আমরা রঙ্গিন এক দুনিয়াতে বসবাস করি। তাকিয়ে দেখুন নীল আকাশ, সবুজ প্রান্তর, সাদা মেঘ, লাল গোলাপ, সোনালী রোদ্দুর, নীল অপরাজিতা, কাল কোকিল সবই আপনাকে আকর্ষনের চেষ্টা করছে। ভেবে দেখেছেন কি, সবুজ বৃন্তে লাল গোলাপ অথবা নীল আকাশের নীচে হলুদ-কমলা সূর্যমুখী কেন বেশী ভালো লাগে? কেন ?
আচ্ছা ভেবে দেখুন তো,
হলুদ রঙয়ের রুমে আপনার মাঝে অজানা উদ্বিগ্নতা কাজ করে কি?
কিংবা, নীল রং আপনার মাঝে কি শান্ত এবং স্বচ্ছন্দতার অনুভূতি জাগায়?
রংয়ের পরিবর্তন আমাদের মন, মেজাজ,আবেগ এবং অনুভূতিতে আসলেই কি নাটকীয় কোন পরিবর্তন আনতে পারে?
উত্তর হল হ্যা, রংয়ের পরিবর্তন আমাদের মন, মেজাজ,আবেগ এবং অনুভূতিতে আসলেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে গিয়ে আর্টিষ্ট এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররাও অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন।
এখন আসি, আমরা কেন বিচিত্র সব রঙ দেখি!!!
আসলে উৎস হতে নিক্ষিপ্ত আলো যখন বস্তুর উপর পতিত হয় তখন এর কিছু অংশ বস্তু কর্তৃক শোষিত হয় এবং অবশিষ্ট অংশ প্রতিফলিত হয়। এই এই প্রতিফলিত আলো আমাদের চোখে বিভিন্ন রঙের অনুভুতির সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে একেক বস্তুকে আমরা একেক রঙে দেখতে পাই।
সহজাতগতভাবেই আমাদের মন রংয়ের প্রতি সংবেদনশীল, নন-ভার্বাল কমিউনিকেশনেও রং আমাদের চিন্তা ও আবেগকে খুব সহজে নাড়া দিতে পারে। তাই কোন ডিজাইন যে গোপন অর্থ বহন করে সেটা তাৎক্ষনিকভাবে বুঝে নিতে রং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে রং একটি পাওয়ারফুল কমিউনিকেশন টুল, শুধুমাত্র কালার ইফেক্টের ব্যবহার মানুষের মাঝে কেনাকাটার মত অভ্যাসেও বিস্তর পরিবর্তন আনতে পারে। শুনলে হয়তো অবাক হবেন, কিছু রং মানুষের ব্লাড প্রেসার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। এমনকি অনলাইন শপিং, এডভার্টাইজিং, মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে প্রায় ৮০ভাগ ক্ষেত্রে ক্রেতার আকর্ষণ বাড়াতে রংয়ের ব্যবহারকে উল্লেখযোগ্য বিবেচনা করা হয়।
তাই নন-ভার্বাল কমিউনিকেশনে যে পার্টগুলো গ্রাফিক ডিজাইনারেরা ব্যবহার করে থাকেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী হল কালার বা রঙ। এজন্যেই সঠিকভাবে জেনে রংয়ের ব্যবহার করা ফটোগ্রাফার, গ্রাফিক্স ও ওয়েব ডিজাইনারদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
মনের উপর রঙের প্রভাব
রঙয়ের ব্যবহার যেহেতু মানুষের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে তাই কালার ইফেক্টের কিছু সার্বজনীন অর্থও রয়েছে। তাই গ্রাফিক ডিজাইনে বিভিন্ন রঙয়ের ব্যবহার কি অর্থ বহন করে সেটা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। বিভিন্ন রং আমাদের মনে বিভিন্ন অনুভুতির সৃষ্টি করে, তাই রঙ এবং এর ব্যবহারে হতে হয় সতর্ক ।চলুন জেনে নিই মনের উপর বিভিন্ন রঙ এর ভূমিকা কেমন হতে পারে।
সাদাঃ
শুদ্ধতা ও শান্তির প্রতীক হিসেবে সাদা রং এর ব্যবহার বিশ্বজনীন। ডিজাইনে এই রঙটি সাধারণত রিভার্সড টেক্সট কিংবা নেগেটিভ স্পেসিং এ বেশী ব্যবহৃত হয়, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ(WWF) এর লোগোটা দেখুন, আশা করি পরিষ্কার ধারণা পেয়ে যাবেন।
মানুষের মনে সাদা রঙ সাধারণত যে ধরণের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরুপঃ
ইতিবাচকঃ পরিচ্ছন্নতা, সত্যনিষ্ঠ, শান্তি, শুদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সরলতা।
নেতিবাচকঃ শূন্যতা, উদাশীনতা।
কালোঃ
সাদার পরই যে রঙ এর কথা আসে সেটা হল কালো। সাধারণ কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী একটি রঙ। সম্পদশালী এবং সুরুচিপূর্ণতাকে যেমন তুলে ধরে তেমনি অশুভ ভয় এবং বিষন্ন ভাবের প্রতিকৃতি মনে জাগিয়ে তুলে। আবার এর শৈল্পিক ব্যবহার মনে এমন একটি প্রতিরক্ষামূলক বাধা সৃষ্টি করে যেন মনে হবে আপনার দিকে আসা সকল অপশক্তিকে শুষে নিচ্ছে।
সাধারণত কালো রঙ মানুষের মনে যে ধরণের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরুপঃ
ইতিবাচকঃ বোল্ডনেস, কর্তৃত্ব, বিশুদ্ধতা, নিয়মানুগত্য, রহস্য, গুরুত্বপূর্ণ ।
নেতিবাচকঃ ভয়, নিপীড়ন, উদাসীনতা।
সবুজঃ
নতুন জীবন এবং নতুনের মতো করা বুঝাতে সবুজ রঙের ব্যবহার উল্লেখ করার মত। সবুজ রঙ মনে যেমন প্রশান্তি ও স্বচ্ছন্দতা জাগিয়ে তুলে তেমনি অপরিপক্কতাকেও তুলে ধরে। প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানীর লোগোতে এই রঙের ব্যবহার চোখে পড়ে, বিষেশত যারা নিজেদেরকে ইকো-ফ্রেন্ডলি হিসেবে পরিচিত করাতে চায়। এনিমেল প্ল্যানেট চ্যানেলের লোগোটি এর বড় উদাহরণ।
সাধারণত সবুজ রঙ মানুষের মনে যে ধরণের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরুপঃ
ইতিবাচকঃ টাটকা, প্রাকৃতিক, ছন্দ, সুস্বাস্থ্য, নিরাময়।
নেতিবাচকঃ কোমলত্ব, একঘেয়েমি।
লাল
সবচেয়ে লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হওয়ায় লাল বেশ শক্তিশালী একটি রং, তাই খুব দূর থেকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। লাল রঙের এই ধর্মের কারণেই ট্রাফিক লাইটে এর ব্যবহার বিশ্বব্যাপী। লাল এমন একটি গাঢ় রঙ যা মানুষের মনে ভালবাসার মত তীব্র আবেগ জাগানো থেকে শুরু করে ব্লাড প্রেসার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। লোগো ডিজাইনে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
সাধারণত লাল রঙ মানুষের মনে যে ধরণের প্রভাব ফেলে তা নিম্নরুপঃ
ইতিবাচকঃ সাহসিকতা, প্রবলতা, উষ্ণতা, শক্তি, ফাইট অর ফ্লাইট, উদ্দীপনা, উত্তেজনা।
নেতিবাচকঃ আক্রমনাত্মকতা, আগ্রাসন, মানসিক চাপ সৃষ্টি।
নীল
নীল এর সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট লাল এর পুরুই উল্টোটা, কারণ লাল রং কাজ করে ফিজিক্যালি আর নীল রং কাজ করে মেন্টাললি। নীল রং খুব সহজেই মনের মাঝে শান্ত করার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে। বেশীরভাগ মানুষেই একটা ব্যাপারে একমত যে, ডিজাইনে অন্তত একটা নীল শেড থাকলেও সেটা তাদের প্রিয় হয়ে উঠে। বেশীরভাগ মানুষের প্রিয় রং নীল, তাই নীল রং কে বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রিয় রং বলা হয়। এমনকি রিসার্চেও এটা প্রমাণিত হয়েছে।
নীল রঙ মানুষের মনে যে ধরণের মানসিক প্রভাব ফেলে তা নিম্নরুপঃ
ইতিবাচকঃ বুদ্ধিদীপ্ততা, যোগাযোগ দক্ষতা, প্রশান্ত ভাব, আস্থা, প্রত্যয়, নির্মলতা, বিশ্বাস।
নেতিবাচকঃ নির্লিপ্ততা, আবেগশূন্যতা।
হলুদঃ
অত্যন্ত দৃষ্টিগোচর একটি রং এবং দেখার জন্য সব থেকে সহজতম রং। তাই খুব সহজেই মানুষের মাঝে উদ্দীপনা জাগাতে পারে। হলুদ রং এর সঠিক ব্যবহার আমাদের মনে যেমন প্রফুল্লতা এবং আত্মসম্মানবোধকে জাগিয়ে তুলে তেমনি এর অতিরিক্ত ব্যবহার ভয় এবং উদ্বিগ্নতাকে জাগিয়ে তুলে।
মানুষের মনে হলুদ রঙ যে ধরণের মানসিক প্রভাব ফেলে তা নিম্নরুপঃ
ইতিবাচকঃ আত্মমর্যাদা, বুদ্ধিদীপ্ততা, আগ্রহ, আনন্দ, ইতিবাচকতা, সূর্যোদয়।
নেতিবাচকঃ নির্লিপ্ততা, আবেগশূন্যতা।
বাদামীঃ
লাল, হলুদ এবং কাল এর সমন্বয়ে রঙটি গঠিত। এর ফলে বাদামী রং মস্তিস্কে কালো রঙের মতই প্রভাব ফেলে কিন্তু এটি তুলনামূলকভাবে উষ্ণ এবং কোমলতার অনুভূতি জাগায়। বাদামী রংকে বলা হয় প্রকৃতির রং, এই রঙটি প্রাকৃতিক বা অর্গানিক বস্তুর সাথে সম্পর্কিত। বেশীরভাগ ডিজাইনাররাই পিউর ব্ল্যাক ব্যবহার করার চেয়ে বাদামী রং ব্যবহারের সাজেশন দিয়ে থাকেন।
মানুষের মনে বাদামী রঙ যে ধরণের মানসিক প্রভাব ফেলে তা নিম্নরুপঃ
ইতিবাচকঃ গুরুত্ব, আন্তরিকতা, প্রাকৃতিক, নির্ভরযোগ্যতা, সাপোর্ট।
নেতিবাচকঃ রসবোধের অভাব, রাশভারী।
কোন রং মানুষের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে সেটা অনেকখানি নির্ভর করে কিভাবে কোথায় রঙটি ব্যবহৃত হয়েছে, তাই গ্রাফিক্স ডিজাইনে রঙের ব্যবহার এবং সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট জানার পরই যে বিষয়টি চলে আসে সেটা হল রং এর ব্যবহার। গ্রাফিক্স ডিজাইনে রং এর ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে আরও কিছু বিষয় আগে জানা লাগবে। সেগুলো মধ্যে একটি হল রং এর শ্রেণীবিভাগ –
অনেক আগে লাল, হলুদ এবং নীল এই তিন রংকে মৌলিক রং বলে ধরা হয়। রংকে আবার ভাগ করা হয়েছে এইভাবে -
১) First Order Colours
২)Second Order Colours
৩)Third-Order Colours
First Order Colours- এই রঙ গুলি হলো Red, Yellow, blue লাল, হলুদ এবং নীল অন্য কোন রং মিশ্রনে তৈরী করা যায় না।
Second Order Colours - এই রংগুলি হলো Red, Yellow, blue লাল, হলুদ এবং নীল এই তিন রঙের মিশ্রনে তৈরী হয়। যেমন - কমলা, সবুজ, বেগুনী।
Third-Order Colours- যা Second Order Colours এবং মৌলিক রং এর মিশ্রনে তৈরী হয়।
গ্রাফিক্স ডিজাইনে রং নিয়ে খেলা করতে চাইলে আরও কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া লাগবে। সেগুলো হচ্ছে-
১.Complementary Colors
২.Simultaneous Contrast
৩.Complementary Ratios
৪. Harmonizing Colors.
এই বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করুন, রং এর ব্যবহার সম্পর্কে আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করবো। আপডেট পেতে চোখ রাখুন DevsTeam Institute এর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ এ।
পরিশেষে বলা যায় প্রতিটি রংই মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষজ্ঞদের গবেষনায় দেখা গেছে প্রতিটি রং মানুষের মনে কিভাবে প্রভাব ফেলে সেটার অনেকখানি মানুষের ব্যক্তিত্ব, সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতার উপরও নির্ভর করে। তাই রং কিভাবে মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে সেটা নিয়ে এখনও বিস্তর গবেষণা চলছে।
আমি DevsTeam Institute। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 41 টি টিউন ও 63 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
nice tune…