ঘটনা-১
পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। তাই পথ চলতি গেরুয়া বসনের, দাড়ি চুলের জটাধারী লোকটি একটা অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাসায় আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। সদাশয় গৃহস্থ মুসাফিরকে ভেতরে ডাকলেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার সময় কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারলেন যে, অতিথি বিরাট বুজুর্গ লোক। তাই, বাড়ির সবচেয়ে ভাল ঘরটাতে ওনাকে থাকতে দিলেন।
পরদিন সকালে আতিথিয়েতার প্রশংসা করে বুজুর্গ বিদায় নিলেন; বাড়ির সকলেই রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ওনার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুদুর গিয়েই হঠাৎ ঐ জটাধারী ফিরে আসলেন .... কোনো সমস্যা হল কি না ভেবে গৃহকর্তা একটু এগিয়ে গেলেন। জটাধারী গৃহকর্তার হাতে একটা খড়ের টুকরা দিয়ে বললেন .. ভুলক্রমে ওনার বাড়ির খড়-কুটা তাঁর দাড়ির সাথে চলে গিয়েছিল তাই ফেরত দিতে এসেছিলেন। হতভম্ব মুগ্ধ গৃহকর্তাকে ঐ অবস্থায় রেখেই লোকটি বিদায় নিলেন। আশেপাশে জড়ো হওয়া প্রতিবেশীরাও অতিথির এহেন বোকামীমার্কা সততায় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
দুপুরে গৃহকর্তার বাড়িতে আবার গোলমাল শোনা গেল। ব্যাপার কিছুই না। অতিথি যে ঘরে ছিলেন সেই ঘর গোছাতে গিয়ে আবিষ্কার হল যে ঐ ঘরে সিন্দুক থেকে সমস্ত টাকাপয়সা হাওয়া হয়ে গিয়েছে। ............ জটার সাথে ভুলক্রমে চলে যাওয়া খড়কুটো ফেরত দেয়াটা একটা ইম্প্রেসিভ স্টান্টবাজি ছিল।
ঘটনা-২
আমার এক পরিচিত ব্যক্তির কাছে এক নেশাখোর একটা নোকিয়া ৩১১০ ক্লাসিক ফোনসেট ২০০ টাকায় বিক্রয় করতে চাইলো কিন্তু উনি সেটা নেননি। আমি খুব অবাক হলাম ..... প্রায় ৬ হাজার টাকার একটা সেট এ্যাত কমদামে পাচ্ছেন নেবেন না কেন? না হয় একটা চার্জার কিনে নিতে হবে, সেটার কতই বা আর দাম। তাছাড়া ঐ সেটটাতে কত সুবিধা একসাথে আছে .... দারুন রঙিন স্ক্রিন, ১.৩ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা, ব্লুটুথ, ক্লাস ১০ এজ মডেম ইত্যাদি। প্রতিটিই দরকারী ফীচার - কোথাও বেড়াতে গেলেন, দারুন কিছু দেখলেন; সেটা পরিচিতদের সাথে পরে শেয়ার করার জন্য ক্যামেরাটা কত কাজে দিত। এছাড়া এজ মডেম দিয়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট কত সহজে পাওয়া যায়, শুধু এজ মডেমের দামই কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা। ব্লু-টুথ দিয়ে তারের ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই অন্য মোবাইল বা কম্পিউটারের সাথে ডেটা/ফাইল/ছবি আদান প্রদান করা যায় .... কত সুবিধা -- এই সুবিধাগুলোর কোনটাই ওনার কমদামী সেটে নাই; যেটাতে শুধু কল করা আর রিসিভ করা যায়। একবার আমার ঐ মডেলের ফোন ছিনতাই হয়েছিল, তাতে যত টাকার ক্ষতি হয়েছিল (তৎকালীন ক্রয়মূল্য ছিল ৮৮০০ টাকা) আপনার তার কিছুই হবে না, ছিনতাই/চুরি যদি হয়েও যায় তবুও ২০০ টাকায় এর চেয়ে অনেক বেশি ভোগ করে নিতে পারবেন। এ্যাত সুবিধার কথা বোঝানোর পরও ওনার এক কথা: নির্ঘাত ওটা চুরির/ছিনতাইয়ের মাল, তাই যত কমদামেই দিক, যত সুবিধাই থাক নেবেন না। এখন ছবি তোলার দরকার হলেও ওটা ছাড়াই চলা যাবে অতি দরকার হলে খেয়ে না-খেয়ে টাকা জমিয়ে তবেই কিনবো আর ঐসব সুবিধা ভোগ করবো।
বাঃ, ওনার বিবেক আর বিবেচনাবোধ দেখে আমি চমৎকৃত হলাম। সত্যই তো চুরির মাল যত লোভনীয় হউক না কেন সেটা পরিত্যাজ্য। আমার ধারণা এই লেখার পাঠকগণের বেশিরভাগই একই রকম মনোভাব পোষন করেন।
কিন্তু কয়েকদিন পরেই অন্য কিছু ঘটনায় আমার মনে হতে লাগলো যে আগের যেই আদর্শবাদীতা দেখেছিলাম ওটা মেকী ছিল ... শুধুই লোক দেখানো ছিল। কিংবা হতে পারে যেই আদর্শের কথা তখন আমাকে বলেছিল সেটার অর্থ ওনার উপলব্ধিতেই নাই ... শুধুই তোতাপাখির মত কপচানো বুলি। নাকি আগের গল্পের জটাধারী অতিথির মত সততা!
কারণটা আর কিছুই না। উনার বাসায় এবং অফিসে অনেক চোরাই মাল অবিশ্বাস্য কমদামে কিনে ব্যবহার করতে দেখলাম। ঐ মালগুলোর দাম ঐ চোরাই মোবাইলের চেয়ে অন্ততপক্ষে ২০গুণ বেশি। ওনাকে যখন বললাম কেন এই কাজ করছেন? অনেক কমদামে অন্য ব্রান্ডের আসল জিনিষ ব্যবহার করা যায় তখন তিনি পুরা ১৮০ ডিগ্রীর ঘুরে উল্টা যুক্তি দিতে থাকলেন ... যে ঐ ব্রান্ডে এই সুবিধা নাই সেইটা সহজে করা যায় না -- কথা বলছে যেন আগের ঘটনার খলনায়ক (আমি)।
ঘটনা ২.১
কি .... এখনও বুঝতে পারেন নাই? ঠিক আছে ..... সহজ হিসাব দিচ্ছি:
প্রতিটি কম্পিউটারে কমপক্ষে: ১৫৬০ ডলার। তাহলে অফিস ও বাসা মিলিয়ে ৩০০০ ডলারের বেশি (= প্রায় ২,১০,০০০ টাকার বেশি) দামের সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন। বলাই বাহুল্য যে ওগুলো সবই চোরাই মাল। সবগুলো সিডি মিলিয়ে ২শ টাকার বেশি খরচ হয়নি। আগের আদর্শ গুলে খেয়ে সেগুলো কিন্তু ঠিকই ব্যবহার করছেন।
তাই ইদানিং যখনই কেউ বড় বড় আদর্শের বুলি কপচায় আর নিজেই লাখ লাখ টাকার চোরাই সফটওয়্যার ব্যবহার করে .... তখন মনের ভেতর থেকে কোনো মুগ্ধতা বের হয়ে আসে না - বরং হিপোক্রেসি দেখলে যেমন অনুভুতি হওয়ার কথা সেরকম মনে হয় (হে জটাধারী ভন্ড!)।
ঘটনা-২.২
একটু হিসাব করুন দেখি প্রতিটি কম্পিউটারে কত টাকার দূর্নীতি হচ্ছে? তাহলে একটা বাসায় কত টাকার দূর্নীতি হচ্ছে, একটা প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র এই সফটওয়্যার/কম্পিউটার খাতে কত টাকার দূর্নীতি হচ্ছে? পরপর ৫ বার দেশ হিসেবে দূর্নীতিতে যখন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম তখন কি এই খাত সহ হিসাব হয়েছিল? না হয়ে থাকলে এগুলো সহ হিসাব হউক -- দূর্নীতিতে আমাদের চ্যাম্পিয়নশীপ কোনদিন হুমকীর সম্মুখীন হবে না!
দেশের জন্য ক্রিকেটাররা কোন জয় আনতে না পারুক ... আমরা ঠিকই শুধু জয় না, চ্যাম্পিয়নশীপ ছিনিয়ে আনবোই আনবো!
ঘটনা-২.৩
নিজেকে বদলানোর কী দরকার?! বরং চ্যাম্পিয়নশীপ উপলক্ষে একটা থীম সং দরকার।
ঘটনা-৩
অল্টারনেটিভ অপশনটা কি জানেন? লিনাক্স .... ঐ সবগুলো সফটওয়্যারের কাছাকাছি বিকল্প সফটওয়্যার সহ বিনামূল্যেই পাওয়া যায়। বোনাস হিসেবে পাচ্ছেন সিকিউরিটি, কারণ লিনাক্সে ভাইরাসের বেইল নাই।
ঘটনা-৪
এসব বুঝাইতে গেলে বেশিরভাগ লোকই যুক্তি মেনে নেয়। আমাকে প্রচন্ড মাত্রায় সমর্থন ও উৎসাহ দেয় কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত এই পোস্টের শিরোনাম বাস্তবায়িত করে।
অবশ্য, আমার প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিচার মেনে তালগাছ ছেড়ে দিয়েছেন । সেই পত্রাঘাতের গল্প চাইলে আরেকদিন (... ... না চাইলেও জোর করে করবো .. হে হে ) । আপাতত অফ যাই।
ঘটনা-৫
যাওয়ার আগে কিছু সালিসের কথাবার্তা ....
তালগাছ বক্তাঃ আরে ... বিদেশি ওরা শত বছর ধরে আমাদের শোষন করেছে, এখন ওদের জিনিষ আমরা পয়সা না দিয়ে ব্যবহার করলে ঠিকই আছে।
বস্তিবাসীঃ বিল্ডিংএ থাকা সাহেবরা আমাদের পাওনা মেরে দিয়ে বড়লোক হৈছে ... তেনাগো বাসার জিনিষ চুরি করলে ঠিকই আছে।
তালগাছ বক্তাঃ ওদের জিনিষ ছিনিয়ে নেয়াই ঠিক পন্থা ... শালারা এই দেশটাকে চুষে খাচ্ছে।
ছিনতাইকারীঃ এই শালার বেটা তোর মোবাইল দে ...
তালগাছ বক্তাঃ আরে ভাই দেশে যেই ইনকাম তাতে তো কিনে সফটওয়্যার ব্যবহার করা যাবে না। পাইরেসী ছাড়া কোনো উপায় নাই ...
ছিচকে চোরঃ চারদিকে কাজ নাই। যেগুলো আছে সেগুলোতে আর কয়টাকা দেয়। তারচেয়ে সিগনালে দাঁড়ানো গাড়ির যাত্রীর ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে দৌড় দিয়ে রেলগাড়ীর সামনে দিয়ে লাইন পার হওয়া ছাড়া উপায় নাই।
তালগাছ বক্তাঃ ফ্রী সফটওয়্যারগুলো ভাল না। হ্যান করা যায় না ত্যান করা যায় না .... কমার্শিয়াল সফটওয়্যারের সুবিধা পেতে অনেক দুর যেতে হবে। তার চেয়ে পাইরেটেড সফটওয়্যার ভাল।
ঘুষখোর আমলার ছেলেঃ এই তোর বাবাটা যে কী ..... .... এ্যাত সততা দেখায় কী হবে... বাসায় একটা এসি লাগাতে পারে না ... এই গরমে এসি ছাড়া থাকা যায় ... ছিঃ ছিঃ
.... .... ....
... ... ...
(লেখাটি সর্বপ্রথম সচলায়তনে প্রকাশিত হয়েছিল (০৯-জানু-২০০৯))
আমি শামীম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 11 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 36 টি টিউন ও 449 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
গুগল আমার সম্পর্কে জানে, কাজেই জানতে চাইলে আমার নাম বা ইউজার নামটা দিয়ে গুগল করুন ... :D
চমৎকার দেখাইলেন গুরু !