চর মাহজাব। হানাফী, সাফী, মালিকি, হাম্বলি। চার মতবাদের কোনটি সঠিক!
মাহজাব শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পথ’। পথ শব্দের আরেকটি সমার্থক শব্দ ‘সুন্নাহ’। অনেকেই হাদিষকে সুন্নাহ বলে থাকে। যদি কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয়, কোন মাহজাবটি সঠিক। বেশির ভাগ মুসলিম বলবে, চারটিই সঠিক। একজন শিক্ষক বললেন, ৫+৫=১১, আরেক জন বললেন ৫+৫=১২। আপনার যদি গনিতের নূন্যতম জ্ঞান না থাকে আপনি বলবেন, যেহেতু দুইজন ই শিক্ষক, সুতরাং দুইজনের কথাই সঠিক। আর যদি গনিতের সমান্য জ্ঞান থাকে আপনি বলবেন, ২টা একসাথে সঠিক নয়। যেকোন একটি সঠিক, কিংবা কোনটিই সঠিক নয়। তাহলে মাহজাবের ক্ষেত্রেও যেকোন একটিই সঠিক হতে পারে। কিংবা সব গুলোতেই ভুল থাকতে পারে। আসুন দেখি হানাফী ও সাফী মাহজাব কি বলে,
অযু করার পর যদি কোন কোন মহিলাকে স্পর্শ করেন, তাহলে অযু ভেঙে যাবে—সাফী মাহজাবের মতে।
আর হানাফী মাহজাব বলে, অযু ঠিক থাকবে।
এবার বলতে পারেন, কোনটি সঠিক?
আসুন দেখি কুরআন ও হাদিষ কি বলে,
কুরআনে বলা আছে,
” হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের
জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ
কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং পদযুগল
গিটসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে
সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি
তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক
অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-
পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা
স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর
পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র
মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-
অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি
দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ
তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান
না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র
রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি
স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে
তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর।”–সূরা মায়িদা, আয়াত: ৬.
এখানে বলা আছে, সহবাস করার কথা, কিন্তু একটু আরবী শব্দের দিকে আসুন।
এখানে “সহবাস” এর আরবী শব্দ “মাইয়াসা”। অভিধান(dictionary) খুললে এর দুটো অর্থ দেখতে পাবেন। একটি অর্থ “শারীরিক স্পর্শ” আরেকটি “সহবাস”। এখন আপনি কোনটা গ্রহন করবেন? হানাফী মাহজাবেরর ইমাম এই শব্দটিকে অনুবাদ করেছেন সহবাস। আর সাফী মাহজাবের ইমাম এই শব্দটির অনুবাদ করেছেন, শারিরীক স্পর্শ। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোনটি সঠিক?
অভিধানে মাইয়াসা শব্দের ২টি অর্থ রয়েছে। যে কোনো টি সঠিক হতে পারে। এখন, কুরআনে যদি কোন উত্তর না পেয়ে থাকেন, তাহলে পরের উৎসে যাবেন। সেটি হল হাদিষ। তবে যদি কুরআনেই পান, তাহলে আর হাদিষে যাওয়ার প্রয়েজন নেই।
যদি কুরআনের অন্যান্য আয়াত গুলো দেখেন, পবিত্র কুরআনে সূরা ইমরানের ৪৭ নাম্বার আয়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে মাইয়াসা শব্দটি। এখানে বলা হয়েছে,
“মারইয়াম বলল, ‘হে আমার রব! কীভাবে আমার সন্তান হবে অথচ কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি’! আল্লাহ বললেন, ‘এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কোনো বিষয়ে সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তাকে শুধু বলেন, ‘হও’। এবং তা হয়ে যায়।”-সূরা ইমরান, আয়াত ৪৭,
এখানে মায়াসা শব্দের অর্থ “স্পর্শ” করা হয়েছে। কোন পুরুষ যদি কোন মহিলাকে শারীরিক ভাবে স্পর্শ করে, তাহলে সন্তান হবে না। শুধু মাত্র সহবাসের মাধ্যমেই সন্তান হওয়া সম্ভব। সুতরাং “মায়াসা” শব্দের সঠিক অর্থ কুরআনে বুঝানো হয়েছে “সহবাস”। তাছাড়া যদি দেখেন, নবি করিম(স.) এর হাদিস,
এটি আছে আবু দাউদ, খন্ড নাম্বার ১, অধ্যায় ৭০, হাদিস নং ১৭৯,
হযরত আয়েশা(রা.) বললেন, একবার নবিজী তার একজন স্ত্রীকে চুমো দিয়ে নামাজ পড়তে গেলেন। তিনি আবার অযু করেন নি। তখন উরুয়া রা: বললেন সে স্ত্রী আপনি ছাড়া আর কেউ নন। হযরত আয়েশা (র.) তখন হেসে উঠলেন।
আবু দাউদের এই সহীহ হাদিস এই প্রমান করে যে, শারীরিক স্পর্শ করলে অযু ভেঙে যাবে না। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন ইমামের কথা সঠিক? ইমাম আবু হানীফা(রহ) এর কথা, নাকি ইমাম সাফীর কথাটা? এখন সবাই একমত হবেন যে ইমাম আবু হানীফার কথা।
এবার আসুন, যখন ইমামের পিছনে নামাজ আদায় করে, তখন ইমাম যখন সূরা ফাতিহা পড়েন(ফজর,মাগরীব আর এশার নামাজে), এবং পড়া শেষে হানাফী মাহজাবের অনুসারিরা মনে মনে আমিন বলে। আর সাফী মাহজাবের অনুসারি রা শব্দ করে আমিন বলে।
প্রশ্ন হলো কোনটি সঠিক? জোরে আমিন বলা! নাকি মনে মনে আমিন বলা? পবিত্র কুরআনে এমন কোন আয়াত দেখি না, যেখানে বলছে শব্দ করে আমিন বলো, বা মনে মনে আমিন বলো। তাহলে দেখতে হবে পরের উৎস-হাদিষ। দেখি হাদিসে কি বলা আছে! এটি আছে, সহীহ বুখারী খন্ড নাম্বার ১, ১১১নং অধ্যায়, ৭৮২ নং হাদিষ। নবিজী (স.) বলেন, যখন নামাজে ইমাম যখন বললেন গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম, ওয়ালাদ দললিন, তখন তোমরা শব্দ করে বলবে আমিন। তোমাদের আমিন বলার সময় যদি ফিরেশতা গনের কেউ আমিন বলে, আগের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে।
এছাড়া সহীহ মুসলিমে ১নং খন্ড, বুক অব সালাহ, ১১৬ নং অধ্যায়ের হাদিষ নং ৮১১ নং হাদিষ থেকে ৮১৬ নং হাদিষ পর্যন্ত, সহীহ মুসলিমের সব মিলিয়ে মোট ৬টা হাদিস বলছে যে শব্দ করে আমিন বলতে হবে। এবং সহীহ বুখারি, বুক অব আযান, ১ নং খন্ড, হাদিষ নং ৭৮০, ৭৮১, ৭৮২ নং হাদিসেও বলা আছে শব্দ করে আমিন বলার জন্য। এখানে আমি আপনাদের সব মিলিয়ে ৯টি হাদিসের কথা বললাম, যেগুলো তে বলা আছে শব্দ করে আমিন বলার জন্য।
এখন যদি প্রশ্ন করি কোন মাহজাব সঠিক এক্ষত্রে? সহজ উত্তর, এক্ষেত্রে সাফী মাহজাব সঠিক। এখন প্রথম প্রশ্নে আসি। কেউ যদি বলে, দেখুন, হিনাফিদেরর ত্বক একটু তেল তেলে, আর সাফীদের ত্বক একটু খসখসে, তাই হানাফীদের কোন মহিলার স্পর্শে অযু ভাঙ্গে না, আর সাফীদের মাহিলাদের স্পর্শে আযু ভেঙ্গে যায়, তাহলে হয়তো ২য় বার ভাবতে হবে। তবে এই রকম কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
প্রথম প্রশ্ন কোন মহিলার স্পর্শে অযু ভাঙ্গে কি না। কুরআন ও হাদিষ থেকে সঠিক উত্তর হচ্ছে ভাঙ্গে না, এখানে হনাফী মাহজাব সঠিক। আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ইমাম সূরা ফাতেহা পড়ার পর আমিন বলতে হয় কি না? সঠিক উত্তর হাদিস থেকে জানা যায়, মুখে শব্দ করে আমিন বলতে হবে, এখানে সাফী মাহজাব সঠিক। এখন কেউ যদি বলেন, ভাই আপনি কি আবু হানিফা (রহ.) বা আবু সাফী (রহ.) হতে বেশি জ্ঞানী, যে তাদের ভুল ধরছেন? নাউযুবিল্লাহ। এর উত্তর হচ্ছে, না। তাদের এসব ভুল হওয়ার নানা করান ছিলো। তারা যখণ বিভিন্ন বিশ্লষণ করে এসব মতবাদ দিয়েছেন, তখনও কিন্তু হাদীষ সব সংগ্রহ করা হয়নি। তখন সংগ্রহ করা হচ্ছিলো। তাছাড়া বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরর যুগ। মিনিটের মধ্যে যে কোন তথ্য সুবিন্যস্ত আকারে পেয়ে যাচ্ছি। হয়তো এসব হাদিষ তখন সংগ্রহ করা হয়নি, কিংবা তাদের হাদিস গুলো জানা ছিলো না। ৪ ইমাম সকলেই একমত, সকল হাদিষ কেউ সব একসাথে জানতে পারে না। তাহলে তাদের ভুল হতে পারে। এবং তারা নিজেরাই বলেছেন, আমার কথা গুলো প্রচার করো না প্রমান পাওয়ার আগে। অর্থাৎ তাদের কথা গুলো ভুল হলে প্রচারের জন্য নিষেদ করেছেন। ইমাম হাম্বলি ছিলেন আরো কঠোর। তিনি বলেছেন আমার কোন কথাই সংগ্রহ করো না। তিনি সরাসরি নিষেদ করেছেন। তাছাড়া ৪ ইমাম- সবার কথাই হলো সহীহ হাদিষই আমার মাহজাব। তারা কেউ নিজেরা নিজ নিজ মাহজাব তৈরি করেন নি। তাই সব মাহজাবই ঠিক যদি সব মাহজাব সহীহ হাদিস অনুসরন করে। সূরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩ এ বলা হয়েছে, তোমরা আল্লার রজ্জুকে শক্ত হাতো ধরো ও পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না। আমাদের আল্লার রজ্জুক শক্ত করে ধরতে হবো। মানে কুরআন ও হাদিষ। যদি কেউ তার মতামত দেয় কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী, তাহলে আমাদের তার মতামত মানতে কোন আপত্তি নেই। চার মাহজাবের যে সব কথা সহীহ হাদিষের সাথে মিলে যায় সেগুলো মানবো। আর যেগুলো মিলে না কুরআন ও হাদিসের সাথে, সেক্ষেত্রে চার ইমাম ই আমাদের তা মানতে নিষেদ করেছেন। তাই চার মাহজাব করে ইসলাম কে খন্ড বিখন্ড করা যাবে না। কুরআনে সূরা আল আন আম-এর ১৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে “নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপার আল্লাহ তা’আয়ালার নিকট সমর্পিত। অতঃপর তিনি বলে দেবেন যা কিছু তারা করে থাকে। ” সুতারাং ইসলাম একটাই। এটির কোন ভাগ নেই। নেই কোন চার ইমামের চার মাহজাব ইসলামে। তবে তাদের কথা যদি ঠিক হয়, তাদের কথা মানতে কোন আপত্তি নেই। মনে রাখতে হবে সব কথা যেন কুরআন ও সহীহ হাদীষের কথা অনুযায়ী হয়।