আমরা আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ নিয়ে চলাচল করি, আমাদের পরিবার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি ব্যবসা বা অনলাইনে। তার মধ্যে যাদের কাছে আমরা আমাদের আবেগ, ভালবাসা বা একান্ত মুহূর্ত কাটাতে ও শেয়ার করতে চায় তাদের অন্যতম হল বন্ধু। বন্ধু একজন মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, পরিক্রমা। আমরা এমন অনেক কিছু তাদের ফলো করে থাকি যার প্রভাব জীবনভর আমাদের মধ্যে চলতে থাকে এবং আমরা উদাহরণ হিসেবে অন্যদের বলে থাকি "আমার এক বন্ধু ছিল-", অন্যদের সাথে প্রথম সাক্ষাৎও সেই আগেই স্বাভাব, অভিজ্ঞতার পুন:রাবৃত্তি করতে থাকি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের ভাল লাগা, বন্ধুত্ব এর ধরন বদলাতে থাকে, বদলাই না শুধু বন্ধুত্ব নামক ভালবাসার টান। তাদের সাথে থাকলে সেই বাল্যকালের বাতসাল্য ফিরে আসে, কোন কিছু না ভেবে আমরা বোকার মত আচরণ, হাসি, বুলি ও হাত পা ছুড়তে থাকি। তুই বলার একমাত্র মাধ্যম ও থাকে এই ব্যক্তি গুলাই।
তাই তাদের ভাল খারাপ প্রত্যকটি প্রভাব আমাদের মধ্যে দারুণ ভাবে পড়ে। ভাল বন্ধু যেমন আপনাকে অনেক বিষয়ে সাহায্য করে থাকে, উতসাহ এবং মানসিক সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমনি আবার খারাপ বন্ধুদের প্রভাব, কথা, আচরণ ও তাদের কুকর্মের ফল ভোগের মাধ্যমের কারণ ও আপনি হতে পারেন। আত্মসম্মান হরণ ও জীবন বিনাশের কারণ হতে পারে এই বন্ধুই।
তাই চলুন জেনে নেই আমরা বন্ধু নির্বাচনে কি কি বিষয়ে সর্তক থাকবো।
আমরা চাইলেও সবার পছন্দ, রুচি ও আচরণ এক রকম করতে পারি না। তাই আমাদের মত একই মানসিকতার বন্ধু খুঁজে পাওয়াও বেশ কষ্টকর। আমাদের বেড়ে ওঠা, স্কুল বা পরবর্তীতে জীবনে আমরা হাতে গোনা কিছু অতি ভাল বন্ধু পেয়ে থাকি যারা খুব কাছের হয়, যাদের সাথে আমাদের ভালবাসা, খুনসুটির কোন কমতি থাকে না এবং যাদেরকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়, এছাড়া অন্য সবার মধ্যে কম বেশি একটা দূরত্ব থাকেই এবং এটা থাকাই স্বাভাবিক কারণ আপনি চাইলেও ২/৩ জনের বেশি অতি প্রিয় বন্ধু থাকা সম্ভব নয়। ভেবে দেখবেন, আপনার কাছের সব বন্ধুদের মধ্যে সাধারণ কিছু মিল থাকে; যেমন, আপনারা সম মানসিকতার, আপনাদের চিন্তা ভাবনা মেলে, তারা আপনাকে যথেষ্ট উতসাহ দিতে জানে, আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, আপনাকে সুপরামর্শ দেয়, বিপদে অনুপ্রেরণা জোগায় এবং আপনার পছন্দের মূল্যায়ন করলেও আপনার সব হ্যা তে হ্যা বলে না কারণ আপনার ক্ষতি তারা চায় না, সঠিক দিকনির্দেশণা দিতে সাহায্য করে, সিধান্ত গ্রহণ সহযোগী হয়, সাথে যত কিছুই হোক না কেন আপনার প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের কোন ঘাটতি দেখা যায় না, তাদের দেওয়া নেওয়ার মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে এবং তাদের চরম অস্থিরতা ও দু:সময়ে তারা সবার আগে আপনাকে স্মরণ করে। অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ না হলেও এ বন্ধুত্বএর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় না।
আপনার চারপাশে আপনি যত ভাল মানুষই দেখেন না কেন, আপনার সফলতার পর অনেকে আপনার পাশে থাকলেও দেখবেন সফলতার আগে বেশিরভাগই ছিল আপনার সমালোচক, তারা আপনাকে উতসাহ তো দেয়নি বরং আপনার পছন্দ ও উদ্যোগ গুলা নিয়ে হাসাহাসি করেছে, আপনার বিশেষ দুর্বলতা নিয়ে শোরগোল করেছে, আপনাকে ছোট করে উদাহরণ দিয়ে রসিকতা করেছে, তাদেরকে এড়িয়ে চলুন।
আবার কিছু বন্ধু আছে যারা সারাক্ষণ গালি, অন্যকে ছোট বা ভিন্ন নামে ডাকতে অভ্যস্ত, রেস্টুরেন্ট এ খাওয়া ও অন্য সুবিধার জন্য তার পকেট কাটতে, তাকে না বুঝে তার নামে নানান কুতসা রটাতে এবং অন্যের নেতিবাচকতা ক্রমাগত আপনার নিকট বলতে অভ্যস্ত, তাদেরকেও এড়িয়ে চলুন। এরা আপনার সাময়িক বন্ধু হলে কখনো বিপদের সঙ্গী হবে না, কাজে লাগবে না বা ক্যারিয়ারের জন্য ভাল হবে না। কারণ আপনি কোন উদ্যোগ নিলে দেখবেন, এদের ছবি আপনার মাথায় আসে না কারণ এদের মধ্য ঐ গুলাবলী গুলা নেই, যা একজন সফল মানুষের থাকা উচিত। মানুষকে ছোট করে কখনওই বড় হওয়া যায় না। এদের অভ্যাসের সাথে কিছু নেতিবাচক গুণাবলী এমনভাবে মিশে যায়, যা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না বা বুঝালেও এর প্রভাব তার মধ্যে যতসামান্য।
কিছু মানুষ পাবেন, যারা আপনার সাথে বন্ধুত্বই করবে শুধু আপনাকে ব্যবহার করার জন্য এবং দিন শেষে বলবে আপনার দ্বারা তার কোন উপকার হয়নি, লাভ হয়নি। বন্ধুত্ব কিন্তু লাভ লস খোঁজার সম্পর্ক না, এটা আত্মিক সম্পর্ক, যে সম্পর্ক কারণ ছাড়াই জুড়ে যায়। কিছু আছে, যারা আপনার বিশেষ কিছু দিক দেখে বন্ধুত্ব করবে, সেটা হতে পারে আপনার টাকা, সামাজিক মর্যাদা, জব বা পদমর্যাদা, এরা কিন্তু আপনার কাছ থেকে নিতে আসে, বন্ধুত্ব করতে আসে না, এদের থেকেও দূরত্ব বজায় রাখুন।
এক সাথে উদ্যোগ গ্রহণ করতে গেলে সবার আগে আপনার কিছু বন্ধুদের নাম আসে কারণ তারা আপনার সম মনার হয়, আপনাকে সবচেয়ে বেশি বুঝে, আপনার ব্যাপারে জানে। কিন্তু এক সাথে চলা এবং উদ্যোগ গ্রহণ এক কথা নয়। নানান চড়াই, উতড়াই এবং লেনদেনের বিষয় জড়িয়ে পড়ে এসব সিধান্তের মাঝে। তাছাড়া লেগে থাকা এবং একে অন্যের উপর অবিচল আস্থা রাখাও বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই দুর্লভ একটা কাজ। তাই উদ্যোগ গ্রহণের আগে খেয়াল করে দেখুন, সে আপনার প্রতি অবিচল আস্থাশীল কিনা, আপনি তার প্রতি আস্থাশীল ও বিশ্বাসী কিনা, তার কথা কাজে মিল আছে কিনা, সে যথেষ্ট পরিশ্রমী কিনা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিনা, সাথে আপনাদের নিজ ক্ষতি গুলার ভাগিদারের অংশীদার হতে ইচ্ছুক কি না। যতই বিপদ আসুক না কেন, আপনার বন্ধু আপনার পাশে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে কিনা।
একটু সামাজিক, দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সৃজনশীল চিন্তাভাবনাকারী ও অন্য মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা তাকে বিশবাসের ক্ষেত্রে বাড়তি গুণাবলী এনে দিতে পারে। আর এসকল গুলাবলী থাকলে আমি বলবো, নি:সন্দেহে আপনি তাকে সাথে নিয়ে চলতেই পারেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অনলাইনে আপনি বন্ধুত্ব করতেই পারেন কিন্তু ব্যক্তি সাক্ষাৎ ও এক সাথে সময় কাটানো ছাড়া বন্ধুত্ব এর বন্ধন কখনওই দৃঢ় হয় না। তাকে বুঝা জানা যায় না। খেয়াল করে দেখেছেন, আমাদের স্কুলের সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্ব কিভাবে হয়? এক সাথে চলতে চলতে খুব ভাল এবং কিছু সম সাময়িক বন্ধু হয়ে যায়। আপনি লাজুক বা অন্তমুখী স্বভাব হলে অনলাইনে বন্ধুত্ব বেছে নিতে পারেন কিন্তু তাদেরকে কখনওই আপনার খুব কাছে বন্ধু হিসেবে শুরুতেই গণ্য করতে পারেন না এবং চোখ বন্ধ করেও বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা সবাই মেকি, নিজের ভালটা প্রদর্শন করতে চাই, এক প্রোগ্রামের হাজার খানেক ছবির মধ্যে বেছে ২/৩ ছবি মানুষকে দেখায় কারণ ঐগুলাই বেস্ট। গরীব কে দান করলে, আগেই ছবি তুলে আপলোড দেয় কারণ বুঝায় আমি সারা বছর দান করি এবং আমি কত দানশীল, মেকাপ ছাড়া ক্যামেরার সামনে আশাকরি অতি কৌশলে। এছাড়া এমন অনেক কিছুই করি যা আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র নেই। এখানে ভাল মন্দ চেনা একটু কষ্টকর যদি না আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে থাকে। একদিনে আপনার খুব ভাল পরিচিত হয়ে দুইদিনে আপনার বড় ক্ষতি করতে পারে আপনার বন্ধুত্ব এর পরিচয় দিয়ে। তাই এই মাধ্যম গুলাতে সর্তকতা ও সচেতনতা দুইটাই অবলম্বন জরুরি। তবে এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে আপনি আপনার সম মানসিকতার ও দক্ষতার বন্ধু নির্বাচন করতে পারেন, যাদের সাথে শারীরিক সাক্ষাৎ এ সিধান্ত গ্রহণ ও বন্ধুত্ব এর বন্ধনের সাথে কিছু উদ্যোগ নিয়েও এগিয়ে যেতে পারেন।
সর্বপরি, বন্ধু যদি আপনার আবেগ এবং ভালবাসার সঙ্গী না হয়, শুধু উপকার ভোগী ও মেকি প্রশংসাকারী হয় তাহলে সে প্রকৃত বন্ধু নয়। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে টাকা ধার দেওয়া নেওয়া না করা উচিত এতে সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং বিশ্বাসী ব্যক্তি অবিশ্বাসী তে পরিণত হয়। যার সাথে আপনার যায় না তাকে জোর করে বন্ধু না বানিয়ে সুকৌশলে এড়িয়ে চলা উচিত কারণ মনে রাখবেন বোকা এবং অতি ধূর্ত ব্যক্তি কারো আস্থা ভাজন ব্যক্তি হতে পারে না। শুধু উদ্দেশ্যহীন আড্ডা আর গাল গল্প আপনার কিছু মূহূর্ত রঙ্গিন করতে পারে, আপনার ভবিষ্যৎ বা আগামী বন্ধুত্ব রক্ষা করতে পারে না, তার জন্য প্রয়োজন বন্ধুত্ব এর সাথে আপনাদের আগামী কিছু সফল উদ্যোগ ও ভাবনা। কারণ সফল না হলে আজকের বন্ধু কিন্তু আপনাকে কালকে চিনবেই না।
তাই সোনালী সময়ে স্বর্ণময় ভাল বন্ধুদের সাথে চলুন, দেখবেন আপনার আগামী টা সুন্দর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সামাজিক পরিচিতি মন্ডিত হয়ে উঠবে, অন্যথায় অসত সঙ্গ আপনার ভবিষ্যৎ টাই ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। তাই সীমাবদ্ধ ভাল বন্ধু নির্বাচন করেই চলা ভাল, খারাপ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেয়ে।
আমি বিপ্লব হুসাইন। CEO, YouthEye Foundation, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 69 টি টিউন ও 4 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 7 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 15 টিউনারকে ফলো করি।
A computer science & engineering student along with a youth social activist in Bangladesh, Love to teach, learning new things and writing articles for the betterment of peoples.