জনপ্রিয় ফেসবুক কোম্পানি যা বর্তমানে মেটা (Meta) তাদের প্রতিশ্রুত মেটাভার্স বা ভার্চুয়াল জগতের প্রযুক্তিতে এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। এটি একটি বিনোদনমুখী প্রযুক্তি হলেও বাস্তবের মত কর্ম ও অনুভূতি পাবার সকল প্রচেষ্টাই তারা চালাচ্ছে। সফলও হয়েছে অনেকাংশেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে যেমন বিনোদন দিতে পেরেছে, তেমনই ঘটে গেছে বিপত্তিও। এসবের বিভিন্ন দিক নিয়ে আজকের আলোচনা।
সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে মেটাভার্স হল ভার্চুয়াল একটি জায়গা যেখানে আপনি খেলতে পারবেন, কাজ করতে পারবেন এবং অন্য লোকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন যারা আপনার মতো শারীরিকভাবে একসাথে উপস্থিত নেই। পাশাপাশি আপনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, ডেটিং করতে, কেনাকাটা করতে ইত্যাদি আরও অনেক কিছু করতে পারবেন।
মেটাভার্সে লোকেরা নিজেদের অবতার তৈরি করতে পারবে যাতে ত্বকের নির্দিষ্ট রঙ, কাপড়ের বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
মেটা (ফেসবুক) কোম্পানি মেটাভার্সের উদ্যোক্তা হলেও এ কোম্পানি একা নয়, বরং মাইক্রোসফটও সাথে যুক্ত রয়েছে।
তাদের তথ্যমতে, ব্যবহারকারীর বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। মেটার Horizon World Metaverse App টি ডাউনলোড করে নিতে হবে। সেইসাথে প্রয়োজন হবেে একটি কোয়েস্ট-২ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট। এটি নতুন আবিস্কৃত হয়েছে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেটটি কোন কিছুর বাস্তব অনুভূতি প্রদান করে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি স্পেসগুলির প্রকৃতি এমন যে, এটি ব্যবহারকারীকে এমন ভাবাতে ও অনুভূতি প্রদানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে যে, যেন তারা শারীরিকভাবে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রয়েছে, তাদের প্রতিটি শারীরিক ক্রিয়া একটি 3D পরিবেশে ঘটছে। তখন বাস্তবের মত মনে হবে।
এর মাধ্যমে যে কোন আবেগের প্রতিক্রিয়া শক্তিশালী হতে পারে। আপনি মেটাভার্সে বাস্তবের মত অথবা 3D মুভির মত দেখতে এবং শুনতে পাবেন। কেবল তাই নয়, বরং বাস্তবের মত আপনি অনুভবও করতে পারবেন হেডসেটটি দিয়ে।
নতুন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট ঠোঁট, দাঁত এবং জিহ্বাতে প্রাণের মতো সংবেদন পাঠায়। ফলে চুম্বনের সংবেদনশীল অনূভুতির পাশাপাশি প্রযুক্তিটি ভার্চুয়াল পানির ফোয়ারা থেকে পান করা বা সিগারেট খাওয়া কিংবা কফি পান করার অনুভূতি পেতে সাহায্য করবে ঠোঁট, দাঁত ও জিহ্বায়।
এমনকি বৃষ্টি ও বাতাসের অনূভুতিও পাওয়া যাবে হেডসেটটির মাধ্যমে। এটি শক্তি, কম্পন এবং গতি প্রয়োগ করে স্পর্শকে অনুকরণ করে।
সাথে রয়েছে গ্লোভস ও স্যুট, যেটি হাত ও শরীরকে সংবেদনশীল অনূভুতি প্রদান করবে। ভিআর হেডসেটের নীচের অংশের ট্রান্সডুসারগুলি একটি পাতলা অ্যারে ব্যবহার করে, যা মুখের বিভিন্ন অংশে আল্ট্রাসাউন্ড শক্তিকে নির্দেশ করে।
হরাইজন ওয়ার্ল্ডস মেটাভার্স অ্যাপটি গতবছরের নভেম্বরে বেটা ভার্সন পরীক্ষার পর ৯ ডিসেম্বর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার জনসাধারণের ব্যবহারের অনুমতি ছিল। তারা সেখানে অন্যদের সাথে একত্রিত হওয়া, গেম খেলা এবং তাদের নিজস্ব ভার্চুয়াল বিশ্ব তৈরি করার সুযোগ পায়।
কিন্তু তখন এমন একটি ঘটনা ঘটে যায় যা মেটাভার্সের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে এবং ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ‘বড় সমস্যা আছে’ বলে মন্তব্য এসেছে।
ঘটনাটি মেটাভার্সের একজন ব্যবহারকারী নারী বলেছেন। তিনি মেটাভার্সে ঘুরার সময় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। অন্য ব্যবহারকারীর 'ভাসমান হাত' তার শরীরের কাছে এসে তার বুকে ঘষতে শুরু করেছিল।
তিনি তখন চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘থাম!’ এমনকি যখন তিনি তার কাছ থেকে সরে আসতে গেলেন, তখন সে তার বুকে চেপে ধরে এবং তাকে তাড়া করে। তিনি বলেন, “সেখানে আমি আমার স্বামীর সাথে ছিলাম মেটাভার্সের একটি তুষারময় দুর্গে। ”
এভাবে প্রথম দিকের ব্যবহারকারীই যৌন হয়রানির শিকার হয়ে যায়। আর এটা যে সাধারণ নয় তার কারণ হল সাথে থাকা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেটটি। এটার মাধ্যমে দুজনই বাস্তবতার অনুভূতি পাচ্ছিল। সুতরাং এটা স্বাভাবিক ছিল না, বরং যৌন হয়রানিই ছিল।
এটা নিয়ে অনেক মন্তব্য ওঠে। নাম প্রকাশ না করা বেটা পরীক্ষক ফেসবুকের অফিসিয়াল হরাইজন গ্রুপে একটি টিউন করেছেন। তিনি লিখেছেন, “যৌন হয়রানি ইন্টারনেটে অহরহ ঘটছে, এটা কোন রসিকতা নয়। আর ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি) সাথে থাকা আরেকটি বাস্তব অনুভূতি যোগ করে তীব্র করে তোলে যৌন হয়রানির বিষয়টি। ”
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন হয়রানির গবেষক ক্যাথরিন ক্রস মেটাভার্সে নিরাপত্তাজনিত অভাবের সমালোচনা করেছেন।
উথারভার্সের প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান শাস্টার সতর্ক করে বলেন যে, “লোকেরা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য মেটাভার্সের অপব্যবহার করতে পারে। লোকেরা এটিকে পুরো জনসংখ্যার মগজ ধোলাই করতে ও তাদের পুতুলের মত নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবহার করতে পারে। “তিনি আরোও বলেন, “বিশ্বে পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের পর মেটাভার্সের চেয়ে ক্ষতিকর জিনিস আর নেই। ”
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ঘরে বসে পাপাচার, ডেটিং ও ইভটিজিং করার ভার্চুয়াল জগৎ হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে এই মেটাভার্স। প্রযুক্তিটি যে অরাজকতা আর পাপাচারের জগতে ঠেলে দেবে এ প্রজন্মকে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বর্তমান প্রযুক্তিগুলো ইতিমধ্যে অনলাইনে আমাদের আচরণ ট্র্যাক করে চলেছে প্রতিনিয়ত, তা মেটাভার্সেও বিদ্যমান থাকবে। আর এ ট্র্যাকিং আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। যেমন ভিআর হেডসেট পরে থাকা অবস্থায় ব্রেইন ও চোখের ট্র্যাকিং সহজেই করে ফেলা যাবে।
বাচ্চারা মেটাভার্সে কী করছে তা বোঝা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে, কারণ তারা তাদের ভিআর হেডসেটের মাধ্যমে যে বিশ্ব দেখছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না এবং ট্যাব বা ফোন ব্যবহার করে তাদের স্ক্রীন পর্যবেক্ষণ করারও কোন প্রক্রিয়া নেই।
ভিআর “হ্যাংওভার” একটি পরিচিত ঘটনা। আশ্চর্যজনকভাবে নিমজ্জিত বিশ্বের অভিজ্ঞতা লাভ করা হবে এর মাধ্যমে। কিন্তু যখন বাস্তব জগতে ফিরে আসা হবে, তখন এটি আমাদের হতাশাগ্রস্ত করে তুলতে পারে।
আরোও বড় বিষয় আইডেন্টটিটি হ্যাকিং। ভার্চুয়াল জগতে আমরা যে অবতার ব্যবহার করব, হ্যাকারের পক্ষে আমাদের অবতারগুলি হ্যাকিং করে অনলাইন পরিচয় চুরি করা সম্ভব হবে। যদি এটি ঘটে, হ্যাকার আপনি সেজে বিভিন্ন কাজ করতে পারে এবং এর মাধ্যমে আপনার ভার্চুয়াল এবং বাস্তব জগতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
হেডসেটটির মাধ্যমে ব্রেইন হ্যাকিং বা গ্লোভসের মাধ্যমে ফিংগারপ্রিন্ট হ্যাকিংয়ের ব্যপারও ঘটতে পারে।
এভাবে মেটাভার্সের মাধ্যমে প্রজন্মের ভবিষ্যত হতে পারে একটি কালো অধ্যায়।
আমি মুফতি রাকিবুল ইসলাম হোযায়ফী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 7 টি টিউন ও 2 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
প্রযুক্তি যেন আপনাকে আল্লাহকে ভুলিয়ে না দেয়।