মানবদেহে পশুপাখির রোগ আসছে অবাধে, রোগ নিয়ন্ত্রণ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

মানুষ যেসব রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে, এর ৭৫ শতাংশই আসে গবাদিপশু থেকে। জলাতঙ্ক, অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, ব্রুসেলোসিস, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ আরও কিছু রোগের জীবাণু গবাদিপশু থেকে আসে।

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য, প্রাণীর বিভিন্ন রোগবালাইয়ের কারণে বাংলাদেশে বছরে ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ দেশে উৎপাদিত টিকার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় পশুপাখির প্রায় ৯০ শতাংশই অরক্ষিত অবস্থায় থাকে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বে ভেটেরিনারি চিকিৎসা, রোগনির্ণয় ও রোগ সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনবল ও বাজেট স্বল্পতার পাশাপাশি পশুপাখির রোগবালাই সম্পর্কে মানুষের সচেতনতারও অভাব আছে। অথচ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩১ শতাংশ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ জড়িত। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মৎস্য ও প্রাণিজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে গরুর সংখ্যা ছিল ২৩ কোটি ৯ লাখ, মহিষ ছিল ১৪ কোটি ৭৮ লাখ, ছাগলের সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি ৯ লাখ, ভেড়া ছিল ৩৪ কোটি, মুরগি ছিল ২৭ কোটি ৫১ লাখ এবং হাঁসের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪ লাখ। এ অর্থবছরে মাথাপিছু দৈনিক দুধের প্রাপ্যতা ছিল দিনে জনপ্রতি ১৫৭ দশমিক ৯৭ মিলিলিটার। মাংসের প্রাপ্যতা জনপ্রতি দিনে ১২১ দশমিক ৭৪ গ্রামে পৌঁছে। ডিমের প্রাপ্যতা বেড়ে হয় বছরে জনপ্রতি ৯২ দশমিক ৭৫টি। অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায় দুধ, ডিম, মাংসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তবে চাহিদা বাড়লেও সে অনুযায়ী রোগবালাই মোকাবিলায় অগ্রসর হতে পারছে না অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন সংস্থা।

টিকার অবস্থা
দেশে এ পর্যন্ত গবাদিপশুর জন্য তড়কা, বাদলা, গলা ফুলা, খুরা রোগ, পিপিআর, জলাতঙ্ক, গোট এবং প্লেগ টিকাসহ মোট ৭টি টিকা উৎপাদন করেছে। হাঁস-মুরগির জন্য রানীক্ষেত, বাচ্চার রানীক্ষেত, মুরগির বসন্ত ও কলেরা, হাঁসের প্লেগ, পিজিয়ন পক্স, গামবোরো, মারেক্স এবং সালমোনেলাসহ ৯টিসহ মোট ১৭টি টিকা উৎপাদন করা হয়েছে। তবে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি দ্বিখুরবিশিষ্ট গবাদিপশুর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক খুরা রোগের উৎপাদিত টিকা দিয়ে মাত্র ০ দশমিক ৬ শতাংশ পশুকে টিকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টেকটিউনসউটের মহাপরিচালক নাথু রাম সরকার বলেন, গবাদি পশুপাখির রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। খুরা রোগের জন্য যে পরিমাণে ভ্যাকসিন দরকার তা নেই, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে টিকার পরিমাণ দ্বিগুণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মনজুর মোরশেদ খান বলেন, বিভিন্ন গবাদিপশুর মধ্যে মুরগির রোগবালাই বেশি হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকার জানার পরও তা স্বীকার করে না। বার্ডফ্লু (এইচ৯ এন২) কে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

চিকিৎসা পরিস্থিতি
উপজেলা এবং জেলা পর্যায় ছাড়াও ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে ১০টি মেট্রো/থানা প্রাণিসম্পদ চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। জেলা ও উপজেলায় ১ জন ভেটেরিনারি সার্জন, রাজধানীতে কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালে একজন চিফ ভেটেরিনারি অফিসার, ১ জন ভেটেরিনারি অফিসারসহ মোট ১২ জন ভেটেরিনারি সার্জন চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আলট্রা সনোগ্রামসহ অসুস্থ পশুপাখির জন্য অন্যান্য যে চিকিৎসাসেবা দিতে হয় তাতে জনবলের তীব্র সংকট আছে।

কেন্দ্রীয় হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো সবই আছে কাগজে-কলমে। বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে একজন ভেটেরিনারি সার্জন বলতে গেলে একাই সব কাজ করেন। সব উপজেলায় এ সার্জনও নেই। তাই বুঝতেই পারছেন কাজ কতটুকু হয়। ’

সরকারি তথ্যও বলছে, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসপ্রতি মাসে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার সেবা গ্রহীতাকে সেবা দিচ্ছে। তবে এই সেবাটি পেতে সেবা গ্রহীতাকে প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণ সময় ব্যয় করতে হয়, যা গড়ে প্রায় ৫ ঘণ্টা।

জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ কোটি ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯৩টি গবাদিপশু এবং ১১ কোটি ৮৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮৭টি হাঁস-মুরগির চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ ঔষধাগার ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ মোট ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর বার্ষিক ১ লাখ ৬১ হাজার ২৯০ টাকার ওষুধ পায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল।

কেন্দ্রীয় ওষধাগারের উপপরিচালক আব্দুল জব্বার শিকদার জানান, চলতি বছর ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ বরাদ্দ ১৪ কোটি টাকা। বাণিজ্যিকভাবে ডেইরি বা পোলট্রি ফার্ম এখান থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ পাচ্ছে না। সাধারণ জনগণকে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে টিকা কিনতে হচ্ছে। ওষুধাগারটিও অনেক পুরাতন।

রোগনির্ণয়
প্রতিটি উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়নকেন্দ্রে রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক সুবিধা এবং প্রতি জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের জন্য মিনি ল্যাবরেটরি থাকলেও জনবল নেই। দেশে ৭টি আঞ্চলিক রোগ অনুসন্ধান ল্যাবরেটরির পাশাপাশি রাজধানীতে ১৯৫৭ সালে নির্মিত পুরাতন ভবনে কেন্দ্রীয় রোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারে পশুপাখির রোগ অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় রোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আ. হ. ম সাইফুল ইসলাম খান জানান, ১৯৫৭ সালের জনবল দিয়ে পুরাতন ভবনেই কাজ চলছে। তবে গবেষণাগারের কাজে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বৈদেশিক সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।

এ ছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা পশু ও পশুজাত পণ্যের মাধ্যমে রোগ প্রবেশ রোধে বিমান, স্থল ও সমুদ্র বন্দরে ২৪টি কোয়ারেন্টাইন স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

নেই স্থায়ী এপিডেমিওলজি ইউনিট
২০০৭ সালে বাংলাদেশে বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে দাতা সংস্থার পরামর্শে এপিডেমিওলজি ইউনিট যাত্রা শুরু করে। সংযুক্তিতে জনবল দিয়ে এ ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা স্থায়ী একটি ইউনিট এবং জেলা পর্যায়ে এর কার্যক্রম বিস্তৃত করার সুপারিশ করেছেন।

সচেতনতার অভাব
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকাসহ যেসব দেশের গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ভালো সে সব দেশের মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো। তাই মানুষের নিজেদের স্বার্থেই এ দিকটাতে নজর দিতে হবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালের চিফ ভেটেরিনারি অফিসার চিকিৎসক মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, অ্যানথ্রাক্স, নিপা ভাইরাস, র‍্যাবিসসহ গবাদি পশুপাখির বিভিন্ন রোগে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন একটা সচেতনতা বা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। খামারিরা পশুপাখির রোগ না হওয়া পর্যন্ত টিকা দেওয়া বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে চান না। গরু ছাগল অসুস্থ হলে লাভের আশায় জবাই করে ফেলছেন খামারিরা। আবার অসুস্থ গবাদিপশু মারা গেলে যে পদ্ধতিতে মাটিচাপা দিতে হয় তা করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, সচেতনতার অভাবে গবাদিপশু বিশেষ করে বিভিন্ন পোলট্রি ফার্মে রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে খামারিরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজেরাই বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন যার প্রভাব পড়ছে মানুষের শরীরে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চিকিৎসক মো. আইনুল হক বলছেন, গত কয়েক বছর আগেও যে হারে রোগবালাই হতো এখন তা কমে গেছে। অ্যানথ্রাক্স এবং গরুর খোরা রোগও আগের তুলনায় নিয়ন্ত্রণে আছে। ২০১০ সালে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ বাংলাদেশকে গবাদিপশুর ভাইরাসজনিত ভয়াবহ রোগ রিন্ডারপেস্ট মুক্ত ঘোষণা করেছে। জনবল কাঠামো সংস্কারের কাজ চলছে। বর্তমানে বিভিন্ন বৈদেশিক সংস্থার সহায়তা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

Collected From: Ajker Prosongo

Level 0

আমি আতোয়ার রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 9 টি টিউন ও 4 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস