দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহারের কারণে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের অর্থোপেডিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই সমস্যাগুলির মধ্যে প্রধানত ঘাড়, পিঠ, কাঁধ, এবং হাতের সমস্যা উল্লেখযোগ্য।
আমার মত অনেকেই আছেন যারা প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টার বেশি কম্পিউটার ডেস্কের সামনে বসে থাকেন। এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য। ফ্রিলান্সার হিসেবে কম্পিউটার ব্যবহার আমাদের জিবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে, এর প্রভাবে অর্থোপেডিক সমস্যাগুলো প্রায় সবাইকে কম বেশি ভোগায়। তবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমরা এই সমস্যাগুলি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি।
আজ আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে আপনাদের এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছি, ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট অর্থোপেডিক সমস্যাগুলি বিভিন্ন রকমের হতে পারে। এটি নির্ভর করে কাজের ধরন, কম্পিউটারের অবস্থান, এবং কাজ করার সময়কাল উপর। ঘাড়, কাঁধ, পিঠের নিচের অংশ এবং হাতের বিভিন্ন সমস্যাগুলি অত্যন্ত সাধারণ। এ ছাড়া, চোখের সমস্যা এবং মাথাব্যথাও দেখা দিতে পারে।
১. দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহারের কারণে ঘাড়ের সমস্যা
দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে ঘাড়ের সমস্যা খুবই সাধারণ। ঘাড়ের অস্বাভাবিক ভঙ্গি এবং একটানা অনেকক্ষণ একই অবস্থানে থাকার কারণে ঘাড়ের পেশী এবং হাড়ে চাপ পড়ে। এর ফলে ঘাড়ে ব্যথা, স্টিফনেস এবং মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
২. কাঁধ এবং বাহুর ব্যথা
কম্পিউটার ব্যবহারের সময় কাঁধ এবং বাহুর অনবরত চলাফেরা না করা এবং ভুল ভঙ্গিতে থাকার কারণে কাঁধের পেশী এবং টেন্ডনে চাপ পড়ে। এর ফলে কাঁধ এবং বাহুর ব্যথা এবং অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা যেমন রোটেটর কাফ ইনজুরি এবং টেন্ডিনাইটিসও হতে পারে।
৩. পিঠের নীচের অংশের সমস্যা
পিঠের নীচের অংশের সমস্যা হলো একটি সাধারণ সমস্যা যা দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করার কারণে দেখা দেয়। সঠিকভাবে বসা না হলে পিঠের নীচের অংশে চাপ পড়ে, যার ফলে লাম্বার স্পাইন সমস্যা এবং ডিস্ক হের্নিয়েশন হতে পারে।
৪. মুঠির সমস্যা এবং কারপাল টানেল সিনড্রোম
মুঠির সমস্যা এবং কারপাল টানেল সিনড্রোম হলো এক ধরনের ব্যথাজনিত অবস্থা যা মুঠি এবং হাতের উপর দীর্ঘসময় ধরে চাপ পড়ার ফলে দেখা দেয়। এর ফলে হাতের মুঠি দুর্বল হয়ে যায় এবং অঙ্গুলির মধ্যে ব্যথা ও অসাড়তা দেখা দেয়।
৫. দৃষ্টি সমস্যা এবং মাথাব্যথা
কম্পিউটারের মনিটরের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের পেশী ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে চোখের ব্যথা এবং মাথাব্যথা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, এটি দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, যেমন চোখের শুষ্কতা এবং ঝাপসা দৃষ্টি সৃষ্টি করতে পারে।
৬. পায়ের সমস্যা
দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে পায়ের উপরেও চাপ পড়ে, যা বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পায়ের ফুলে যাওয়া, টেন্ডিনাইটিস, এবং ভেরিকোজ ভেইনসের মত সমস্যা হতে পারে।
অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধের জন্য কিছু সহজ এবং কার্যকর উপায় আছে। সঠিক বসার ভঙ্গি, বিরতি নেওয়া, এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমে আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি। এছাড়াও, সঠিক ডেস্ক এবং চেয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যার সম্ভাবনা কমানো যায়। বিকল্প চিকিৎসার মাধ্যমে অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়। ফিজিওথেরাপি, আকুপাংচার, এবং ম্যাসাজ থেরাপির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যথা এবং স্টিফনেস কমানো যেতে পারে।
1. সঠিক বসার ভঙ্গি
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমে আমরা সুস্থ থাকতে পারি। সঠিক বসার ভঙ্গি হলো অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় আমাদের পিঠ সোজা রাখতে হবে এবং ঘাড় ও কাঁধ রিল্যাক্স রাখতে হবে। সঠিক বসার ভঙ্গি নিশ্চিত করতে পিঠ সোজা রাখা, কনুই ৯০ ডিগ্রি কোণে রাখা, এবং পায়ের তলা মেঝেতে সোজা রাখা উচিত।
2. কম্পিউটার ডেস্ক এবং চেয়ারের উচ্চতা
কম্পিউটার ব্যবহারের সময় কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করলে অর্থোপেডিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট সময় পরপর বিরতি নেওয়া এবং সঠিক ভঙ্গিতে কাজ করা উচিত। কম্পিউটার ডেস্ক এবং চেয়ারের উচ্চতা সঠিক হলে শরীরের বিভিন্ন অংশের উপর চাপ কমে যায়। চেয়ারের উচ্চতা এমনভাবে রাখতে হবে যাতে পায়ের তলা মেঝেতে সোজা অবস্থায় থাকে এবং কনুই ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে থাকে। অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। অটোমেটেড ডেস্ক, ইলেকট্রিক স্ট্যান্ডিং ডেস্ক এবং এর্গোনমিক চেয়ার ব্যবহার করে শরীরের উপর চাপ কমানো যায়।
2. পায়ের সাপোর্ট
পায়ের সাপোর্ট ব্যবহারের মাধ্যমে পায়ের উপর চাপ কমানো যায়। পায়ের সাপোর্ট ব্যবহার করলে রক্ত সঞ্চালন সঠিকভাবে হয় এবং পায়ের পেশী রিল্যাক্স থাকে।
4. বিরতির গুরুত্ব
দীর্ঘক্ষণ একটানা কাজ না করে কিছুক্ষণ বিরতি নেওয়া উচিত। প্রতি ৩০-৪৫ মিনিট পরপর ৫-১০ মিনিট বিরতি নেওয়া উচিত।
5. কম্পিউটার ব্যবহারের সময় চোখের সুরক্ষা
কম্পিউটার ব্যবহারের সময় চোখের সুরক্ষার জন্য নিয়মিত চোখের বিশ্রাম নিতে হবে। ২০-২০-২০ নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে, যেখানে প্রতি ২০ মিনিট পরপর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরে তাকাতে হবে।
6. স্ট্রেচিং এবং ব্যায়াম
স্ট্রেচিং এবং ব্যায়াম করার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন পেশী ও টেন্ডনের নমনীয়তা বাড়ানো যায়। দৈনন্দিন শরীরচর্চা শরীরকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কম্পিউটারের সামনে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে শরীরের পেশীগুলি শক্ত হয়ে যায়, যা বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। নিয়মিত শরীরচর্চা করার মাধ্যমে আমরা পেশীগুলিকে নমনীয় ও শক্তিশালী রাখতে পারি। যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশন শরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত উপকারী। নিয়মিত যোগব্যায়াম করার মাধ্যমে শরীরের পেশী ও টেন্ডনের নমনীয়তা বৃদ্ধি পায় এবং মনের প্রশান্তি আসে।
7. মনিটরের সঠিক অবস্থান
কম্পিউটার মনিটরের সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনিটরটি এমন উচ্চতায় স্থাপন করতে হবে যাতে এটি চোখের সোজাসুজি থাকে এবং এর ফলে ঘাড় ও চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। কম্পিউটার ব্যবহারের সময় চোখের সুরক্ষা করার জন্য ২০-২০-২০ নিয়ম অনুসরণ করা উচিত, যেখানে প্রতি ২০ মিনিট পরপর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরে তাকাতে হবে। এছাড়াও, নিয়মিত চোখের বিশ্রাম নেওয়া উচিত।
8. কীবোর্ড এবং মাউসের ব্যবহার
কীবোর্ড এবং মাউসের সঠিক ব্যবহার অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। কীবোর্ডটি এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে কনুই ৯০ ডিগ্রি কোণে থাকে এবং হাত সোজা অবস্থায় থাকে।
9. কম্পিউটার ব্যবহারের সময় হাতের অবস্থান
কম্পিউটার ব্যবহারের সময় হাতের অবস্থান সঠিক না হলে হাতে ব্যথা এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। হাতকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আরামদায়ক কুশন ব্যবহার করা যেতে পারে।
10. আলো এবং পরিবেশ
কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আলো থাকা অত্যন্ত জরুরি। পর্যাপ্ত আলো না থাকলে চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যা সৃষ্টি হয়। এছাড়া, সঠিক আলো ব্যবহার করলে কাজের পরিবেশও আরামদায়ক হয়।
11. কর্মক্ষেত্রের আরামদায়কতা
কর্মক্ষেত্রের আরামদায়কতা অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। কর্মক্ষেত্রকে এমনভাবে সাজানো উচিত যাতে এটি ব্যবহারকারীর জন্য আরামদায়ক হয় এবং দীর্ঘক্ষণ কাজ করার পরেও কোনো সমস্যা না হয়। অফিসের পরিবেশ সঠিক হলে কর্মীরা আরামদায়কভাবে কাজ করতে পারে এবং অর্থোপেডিক সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারে। সঠিক আলোর ব্যবস্থা, আরামদায়ক চেয়ার এবং ডেস্ক ব্যবহার করা উচিত।
১২. পুষ্টি এবং খাদ্যাভ্যাস
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা শরীরের সার্বিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন, মিনারেল, এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের পেশীগুলির শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়।
১৩ অর্থোপেডিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা
অর্থোপেডিক সমস্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। অর্থোপেডিক সরঞ্জাম, যেমন সাপোর্ট বেল্ট, নেক ব্রেস, এবং সাপোর্ট শু ব্যবহার করে অর্থোপেডিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে অর্থোপেডিক সমস্যা এবং প্রতিরোধের উপায়
দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট অর্থোপেডিক সমস্যার প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সঠিক বসার ভঙ্গি, সঠিক ডেস্ক এবং চেয়ারের ব্যবহার, নিয়মিত বিরতি, এবং শারীরিক ব্যায়াম অর্থোপেডিক সমস্যা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, ভিটামিন, মিনারেল, এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং পুষ্টিকর খাদ্য শরীরের সার্বিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থোপেডিক সমস্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
আজ এই পর্যন্ত, ভাল লাগলে উৎসাহ দিতে ভুলবেন না।
আমি মোঃ সামিম চৌধুরী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 5 মাস 1 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 1 টি টিউন ও 1 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।