২০১২ সালের প্রথম দিকের কথা। তখন আমি আমাদের জেলার সরকারি কলেজে অনার্স করছিলাম। ছাত্র হিসেবে খারাপ না তাছাড়া ইংরেজি ভাষাটার প্রতি ছিল আমার অঘাট কৌতূহল ও শ্রদ্ধা। তাই পড়ছিলাম ইংরেজি বিষয়ের ওপরই। প্রথম বছরটা ভাল করে পার করে আমি তখন ২য় বর্ষে।
ইন্টারনেটের এই যুগে ফেসবুকের প্রভাবটা স্বাভাবিকভাবে আমার উপরেও পরেছিল। এর ফলে আমি আস্তে আস্তে জানতে পারি অনলাইনে নাকি টাকা আয় করা যায়। প্রথম দিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও পরে অনলাইনের মাধ্যমে দুর-দুরান্তের বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগের ফলে নিশ্চিন্ত হই যে ব্যপারটা সঠিক। এরপর আরও নিঃসন্দেহ হলাম যখন নিজ জেলার কিছু ফ্রিলান্সারদের সাথে পরিচিত হলাম। তাছাড়া অনলাইনে কাজ করে এমন ২/১ জনের সাথে আমার ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে (নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না)। বন্ধুরা আমাকে উৎসাহ দিতে থাকে যে শুধুমাত্র ইংরেজি গল্প লিখেও নাকি টাকা আয় করা যায়। শুনে তো ভালই লাগছে। ওরা ঢাকাতে থেকে কাজ করে কিন্তু গ্রামের বাড়ি আমাদের জেলাতেই। বিশ্বাস করেন তখনো জানতাম না আসলে কি হতে চলেছে!
একদিন/ দুইদিন এভাবে যেতে যেতে ফ্রিলান্সিং এর ব্যপারটা মাথায় চেপে বসে। চিন্তা করতে লাগলাম আমি কি পারবো না! ওরা পারলে আমি কেন না!!! খুব একটা সচ্ছল পরিবারের সন্তান না আমি। তাই ভাবলাম পড়াশুনার পাশাপাশি টুকটাক কাজ করলে ক্ষতি কি? বাড়িতে বলে কয়ে একটা কম্পিউটার কিনলাম। সত্যি কথা বলতে পূর্বে আমার কম্পিউটার সম্পর্কে তেমন একটা ধারনা ছিল না। তাই ২/১ মাস এমনিই টাইপিং এর জন্য অনুশীলন করতে থাকি। সাথে চলে ইন্টারনেট ব্রাউজিং। কম্পিউটার তো হল এবার অনলাইনে কাজ করবো ক্যামনে! আগেই বলে রাখি যে আমার খালাতো ভাই ওয়েব ডেভেলপিং এর কাজ করে। ঢাকাতে থাকে পরিবার সহ। ভাইয়ার সাথে কথা হয় এই ব্যপারে। উনি আমাকে জানালেন এই কাজ করে ফ্রিলান্সিং করতে তোমাকে আগে কাজ শিখতে হবে এবং কাজ শিখতে অন্তত ৬/৭ মাস অনুশীলন করতে হবে। এদিকে শুনছি ঢাকার বন্ধুরা নাকি ৪০/৫০ হাজার টাকা করে ইনকাম করছে প্রতি মাসে। আমি ওদেরকে বললাম আমাকেও কাজ দাও, করবো। ওরা আমাকে ওদের সাথে কাজে নিতে রাজি হল। আমি জানতে চাইলাম তোমাদের এই শিখতে কতদিন লাগবে? ওরা বলল খুব ইজি কাজ। ৪/৫ দিন দেখলেই হয়ে যাবে। এবং কাজ করতে হলে নাকি ঢাকাতে থাকতে হবে। তারপর বললাম কেমন আয় হবে আমার? ওরা জানালো যেমন করবে তেমন পাবে। তবে আনুমানিক ১৫ হাজার টাকা ধরে রাখেন। শুনে আমি তো পুরাই “থ” হয়ে গেলাম।
বিশ্বাস করেন তখনও জানতাম না আসলেই কি হতে চলেছে! তাই এবার আমি পরলাম মহা-চিন্তায়। ওয়েব ডেভেলপিং এর কাজ শিখবো ৬/৭ মাস ধরে! নাকি বন্ধুদের সাথে কাজ করে চলতি আয় করবো প্রতি মাসে! কিন্তু ঢাকাতে গেলে তো পড়াশুনা হবে না। ফ্রিলান্সিং এর ভুত টা মনের মধ্যে এমন ভাবেই গেঁথে গেছে যে তখন মনে হচ্ছিল পড়াশুনা করে কি হবে আর? ওদিকে বন্ধুরা মাসে হাজার হাজার টাকা আয় করছে ম্যাট্রিক পাশ না করেও। আর আমার তো ইংরেজি জ্ঞান খারাপ না।
বাড়িতে জানালাম আমার পরিকল্পনা। বাবা-মা কেউই রাজি না। বলল যত কষ্টই হউক না কেন আগে অনার্স টা শেষ কর। আসলে তখনও বুঝতে পারিনি আসলেই কি হতে চলেছে! তাই পরিবারের সবাইকে নাম মাত্র বুঝিয়ে পারি দিলাম ঢাকার পথে। উদ্দেশ্য একটাই অনলানে টাকা আয় করবো, হাতে আমার একটা কাপড়চোপড়ের ব্যাগ আর একটা ল্যাপটপ। (ধৈর্যহারা হবেন না প্লিজ। আর আছে।)
আসলে অনলাইনে সাধারনত কি কি কাজ করা যায় জানা ছিল না আমার। ঢাকাতে গিয়েই আমার পরিচয় হয় ওডেস্ক এর সাথে। জানতে পারলাম এখান থেকে নাকি কাজ নিয়ে নিয়ে করতে হয়। তবে নতুনদের কাজ নিতে অনেক কষ্ট হয়। যাই হউক আমার এগুলো নিয়ে চিন্তা করার কোন মানে হয় না। কারন আমিতো করবো আমার বন্ধুদের দেয়া কাজ যা করলে আমি পাব প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫০০০ টাকা। ভাবতেই অবাক লাগছে। ওখানে গিয়ে দেখি আমার সাথে আরও ৩/৪ জন যারা আমার মত কাজ করবে। পরে ৩/৪ দিন ধরে কাজ দেখিয়ে দিল কিভাবে করতে হয়। আমরা করতে থাকলাম। কারন তখনও জানতাম না আসলেই কি হতে চলেছে! শুধু এইটা জানতাম অনলাইনে নাকি সবাই এই ধরনের কাজই করে। যেমন ক্যাপচা এন্ট্রি, ক্রেইগগ্লিস্ট, ডাটা এন্ট্রি, আর্টিকেল রাইটিং। তো আমি ওখানে গিয়ে মূলত ক্রেইগগ্লিস্ট এর কাজ করতে থাকি।
পরে আস্তে আস্তে কিছু সমস্যা দেখা দিতে থেকে। যেমনঃ ১। আজ কাজ করা যাবে না, সার্ভার ব্যস্ত। ২। আজ কাজ করা যাবে না, বায়ার নিষেধ করেছে। তাছাড়া মাস শেষে বলে কাজের রেট খুব কম। তাই এই মাসের বাড়ি ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া আনুসাঙ্গিক সব খরচ করে মাস শেষে কিছু থাকছে না। এভাবে চলতে থাকে ২/৩ মাস। এতে আমার মনে হচ্ছে কেন এলাম আমি এগুলো করতে? আসলে সবার কথা অমান্য করাটাই আমার ভুল হয়েছে। হয়তো আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে এই আশায় পড়ে থাকি আরও কয়েকটি মাস। এদিকে বাড়ি থেকে জানতে চায় আমার অবস্থা। আমি সবাইকে জানাই যে কাজ শিখতে অনেক সময় নিচ্ছে। পুরোপুরি ভাবে কাজ করতে আরও ২/১ মাস লাগবে।
কিন্তু আমার অবস্থার কোন ইতিবাচক পরিবর্তন না হওয়াতে সিদ্ধান্ত নিলাম যা হওয়ার হবে। বাড়ির একমাত্র ছেলে আমি। হয়তো আমার এ অন্যায় তারা ক্ষমা করে দিবে। অবশেষে ৬ মাস পর ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে আসি (অবশ্য ঢাকা থাকাকালীন এর মধ্যে ২ বার বাড়িতে এসেছিলাম)। এর মধ্যে আমার পড়াশুনাতে ১ বছর সময় নষ্ট হয়। তাতে কি আমি আমার শুরু করে দিলাম লেখা পড়া। আর অভিজ্ঞ ফ্রিলান্সার খালাতো ভাইয়ের পরামর্শে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর কাজ শেখা আরম্ভ করে দিই। এর মধ্যে বিভিন্ন ভিডিও / পিডিএফ বই সংগ্রহ করে এই চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে কাজ শেখা শুরু করি। প্রতিদিন ৮+ ঘণ্টা করে অনুশীলন করে যাচ্ছি এখন পর্যন্ত। যার ফলে আমি এখন HTML, CSS, PHOTOSHOP, JAVACRIPT আয়ত্তে এনেছি। অনলাইনে খালাতো ভাই এবং বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ওয়েব সাইট এর সাহায্যে এখন আমি ওয়েব ডিজাইনিং এ অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছি। ডিজাইনিং এ ভাল করতে পারলে পরে ডেভেলপিং এর কাজে নজর দিব।
এখন মনে হচ্ছে আমি অনেকটাই সুস্থ পরিবেশে বাস করছি। নিজের ভুলে এবং আবেগের মোহে নিজের বিবেক বুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট করেছি। কারন আমি প্রথমবস্থায় সুনির্দিষ্ট ও ভালুয়েবল কোন কাজ না শিখেই ফ্রিলান্সিং করতে মাঠে নেমে পরেছিলাম। এবং যেই ধরনের কাজ আমি করতাম সেই কাজ গুলি এখন নাকি আর ওডেস্ক এ নেই। ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।
নিজের ভুল আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি। তাই আমি চাই আমার মত ভুল যেন কেউ না করে। তাই আমি আপনাকে বলবো যে, আপনি যদি আউটসরসিং করতে চান তবে অবশই কাজ শিখুন। না হলে আপনার মূল্যবান সময়টুকুই নষ্ট হবে। এর বেশি কিছু না। এখন আমি পড়াশুনার পাশাপাশি কাজ শিখছি ডেইলি রুটিন অনুযায়ী। ফ্রিলান্সিং এর বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস গুলো সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা হচ্ছে দিন দিন যা গত ৪ মাস আগেও ছিল না। আমি মনে করি এই ধরনের কাজের মূল্য সবখানে সবসময়ই আছে। এখানে নিজের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায় অনায়াসেই। আমি বাপ্পি, সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যাতে একজন দক্ষ ওয়েব ডেভেলপার হতে পারি এবং হতে পারি একজন সফল ফ্রিলান্সার।
আপনাদের জন্যও রইলো শুভ কামনা। 🙂
আমি বাপ্পি চৌধুরী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 12 টি টিউন ও 20 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
ভাল লিখেছেন