সুপ্রিয় টেকটিউনস কমিউনিটি, সবাইকে আমার আন্তরিক সালাম এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি তারবিহীন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক এবং বহুল প্রচলিত কেবল কানেকশন (ইথারনেট) এর মাঝে তুলনামুলক আলোচনা নিয়ে আমার আজকের টিউন।
পৃথিবী ক্রমেই তারবিহীন প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আগে যেখানে টেলিফোন, টেলিগ্রাফ দিয়ে তারের মাধ্যমে যোগাযোগ হতো সেখানে বর্তমানে মোবাইল ফোন সেই জায়গা তারবিহীন প্রযুক্তি দিয়ে দখল করে নিয়েছে। অহেতুক তারের ব্যবহার থেকে বাঁচতে নিত্য নতুন তৈরী হচ্ছে ওয়্যারলেস হেডফোন, চার্জার, চুল্লি থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু। ইন্টারনেট জগতে এই পরিবর্তনটা আরও ভালোভাবে চোখে পড়ছে।
আপনার বাসায় যখন একাধিক ইন্টারনেট কানেকশন যুক্ত ডিভাইস রয়েছে তখন সেগুলোকে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত করতে অবশ্যই তারবিহীন প্রযুক্তি (ওয়াই-ফাই) ব্যবহার করছেন? ওয়াই-ফাই কানেকশন এর ব্যবহার আজকাল খুবই দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাদের বাসায় বহুল ব্যবহৃত কেবল কানেকশন (ইথারনেট) ছিলো তারাও আজকাল তার সাথে ওয়াই-ফাই রাউটার সংযুক্ত করে ফেলছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে ওল্ড ফ্যাশন ইথারনেট কেবল কানেকশনের দিন কি তাহলে শেষ হওয়ার পথে? আধুনিক ওয়াই-ফাই টেকনোলজি কি তাহলে ইথারনেট এর স্থান দখল করে নিচ্ছে? উত্তরের স্বপক্ষে হ্যাঁ বলার আগে আপনার অবশ্যই ওয়াই-ফাই এবং ইথারনেট সংযোগের মাঝে পার্থক্য এবং এদের সুবিধা অসুবিধা জানতে হবে। অন্ধের মতো অনুকরণের মাধ্যমে সঠিক কাজ করার চেয়ে জেনে বুঝে ভুল করেও শান্তি পাওয়া যায়।
কয়েক বছর আগেও ওয়াই-ফাই এবং ইথারনেট ব্যবহারের পেছনে যুক্তিটা ছিলো খুবই সহজ। ইথারনেট কানেকশন খুবই দ্রুতগতির এবং অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ডেস্কটপ এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন। সেখানে তারবিহীন ইন্টারনেট (ওয়াই-ফাই) প্রযুক্তির স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ ছিলো না বলে বিতর্কটা ছিলো না বললেই চলে।
কিন্তু বর্তমানে মোবাইল (ভ্রাম্যমান) ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং ট্যাবলেট কম্পিউটারের দ্রুত বৃদ্ধির কারনে এখানে ডিভাইসগুলোর নড়াচড়াটা প্রধান ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। আপনি নিশ্চয় স্মার্টফোনের সাথে ইথারনেট কেবল লাগিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চাইবেন না? তাই এ সমস্যা থেকে সমাধানের একমাত্র উপায় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে তারবিহীন ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি।
আপনি একটি ওয়াই-ফাই রাউটারের সাহায্যে এর আশেপাশে ১৫০ ফুট এলাকা জুড়ে যেকোন সংখ্যক ডিভাইসে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন।
কিন্তু সমস্যা হলো ওয়াই-ফাই কানেকশন ইথারনেট এর চেয়ে তুলনামুলক ভাবে ধীরগতির এবং আনস্টেবল। কারন ওয়াই-ফাই সিগনালগুলো এর আশেপাশে থাকা রেডিও ওয়েব দ্বারা প্রভাবিত হয়। এটি অন্য ডিভাইসের সাথে সিগনালের কনফ্লিক্ট করে। তাছাড়া সীমাবদ্ধ দেয়াল এবং ওয়াই-ফাই রাউটারের অবস্থানের কারনে সিগনালের তারতম্য হয়।
সুতরাং মোবাইল ডিভাইসের জন্য সুবিধাজনক হলেও স্পীডের দিক থেকে আপনি একটু ভালোই অসুবিধার শিকার হচ্ছেন। এখন প্রশ্নটা যেহেতু স্পীড এবং সুবিধার মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে সেহেতু সঠিক সিদ্ধান্তে আসাটা একটু কঠিন হয়েছে বলা চলে।
আমি নিশ্চিত টিউনের এই পর্যন্ত পড়ার পর আপনারা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছেন ওয়াই-ফাই এবং ইথারনেট এর মাঝে কোনটা ভালো হবে সেই বিষয়ে। টিউনের বাকি অংশে আপনাদের দ্বিধান্বিত ভাবকে প্রশমিত করার সব ধরনের চেষ্টা করা হবে। তবে আর দেরি কেন?
যখন প্রথম ওয়াই-ফাই টেকনোলজি সর্বসাধারনের জন্য উন্মোক্ত করা হয় তখন এটা ছিলো 802.11g স্ট্যান্ডার্ড। যা Theoretically সর্বোচ্চ 54Mbps (7MB/s) স্পীড দিতে পারতো। বাস্তবতা যদিও অনেকটাই ভিন্ন কিন্তু মোবাইল ডিভাইসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য এটা অনেকটাই সন্তোষজনক ছিলো।
ঠিক এর বিপরীতে ইথারনেট কানেকশন 100Mbps থেকে 1000Mbps বা আরও বেশি স্পীড দিতে সক্ষম। যদিও লেটেস্ট 802.11ac ওয়াই-ফাই স্ট্যান্ডার্ড Theoretically সর্বোচ্চ 3200Mbps স্পীড দিতে সক্ষম কিন্তু বাস্তবে এর অর্ধেকও পাওয়া যায় না।
যদিও ওয়াই-ফাই রাউটার যে পরিমাণ সর্বোচ্চ স্পীড দিতে পারে সেই অনুযায়ী ব্রডব্যান্ড কানেকশনগুলো স্পীডি না। তারপরেও হার্ডওয়্যার কনফিগারেশন ঠিক থাকলে একটি ইথারনেট সংযোগ যে রকম স্ট্যাবল কানেকশন দিতে পারে ওয়াই-ফাই ততোটা কখনোই পারে না। অনেক বড় ফাইল ডাউনলোড, ভিডিও স্ট্রিমিং এবং অন্যন্য কাজের জন্য ইথারনেট নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সর্বোচ্চ স্পীড দিতে সক্ষম।
ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক চারপাশের পরিবেশ দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়। ওয়াই-ফাই এর রেডিও তরঙ্গগুলো দেয়াল কিংবা ফ্লোর দ্বারা ব্লকড হয়ে যেতে পারে। ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক এর পাশে অন্যন্য ওয়্যারলেস ডিভাইস যেমন মাইক্রোওয়েব, কর্ডলেস ফোন, অন্য কোন রাউটার ইত্যাদি থাকলে সেগুলো দ্বারা ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক বাধাগ্রস্থ হয়।
এছাড়াও বায়ুমণ্ডলে সমস্যার কারনে ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক ঝামেলা করতে পারে। তাছাড়া আপনি যদি ওয়াই-ফাই রাউটার থেকে একটু দুরে সরে যান কিংবা আপনার বাসায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যান তাহলে দেখবেন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক উঠানামা করছে। সেই সাথে ইন্টারনেট স্পীড নেমে যাওয়া তো নিয়মিত ঘটনা। তাছাড়া বাসার সব জায়গায় ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক সমানভাবে পায় না এমনকি কিছু জায়গায় কখনোই সিগনাল পাওয়া যায় না।
;
যদিও ওয়াই-ফাই রাউটারের অবস্থান পরিবর্তন করে এই সমস্যা কিছুটা কমিয়ে আনা যায় তবুও এক্ষেত্রে ইথারনেট কানেকশনে কোন প্রকার ঝামেলা হয় না। ইথারনেট কানেকশন স্থান এবং পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হয় না।
কানেকশন ঠিক থাকলে এটা যেকোন স্থানে একই রকম স্পীড দিতে সক্ষম। যাহোক, ওয়াই-ফাই রাউটারকে কিভাবে সেট করলে সর্বোচ্চ স্পীড এবং সিগনাল পাওয়া যাবে এ ব্যাপারে আমার একটা টিউন আছে। আপনাদের প্রয়োজন হলে এখানে ক্লিক করে টিউনটি দেখে নিতে পারবেন। হয়তো টিউনটি দেখে এ সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তিও পেতে পারেন।
ওয়াই-ফাই এবং ইথারনেট এর সিকিউরিটির বিষয়টা অবশ্যই সবার আগে দেখতে হবে। আপনি যখন কোন ইথারনেট কানেকশন ব্যবহার করবেন তখন ইথারনেট নেটওয়ার্ক কেবল তার সাথে সংযুক্ত ডিভাইসে প্রবেশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার বা ডিভাইসের ফায়ারওয়াল সমস্ত কানেকশন নিয়ন্ত্রন করে এবং ডাটা সুরক্ষিত থাকে। কেউ চাইলেই কোন ভাবে সিস্টেম হ্যাক করতে পারবে না।
ওয়াই-ফাই এর ক্ষেত্রে বিষয়টা সামান্য আলাদা। আপনি যে তথ্য আদান প্রদান করছেন সেটা অন এয়ারে থাকে। ফলে কোন ওপেন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে সেটাকে হাতিয়ে নেওয়া সহজ হয়। সুতরাং কোন ওপেন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে যে কেউ আপনার তথ্য চুরি করতে পারে। তবে পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড এবং ম্যানিয়েলি হাইলি সিকিউরড কানেকশনগুলোকে নিরাপদ বলা চলে।
আমরা এতোক্ষণ ওয়াই-ফাই এবং ইথারনেট এর তুলনামূলক পার্থক্য আলোচনা করলাম। আলোচনা থেকে হয়তো ইথারনেট কানেকশনকে এগিয়ে রাখা যায়। কিন্তু দিনের পর দিন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের উন্নতির জন্য কাজ করা হচ্ছে। সুতরাং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার নিজের ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরনের উপর চিন্তা করতে হবে।
তার আগে আপনার যদি সুযোগ থাকে তাহলে স্পীড টেস্ট করার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে নিন আপনার জন্য কোন অপশনটি বেশি উপযোগি। তবে আমি দুটি শ্রেণী তৈরী করে দিচ্ছি। আপনাদের সেটাতে বেশি সুবিধা হবে আপনারা সেটা ব্যবহার করবেন।
ইথারনেট এবং ওয়াই-ফাই কানেকশনের এই তুলনামূলক আলোচনার সবটুকুই আমার কল্পনা প্রসুত নয়। ইন্টারনেট থেকে এই দুটি নেটওয়ার্কের আদিঅন্ত বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ সময় ইথারনেট কানেকশনে ওয়াই-ফাই রাউটার সংযুক্ত করে কাজ করা হয়। সেক্ষেত্রে ওয়াই-ফাই রাউটার নাকি ইথারনেট মেইন লাইন থাকবে সে নিয়ে আমাদের মাঝে এক দ্বিধা কাজ করে। আজ আশা করি সেই দ্বিধার অবসান হয়েছে। তবে টিউন সম্পর্কে যদি আপনাদের ভিন্ন মত থাকে তাহলে সেটা সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করুন। আমার সামান্য জ্ঞানের সবটুকু দিয়ে আপনাকে সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
টিউনটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে অথবা বুঝতে যদি কোন রকম সমস্যা হয় তাহলে আমাকে টিউমেন্টের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না। কারন আপনাদের যেকোন মতামত আমাকে সংশোধিত হতে এবং আরো ভালো মানের টিউন করতে উৎসাহিত করবে। আর টিউনটিকে মৌলিক মনে হলে এবং নির্বাচিত টিউন হওয়ার উপযুক্ত মনে হলে নির্বাচিত টিউন মনোনয়ন দিতে ভুলে যাবে না যেন। সর্বশেষ যে কথাটি বলবো, আশাকরি এবং অপরকেও কপি পেস্ট টিউন করতে নিরুৎসাহিত করি। সবার সর্বাঙ্গিন মঙ্গল কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। দেখা হবে আগামী টিউনে।
-
আপনাদের জন্য » সানিম মাহবীর ফাহাদ
আমি সানিম মাহবীর ফাহাদ। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 176 টি টিউন ও 3500 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 159 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আগে যা শিখেছিলাম এখন তা শেখানোর কাজ করছি। পেশায় একজন শিক্ষক, তবে মনে প্রাণে টেকনোলজির ছাত্র। সবার দোয়া প্রত্যাশি।
ভাই আপনার টিউনগুলো আমার ধারুন লাগে