ওভার ক্লকিং সম্পর্কে হয়তো আপনারা অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু আপনি যদি না জেনেন যে এটি কি? আপনার ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা মোবাইলে কীভাবে করা যায় এবং এর সুবিধা অসুবিধা গুলো কি কি? তবে এই টিউন টি পড়তে থাকুন, আশা করছি আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আজকের এই টিউন টি হালকা টেকনিক্যাল বিষয়ে চলে যেতে পারে, কিন্তু আমি চেষ্টা করবো সহজ এবং বোধগম্য ভাষায় আপনাদের সকল টার্ম গুলো বোঝাবার। তো চলুন আলোচনা শুরু করা যাক।
বন্ধুরা এই শব্দটিকে ভাগ করলে দুটি অংশ পাওয়া যায়। একটি হলো “ওভার” এবং আরেকটি হলো “ক্লক”। এখানে ক্লক মানে ঘড়ি তা আমরা সবাই জানি। আর ওভার মানে কোন কিছুর মান বাড়ানো বা মানের ঊর্ধ্ব পরিবর্তন। অর্থাৎ “ওভার ক্লকিং” মানে ঘড়ির মান পরিবর্তন করে বাড়িয়ে দেওয়া। এখন কিসের ঘড়ি? অবশ্যই আপনার মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের প্রসেসরের ঘড়ি। কম্পিউটার প্রসেসর এবং মোবাইল প্রসেসর এর উপর আমার দুটি টিউন আছে। আপনি যদি তা এখনো পড়ে না থাকেন তবে আমি আপনাকে হাইলি রেকমেন্ড করবো পড়ে ফেলার জন্য। তাহলে প্রসেসর সম্পর্কে আপনার একটি সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ হবে, এবং এই টিউন টি বুঝতে অনেক সুবিধা হবে।
যাই হোক, যেমনটা আমি পূর্বের টিউনে বলেছিলাম, যে প্রত্যেকটি প্রসেসরে একটি ঘড়ি লাগানো থাকে। এবং এই ঘড়িটি চিপ এর ভেতর বসানো থাকে। ঘড়িটি বারবার জিরো এবং ওয়ান দিয়ে আউটপুট প্রদান করে। তো এভাবে ঘড়িটি লাগাতার একবার জিরো এবং একবার ওয়ান মান প্রদান করতেই থাকে। এই প্রসেসর ক্লকটি প্রচণ্ড গতিতে কাজ করে। একদম প্রথমের দিনে দেখতাম এই ঘড়ি ১ সেকেন্ডে ৫০০ বার কাজ করে তারপর ১ সেকেন্ডে ৫, ০০০ বার তারপর ৫০, ০০০ বার। আর এখনকার দিনে মডার্ন প্রসেসর গুলো যেগুলো ২ গিগাহার্জ বা ৪ গিগাহার্জ ফ্রিকুএন্সিতে কাজ করে সেগুলো তে সেকেন্ডে কোটিবার কাজ করে বা অন অফ হতে পারে। তো, বুঝলেন বিষয়টা? কেনোনা আমরা যে গিগাহার্জ বা মেগাহার্জ ইউনিট ব্যবহার করি তা ঐ প্রসেসরের ক্লক স্পীডকেই পরিমাপ করার জন্য। এখানে সবচেয়ে বেসিক ইউনিট হচ্ছে হার্জ। অর্থাৎ যদি একটি ৫০০ হার্জ (500Hz) স্পীডের প্রসেসর হয়, তবে এর মানে এটি ১ সেকেন্ডে ৫০০ বার অন অফ করে কাজ করে। যদি ৫০০ কিলোহার্জ (500KHz) হয় তবে ৫ লাখবার অন অফ করে কাজ করবে। যদি ৫০০ মেগাহার্জ (500 MHz) হয় তবে ৫০০, ০০০, ০০০ বার কাজ করবে এবং বর্তমান দিনের ২ গিগাহার্জ (2GHz) প্রসেসর তো ২, ০০০, ০০০, ০০০ (নিজেই জিরো গুলো গুনে নিন) বার কাজ করতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো এই প্রসেসর ক্লক অন অথবা অফ হওয়াতে কি হয়? দেখুন এই ঘড়ি একবার অন এবং অফ হওয়াকে বলা হয় এক সাইকেল। অর্থাৎ ১ বার অন অফ হওয়া মানে ১ সাইকেল কাজ সম্পূর্ণ করা। এখন এই ১ সাইকেলে, প্রসেসর এর কার্যক্ষমতার উপর নির্ভর করে যে সে প্রসেসরটি কতটা কাজ করতে পারে এবং এটি নির্ভর করে কাজের কমান্ডের ধরনের উপর। একটি উন্নত প্রসেসর এবং একটি কম উন্নত প্রসেসরের মধ্যকার পার্থক্য এখানেই লখ্য করা যায়। মনে করুন দুটি প্রসেসরকে তুলনা করা হচ্ছে। এবং দুটি প্রসেসরই ২ গিগাহার্জ স্পীডে কাজ করে। কিন্তু বেশি উন্নত প্রসেসরটি ১ সাইকেলেই বেশি কাজ করতে পারে। এবং আরেকটি কম কাজ করে। কি বুঝতে অসুবিধা হলো? ঠিক আছে একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। মনে করুন আমার ঘরে একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব আছে, এবং আমি বাল্বটি অন অফ করার জন্য সুইটি একবার চেপে অন করলাম তারপর অফ করলাম। এখন ভাবুন আমি সেই সুইচটির পরে আরো অনেক মাস্টার সুইচ ইত্যাদি লাগালাম এবং একসাথে ১, ০০০ বাল্ব যুক্ত করলাম। এখন আমি যদি সেই সুইচটিকে চাপি তবে দেখা যাবে কোন বাল্ব অন হচ্ছে তো কোনটা আবার ব্লিঙ্ক করছে তো কোনটাই কেবল সংযোগ গেলো ইত্যাদি। তো এখানে একসাথে অনেক কাজ হলেও আমি তো সেই একই সুইচ থেকেই কাজ করছি তাই না? ঠিক একই ভাবে উন্নত প্রসেসর গুলো প্রত্যেকটি ওয়ার্কিং সাইকেলে বেশি কাজ করতে পারে।
তো এইভাবেই মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপে যে প্রসেসর গুলো দেখতে পাওয়া যায় তা বিভিন্ন প্রকারভেদে দেখতে পাওয়া যায়। আলোচনা অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে, এবার চলুন আসল প্রস্নে আসা যাক যে ওভার ক্লকিং টা আসলে কি? এর মানে হচ্ছে প্রসেসরের ঘড়ির কাজ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া। যদি এখন ঘড়িটি ১ সেকেন্ডে কিছুবার অন অফ হয় তবে তা বৃদ্ধি করে আরো বেশিবার অন অফ করানোয় হলো ওভার ক্লকিং করানোর উদ্দেশ্য। কেনোনা বেশিবার যদি ঘড়িটি অন অফ করানো যায় তবে নিঃসন্দেহে কম্পিউটার বেশি কাজ করবে। কেনোনা প্রসেসরটি প্রত্যেকটি ওয়ার্কিং সাইকেলে কিছুনা কিছু কাজ করে। এইজন্য ১ সেকেন্ডে যতো বেশি ওয়াকিং সাইকেল হবে ততো বেশি আউটপুট পাওয়া যাবে। তো আমার ধারণা অনুসারে ওভার ক্লকিং এর এই উদ্দেশ্যটি আপনি এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন নিশ্চয়।
“ওভার ক্লকিং” কি এবং কেন করা হয় এই দুটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পরে আজকের সর্ত অনুসারে এবারের প্রশ্ন আশাকরি। দেখুন আপনার কাছে যদি একটি রুট করা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে থাকে তবে আপনি সহজেই এটি করতে পারেন। আইফোন বা উইন্ডোজ ফোনের কথা আপাতত ভুলে যান। কেনোনা এই ফোন গুলোতে এটি করানো সম্ভব নয়। যাই হোক আপনার ফোনটি রুট করার পর এমন অনেক অ্যাপস প্লে স্টোরে দেখতে পাবেন যার সাহায্যে আপনি অনেক সহজেই আপনার ফোনের সিপিইউ বা প্রসেসরকে ওভার ক্লক করাতে পারবেন। শুধু মাত্র প্লে স্টোরে প্রবেশ করে সিপিইউ ওভার ক্লক লিখে সার্চ করুন দেখুন অনেক সফটওয়্যার পেয়ে যাবেন, এদের মধ্যে যেকোনো একটিকে ইন্সটল করুন, এবং দেখবেন ১ অথবা ২ ক্লিকেই ওভার ক্লক করতে পারবেন। এবং এর মাধ্যমে আপনার সিপিইউ বা জিপিইউ এর ফ্রিকুএন্সি সহজেই বাড়াতে পারবেন। ফ্রিকুএন্সি বলতে সাধারনত ক্লক স্পীডকেই নির্দেশ করা হয়। আবার আপনি চাইলে আন্ডার ক্লক বা ফ্রিকুএন্সি কমাতেও পারেন।
মনে করুন, আপনার প্রসেসর ১.৫ গিগাহার্জ এ কাজ করে তবে আপনি ওভার ক্লক করে তা ১.৬ করতে পারেন বা ১.৭ করতে পারেন। আবার আপনি আন্ডার ক্লক করে ১.২ করতে পারেন, ১.০ করতে পারেন বা ০.৮ ও করতে পারেন। এবং এই দুটিই আপনার মনের ইচ্ছার কথা। এখন দেখুন এই ফ্রিকুএন্সি বেশি বা কম করলে কি হবে, অবশ্যই কার্যক্ষমতার উপর প্রভাব পড়বে। ফ্রিকুএন্সি বাড়ালে কার্যক্ষমতা বাড়বে এবং ফ্রিকুএন্সি কমালে কার্যক্ষমতা কমবে। এবং এর সাথেসাথে পাওয়ার ক্ষয়ের বিষয়েও পরিবর্তন আসবে। আপনি যদি ফ্রিকুএন্সি বেশি করে দেন তবে প্রসেসরটি বেশি কাজ করতে আরম্ভ করবে এবং ব্যাটারির পাওয়ার বেশি ক্ষয় করবে। আর যদি ফ্রিকুএন্সি কমিয়ে দেন তবে ব্যাটারি ক্ষয়ও কমে যাবে। এখন আপনিই ভেবে দেখুন, আপনার বেশি পারফর্মেন্স প্রয়োজন না বেশি ব্যাটারি লাইফ প্রয়োজন।
ওভার ক্লকিং করার সময় আরেকটি বিষয়ের উপর বিশেষ খেয়াল রাখা আবশ্যক। আর সেটি হচ্ছে প্রসেসরের স্বাস্থ্য। আপনি এমনটা কখনোও করতে পারবেন না যে, যে প্রসেসর এর স্পীড ১.৫ গিগাহার্জ তার ফ্রিকুএন্সি বাড়িয়ে দিলেন ৫ গিগাহার্জ। এরকম করাতে আপনার প্রসেসর চিপটিতে আগুন ধরে যাবে। কেনোনা ৫ গিগাহার্জ স্পীডে কাজ করতে গিয়ে প্রসেসরটি এতো বেশি পাওয়ার শোষণ করবে যে সে তা নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন না। এবং আপনার মোবাইল বা ল্যাপটপ চুলায় পরিণত হয়ে যাবে। তো ওভার ক্লকিং করার একটি নিরাপদ লিমিট থাকে। আপনার প্রসেসরটি ১.৫ হলে আপনি ধিরেধিরে তা ১.৬ বা ১.৭ বা ১.৮ করতে পারেন। এবং এভাবে ওভার ক্লক করলে আপনার ফোন যথারীতি ভাবে বেশি পারফর্মেন্স দেখাতে সক্ষম হবে। আর যদি বেউকুফি করে একদম দুই গুন তিন গুন বাড়িয়ে ফেলেন তবে আর কি, ফোন বা ল্যাপটপ দিয়ে বসে বসে পরোটা আর ডিম ভাঁজুন 😛
কিছু কিছু কাস্টম রম আছে যদি সেগুলো দিয়ে আপনার ফোন ফ্ল্যাশ করা থাকে তবে সিপিইউ ওভার ক্লক করতে আলাদা সফটওয়্যার এর প্রয়োজন পড়বে না। যেমন সাইনজেন মোড (cyanogenmod), এটি একটি কাস্টম রম। সাইনজেন মোড এ আপনার ফোনের সেটিংস এর ভেতর সিপিইউ ওভার ক্লক বা আন্ডার ক্লক করানোর ইনবিল্ড অপশন থাকে। তাছাড়া আপনি আরো আলাদা আলাদা অপশন ব্যবহার করতে পারেন। যেমনঃ ব্যাটারি সেভার মুড, পারফর্মেন্স মুড ইত্যাদি।
কম্পিউটার বা ল্যাপটপে ওভার ক্লক করা একটু আলাদা বিষয়। আপনার কাছে যদি ইনটেল এর “কে(K)” সিরিজের একটি প্রসেসর থাকে। “কে” মানে, আপনার প্রসেসরের মডেল নাম্বারের শেষে যদি “কে(K)” লেখা থাকে এবং যদি আপনার কাছে এমন একটি মাদারবোর্ড থাকে যা ওভার ক্লক ফিচার সমর্থন করে তবে আপনি অনেক আরামে আপনার কম্পিউটার বা ল্যাপটপে ওভার ক্লক করতে পারবেন। আপনাকে ব্যাওস সেটিংস এ যেতে হবে এবং কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করতে হবে এবং অনেক সহজেই আপনি ওভার ক্লক করতে পারবেন।
এখানেও একই নিয়ম, আপনি ওভার ক্লক করলে পাওয়ার ক্ষয় বেড়ে যাবে। প্রসেসর অনেক গরম হবে এবং তার জন্য আপনাকে একটি ভালো কুলিং সিস্টেম লাগাতে হবে। আর যদি আন্ডার ক্লক করেন তবে পাওয়ার ক্ষয় কমে যাবে। কিন্তু কম্পিউটারে তো আমরা কখনোয় আন্ডার ক্লক করবো না। হাঁ, মোবাইলে অনেক সময় ব্যাটারি সেভ করার প্রসঙ্গ আসে তাই আন্ডার ক্লক করা হয়। কিন্তু কম্পিউটারে করলে সবসময় ওভার ক্লকই করা হয়। আর ওভার ক্লক করতে আপনার ইনটেল এর “কে(K)” সিরিজ প্রসেসর থাকা আবশ্যক এবং সাথে একটি ওভার ক্লকিং সমর্থন করা মাদারবোর্ড। তবে এএমডি এর কিছু নির্দিষ্ট প্রসেসর দিয়েও ওভার ক্লক করা যায়। তো আপনার ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে যদি নির্দিষ্ট হার্ডওয়্যার না থাকে তবে আপনি ওভার ক্লক করতে পারবেন না।
স্টেপ বাই স্টেপ পিসিতে ওভার-ক্লকিং করার পদ্ধতি জানতে সানিম মাহবীর ফাহাদ ভাইয়ের এই টিউন টি দেখতে পারেন।
আপনি যদি সঠিক নিয়ম অনুসারে এবং আজকের বর্ণিত সতর্কবার্তা গুলো অনুসরন করে আপনার ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা মোবাইলে যদি ওভার ক্লকিং করেন তবে সামান্য বেশি পাওয়ার ক্ষয়ের বদলে অনেক বেশি পারফর্মেন্স উপভোগ করতে পারবেন। আপনি যদি ফোনে বেশি কার্যক্ষমতা দেখতে চান তবে ওভার ক্লক করতে পারেন আর যদি বেশি ব্যাটারি লাইফ চান (সাধারন থেকেও বেশি) তবে আন্ডার ক্লক করতে পারেন। আশা করি এ সকল বিষয় এখন আপনার কাছে একদম পানির মতো পরিষ্কার। এছাড়াও আরেকটি বিষয় আছে যাকে আমরা বলি ওভার ভোল্টিং এবং আন্ডার ভোল্টিং। এটি একটি আলাদা বিষয়, এটি প্রসেসর এর ফ্রিকুএন্সি সম্পর্কিত কোন বিষয় না। এখানে সিপিইউ এর ভোল্টেজ কম বা বেশি করা হয়। যাই হোক, এই বিষয় নিয়ে পরে আরেকটি টিউন লিখে ফেলবো আপনাদের জন্য। আর হাঁ, আজকের টিউন টি শেয়ার করতে একদম ভুলবেন না। আর যদি ওভার ক্লকিং সম্পর্কে আপনার আর কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তবে অবশ্যই নিচে টিউমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি সর্বদাই আপনাদের মতামত এবং প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করে থাকি।
আমি তাহমিদ বোরহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 177 টি টিউন ও 680 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 43 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি তাহমিদ বোরহান। টেক নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালোবাসি। টেকটিউন্স সহ নিজের কিছু টেক ব্লগ লিখি। TecHubs ব্লগ এবং TecHubs TV ইউটিউব চ্যানেল হলো আমার প্যাশন, তাই এখানে কিছু অসাধারণ করারই চেষ্টা করি!
ভালো টিউন