সর্বপ্রথম যখন ইমেইল কিংবা এসএমএস চালু হয়েছিল, তখন একটি প্রচলিত ধারণা ছিল যে, এগুলো কখনোই চিঠির বিকল্প হতে পারে না। একটি হাতে লেখা চিঠির মাঝে যে আবেগের ছোঁয়া, মাসখানেক অপেক্ষার পর প্রিয়জনের চিঠি পাওয়ার মাঝে যে ভালোবাসা, তার জায়গা কখনোই এই পুঁজিবাদী সমাজের যান্ত্রিক ইমেইল কেড়ে নিতে পারবে না।
হ্যাঁ, চিঠির সেই আবেগ এবং গুরুত্ব কমে যায়নি। কিন্তু চলুন বাস্তবতার মুখোমুখি হই। মনে করতে পারবেন, শেষ কবে চিঠি লিখেছেন? পৃথিবীর আরেক মাথায়, জাতিসংঘের মিশনে যাওয়া সেনাদের বাবা হওয়ার সংবাদ পেতে এখন আর মাসখানেক অপেক্ষা করতে হয় না। চিঠির গুরুত্ব কমেনি, কমে গিয়েছে ব্যবহার। চিঠি কখনোই হারিয়ে যাবে না। কিন্তু দৈনন্দিন প্রয়োজনে তার স্থান অনেকাংশেই হারিয়েছে, ভবিষ্যতে আরো হারাবে।
এখন এই একই চিত্র চলুন আমরা ডাক্তারির ক্ষেত্রে দেখি। আমরা ভাবছি, আমার জীবন-মরণের দায়িত্ব নিশ্চয়ই মেশিনের হাতে ছেড়ে দেবো না। "কেউ মাত্র আর ছয় মাস বেঁচে থাকবে"- এই ভয়াবহ খবরটি দেয়ার পাশাপাশি যে মানসিকভাবে পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপার আছে, তা নিশ্চয়ই কোনো মেশিন দিয়ে সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, এ কথাও সত্য, যারা বলেন, "আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কখনও ডাক্তারের জায়গা নিতে পারবে না" তাদের কাছে এই কথা বাদে আর তেমন কোনো দৃঢ় যুক্তি নেই। আবার যেসকল জটিল রোগে মৃত্যুঝুঁকি নেই, কিন্তু একজন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিতে যে পরিমাণ খরচ এবং অনেক সময়ের প্রয়োজন, সেসকল রোগ যদি নামমাত্র মূল্যে এবং ঘরে বসেই সময় অপচয় ছাড়াই নির্ভুলভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা যায়, তবে ক'জন ডাক্তারের কাছে যাবে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।
বিবিসি নিউজে কয়েকদিন আগে ফিচার করা ব্যাবিলন নামের হেলথকেয়ার কোম্পানির উদাহরণেই আসা যাক, যারা কি না মেডিকেল সেক্টরে সফলভাবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে! যুক্তরাজ্যের ব্যাবিলন হেলথ নামক কোম্পানিটি রুয়ান্ডাতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। রোগের লক্ষণগুলো চ্যাটবটের মাধ্যমে নিয়ে এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমাধান দিয়ে থাকে। এই সফটওয়্যার MRCGP এর মতো মেডিকেল এক্সামগুলোতে ৮১% এর বেশি মার্ক নিয়ে পাশ করছে, যেখানে গড়ে একজন 'মানুষ' ডাক্তারের মার্ক থাকে ৭২%। ব্যাবিলনের সিইও আলি পার্সা বলেন, "এটা শুধু ডাক্তারদের মতোই অসাধারণ পারফর্মেন্স দিচ্ছে না, বরং ৯৮% নির্ভুলভাবে রোগের সমাধান দিচ্ছে। আর একটা মেশিন যখন কিছু একটা শেখে সেটা আর কখনোই সে ভোলে না। "
চলুন, এখন একটু ট্রিয়াজের দিকে তাকানো যাক। ট্রিয়াজ হলো এমন একটি পদ্ধতি, যা কি না দরকারি রিসোর্সের অভাবের সময় কীভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে তা ঠিক করে। জেনারেল প্র্যাক্টিশনারদের একটি প্যানেলের গবেষণা অনুযায়ী, ডাক্তাররা ৭৭.৫% এবং ব্যাবিলনের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ৯০.২% সময়ে সঠিক ট্রিয়াজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
রেডিওলজি নামক জার্নালে পাবলিশ হওয়া ২৫৬ জনের উপর করা এক গবেষণা অনুযায়ী, আরেকটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার প্রত্যেক হার্টবিটের সময় ৩০, ০০০ ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টের আকার, নড়াচড়া ও গতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত রোগীর টিকে থাকার সম্ভাবনার ভবিষ্যদ্বাণীও করতে সক্ষম হয়েছে।
চিকিৎসার যেসকল ক্ষেত্রে তেমন জটিল বিচার বিবেচনার প্রয়োজন নেই, সেদিকটা একটু দেখা যাক। ধরুন, একটি সাধারণ মেডিকেল টেস্ট রিপোর্টের কথা। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে যদি একটি রিপোর্ট দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে সে তার ডাটাবেজে থাকা একই ধরনের লক্ষাধিক রিপোর্টের সাথে মিলিয়ে আগে যে সমাধান দেয়া হয়েছিল, সেই সমাধান মূহুর্তের ভেতরেই দিতে পারবে। যদি এমন হয় যে, একটি নতুন টেস্ট রিপোর্ট পাওয়া গেলো, যা আগের কোনো রিপোর্টের সাথে মেলে না, সেক্ষেত্রে সেই রিপোর্ট কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে সমাধান নিয়ে নিলেই হলো। ভবিষ্যতে একই রকম রিপোর্ট আসলে ঠিক কী করতে হবে তা জানার জন্য আর ডাক্তারের প্রয়োজন হবে না। লাখখানেক রিপোর্ট দেখার জন্য আগে যেখানে দৈনিক হাজার দুয়েক ডাক্তার লাগতো, সেখানে ব্যতিক্রমী রিপোর্টগুলো দেখার জন্য এখন মাত্র কয়েকজন ডাক্তারই যথেষ্ট। আর বাকি সকল টেস্ট রিপোর্ট দেখবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
এতক্ষণ তো অনেক টেকনিক্যাল কথাবার্তা হলো। এখন কিছু সাধারণ কথাবার্তায় আসা যাক। একজন ডাক্তার সময়ের স্রোতের সাথে সাথে অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন। তিনি দৈনিক দশজন করে, একদিনও বিরতি না নিয়ে, টানা ত্রিশ বছর যদি রোগী দেখেন, তবে তার পক্ষে লাখখানেকের মতো রোগী দেখা সম্ভব। আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এই লাখখানেক রোগী দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে একদিনেই। সে মানুষের সাহায্য নিয়ে শেখার পাশাপাশি শিখতে পারে নিজে থেকেই।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কখনও ছুটির প্রয়োজন হবে না। রিপোর্ট দেখতে দেখতে ক্লান্ত হবে না। একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের মৃত্যুর সাথে সাথে তার অর্জিত অভিজ্ঞতা হারিয়ে যায়। তিনি হয়তো অভিজ্ঞতা লিখে রেখে যেতে পারেন, কাউকে শেখাতে পারেন। কিন্তু সেগুলো পড়া আর নিজে অভিজ্ঞতা অর্জন মোটেই এক নয়। এক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে সেই সমস্যাও নেই। একবার কিছু শিখলে তা ভোলার কোনো সুযোগ নেই। এ সবকিছুর সাথে টেক্কা দেয়াটা মানুষের পক্ষে কষ্টকর হবার কথা।
আমরা সবাই বিশ্বাস করি, একটা সময়ে মানুষের সব কাজ রোবট বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স করবে। কিন্তু সেটা অনেক পরের কথা। এই লেখার মূল উদ্দেশ্যই হলো এটা বলা যে, সেই সময় ইতোমধ্যে এসে গেছে। সব কাজ কম্পিউটারের হাতে চলে যেতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। একটি প্রচলিত ধারণা হলো, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয়তো মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির দিক থেকে বিচার করলে অনেক পিছিয়ে। একটি উদাহরণ দেখলে বুঝতে পারবো, আমাদের এই ধারণা কতটা ভুল!
দাবা খেলায় ELO হলো একটি রেটিং সিস্টেম, যা দিয়ে পরিমাপ করা হয় একজন খেলোয়াড় দাবায় কতটা পারদর্শী। মানুষের মাঝে এখন পর্যন্ত সেরা ELO রেটিং ২৮৮২, যার মালিক ম্যাগনাস কার্লসেন। বর্তমানে 'স্টকফিশ' নামক আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজন্সের ELO রেটিং ৩৪৫৮।
ELO রেটিং ২০০ এর বেশি থাকার অর্থ হলো, দুজনের মধ্যে যার রেটিং ২০০ বেশি, সে অপরজনের বিপক্ষে ৭৮% ম্যাচে জয়লাভ করবে। এই রেটিং পার্থক্য যদি ৬০০ হয়, তখন জেতার সম্ভাবনা ৭৮% থেকে লাফ দিয়ে চলে যায় ৯৮% এ! অর্থাৎ কার্লসেনও স্টকফিশের বিপক্ষে ৯৮% খেলায় হারবে!
সম্প্রতি ডিপমাইন্ডের বানানো আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স 'আলফাজিরো' এই 'স্টকফিশের' সাথে ১০০ ম্যাচের সবগুলোতেই হয় জিতেছে, নয়তো ড্র করেছে। স্টকফিশের সাথে আলফাজিরোর পার্থক্য কোথায়? স্টকফিশের প্রোগ্রামাররা খেলার নিয়মের পাশাপাশি খেলার কৌশলের ব্যাপারেও অনেক কিছু শিখিয়েছেন স্টকফিশকে। আর সেখানে 'আলফাজিরো'কে শুধু নিয়ম বলে দেয়া হয়েছে, কোনো কৌশল শেখানো হয়নি। মাত্র চার ঘন্টায় আলফাজিরো যা শেখার, নিজে নিজেই শিখে নিয়েছে। অর্থাৎ মানুষের সাহায্য ছিল বরং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কাছে এক মস্ত বোঝা! যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স মাত্র চার ঘন্টায় নিজে নিজে এমন উচ্চতায় যেতে পারে, সেই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর মেশিন লার্নিংকে বোকা বলে আমরা নিজেরা কতটা বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছি সেটিও একটি বড় প্রশ্ন!
হ্যাঁ, এ কথা মেনে নিতেই হবে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে সংখ্যার দিক থেকে ডাক্তার কমে যাবে অনেক। কিন্তু বাকি যারা থাকবেন, তাঁদের প্রয়োজনীয়তা কমবে না কোনোদিনই। তাঁদের যুগান্তকারী চিন্তাভাবনা, তত্ত্বাবধান, গবেষণা আর সহায়তায়ই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স চিকিৎসা ক্ষেত্রকে নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে এক অনন্য উচ্চতায়। মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে সরকারের বাজেটের একটা বড় অংশ শেষ হয়ে যাবে না। "অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না"- এই কথার শেষ ঠাঁই হবে গল্প-উপন্যাসেই।
আর এ কথা বলতেই হবে, বছর দশেক পরে কেউ নামমাত্র মূল্যে, সময় নষ্ট না করে নির্ভুল চিকিৎসার জন্য একজন মানুষ ডাক্তার, নাকি মেশিনের শরণাপন্ন হবে সেটি তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমি বিপ্লব হুসাইন। CEO, YouthEye Foundation, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 69 টি টিউন ও 4 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 7 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 15 টিউনারকে ফলো করি।
A computer science & engineering student along with a youth social activist in Bangladesh, Love to teach, learning new things and writing articles for the betterment of peoples.