ছোট ছোট নাদুস-নুদুস পেঙ্গুইনদেরকে দেখলে মনটা আসলেই ভাল হয়ে যায়। দেহের উজ্জ্বল বর্ণে অদ্ভুত কাঠামোতে সাদা বরফের মাঝে পেঙ্গুইন দলের ঝাঁক দেখে কার না ভাল লাগে?? এ লেখা কুট্টিসোনা সেই পেঙ্গুইনদের নিয়েই।
পেঙ্গুইনের কথা বললেই ধবল সাদা পেট, ধূসর কালো পিঠ আর চোখা ঠোঁটের যে পেঙ্গুইনের ছবি আমাদের চোখের সামনে যে পেঙ্গুইনের চেহারা ভেসে ওঠে তা মূলত পেঙ্গুইনের ১৭টা প্রজাতির একটা, Emperor পেঙ্গুইন। পেঙ্গুইন গোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম এই সম্রাট (!) পেঙ্গুইন ছাড়াও আরেক ধরণের পেঙ্গুইন খুব চোখে পড়ে। এরা হল Adélie পেঙ্গুইন।
সমগ্র পাখিজগতের মাঝে পেঙ্গুইন এক অদ্বিতীয় সৃষ্টি। এদের ১৭টা প্রজাতির কোনটাই উড়তে পারে না কিন্তু তাদের টর্পেডোর মত দেহটা যেন সাঁতার কাটার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তাও আবার চরম ঠাণ্ডা পানিতে। যেখানে তাদের আকাশে থাকার কথা, সেখানে পানিকেই তারা আপন করে নিয়েছে। অবাক করার বিষয় হল, জীবনের প্রায় ৭৫% সময় এরা পানির নিচে কাটায়। বেশিরভাগ পেঙ্গুইন দক্ষিণ গোলার্ধের (উত্তর গোলার্ধে পেঙ্গুইন থাকে না।) কুলফি জমানো ঠাণ্ডার মধ্যে নির্দ্বিধায় বসবাস করে। বিবর্তনের হাজারো বছরের ইতিহাসে তাদের দেহটা এই ঠাণ্ডায় দাপ্টে চলার মত করেই তৈরি হয়েছে।
মজার ব্যাপার হল Galápagos নামে এক প্রজাতির পেঙ্গুইন আছে, যারা এই ঠাণ্ডার আপন বাসস্থান ছেড়ে এসে নিরক্ষরেখার কাছাকাছি গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে ভিত গড়েছে।
প্রত্যেক বছর পেঙ্গুইনের নতুন পালক ওঠে। এখানেও জীবনের এক আশ্চর্য সূক্ষ্ম হিসাব আছে। পুরনো পালক ততক্ষণ ওঠে না যতক্ষণ না সেই পালকের নিচে নতুন তরতাজা পালক গজিয়ে উঠছে। ছোট্ট এই ক্যালকুলেশনের কারণে পেঙ্গুইনরা সারাক্ষণ বরফের ঠাণ্ডা কামড় থেকে বেঁচে থাকে।পেঙ্গুইনের পা জোড়া দেহের অনেক পেছনে থাকে। তাই এরা যখন সোজাভাবে দাঁড়ায় তখন এরা এদের লেজখানা দিয়ে ভূমিতে ঠেস দিয়ে রাখে। যাতে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে!!ডানার কাজটা যখন ওড়ার প্রয়োজনে আর লাগছে না, তখন বিবর্তন একে সাঁতারের জন্য একেবারে ঢেলে সাজিয়েছে। যেদিকে অন্যান্য পাখিদের ডানা হয় হালকা, সেখানে এদের ডানা একেবারে বৈঠার মত মজবুত আর অনড়। এদের হাড়ের ঘনত্বটাও প্রায় সমুদ্রের পানির ঘনত্বের সমান। এ কারণে এরা খুব সহজেই পানির গভীর পর্যন্ত ডুব দিতে পারে। গায়ের ছোট ছোট ওয়াটারপ্রুফ পালক এদেরকে আরও গতি এনে দেয়। সর্বোচ্চ প্রায় ৪০কিলোমিটার বেগে সাঁতার কাটার সময় লেজ আর পা দিয়ে ছুটন্ত এই টর্পেডোরা দিক ঠিক রাখে খুবই দক্ষতার সাথে।
এদের সাঁতারের আরেকটি মজার ব্যাপার আছে। অনেক সময় এরা গভীরে ডোবানোর আগে পানির ওপর দাপিয়ে দাপিয়ে চলে, যাতে এদের পালকের মাঝে বাতাসের বুদবুদ জমতে পারে। এই বুদবুদ গভীর পানিতে ডুব দেবার সময় এদেরকে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচায় আবার ডুবের সময় দেহের সাথে সাগরের পানির কম ঘর্ষণ সৃষ্টি করে। আর ঘর্ষণ কম সৃষ্টি হলে এরা পানিতে আরও দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে।
পেঙ্গুইনরা মূলত দল বেঁধে থাকে। এদের এই দলের একটা বিশেষ নাম আছে, Rookery. একটা Rookery-তে একসাথে প্রায় হাজারখানেক পেঙ্গুইনও থাকতে পারে।
ডাঙ্গায় পেঙ্গুইন মায়েরা ডিম পাড়ে আর বাবারা সেগুলোকে তা দেয়। অনেকসময় দেখা গেছে কোন মা তাদের ছানা হারিয়ে ফেললে অন্য মায়ের ছানা নিয়ে এসে হাজির হয়!!! নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে স্পাইক করা এই ভদ্রলোক একটা ডিমে তা দিচ্ছেন।
পেঙ্গুইনের ডিম দেখতে যাদের ইচ্ছা করছে, তাদের জন্য পাশের এই ছবিটা।
নিচের ছবিটা দেখে কি চেনা পরিচিত কিছু বলে মনে হচ্ছে?? বিশ্বাস করুন আর নাই করুন পেঙ্গুইনের ছানাদেরকে ছোট বেলায় ঠিক এমনই দেখায়। এই পালক পড়ে গিয়ে যখন নতুন পালক উঠবে, তখন অবশ্য চেহারাটা আমাদের কাছে পরিচিত লাগবে।
আরেকটা মজার জিনিস জানিয়ে রাখি। পেঙ্গুইনেরা যখন সাঁতারকেটে পানি থেকে ডাঙ্গায় ওঠে, তখন বেশিরভাগ সময় এরা পানি থেকে প্রায় ৬ফুটের মত লাফিয়ে সোজা হয়ে ডাঙ্গায় পড়ে। মনে হয় যেন আকাশ থেকেই দাঁড়ানো অবস্থায়ই ভূমিতে অবতরণ করল!! এ দৃশ্যটা দেখতে অনেক মজার লাগে। অনেকটা পাশের ছবির মত। এ অবস্থায়ই ওরা ডাঙ্গায় গিয়ে পড়ে।
ডাঙ্গায় পেঙ্গুইনদের কোন শত্রু না থাকায় এরা ডাঙ্গার প্রাণীদের ভয় করে না (রূঢ় মানুষের ইতিহাস বোধহয় এদের DNA-তে থাকা উচিত ছিল)। তাই প্রথমদিকে মানুষ এই পেঙ্গুইনদেরকে খুবই সহজ একটা শিকার বলে ধরে নেয়। ছবিটাতে দেখুন কি মজা করেই-না রাধুনী পেঙ্গুইন রান্না করছে (!)। আশার কথা হল এ বর্বরতা এখন কমে এসেছে।
কিন্তু শুধু ধরে ধরে খেয়ে ফেলার কথা বাদ দিলেও Global Warming আর ক্রমবর্ধমান মানব বসতি চিরচেনা এই কুট্টিসোনাদেরকে বিপদে ফেলা শুরু করেছে অনেক আগেই। তাই পেঙ্গুইনের কথা না ভাবলেও অন্তত নিজের কথা ভেবে, বর্তনাম ও আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে আমাদের উচিত প্রকৃতির প্রতি একটু সদয় হওয়া। পরিবর্তনের এ যাত্রা অনেক আয়োজন করে শুরু করতে হবে-এমনটি নয়। দৈনন্দিন ছোট ছোট কাজে সামন্য পরিবর্তনও অনেক বড় সুফল বয়ে আনতে পারে। কারণ পৃথিবীপৃষ্ঠে জীবন বাঁচানোর এ বিপ্লবে EVERY SINGLE STEP COUNTS.
ধন্যবাদ ভাই ।
অনেক কিছু জানা গেলো ।