখে।
তো আপনি যখন ফুল ভার্সন বা প্রিমিয়াম ভার্সন কিনবেন তখন আপননাকে কিছু অর্থের বিনিময়ে একটি লাইসেন্স কী দেয়া হবে। কিন্তু এই Crack হল এমন প্রোগ্রাম যা এই লাইসেন্স কী অ্যাকটিভেশন প্রক্রিয়াটা বাইপাস করে। আবার কোন কোন Crack লাইসেন্স কী এর প্যাটার্ন বা ধরন অনুসারে কী জেনারেট করতে সক্ষম। এর মানে হল Crack বা প্যাঁচ এর মাধ্যমে আপনি লাইসেন্স কী না কিনেই প্রোগ্রামকে(প্রোগ্রামারকেও) ফাঁকি দিয়ে তার প্রাপ্য অর্থ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে প্রোগ্রাম অ্যাকটিভেট করতে পারবেন।
এখন কথা হল, প্রোগ্রাম তো অ্যাকটিভেট হল, কিন্তু আপনার বিবেক কি একবারও আপনাকে বাধা দিবে না, যে আপনি অন্যায় করলেন। আপনি যদি একজন খাঁটি মনের মানুষ হন, বিবেক আপনাকে বারবার বাঁধা দিবে।পাইরেসি কে চৌর্যবৃত্তি'র সাথে তুলনা করা চলা। আরেকভাবে বলা যায় পাইরেসি এক প্রকার চুরি বা লাইসেন্স চুরি। আপনি যে ধর্মেরই অনুসারী হন না কেন, তা কখনই চুরি সমরথন করে না। শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখিরাতেও এর জন্য হবে চরম শাস্তি। দেশে আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় হয় তো আমরা বেচে যাব , কিন্তু আল্লাহকে কে ফাঁকি দিতে পারবে??
যখন কোন সফটওয়্যার ইন্সটল করা দরকার, ধৈর্যের সাথে "Terms and Conditions" ভাল ভাবে পড়তে হবে। শুধু পড়লেই হবে না, কর্মে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
কিন্তু আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশে আরেক সমস্যা হয়েছে। তাহল সামর্থ্য থাকলেও বা ইচ্ছা থাক্লেও কোন সফটওয়্যার সরাসরি আমরা কিনতে পারি না। এজন্য Crack প্যাঁচে আমরা আকৃষ্ট হই। এমনকি অনেক পাগল আছে, যারা ওপেন সোর্স কিংবা ফ্রীওয়্যার এরও Crack/লাইসেন্স কী খোঁজে। হায়! বাঙালি ! আমাদের অবস্থান আজ কোথায়!
দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে পাইরেসির হার ৯২%। কয়েক বছর আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইরেসির সাথে জড়িত দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এখন যদিও কয়েক বছর পেড়িয়ে গেছে, কিন্তু পাইরেসির হার যে বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য।
যেহেতু এখনও অনলাইনে লাইসেনস কেনার পর্যাপ্ত সুযোগ দেশে নাই, তাই পাইরেসি থেকে রক্ষা পাওয়ার কার্যকরী হাতিয়ার ফ্রীওয়্যার, ওপেন সোর্স সফটওয়্যার এবং সকল প্রকার ফ্রী সফটওয়্যার।
প্রতিটি Creative Work বা সৃজনশীল কর্মের কপি বা পুনরুৎপাদন, অবৈধ ব্যবহার বন্ধের জন্য সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যে ১৬৬২ সালে কপিরাইট আইন(Licensing of the Press Act 1662) প্রথম পার্লামেন্টে পাস করে। যেহেতু কম্পিউটার প্রোগ্রাম ও একটা Creative Work তাই এর স্রষ্টাও এই আইনের মাধ্যমে তার অধিকার সংরক্ষণ করতে পারেন। তবে এজন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়।বর্তমানে যেসব দেশে এই আইন আছে তা স্রষ্টার মৃত্যুর পরও এমনকি ১০০ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকতে পারে।
উল্লেখ্যঃবাংলাদেশ কপিরাইট আইন ২০০০ এর মেয়াদ ৬০ বছর । আর যখন কোন ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক কপিরাইট ভঙ্গ করে করা হয়, তাঁকে বলা হয় পাইরেটেড কপি।
অনেক প্রোগ্রামার তাদের সৃজনশীল কর্মকে সকলের জন্য শর্তসাপেক্ষে কপি করার অনুমতি দিতে পারেন। একে বলা হয় Open Source Philosophy বা মুক্ত দর্শন। এর দর্শনের মাধ্যমে প্রোগ্রামার তার প্রোগ্রামকে সকলকে কয়েকটি লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহার করতে দেন। এর মধ্যে কপিরাইটের একেবারে বিপরীত হল কপি লেফট।
কপি রাইট আর লেফট এর ঠিক মাঝখানে রয়েছে ক্রিয়েটিভ কমনস। এর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রোগ্রামার এর কিছু অধিকার সংরক্ষিত থাকে।
মুক্ত দর্শনের আওতায় প্রকাশিত সফটওয়্যার হল ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। এদের সোর্স কোড থাকে উন্মুক্ত।যে কেউ এ সফটওয়্যারগুল কপি করতে পারে, একে অন্যকে দিতে পারে।
এ সফটওয়্যারগুল সাধারণত ফ্রী হয়ে থাকে কোন অর্থ দিয়ে কেনার দরকার হয় না।
এগুলো ফ্রী সফটওয়্যার তবে আপনি চাইলে প্রোগ্রামারকে কিছু অর্থ দিতে পারেন।
পাইরেসি থেকে বাঁচতে আমাদের পেইড সফটওয়্যার এর পরিবর্তে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে। " মানুষ অভ্যাসের দাস"। ওপেন সোর্স ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে।
পেইড সফটওয়্যার | বিকল্প |
উইন্ডোজ/ম্যাক | উবুন্টু বা অন্য লিনাক্স ভার্সন |
ফটোশপ | গিম্প (GIMP) |
বিজয় | অভ্র |
আইডিএম | এফডিএম(FDM) |
মাইক্রোসফট অফিস | LibreOffice |
মাইক্রোসফট আউটলুক | মজিলা থান্ডারবার্ড(Thunder bird) |
ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার | গুগল ক্রোম |
নরটন | অ্যাভাস্ট |
Adobe Illustrator | Inkscape |
Splash pro ex player | VLC Player |
Winrar | Seven zip |
Windows Live Messanger | Pidgin |
Adobe Audition | Audacity |
ez PDF reader | Foxit Reader |
এই তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ হতে পারে। বিকল্প থাকতে কেন চুরি করতে যাবেন? আর বিকল্প না পেলে গুগল তো আছেই।যেকোনো সমস্যার সমাধান পাবেন সেখানে। আর সবশেষে বাংলার প্রবাদ- "ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়" মনে রাখবেন। দেখবেন, ওপেন সোর্স আপনার কাছে পেইড এর চেয়ে ভাল মনে হবে। আসুন, আজ থেকে এই সফটওয়্যার গুলোর ব্যবহার শুরু করি। "পাইরেসি আক্রান্ত" অপবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করি।
আমি Unkn0wn। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 79 টি টিউন ও 511 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
তথ্য প্রযুক্তি পছন্দ করি। আইসিটি ডিভাইস এর সাথে সর্বক্ষণ থাকতে চেষ্টা করি। এইতো আর কি!
ধন্যবাদ। অনুপ্রেরণা মুলক টিউনের জন্য। ইচ্ছা থাকা সত্তেও হয়ে উঠছে না।