ছোটবেলায় আমরা সবাই পড়েছি মানুষের মৌলিক চাহিদা- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা। সময়ের পরিক্রমায় তাতে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বিষয়- ইন্টারনেট! ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল ছাড়া এখন জীবনযাপনের কথা চিন্তাও করতে পারেন না পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ। বাংলাদেশেও ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। যদিও আমাদের দেশের অনেকের কাছেই ইন্টারনেট এখনও একটি নতুন ধারণা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ইন্টারনেটের বয়স কিন্তু পঞ্চাশ ছুঁতে চলেছে! গত বিশ বছরে পৃথিবীর ২১০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেট, গোটা বিশ্বকে বেঁধেছে এক সুতোয়, ঘুঁচিয়ে দিয়েছে যত দূরত্ব। আজ আমরা জেনে নেবো ইন্টারনেটের অর্ধশতাব্দীব্যাপী ঘটনাবহুল বিস্ময়কর পথচলায় যা কিছু প্রথম- প্রথম ই-মেইল, প্রথম ইউটিউব ভিডিও, প্রথম মাল্টিপ্লেয়ার গেম, প্রথম সাইবার ক্যাফে ইত্যাদির চমকপ্রদ গল্প!
ই-মেইলের কল্যাণে হাতে লেখা চিঠিপত্রের চল উঠে গেছে সেই কবেই। ই-মেইল একাউন্ট নেই এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে এই সময়ে। ই-মেইল এতটাই জনপ্রিয় যে হিসেব করে দেখা গেছে পৃথিবীজুড়ে প্রতি সেকেন্ডে ২৪ লক্ষেরও বেশি ই-মেইল চালাচালি হয়ে থাকে, বছরের হিসেবে সেই সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ৭৪ ট্রিলিয়নে!
কিন্তু ইতিহাসে সর্বপ্রথম ই-মেইল কবে পাঠানো হয়েছিল তা কি জানো? আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, সেই ১৯৭১ সালে! কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার Ray Tomlinson টিনেক্স নামের একটি টাইম শেয়ারিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করছিলেন।
তিনি CYPNET এবং SNDMSG নামের দুটি প্রোগ্রামকে একসাথে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম নেটওয়ার্ক ই-মেইল পাঠিয়ে বাজিমাত করেন! এর আগে শুধু একটি কম্পিউটারে এক ইউজার থেকে অন্য ইউজারে ই-মেইল পাঠানো যেতো, কিন্তু Ray সর্বপ্রথম এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে নেটওয়ার্ক ই-মেইল পাঠাতে সক্ষম হন। সূচনা হয় তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের এক নতুন দিগন্তের।
সব আবিষ্কারেরই ভালমন্দ দুটি দিক রয়েছে। বিজ্ঞানীরা যখন ইন্টারনেটকে মানুষের কল্যাণে কিভাবে আরো উপযোগী করে তোলা যায় সেজন্য নিরলস গবেষণা করে চলেছেন, তখন গণিতবিদ জন ভন নিউম্যানের মাথায় আসলো একটি অভিনব আইডিয়া- মানুষের শরীরে যেমন ভাইরাস আক্রমণ করে, কেমন হয় যদি অন্তর্জালেও তৈরি করা যায় এমন ভাইরাস!
যেই ভাবা সেই কাজ- Virus এবং Worms নামে ১৯৪৯ সালে তিনি একটি থিওরি দাঁড় করান- যেই প্রোগ্রাম কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলোকে ইচ্ছামতো এলোমেলো করে দিতে পারে! তাঁর সেই থিওরি দিয়ে ১৯৭১ সালে BBN কোম্পানির বব থমাস নামের একজন ইঞ্জিনিয়ার বানালেন পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার ভাইরাস- Creeper! সেটি ১৯৭১ সালে আরপানেট নামের একটি কম্পিউটারে আক্রমণ করে।
অবশ্য Creeper কে কোন ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়নি। Creeper আক্রান্ত কম্পিউটারে শুধু “I’m the creeper: catch me if you can” এই লেখাটি ফুটে উঠতো! ক্রিপারকে শায়েস্তা করতে তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম এন্টিভাইরাস- The Reaper! সেটি কম্পিউটার সিস্টেমের সবখানে খুঁজে খুঁজে Creeper ভাইরাসকে সনাক্ত করে সেটিকে মুছে দিতে পারতো।
অনলাইন কমিউনিটি এখন অনেকেই ব্যবহার করে সময় কাটানোর জন্য, প্রথম অনলাইন কমিউনিটি কিন্তু গঠন করা হয়েছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্যে- নেপালে বন্যা কবলিত অঞ্চলে হেলিকপ্টারে সাহায্য পাঠানোর উদ্দেশ্যে।
১৯৮১ সালে ড. ল্যারি ব্রিলিয়েন্ট ভাবলেন কীভাবে ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে দুর্যোগে বিপন্ন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা যায়। তিনি তাঁর পরিকল্পনার একটি খসড়া তৈরি করে স্টিভ জবসকে দেখান। পরে স্টিভ জবসের পরামর্শ মতো ১৯৮৫ সালে ড. ল্যারি এবং স্টুর্য়াড ব্রান্ড মিলে দুনিয়ার প্রথম অনলাইন ফোরাম The Well তৈরি করেন।
“সার্চ ইঞ্জিন” বললেই আমাদের মাথায় সবার আগে চলে আসে গুগলের নাম। গুগল ছাড়া ইন্টারনেটের কথা যেন চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু প্রথম সার্চ ইঞ্জিনের জন্ম গুগলের অনেক আগে। ১৯৮৯ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানী Alan Emtage ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়ার সময় তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেম এডমিনিস্টেটরের পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেন ছাত্রদের জন্য সারাক্ষণ ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে সফটওয়্যার খোঁজা ভয়ানক বিরক্তিকর একটি কাজ! তিনি ভাবলেন এমন কিছু তৈরি করার, যেন চাইলেই যে কোন তথ্য খুঁজে বের করা যায় সহজেই। সেই ভাবনা থেকে তিনি একটি Script set তৈরি করেন যেটি ভার্সিটির সিস্টেম ডেটাবেজ থেকে নিজে নিজেই অনায়াসে তথ্য খুঁজে দিতে পারে!
তাঁর এই চমৎকার আবিষ্কারের গল্প চারিদিকে ছড়িয়ে গেলে, আরো দুইজন বন্ধু বিজ্ঞানী এগিয়ে এলেন- Mike Parker এবং Bill Heelan। তাঁরা তিনজন মিলে ১৯৯১ সালে তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম অনলাইন সার্চ ইঞ্জিণ- Archie! Archive থেকে তথ্য খুঁজতেই সার্চ ইঞ্জিনের আবিষ্কার, তাই শব্দটি থেকে শুধু ‘v’ অক্ষরটি বাদ দিয়ে নাম হলো Archie!
এখন আমরা সবাই যেই WorldWideWeb ব্যবহার করে থাকি, সেটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ব্রাউজার, টিম বার্নার লি ১৯৯১ সালে এটি তৈরি করেন।
তিনি ব্রাউজারটি তৈরি করেন ইউরোপিয়ান কোম্পানি Cern এর নিউক্লিয়ার রিচার্জের জন্য। সেটি তখন কেবল Nextstep এ চালানো যেতো। কিন্তু Nextstep ফর্মটি সবার ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা হয়নি দেখে WorldWideWeb ব্রাউজারটি জনসাধারণের ব্যবহারের সুযোগ ছিল না তখন।
১৯৯৩ সালে এ সমস্যার সমাধান হয়। ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের জন্য সর্বপ্রথম জনসাধারণের ব্যবহার উপযোগী ওয়েব ব্রাউজার Mosaic রিলিজ করা হয়
পৃথিবীর প্রথম ওয়েবক্যাম সিস্টেমটির নাম ছিল “XCoffee” সেটি ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করে। XCoffee তৈরির পেছনের গল্পটা বেশ মজার! ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাবে তখন বেশ কয়েকটি কফি মেশিন ছিলো। কিন্তু কফি খেতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যেতো মেশিন খালি! ছাত্র শিক্ষক সবাই কফি মেশিনের কাছে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যেতো।
কফি নিয়ে মজার এই সমস্যায় বিরক্ত হয়ে ক্যামব্রিজের বিজ্ঞানীরা অভিনব একটি সমাধান বের করলেন। কফি মেশিনের সামনে একটি পুরোনো ক্যামেরাকে বসিয়ে সেটিকে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করলেন তারা- সেটির মাধ্যমে ল্যাবের কফি মেশিনগুলোর লাইভ ছবি প্রর্দশিত হত! ফলে সবাই জায়গায় বসেই জানতে পারতো মেশিনে কফি আছে নাকি নেই!
পৃথিবীর সর্বপ্রথম সাইবার ক্যাফের নাম সাইবেরিয়া, ১৯৯৪ সালে ব্রিটেনে লন্ডনের ওয়াইটফিল্ড স্ট্রিটের ইজিনেট অফিসের নিচতলায় সেটি খোলা হয়। সাধারণ মানুষ তখনও ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল না।
দুনিয়ার সর্বপ্রথম সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জন্ম ফেসবুকেরও দশ বছর আগে
কিন্তু সময়ের সাথে সাইবার ক্যাফের জনপ্রিয়তা হুহু করে বাড়তে থাকে এবং সাইবার ক্যাফেটির মালিকরা মওকা বুঝে প্যারিস, ব্যাংকক, টোকিও ইত্যাদি শহরে শাখা অফিস খুলে বসেন। সাইবেরিয়া সাইবার ক্যাফেতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চাইলে তখন ঘন্টাপ্রতি গুণতে হতো ১৫০ ডলার!
ফেসবুকের নাম শুনেনি এমন মানুষ বিরল। কিন্তু দুনিয়ার সর্বপ্রথম সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জন্ম ফেসবুকেরও দশ বছর আগে। ১৯৯৫ সালে Randy Conrads তৈরি করেন Classmates.com নামের এই সাইট। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিলো ফেলে আসা শৈশবের স্কুলের বন্ধুদের সবাইকে ইন্টারনেটে খুঁজে বের করে একসাথে করা।
ইউটিউবের সাথে আমাদের অনেক বড় গর্বের একটি বিষয় জড়িয়ে আছে। ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা যে বাংলাদেশেরই এক বিজ্ঞানী! ইউটিউবের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ভিডিওটি তাঁরই আপলোড করা। জাওয়েদ করিম নামের সেই বাংলাদেশি তরুণ ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল স্যান ডিয়াগোর চিড়িয়াখানায় হাতিদের সামনে ধারণ করেছিলেন ১৮ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি, তারপর তো ইতিহাস! তোমরা এই লিঙ্কে গিয়ে দেখে নিতে পারো সেই ভিডিওটিঃ
https://www.youtube.com/watch?v=jNQXAC9IVRw
ফেসবুকের প্রথম প্রোফাইলটি কার? কার আবার? ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের! আসলে তাঁর প্রোফাইলটি খোলার আগে আরো তিনটি প্রোফাইল খোলা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো পরীক্ষামূলক হওয়ায় প্রথম প্রোফাইলের কৃতিত্ব জাকারবার্গের নামেই যায়! সেই প্রোফাইল পেইজটি দেখতে ছিল এমন
আমি রশিদ হৃদয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 7 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 4 টি টিউন ও 4 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 4 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।