সুপ্রিয় টেকটিউনস কমিউনিটি, সবাইকে আমার আন্তরিক সালাম এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি প্রচলিত ধ্যান ধারনার বিপরীত কিছু তথ্য, তত্ত্ব এবং সত্যিকারের বাস্তবতা বিষয়ে আমার আজকের টিউন।
ইংরেজি যে প্রবাদটি বলে আমাদের সন্ধা রাতে ঘুম পাড়ানো হতো এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে তোলা হতো তার মুল ভাব ছিলো এরকম, যারা তাড়াতাড়ি ঘুমাবে এবং সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠবে তারাই স্বাস্থবান, ধনবান এবং জ্ঞানী হবে। বাবা মায়েদের তাদের সন্তানকে এই তিনটি শ্রেণীর সবগুলোতে রাখার প্রতিযোগিতায় পড়ে কোন সন্তান একটু দেরি করে ঘুমাতে কিংবা ঘুম থেকে উঠতে পারতো না। আমি নিজেও সকাল বেলায় আম্মুর অত্যাচারে মসজিদ এর বারান্দায় গিয়ে ঘুমাতাম।
যদিও শহরের অনেক পরিবারে এখন বাবা মায়েরাই সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না, সেখানে তাদের সন্তানদের সকালে ঘুম ভাঙ্গানোর প্রশ্নই আসে না! তবে কেউ সন্ধা রাতে না ঘুমালেও কিংবা সকালে ঘুম থেকে না উঠতে পারলেও প্রবাদটা (Early To Bed & Early To Rise Makes a Man Healthy Wealthy & Wise) কিন্তু এখনো মানুষের মুখে চিরন্তন সত্য বুলির মতো লেগে আছে। আজকের টিউনে আমি সচরাচর পরিচিত এই প্রবাদটির বিপরীত ধর্মী কিছু কথা বলবো। বর্তমানে মুক্ত কাজের ক্ষেত্রের পরিধি যতো বৃদ্ধি পাচ্ছে, ইন্টারনেট এবং তথ্য প্রযুক্তির যতো উন্নয়ন হচ্ছে। আর সেই সাথে মানুষের রাত জাগার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ থেকে ৫-৭ বছর আগে যেখানে রাতের এগারোটা পর্যন্ত জাগতে পারতাম না অথচ আজকাল রাত ফুরিয়ে সকাল আসলেও ঘুমানোর কথা মনে হয় না।
যাহোক, আজকের টিউনে আমরা রাত জাগা পেঁচা (নিশাচর) কিংবা ভোরের পাখি নিয়ে আলোচনা করবো। অর্থাৎ আমাদের মতো যারা রাত জেগে থাকে তাদের বিষয়ে সায়েন্টিফিক কিছু মতবাদ ব্যাখ্যা করবো। তবে আশ্চর্য কথা হলো বিজ্ঞান কিন্তু অনেকটা নিশাচরদের পক্ষেই রায় দিয়েছে। যাহোক, চলুন তাহলে জেনে নিই ঠিক কোন কারনগুলোর জন্য রাত জাগা মানুষদের বেশি প্রোডাক্টিভ বলা হয়েছে। তবে রাতের অন্ধকারে জেগে থাকা মানুষদের উজ্জল্য দেখে আবার রোজার দিনে টাস্কি খাবেন না যেন, কারন.
আমরা মনে করি সকালবেলা আমরা পরিপূর্ণ শক্তি নিয়ে দিন শুরু করি এবং সারাদিনের কাজের ফলে শক্তি শেষ হতে হতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে যাই তখনি ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি। কিন্তু বিজ্ঞান ভিন্ন কথা বলে। সাম্প্রতিক গবেষণায় খুবই আশ্চর্যজনক তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
মুলত সন্ধার সময় একজন মানুষের পরিপূর্ণ শক্তি বিকশিত হয়। এবং কেউ যদি সারা রাত জেগে কাজ করে তাহলে সে তার পূর্ণ শক্তিতে কাজ করতে পারে। ঠিক এই কারনেই রাতে কাজ করলে ক্লান্তি অনেক কম আসে। সম্পূর্ণ ফ্রেশ মনে এবং ফ্রেশ দেহে রাতের কর্মীরা কাজ করতে পারলেও ভোরের পাখিরা অর্থাৎ যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা এই জিনিসটা অনেক মিস করে।
যদিও সারা রাত জেগে কাজ করা আপনার ঘুমের ধরনে এবং সামাজিক দিক থেকে একটা খারাপ প্রভাব সৃষ্টি করবে তবুও কাজের অগ্রগতির দিক থেকে এটা অনেক ইতিবাচক। সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গার পরে কেউ কখনোই পরিপূর্ণ শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন না যেমনটা একজন নিশাচর ব্যক্তি পারে। এই ধারনা নিশ্চয় কিছু মানুষকে রাতে কাজ করতে উদ্বুধ্য করবে। এবং সেই সাথে আসবে কিছু প্রোডাক্টিভ ফলাফল।
এই কথাটির পেছনে অনেকেই দ্বিমত পোষন করতে পারেন কিন্তু চলুন একটু পেছনে ফিলে তাকায়। যখন কেউ কোন বিষয়ে রিসার্চ করে তখন দেখা তাদের অধিকাংশ সময় রাত জেগে কাজ করতে হয়। আমরা হয়তো সহজ দৃষ্টিতে বুঝতে পারিনা, কিন্তু মনে করে দেখুন আপনি যখন পড়ালেখা করেন তখন সময়টা কখন থাকে? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্ট্রিটল্যাম্পের আলোতে পড়ালেখা করেছে, সেটা তো রাতের বেলায় তাই না? সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, বর্তমান সময়ের অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
তিনি তার অধিকাংশ কাজ রাত জেগে করেন। বিভিন্ন থিওরী এবং হাইপোথিসিস এটা বলে যে, যারা রাত জেগে কাজ করে তাদের কাজে সফলতার হার দিনে যারা কাজ করে তাদের চেয়ে অনেক বেশি। যদি আপনার রাত জাগার বদঅভ্যাসখ্যাত সুঅভ্যাস থেকে থাকে তাহলে আজ থেকে আপনার নিজের প্রতি আরও বেশি কনফিডেন্ট হওয়া উচিত।
এটা খুবই চমকপ্রদ একটি তথ্য। লন্ডনের School of Economics and Political Science এর একটি জরীপে এটা প্রকাশ হয়েছে যে যারা রাত জেগে কাজ করে তাদের IQ (Intelligence Quotient) অনেক বেশি হয়। তারা যেকোন জটিল কাজ ঠান্ডা মাথায় এবং খুব দ্রুততার সাথে সমাধান করে ফেলতে পারে। যদিও এর পেছনে মুল কারন হলো, রাতের প্রকৃতি অনেক নীরব থাকে। এক্ষেত্রে ধীর স্থির ভাবে অনেক কিছু সহজে এবং সুন্দরভাবে চিন্তা করা যায়।
বেলজিয়াম এবং সুইজারল্যান্ড এর এক যৌথ গবেষকদল ১৬ জন সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠা ব্যক্তি এবং ১৫ জন রাতে জেগে থাকা ব্যক্তির মাঝে কাজে মনযোগী থাকার উপরে গবেষণা পরিচালনা করেন। যদিও শুরুর দিকে তারা উভয় দল প্রায় সমানভাবে পারদর্শিতা দেখাতে থাকে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠা ব্যক্তিদের মাঝে মনযোগহীনতা দেখা দেয়।
দিনের দশ ঘন্টা সময়কে স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে নেওয়া হলে শেষের সময় গুলোতে রাতজাগা ব্যক্তিদের তুলনায় সকালে উঠা ব্যক্তিদের মনযোগের ঘাটতি বেশি দেখা যায়। এই গবেষণা চলাকালে উভয় দলের সদস্যদের মস্তিষ্কের ফোকাস এবং মনযোগের জন্য কার্যকর অংশের উপর MRI (Magnetic Resonance ইমেজিং) স্ক্যান করে জানা যায় যারা রাতে কাজ করে তাদের মাথার ওই অংশটুকু বেশি কার্যকর।
দিনের বেলা কাজের সময় সকাল ৯টা থেকে ৫ পর্যন্ত থাকলেও রাত জাগা ব্যক্তিরা এটাকে ঘুমের সময় হিসাবেও নিতে পারে। কারন এক্ষেত্রে ঘুম থেকে উঠার পর তারা পরিপূর্ণ শক্তিতে কাজ শুরু করতে পারবে। অনলাইন বিজনেস এবং কাজের ক্রমাগত বিকাশের ফলে অধিকাংশ চাকরীদাতারা রাতের বেলায় কর্মী নিয়োগকে আজকাল তাই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
কারন রাতে কাজ করা অনেক বেশি প্রোডাক্টিভ এবং সময় অপচয়ের ঝুকি অনেক কম। এ সময় ঘুমের সমস্যাগুলোকে ইগনোর করা যায়। অনিদ্রা রোগের কোন সমস্যা হয় না। কারন কাজের ফাঁকে যখন ঘুম আসবে তখনি ঘুমাতে পারবেন। অনেকে সকাল বেলার সুন্দর সময়ে ঘুমিয়ে যেতে পারেন। তারমানে দিনের কাজগুলো রাতে করলে প্রোডাক্টিভিটি এবং জীবনে ফ্লেক্সিবিলিটি দুটিই আসে।
রাত জাগার ফলে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো বিষন্নতা। মানুষ হলো সামাজিক প্রাণি। সামাজিকতার খাতিরে একে অন্যকে সঙ্গ দেওয়াটা একান্তই কর্তব্য। সেই সাথে নিজের অনুভুতির ভাগাভাগি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাইকিয়াট্রিক এবং নিউরোসায়েন্স অনুসারে এই বিষন্নতার কারনটা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
রাত জেগে কাজ করার ফলে এবং দিনে ঘুমানোর ফলে শরীরে সূর্যের আলোর সংস্পর্শ কম হয়। আমরা জানি সূর্যের আলো ত্বকে পড়লে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয় (অনেকেই অবশ্য মনে করে সূর্যের আলোয় ভিটামিন ডি থাকে, এটা ভ্রান্ত ধারনা)। সূর্যের আলোর অনুপস্থিতে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি অনেকটা বিষন্নতার কারন।
তবে বিষন্নতা কাটানোর জন্য আমাদের প্রাকৃতিক পন্থাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। মানে হলো অন্যদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ। মাঝে মাঝে একটু বায়রে ঘুরতে যাওয়া। কাজের সময় ছাড়া অন্য সময়গুলোতে পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানো। কাজের জায়গাটা সব সময় ফ্রেশ এবং পরিচ্ছন্ন রাখা।
তবে সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়, সেটা হলো আল্লাহ তা’য়ালা রাতকে তৈরী করেছেন বিশ্রামের জন্য। সুতরাং যে জিনিস যেটার জন্য সেটা সেভাবেই ব্যবহার করা উচিত। তবে প্রত্যেকটি তথ্য এবং তথ্যের জন্য আপনার নিজস্ব মতামত প্রত্যাশা করছি। যাতে বুঝতে পারি যে আপনারা আসলে কোন মতবাদে বিশ্বাসী।
টিউনটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে অথবা বুঝতে যদি কোন রকম সমস্যা হয় তাহলে আমাকে টিউমেন্টের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না। কারন আপনাদের যেকোন মতামত আমাকে সংশোধিত হতে এবং আরো ভালো মানের টিউন করতে উৎসাহিত করবে। সর্বশেষ যে কথাটি বলবো সেটা হলো, আশাকরি এবং অপরকেও কপি পেস্ট টিউন করতে নিরুৎসাহিত করি। সবার সর্বাঙ্গিন মঙ্গল কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। দেখা হবে আগামী টিউনে।
আপনাদের জন্য » সানিম মাহবীর ফাহাদ
আমি সানিম মাহবীর ফাহাদ। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 12 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 176 টি টিউন ও 3500 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 159 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আগে যা শিখেছিলাম এখন তা শেখানোর কাজ করছি। পেশায় একজন শিক্ষক, তবে মনে প্রাণে টেকনোলজির ছাত্র। সবার দোয়া প্রত্যাশি।
তারমানে পরিক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে দেয়ার জন্য রাতে জেগে থাকতে হবে।