আজকাল অনেক বিজ্ঞানীই খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করেন যে, আমাদের পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, তারা, গ্রহ, নক্ষত্রসহ এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আরো যা কিছু আছে, এসব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে একবারে শূন্য থেকে। কেবলমাত্র ধারণা থেকেই যে তাঁরা এটি বিশ্বাস করছেন তা নয়। বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এটি প্রমাণ করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
আলবার্ট আইনস্টাইন অবশ্যি মনে করতেন যে মহাবিশ্ব হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। মহাবিশ্ব অসীম এবং চিরস্থায়ী। এটি যেমন ছিল তেমনই আছে এবং ভবিষ্যতে এমনই থাকবে। Static Universe Model নামের এই মতবাদ অনুসারে তখন বলা হতো বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোন শুরু বা শেষ নেই। প্রথম দিকে মহাবিশ্ব সম্পর্কে সারা পৃথিবীতে এই ধারণা প্রচলিত থাকলেও পরবর্তিতে অনেক বিজ্ঞানী এবং গবেষকগণ তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গানিতিক বিশ্লেষণের সাহায্যে এটি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে মহাবিশ্ব স্থায়ী বা স্থির না। এর যেমন শুরু আছে, তেমনি শেষও আছে। এটি ক্রমাগত সম্প্রসারণশীল, পরিবর্তনশীল এবং একটি নির্দিষ্ট গতিতে গতিশীল। আর এটির সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকে তাৎক্ষণিক এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে, যা বিজ্ঞানীদের ভাষায় বিগ ব্যাং (Big Bang) নামে পরিচিত।
১৯২৩ সালে মার্কিন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী এডউইন হাবল (Edwin Hubble) পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে, মহাকাশের ছায়াপথগুলো আমাদের কাছ থেকে ক্রমশঃ তাদের দূরত্বের অনুপাতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর এই পর্যবেক্ষণটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকেই সমর্থন করে। যেহেতু ছায়াপথগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাই তিনি ধরে নেন সৃষ্টির শুরুতে তারা একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। আর তখন মহাবিশ্ব ছিল দৃঢ় ও সংকুচিত। হাবলের মতে, প্রায় দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের সমন্বয়ে আমাদের নভোমন্ডলে যে ছায়াপথ রয়েছে, এরকম আরো প্রায় একশ’ কোটি ছায়াপথ রয়েছে আমাদের নভোমন্ডলের বাইরে। দূরবর্তী এসব ছায়াপথ থেকে নিঃসরিত তড়িৎচ্চৌম্বকীয় বিকিরণকে (দৃশ্যমান আলো) বলা হয় লোহিত সরণ বা লাল সরণ (red-shifted)।
উৎস এবং পর্যবেক্ষকের মধ্যকার আপেক্ষিক গতির কারণে কোন তরঙ্গ-সংকেতের কম্পাঙ্ক পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে বলা হয় ডপলার ক্রিয়া (Doppler effect)। ডপলারের এই মতবাদ অনুসারে আলো বিকিরণকারী কোনো নক্ষত্র যদি আমাদের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে আসতে থাকে, তাহলে এর বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আপেক্ষিক হারে কমতে থাকে এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে কারণে এর আলো তখন নীল দেখায়। আবার একইভাবে, আলো বিকিরণকারী কোনো নক্ষত্র যদি আমাদের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে এর বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আপেক্ষিক হারে বাড়তে থাকে এবং অপেক্ষাকৃত বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে কারণে এর আলো তখন লাল দেখায়।
হাবল আবিষ্কার করেন যে, মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার কারণে মহাজাগতিক লোহিত সরণ বা লাল সরণ ঘটে থাকে। দূরবর্তী ছায়াপথ, কোয়াসার এবং আন্তঃছায়াপথীয় গ্যাস মেঘের লোহিত সরণ পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্বের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। যেহেতু এসব নক্ষত্রমন্ডলী ক্রমশঃ পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাই ধরে নেয়া যায় একসময় তারা খুব কাছাকাছি ছিল এবং মহাবিশ্ব ছিল খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির। আর এই ধারণা থেকেই আধুনিক বিশ্বতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ মতবাদের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের মতে অতীতের কোনো এক সময় হতে আমাদের এই মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছে। পদার্থবিদগণ হিসেব করে দেখেছেন যে, আজ থেকে প্রায় এক হাজার পাঁচশ’ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছে এই সম্প্রসারণ। তাঁদের মতে মহাবিষ্ফোরণের এক সেকেন্ডের প্রায় একশ’ ভাগের এক ভাগেরও কম সময়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে আর তখন এর আকার বেড়ে দাঁড়ায় কোটি কোটি কোটি গুণ (১ এর পরে ৩০ টা শূণ্য)। যা শুরুতে ছিল ছোট্ট একটি মটরদানার সমান এবং এটি ছিল খুবই ঘন এবং খুবই উত্তপ্ত। কিন্তু এই মটরদানাসম পদার্থ হঠাৎ কিভাবে সৃষ্টি হলো এর সঠিক কোনো ব্যাখ্যা পদার্থবিদগণ আজ পর্যন্ত সুস্পষ্ট করে বলতে পারেন নি। তাদের মতে, মহাবিশ্বের সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে বিগ ব্যাং এর পরে এবং এর পূর্বে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। বিগ ব্যাং এর আগের এই অবস্থাটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘সিঙ্গুলারিটি’। আর এই ‘সিঙ্গুলারিটি’ হচ্ছে একটি বিশেষ ক্ষেত্র যেখানে সাধারণ পদার্থবিদ্যার কোন নিয়ম খাটে না এবং আমাদের বোঝার ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে। সিঙ্গুলারিটির অস্তিত্ব কল্পনা করা হয় কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole) এর অন্তস্থলে।
১৯৪০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই দুই দশক সময়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে, মহাবিশ্বের সবকিছুই অপরিবর্তিত। বিগ ব্যাং এর মতো কোনো ঘটনা কখনোই ঘটেনি। বিশ্বব্রহ্মান্ড শুরুতে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে এবং ভবিষ্যতে এমনই থাকবে। আর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের বিষয়টিকে তখন তাঁরা মেনে নিলেও এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন পুরাতন ছায়পথের মৃত্যু এবং সেখানে নতুন ছায়াপথের স্থলাভিষিক্তর যুক্তি দিয়ে। পরবর্তিতে মার্টিন রায়েল (Martin Ryle) ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে বাইরের ছায়াপথ থেকে আসা শক্তিশালী বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান যে, নভোমন্ডলের বাইরে অবস্থিত ছায়াপথ বা নক্ষত্রমন্ডলীগুলো থেকে নিঃসরিত তড়িৎচ্চৌম্বকীয় বিকিরণ আমাদের এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে সময় লাগছে প্রায় এক হাজার কোটি বছর। সংখ্যার দিক দিয়েও দূরবর্তী এসব ছায়াপথের সংখ্যা আমাদের নিকটতম ছায়াপথ গুলোর চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আর দূরবর্তী এসব ছায়াপথ ক্রমাগত পরিবর্তনশীল।
আমাদের মহাবিশ্ব প্রাথমিক অবস্থায় যদি খুবই সংকুচিত এবং খুবই উত্তপ্ত থেকে থাকে, তাহলে বিগ ব্যাং থিওরী অনুসারে বর্তমানেও আমরা সেই তাপের কিছু অবশিষ্টাংশ পেতে পারি। ১৯৬৫ সালে দুই মার্কিন বেতার জ্যোতির্বিদ আরনো পেনজিয়াস (Arno Penzias) এবং রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) নিউ জার্সির বেল টেলিফোন ল্যাবটেরিতে উপগ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ে কাজ করার সময় ২.৭২৫ ডিগ্রী কেলভিন (-৪৫৪.৭৬৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা -২৭০.৪২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস) তাপমাত্রার একটি কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) খুঁজে পান, যা বিগ ব্যাং এর পর পর্যবেক্ষনশীল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। একেই সেই অবশিষ্টাংশ ভাবা হয় যা বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই খোঁজ করছিলেন। তাঁদের এই অসামান্য আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে দু’জনকেই পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় আমাদের পর্যবেক্ষনশীল মহাবিশ্বে ‘আলোক উপাদান’ (Light Elements) হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম এর প্রার্চুয পাওয়া গেছে যা বিগ ব্যাং থিওরীর উৎপত্তির কারণকেই সমর্থন করে।
সর্বোপরি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআন শরীফেও উল্ল্যেখ আছে, ‘যারা (নবীর কথা মেনে নিতে) অস্বীকার করেছে তারা কি চিন্তা করে না যে, এসব আকাশ ও পৃথিবী এক সাথে মিশে ছিল, তারপর আমি তাদেরকে আলাদা করলাম এবং পানি থেকে সৃষ্টি করলাম প্রত্যেকটি প্রাণীকে। তারা কি (আমার এ সৃষ্টি ক্ষমতাকে) মানে না?’ (২১:৩০)। পবিত্র কোরআন শরীফের এই উদ্বৃতির সঙ্গে বিগ ব্যাং মতবাদ যথেষ্টই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আমি অয়ন রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 12 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
Like ! Superb, R o chai, vai.
apnar moto lok adese aro baruk…