জগতের সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস আমার মনে হয় মৃত্যু। মৃত্যুর পরের জিনিস নিয়ে মানুষের কত কৌতুহল। তারপর কী আছে ?
সবজাতির মধ্যেই মৃত্যুর পর একটা আলাদা জগৎ কল্পনা করা আছে। আদতে কী আছে আমরা কেউ জানি না।তাই আগ্রহটা একটু বেশিই।মৃত্যুর পর বেহেস্ত , স্বর্গ , দোজখ, নরক, কয়ামত ,যমলোক পাপের-বিচার নানা চিন্তা সব জাতির মানুষের মধ্যেই আছে।কতটা সত্য বা মিথ্যা তার বিচার করার কোনো উপায় নেই।একমাত্র সেই এর প্রমাণ দিতে পারে যে ওখানে গিয়েছে। কিন্তু কেউই তো সেটা করতে পারে না ।তাই কল্পনার আশ্রয়।বাকিটুকু আমাদের অনুভূতি।এক একজনের কাছে এক এক রকম।
আমারও কিছু অনুভূতি আছে।কোনো ভাবেই তাকে প্রমাণ বলা যাবে না।আসলে খুব কাছের মানুষকে না হারালে এই অনুভূতিগুলো আসা মুশকিল।
বিজ্ঞানও স্বীকার করেছে যে মানুষ মৃত্যুর সময়ে কিছু কিছু জিনিস দেখতে পায়।যেটা আসলে দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়(সঠিক মনে না আসার কারণে উৎস উল্লেখ করতে পারলাম না।) এইসময় নাকি শারীরবৃত্তীয় কারণে চোখের স্নায়ুগুলো সংকুচিত হতে থাকে।ফলস্বরূপ মৃত্যুপথযাত্রী কিছু একটা দেখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নাকি তারা একটা আলোক উজ্জ্বল টানেলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে –এটাই নাকি দেখতে পায়। মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা মানুষের কাছ থেকে সমীক্ষায় এটাই জানা গেছে।সুতরাং এই সময়ে মানুষ কিছু একটা দেখে এ বিষয়ে বিজ্ঞানের একটা সাপোর্ট পাওয়া গেল।
সাহিত্যেও এর নজির আছে।
প্রথমে বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের নবম পরিচ্ছেদ থেকে সর্বজয়ার মৃত্যুদৃশ্যটি একটু পড়ুন।
এবার অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব অষ্টম পরিচ্ছেদ থেকে নিরুদিদির মৃত্যুদৃশ্য-
এখন পরিচিত বাস্তব জগৎ থেকে দু একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
আমার এক পরিচিত দাদার কাছে মাঝে একদিন তাঁর বাবার কথা শুনছিলাম।
তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী-‘জানোতো, বাবা যখন মারা যান।তখন মাঝে মাঝে আমাদের কাছে ডেকে বসিয়ে রাখতেন।আবার কখনো কখনো জোর করে তাড়িয়ে দিতেন।
বললাম-এরকম আচরণ করার মানেটা কী দাদা ?
দাদার বক্তব্য - মরার সময়ে মানুষের কাছে মায়া ( মানে মায়া দেবী {দয়া-মায়া এই রকম একটা কিছু}) আর যমদূত আসে। যখন মায়া কাছে আসে তখন মানুষ মায়া কাটানোর জন্য ছেলে মেয়ে আত্মীয় স্বজনদের দূরে চলে যেতে বলে।আর যমদূত যখন আসে তখন ভয় লাগে।তখন ছেলে-মেয়ে আত্মীয় স্বজনদের কাছে ডেকে বসিয়ে রাখতে চায়।'
বিষয়টা খানিকটা উপলব্ধি করলাম-কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার পর মনে একটা বেদনা জন্মাল-এই মেয়েতো অন্যকে দিয়ে দিতে হবে।মানে বিচ্ছেদ বেদনা।আর মৃত্যুর সময়তো সব ছেড়ে চলে যাওয়া ।সেতো আরো বেদনার । দাদার বাবা সেই বেদনাকে সামাল দিতে চেষ্টা করেছেন পরিচিতদের তাড়িয়ে দিতে চেয়ে।এখানে নিজের কষ্ট নিজে সামাল দেওয়া।
আবার সকলকে ছেড়ে যাবার যে ভয় ,সেই ভয় থেকে সবাইকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন।তখন সবাইকে কাছে ডেকে বসিয়েছেন-“যেতে নাহি দিব , তবু যেতে দিতে হয়।’’
আমার দাদুর কথা দিদিমার কাছ থেকে শুনে ছিলাম- দিদিমাকে ডেকে সেই সময়ে দাদু বলত-ওরা সব কারা এসেছে ?
দিদিমা জিজ্ঞাসা করত- কারা ? আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
-ঐ তো ঐ যে।আমার ভয় করছে।আমার কাছে বস।”
সুতরাং আমার পরিচিত ঐ দাদার কথার এবং শরৎচন্দ্রের লেখার একটু মিল যেন খুঁজে পেলাম।
আমি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমার বাবার মৃত্যুর সময়ে । অল্প কিছুদিন মাত্র আগে।
আমি অর্থবান নই।বাবাকে আমার সামর্থ্য মতো একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করেছিলাম।দেখতে দিত বিকেলে একঘন্টা। কিন্তু সেখানে পাঁচটা মিনিট কাটানোও আমার কাছে দুঃসাধ্য হত।বাইরে বেরিয়েও যে কাঁদব।তার উপায় নেই। মা , দিদি , আর পাঁচজন , তাদেরকে সান্ত্বনা দিতে হবে। আমি কাঁদলে কে তাদের সান্ত্বনা দেবে ! পুরুষ হওয়ার এই এক যন্ত্রণা আমি তখন সহ্য করেছি।বরং মেয়ে হলে গলাছেড়ে কাঁদতেতো পারতাম।
বাবা ওখানে সাতদিন ছিলেন।বাবার তখন খুব রাগ। বাবাকে কেন ওখানে ভর্তি করলাম , কেন বাড়িতে রাখলাম না। বিকালে ভেতরে যাবার সময় হয়েছে। ভিতরে ঢুকলাম।বাবা চোখ বন্ধ করে আছেন।
ডাকলাম-বাবা....
বাবা চোখ মেলে কটমট করে তাকালেন।হঠাৎ বলে উঠলেন-ভেবেছিস গোপালকে রেখে দিবি।গোপালকে আর রাখতে পারবি না। গোপালকে আর রাখতে দেব না।
আমার কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হল-মনে হল এ বাবার কথা না। বাবা নিজের নাম ধরবেন কেন ! আমরা তো নিজের নাম ধরে কিছু বলিনা!
জিজ্ঞাসা করলাম-বাবা তোমার নাম বলতো !
বাবা এবার আবার স্বাভাবিক ভাবে নিজের নাম বললেন।
আজও আমার মনে প্রশ্ন জাগে-বাবা সেদিন কাদের দেখেছিলেন ? বাবাকে দিয়ে কারা সেদিন কথাগুলো বলাচ্ছিল !
********************************************************************************************************************************************
***********************************************************************************************************************************************
বাবাকে ঠিক দুই বছর আগে আজকের দিনে অর্থাৎ ৯ ই ফেব্রুয়ারি হারিয়েছিলাম।
এই লেখা বাবার জন্য আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
p
আমি সবুজের অভিযান ( Sobujer Abhijan )। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 13 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 22 টি টিউন ও 333 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
সব কিছুই তো শিখতে চাই , তবু সময় যে খুব অল্প , এক পলকেই ফুরিয়ে যাবে জীবনের যত গল্প।
খুব কষ্ট পেলাম আপনার বাবার চলে যাওয়াতে। এবং কিছুটা অনুভূতি হলো মৃত্যু সর্ম্পকে।