আজ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ১১ মিনিট ২৭ সেকেন্ড এ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ জোরালো ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যার উৎপত্তিস্থল ছিল নেপালে। রিখটার স্কেলে উৎপত্তিস্থলে এর তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৫। তীব্রতা অনুযায়ী এটি ছিল একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প। সৌভাগ্য বশতঃ দেশের কোথাও বড় ধরনের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর জানা যায়নি।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে একবার প্রায় ধরেই নেয়া হয়েছিল যে, অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পেরও পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। ১৯৭৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চীনের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সমুদ্রতীরবর্তী হাইচেং শহরটি ফাঁকা করে দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। লোকজন সরিয়ে নেয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সত্যি সত্যিই এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে পুরো শহরটি তছনছ হয়ে যায়। রক্ষা পায় নিরাপদে সরিয়ে নেয়া প্রায় এক লাখ লোকের প্রাণ। চীনের বিশেষজ্ঞরা এই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন যাবৎ ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকা মৃদু ভূকম্পন এবং পানির স্তরের তারতম্য দেখে। শুধু পূর্বাভাস নয়, তাঁরা ঐ ভূমিকম্পের মাত্রাও বলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৩। কিন্তু এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই চীনের তাংশান শহরে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার আরেকটি শক্তিশালী ভুমিকম্প আঘাত হানে। যার কোনো পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হয়নি। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ লোক। ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের পূর্ব উপকূলীয় তহোকুর নিকটবর্তী ফুকুশিমায় অভাবনীয় ভাবে ৮ দশমিক ৯ মাত্রার একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্প আঘাত হানে। তহোকুতে কোন ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে, এ ব্যাপারে জাপানী বিজ্ঞানীরা আগাম কোনো আভাস দিতে পারেননি। তারা বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশংকা করছিলেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় তোকাই, তানানকাই ও নানকাই অঞ্চলে। একই ভাবে কোনো পূর্বাভাস দেয়া ছাড়াই ২০১১ সালে ভূমিকম্প আঘাত হানে নিউজিল্যান্ডের ক্রিস্টচার্চে। অথচ এই এলাকাকে আগে থেকেই স্বল্প ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানাতে সক্ষম হলেও বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে ভুমিকম্পের সঠিক কোনো পূর্বাভাস জানাতে পারছেন না। অথচ পৃথিবীর বুকে ছোট বড় মিলিয়ে প্রতি বছর গড়ে প্রায় দশ লক্ষ ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়- শুধু জাপানেই এই সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজারের মতো। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ভূমিকম্পের মাত্রা এতটাই কম থাকে যে অতি সংবেদনশীল যন্ত্র ছাড়া এগুলোর অস্তিত্ব নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যাও একবারে নগন্য নয়। ভূ-অভ্যান্তরে প্রতি দুই সপ্তাহে প্রায় একটি করে বড় মাপের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। সৌভাগ্য বশতঃ এর অধিকাংশই ঘটে সমুদ্রের তলদেশে অথবা আমাদের জনবসতি থেকে বহু বহু দূরে।
আমরা যে ভূ-ত্বকে বসবাস করি এটি ফলের খোসার মতো অবিচ্ছিন্ন কোনো আস্তরণ নয়। প্রায় এক ডজন ছোট-বড় অংশ নিয়ে আমাদের এই ভূ-ত্বক গঠিত। যা প্লেট টেকটোনিক নামে পরিচিত। এই টেকটোনিক প্লেটগুলোর নিচেই আছে গলিত এবং অর্ধগলিত ম্যাগমা। গলিত ম্যাগমা বা তরল লাভার ওপর ভাসমান পাশাপাশি দুটি মহাদেশীয় প্লেটের আপেক্ষিক স্থান পরিবর্তনের সময় এদের সীমান্ত অঞ্চলে প্রবল পীড়নের সৃষ্টি হয়। উক্ত পীড়ন যখন বড়সড় চ্যুতির সৃষ্টি করে এবং এর অন্তর্নিহিত শক্তি বের করে দেয়ার চেষ্টা করে ঠিক তখনই আমাদের এই ভূ-পৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে। ভাসমান অবস্থায় থাকে বলে এই প্লেটগুলো অনবরত একে অপরের সাথে ঘর্ষণ খেতে থাকে, কখনো একটি প্লেট অপরটির উপরে উঠে যায়, কখনো বা নিচে চলে যায়, কখনো আবার একে অপর থেকে দূরে সরে চলে যায়। অর্থাৎ কখন ঠিক কী ঘটবে এবং সঞ্চিত পীড়নের পরিমাণ কেমন হবে আগে থেকে নিশ্চিতভাবে এর কিছুই বলা যায় না। ফলে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাব্যতার কারণে ভূমিকম্পের কার্যকরী পূর্বাভাস দেয়া বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। টোকিও বিশ্বব্যিালয়ের অধ্যাপক ও ভূকম্পবিদ রবার্ট জে. গেলার (Robert J. Geller) একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘ভূমিকম্পের সৃষ্টি ও এর বিকাশের প্রভাব এতো অগণিত ও জটিল যে, এগুলো নির্ণয় ও বিশ্লেষণ করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়।’
ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তৈরি বেশকিছু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কোনো অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে সেখানে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক এমিলি ব্রডস্কি (Emily Brodsky) ও থর্ন লে (Thorne Lay) জাপানের তহোকুতে ঘটে যাওয়া ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও ২০১৪ সালে চিলির উত্তরাঞ্চলে সংঘটিত বড় মাপের দু'টি ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, ওই দুটি অঞ্চলে আগে থেকেই ধারাবাহিকভাবে ছোটখাটো বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। তবে, ছোট ছোট একাধিক ভূমিকম্প হলেই যে বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটবে সবক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা অবধারিত নয়৷ এর কিছু ব্যতিক্রমও আছে। সুতরাং কখন সেই বড় বিপর্যয়টি ঘটবে তা নিশ্চিত করা যেমন কঠিন, তেমনি কোথায় ও কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে তা নির্ণয় করা আরও কঠিন।
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা ও লোককথায় ভূমিকম্প বা বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে পশুপাখির অদ্ভুত আচরণের সম্পর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে। তাই শুধু বিজ্ঞানের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে অনেকেই আবার পশুপাখির দ্বারস্থ হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, পৃথিবীতে এমন অনেক পশুপাখি আছে যারা বেশ আগে থেকেই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বুঝতে পারে। সত্তরের দশকে চীনের বিশেষজ্ঞরা হাইচেং শহরে ভূমিকম্পের যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন সে সময়ও তারা পশুপাখির মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন। হাইচেং শহরের রাসত্মায় হঠাৎ অসংখ্য সাপ ও ইঁদুর দেখে বিষয়টিকে তারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছিলেন। এরপর নব্বইয়ের দশকে চীনের বেইজিংয়ে আবারও ইঁদুর, বিড়াল সব ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে৷ কুকুর চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে থাকে। ঘোড়া, গরু, মহিষ, ছাগল সব লাফালাফি করতে থাকে। এর প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা পর সেখানে একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘঠিত হয়৷ আমেরিকাতেও এরকম ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রাণীদের অনুরূপ আচরণ লক্ষ্য করেছেন। ২০০৬ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি ঘটার আগে সমুদ্রের গভীর থেকে প্রচুর মাছ উপকূলে এসে জেলেদের জালে ধরা পড়ে৷ কুনোব্যাঙ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায়- এ রকম ইঙ্গিত পাওয়ার পর যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিদ ড. রাচেল গ্রান্ট (Rachel Grant) কুনোব্যাঙের এই অদ্ভূত আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন। ইতালির সান রাফিনো (San Ruffino) লেককে গবেষণার স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন, যেখানে প্রায়ই ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। তার এই গবেষণাকালীন সময়টিতে ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল সেখানে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং শহরটিতে প্রায় তিন শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। ড. গ্রান্ট জানান, ভূমিকম্প আঘাত হানার পাঁচ দিন দিন আগেই সেখানকার প্রায় ৯৬ শতাংশ ব্যাঙ তাদের প্রজননক্ষেত্র ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যায়। ভূমিকম্পের পর ব্যাঙগুলো পুনরায় তাদের আবাসস্থলে ফিরে আসে।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের এ দাবির সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন ব্রিটিশ জুওলজিক্যাল সার্ভের ভূকম্পনবিদ রজার মুসন (Roger Musson)। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় অনেকেই প্রাণীদের অদ্ভুত আচরণ দেখতে পান। এর পর হয়তো সেখানে ভূমিকম্প হয়। ফলে তারা দুটো ঘটনার মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে চান। আবার এমন অনেক ঘটনাই দেখা গেছে, যেখানে প্রাণীরা অস্বাভাবিক আচরণ করেছে কিন্তু কোনো ভূমিকম্প হয়নি।’ ভূমিকম্পের সঙ্গে পশুপাখির আচরণের সম্পর্ক নিয়ে এ পর্যন্ত গবেষণায় চূড়ান্ত কোনো ফল বা সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য করেন রজার মুসন। নব্বইয়ের দশকে জাপানের বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জানার জন্য এক ধরনের মাগুর মাছের ওপর গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায় ঐ গবেষণা প্রকল্পটিই বাতিল ঘোষণা করা হয়।
পূর্ববর্তী টিউনসঃ
কেন এমন হয়? [পর্ব-০১] :: বিগ ব্যাং বা মহাবিষ্ফোরণ থেকে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি, এমনটি ধারণা করা হয় কেন?
কেন এমন হয়? [পর্ব-০২] :: পৃথিবীর অভ্যান্তর ভাগ এখনও এতটা উত্তপ্ত কেন?
কেন এমন হয়? [পর্ব-০৩] :: সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় আকাশ লাল দেখায় কেন?
আমি অয়ন রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 12 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
ভাই আপনি এত দ্রুত সময়ে এত সাজিয়ে গুছিয়ে, এত তথ্য দিয়ে লিখেছেন, মনে হচ্ছে আজকের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস আপনি জানতেন এবং আপনি আগে থেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিলেন এ কারনে যে, ভূমি কম্প হবার সাথে সাথে পোষ্ট করে দিবেন।
অনেক ধন্যবাদ। খুব সুন্দর হয়েছে।