গ্রীক মিথোলজি থেকে রাইট ভাতৃদ্বয়ঃ মানুষের আকাশ জয়ের ঘটনাপঞ্জী

টিউন বিভাগ নির্বাচিত
প্রকাশিত
জোসস করেছেন

15

মানুষ সেই সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব স্বপ্ন দেখে আসছে তার মধ্যে আকাশে ডানা মেলার স্বপ্নই সবচেয়ে প্রাচীন। পাখিকে আকাশে উড়তে দেখে মানুষেরও সাধ জেগেছে পাখির মতোই আকাশে অবাধে উড়ে বেড়াতে। তারপর দীর্ঘদিন অনেক মানুষের অনেক কষ্ট, পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে আজ মানুষ আকাশে চড়ে বেড়াচ্ছে, মহাশূন্য, চাঁদ জয় করে চলেছে তবুও তার সেই প্রাচীনতম আকাঙ্খার মৃত্যু হয়নি। সে চায় আরও দৃপ্ত, নিরাপদ, সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে আকাশে ডানা মেলতে। আর এজন্য যথারীতি চলছে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা কিভাবে আকাশ আরও নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও দ্রুত করা যায় তার জন্য। আর বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সাফল্য এসে ধরা দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিশালাকার, দ্রুতগতির ও আরামদায়ক বিমানের। একটা উদাহরণ দেই যেমন- হজ্বের কথাই ধরা যাক। আগে আমাদের দেশ থেকে হজ্বে যাওয়া-আসা মানে ছিল প্রায় বছরের ধাক্কা। আর এখন? সাধারণ হাজ্বীদের ফ্লাইট সংকটে বেশি সময় লাগে কিন্তু আসা আর যাওয়ার বিমানযাত্রার সময়টা ১০/১২ ঘণ্টার বেশি নয়।

01

এই আধুনিক উড়োজাহাজের আবিষ্কার কিন্তু বেশিদিন আগে হয়নি। বলা যায় আজ থেকে ১০০ বছর আগে উড়োজাহাজ ভূমিষ্ঠ হয়েছে মাত্র। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও এই উড়োজাহাজ আকাশে ডানা মেলতে পারেনি। তবে এর শুরু কবে? মানুষের আকাশে উড়ার বাসনাকে বাস্তবে রূপদানের চেস্টার। সূচনা কিন্তু হয়েছে অনেক প্রাচীনকালেই। মানুষের দীর্ঘকালের আকাশে উড়ার স্বপ্ন, প্রচেষ্টা, পরীক্ষা, ত্যাগ, সাফল্যের সমন্বয়ই আজকের আধুনিক উড়োজাহাজ। আসুন একটু শুরু থেকেই দেখে আসি উড়োজাহাজের আবিষ্কারের কাহিনী ও এর পেছনের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ।

প্রাচীন রূপকথা থেকে শুরু

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ উড়বার জন্য যে কতটা ব্যাকুল ছিল তা বোঝা যায় বিভিন্ন প্রাচীন উপকথার দিকে তাকালেই। সেখানেও বিভিন্নভাবে এসেছে মানুষের আকাশে ভ্রমণের কথা। গ্রীক পুরানের একটি গল্প আমাদের অনেকেরই জানা। অনেক অনেক আগে ডিডালুস ও তার ছেলে ইকারাস পাখির পালক দিয়ে ডানাসদৃশ বস্তু তৈরি করে তা মোম দিয়ে পরস্পরকে দিয়ে নাকি আকাশে উড়তে সক্ষম হয়েছিল।

03

এভাবে এক সময় ইকারাস বেশি উপরে উঠে গেলে সূর্যের উত্তাপে তার ডানার মোম গলে গেলে তা থেকে থেকে পালক খসে পড়ে গেলে সে নদীতে পড়ে যায়। গ্রীকরা যে শুধু রূপকথা নিয়েই পড়ে ছিল তা কিন্তু নয়। এই গালগপ্পোকে বাস্তবে রূপ দিতেও তাদের দেশে সেই সময়ে অনেকেই কাজ করে গেছেন। আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ সালে আর্কিটাস, যিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতিষি তিনি প্রথম উড়ুক্কু মানের ডিজাইন ও মডেল নির্মাণ করেছিলেন এবং এটি নাকি ২০০ মিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম হয়েছিলে। তিনি এই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন পিজিয়ন।

প্রাচীন চীনে বেলুন আর ঘুড়ির নিদর্শন

তবে উড়বার আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপদানের চেস্টার প্রাচীনতম নিদর্শন আমরা দেখতে পাই প্রাচীন চীনদেশে। সেখানে কিংমন ঝুং লিয়াং (১৮০-২৩৪ খ্রীষ্টাব্দ) গরম বাতাস ব্যবহা রকরে সর্বপ্রথম বেলুন উড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর জেনারেল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে ভয় দেখাতে তিনি এই বেলুন ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। একটি বড় কাগজের ব্যগের নিচে তেলের বাতি জ্বালিয়ে তিনি এই বেলুন উড়াতেন। শত্রুপক্ষ ভাবতো যে আকাশ থেকে কোনো মহাশক্তিধর কেউ তাদের বিপড়্গে লড়তে এসেছে। তবে আবার আরেক ইতিহাসবিদ জোসেফ নিধাম-এর মতে চীনের মানুষ আরও আগে (খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ) থেকেই গরম বাতাস দিয়ে কাগজের বেলুনের ব্যাপারে জানত।

16

এরপর ৫ম শতাব্দীতে এসে চীনের লু বান কাঠের কাঠামো ব্যবহার করে দীর্ঘাকৃতির ঘুড়ি বানান। তবে অনেকেই একে আধুনিক গ্লাইডারের আদিরূপ মনে করেন। ১৩শ শতাব্দীতে কুবলাই খানের শাসন আমল থেকে শুরু হয় বিভিন্ন উৎসবে রঙিন ফানুসের ব্যবহার। কালের পরিক্রমায় পরবর্তীতে মঙ্গোলিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, তিব্বত ও ভারতবর্ষেও এর প্রচলন দেখা যায়। আর সম্ভবত মানুষের প্রথম আকাশে উড়ার ইতিহাসও সৃষ্টি হয়েছিল এই চীনেই। ৫৫৯ সালে চীনের নদার্ণ উই রাজ্যের রাজধানী উই-এর একটি উঁচু প্রাসাদের উপর থেকে বিশালাকৃতির ঘুড়ির সাথে নিজেকে বেঁধে আকাশ ভ্রমণ করেন তৎকালীন রাজার ছেলে উয়ান হুয়াংতাও।

মুসলিম খলিফাদের আমলের প্যারাসুট ও গ্লাইডার

মুসলিম খলিফাদের শাসনামলেও বিভিন্ন সময়ে আকাশে উড্ডয়ন স্বপ্ন বিভিন্নভাবে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে থাকে অনেকেই। আমির আব্দুর রহমান (দ্বিতীয়) এর সময়ে তার সহায়তায় বিশিষ্ট মুসলিম বিজ্ঞানী আব্বাস ইবনে ফিরনাস আকাশে উড়বার বেশ কিছু প্রয়াস চালান। ৮৫২ সালে তিনি কাঠ, কাপড় ও পশমের তৈরি কাঠামো দিয়ে উড়বার উপযোগী ডানাসদৃশ বস্তু তৈরি করেন। এটি দেখতে কিছুটা ছাতার মতো হয়েছিল। এরপর তিনি তৎকালীন করডোবার (স্পেন) গ্র্যান্ড মসজিদের উঁচু মিনার থেকে লাফ দেন এবং বেশ সফলতার সাথে মাটিতে নেমে আসেন। এই ডানাকেই বর্তমানের আধুনিক প্যারাসুটের আদিরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।

06

এর ২৫ বছর আরও অনেক উন্নত গবেষণার পর আবার জাবাল আল-আরস পাহাড়ের উপর থেকে গ্লাইডার সদৃশ কাঠামো নিয়ে লাফ দেন। কিন্তু এবার এটি বিদ্ধস্থ হয়ে তিনি আহত হয়েছিলেন। কেননা এতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোনো লেজ ছিল না। তবে পরবর্তীতে ১০১০ সালে অনুরূপ সংশোধিত গ্লাইডার ব্যবহার করে ২০০ মিটার পর্যন্ত উড়বার রেকর্ড আছে।

রেনেসা যুগে অগ্রগতি

এর প্রায় ৬ শতাব্দি পর আরেকটি উন্নত উড্ডয়ন যন্ত্রের চিত্র অংকন করেন শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি সর্বপ্রথম আকাশে উড়ার একটি তাত্ত্বিক ধারণাও দেন। তার ডিজাইন করা গস্নাইডারে ডানার ভেতরের অংশ ছিল মূল কাঠামোর সাথে শক্তভাবে লাগানো। আর ডানার নড়তে সক্ষম অংশগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ওরনিথপ্টার’।
05
১৪৯৬ সালে তিনি এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। কেননা এ যন্ত্রের সাহায্যে আকাশে পাখির মতো মুক্তভাবে উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করা সম্ভব ছিল না সেই সময়। অনেকে অবশ্য বাহুবলেই এই যন্ত্রের সাহায্যে উড়তে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টায় কেউ সফল হয়েছে বলে শোনা যায়নি কখনো। কেননা মানুষের বুকের ও কাঁধের পেশীগুলো এই কাজ করার মতো যথেষ্ঠ শক্তিশালী নয়। ভিঞ্চির মৃত্যুর পর অনেকদিন আর আকাশে ডানা মেলার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

১৬৩০ সালের দিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ৬২.৫৯ মিটার উঁচু গালাতা টাওয়ার থেকে হিজাফেন আহমেদ সালাবী নামক এক ব্যক্তি নিজের তৈরি উডুক্কু এক যানে করে ৩ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৩৩ সালে তার আরেক ভাই হাসান সালাবী সাত ডানার এক রকেটে করে আকাশ উড্ডয়ন করেছিলেন। এর উপরের অংশ ছিল গান পাউডারে পূর্ণ। এটিই মানুষের বানানো প্রথম রকেট বলে মনে করা হয়। তিনি গান পাউডার শেষ হবার পর ডানাগুলোকে প্যারাসুটের মতো ব্যবহার করে নিরাপদেই অবতরণ করেছিলেন। তিনি আকাশে ছিলেন প্রায় ২০ সেকেন্ড আর ৩০০ মিটার মতো উঁচুতে উঠেছিলেন বলে জানা যায়।

বেলুন ভ্রমণের সূচনা

ডানা নিয়ে এতো কিছু করেও তেমন কোনো সফলতা না পেয়ে সপ্তদশ শতকের শেষ দিক থেকে মানুষ নজর দেয় বেলুন দিয়ে আকাশে উড্ডয়নের দিকে। কেননা প্রায় সবাইই সেই সময় জানতো যে, উত্তপ্ত বাতাস সাধারণ বাতাসের চেয়ে হাল্কা, তাই গরম বাতাস কোনো বড় বেলুনে ভরে রাখলে সেই বেলুনটি বাতাসে ভেসে থাকতে সড়্গম। এভাবে গরম বাতাস বেলুনে ভরে ১৭৮৩ সালে মানুষ সর্বপ্রথম আকাশে ভেসে বেড়াতে সক্ষম হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ফ্রান্সে। মন্টগোফিয়র ভ্রাতৃদ্বয়ের আবিস্কৃত বেলুনে চড়ে জেন ফ্রান্সিস ডি রোজিয়ার এবং ফ্রান্সিস লরেন্ট ডি’আরলান্দিস নামক দুই ব্যক্তি ৮ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন। বেলুনে গরম বাতাসের উৎস হিসেবে ছিল কাঠ জ্বালিয়ে পাওয়া ধোঁয়া। ঐ বছরেই হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি বেলুন নিয়ে মানুষ আকাশ ভ্রমণ করে ফেলে।

07
চিত্রঃ হেনরি গিফার্ডের বেলুন(১৮৫২)

এভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে বেলুন ভ্রমণ ইউরোপে বেশ জনপ্রিয় হয়। এ সময়ে উচ্চতা ও দিক পরিবর্তনে সক্ষম এমন বেলুনের উন্নয়ন সাধিত হতে থাকে। এরকম ইঞ্চিনচালিত প্রথম বেলুন যেটি আলোর মুখ দেখেছিল সেটি হচ্ছে হেনরি গিফার্ডের বেলুন। সময়কাল ১৮৫২, দেশ ফ্রান্স। ইঞ্জিন ছিল বাস্পচালিত। তিনি ২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়েছিলেন। আমেরিকায় সিভিল যুদ্ধের সময়তো সেনাবাহিনীর একটি বেলুন ইউনিটই ছিল।

08
চিত্রঃ লা ফ্রান্স এয়ারশীপ, ১৮৮৫ সালে তোলা ছবি
এরপর ১৮৮৪ সালে ফ্রান্সেই সেনাবাহিনী কর্তৃক বিদ্যুৎচালিত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণযোগ্য বেলুন, ‘লা ফ্রান্স’ উড্ডয়ন করানো হয়। এর নির্মাতা ছিলেন চার্লস রেনার্ড এবং আর্থার ক্রেবস। এটি ছিল ৫২ মিটার উঁচু, এর বেলুনের আয়তন ছিল ৬৬০০০ ঘন ফুট। এটি ৮টি.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে ২৩ মিনিটের মধ্যেই ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম ছিল। এর পর ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধেও বেলুনের ব্যবহার দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে সৌখিন কাজে ও পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য বেলুন ব্যবহৃত হয়।

গ্লাইডার সমাচার

বেলুন হচ্ছে বাতাসের চেয়ে হাল্কা। আর বাতাসের চেয়ে ভারী কোনো উড়ুক্কু যান সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭১৬ সালে, ‘স্কেচ অফ এ মেশিন ফর ইন দা এয়ার’। লিখেছিলেন ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ। তিনি এই বইয়ে তার ফ্লাইং মেশিনের বর্ণনায় বলেছিলেন এটি হাল্কা কাঠামোর শক্ত ক্যানভাসে ঢাকা একটি যন্ত্র যার দু’টি বড় ডানা ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন যে, এই কাঠামো আকাশে উড়বার মতো প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেবার মতো ব্যবস্থা এতে ছিল না। তবে তিনি আশা করেন ভবিষ্যতে কেউ না কেউ এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।

গ্লাইডার হচ্ছে বাতাসের চেয়ে ভারী উড়ুক্কু যান নির্মানের প্রথম ধাপ। এটি বাতাসের চেয়ে ভারী এক ধরনের ইঞ্জিনবিহীন ডানা ও লেজবিশিষ্ট উড়োজাহাজ। গস্নইডারকে বাহ্যিক শক্তির সাহায্যে একবার উড়িয়ে দিলে বা উঁচু পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়লে এটি তার নিজস্ব বড় ডানায় ভর করে অনেকক্ষণ ধরে বাতাসে ভেসে বেড়াতে সক্ষম।

এরপর ১৭৯৯ সালে স্যার জর্জ ক্যালে প্রথম আধুনিক গ্লাইডারের মডেল উপস্থাপন করেন। এতে আলাদা লেজ ছিল দিক নিয়ন্ত্রণের জন্য। এই মডেল সর্বপ্রথম আকাশে উড়ে ১৮০৪ সালে। এর পরের অনেক বছর তিনি আরও উন্নত গ্লাইডার আবিষ্কারের জন্য চেষ্টা করে যান। তিনিই সর্বপ্রথম এরোডাইনামিক্সের অনেক সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করেন এবং Lift (উত্তোলন বল), Drag (রোধক বল) ইত্যাদি শব্দের সূচনা করেন। তিনি পরে তার গ্লাইডারে গান পাউডার দিয়ে চালিত ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল ইঞ্জিন স্থাপন করেন। পরে অবশ্য এলফন্স পেনাউড নামের আরেক ব্যক্তি জ্বালানী হিসেবে রাবার পাউডার ব্যবহার করে এই ইঞ্জিনকে আরও আধুনিক করে তোলেন। ১৮৫৩ সালে জর্জ ক্যালে তার আবিষ্কৃত গস্নাইডার ব্যবহার করে বেশ সফলতার সাথেই ছোটখাট আকাশ ভ্রমণ করে ফেলেন।

১৯০১ ও ১৯০৩ সালে দুটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইড পরিচালনা করলেও এগুলোর ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা তেমন আশানুরূপ ছিল না। পরে তিনি ৫২ হর্সপাওয়ারের দুটি শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে পরীক্ষা চালালেও তার এই মডেল এইক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখেনি; সাথে প্রথম উডুক্কু যান নিয়ে আকাশে উড়বার কৃতিত্ব অর্জন করেন।

23
অরভিল রাইট

22

উইলবার রাইট

অরভিল রাইট আর উইলবার রাইট নতুন করে তাদের পরিচয় করিয়ে দেবার আর কিছু নেই। উড়োজাহাজের আবিষ্কারক হিসেবে পৃথিবীবাসী চিরকালের জন্য স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছে তাদের নাম। তাদের শুরুটাও হয়েছিল গ্লাইডার দিয়েই। তারা সে আমলেই পাঁচ হাত লম্বা আর দুই হাত প্রশস্ত একটি সুড়ঙ্গ (উইন্ড টানেল) তৈরি করে এর মধ্যে দিয়ে প্রবল বেগে বাতাস প্রবাহিত করে বিভিন্ন ধরনের গ্লাইডার সম্ভাব্য সব উপায়ে সেখানে উড়িয়ে দেখেন।

24
চিত্রঃ রাইট ভ্রাতৃদ্বয় তাদের গ্লাইডার নিয়ে, বামের ছবিটি ১৯০১ সালের পরেরটি ১৯০২ সালের

অবশেষে উড়োজাহাজের উড্ডয়ন

এরপর তারা আকাশযানের নিয়ন্ত্রণ ও এর উড্ডয়নের শক্তির উৎস কি হবে তা নিয়ে নিরলস গবেষণা করতে থাকেন। এ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে অবশেষে তারা ‘ফ্লায়ার ওয়ান’ নামে একটি উড়োজাহাজ নির্মাণে সক্ষম হন।
12
চিত্রঃ ফ্লায়ার ওয়ানের প্রথম ফ্লাইট, চালকের আসনে অরভিল রাইট, নীচে উইলবার রাইট
পরে এর জন্য উপযুক্ত একটি পেট্রোল চালিত ইঞ্জিন নির্মাণেও তারা সফল হন। অবশেষে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার কিল ডেভিল হিলস-এ ১৯০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারা ফ্লায়ার ওয়ানের সফল উড্ডয়ন করান। প্রথম ফ্লাইট-এর পাইলট ছিলেন অরভিল রাইট। তিনি প্রথম ফ্লাইটে ১২ সেকেন্ড ৩৭ মিটার পথ পাড়ি দেন। একই দিনের চতুর্থ ফ্লাইটে উইলবার রাইট ৫৯ সেকেন্ডের ফ্লাইটে ২৬০ মিটার পথ পাড়ি দেবার কৃতিত্ব দেখান। চারটি ফ্লাইটই মাটির ১০ ফুট উপর দিয়ে পরিচালনা করা হয়। প্রথম উড্ডয়নে আকাশযানের সামনের রাডার বহনকারী কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মূল কাঠামো সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল।
27
চিত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার এন্ড স্পেস জাদুঘরে ফ্লায়ার মডেলটি এখনো সংরক্ষিত আছে

পরের দুই বছর তারা এই আকাশযান নিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা চালাতে থাকেন। কোনো অভিযানই অবশ্য মিনিটখানেকের বেশি স্থায়ী হয়নি। তবে ১৯০৫ সালের ১৪ জুলাই এক দূর্ঘটনার পর তারা তাদের ফ্লায়ার-এর মডেল বেশ কিছুটা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। তারা তাদের ফ্লায়ারের এলিভেটর ও রাডারের আকার দ্বিগুণ করেন এবং মূল কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন এনে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংশোধন করেন। নতুন ফ্লায়ারের নাম দেয়া হয় ‘ফ্লায়ার-৩’। ১৯০৫ সালের ৫ অক্টোবর উইলবার রাইট ৩৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ডে ২৪ মাইল পথ পাড়ি দেবার গৌরব অর্জন করেন।
26
চিত্রঃ ফ্লায়ার-৩, ১৯০৫ সালের ছবি
এরপর ১৪ মে, ১৯০৮.উড়োজাহাজ আবিষ্কারের দিন হিসেবে অফিশিয়ালি এটিকেই স্মরণ করা হয়। এ সম্পর্কে অন্য আরেকদিন বিস্তারিত বলব।
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮ অরভিল রাইট গড়েন মর্মান্তিক এক ইতিহাস। ভার্জিনিয়ার ফোর্ট মেয়ারে সেনাবাহিনীর এক পরীক্ষণের সময় তার উড়োজাহাজ বিধ্বস্থ হলে সহযাত্রী থমাস সেলফ্রিজ মৃত্যুবরণ করেন।
21
চিত্রঃ ১৯০৮ সালে ফোর্ট মেয়ারে দূর্ঘটনার ছবি
এর আগেই অবশ্য রচিত হয়েছিল নতুন এক ইতিহাস। থেরেস পেলচায়ার প্রথম মহিলা যাত্রী হিসেবে আকাশে উড্ডয়নের সৌভাগ্য অর্জন করেন। আর রেমন্ড ডা ল্যারোচে হচ্ছেন প্রথম মহিলা চালক যিনি ১৯০৯ সালের ২২ অক্টোবর আকাশে উড্ডয়ন করেন। তিনিই মেয়েদের মধ্যে প্রথম পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছিলেন।

এভাবেই রাইট ভ্রাতৃদ্বয় সারাবিশ্বে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য। তবে একটি বিষয়ে তারা ভুল করেছিলেন। তারা ঠিকভাবে উড়োজাহাজ উড়াতে পারলেও পারেননি তাদের আকাশযানের ভবিষ্যত নির্ণয় করতে উইলবার রাইট একবার মন্তব্য করেছিলেন-

‘এই উড়োজাহাজ ভবিষ্যতে মানুষের স্থল যোগাযোগের বিকল্প হবে এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা শুধু বিশেষ উদ্দেশ্যেই এর ব্যবহার সীমিত থাকবে। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে। আর ডাক আদান-প্রদানেও এটি কাজে আসতে পারে’ তবে এই ভুল ভবিষ্যতবাণীর জন্য উইলবার রাইটের তেমন কোনো আফসোস আছে বলে আমার মনে হয় না পাঠক। আপনি কি বলেন?
25
চিত্রঃ ১৯১০ সালে রাইট ভাতৃদ্বয় কর্তৃক ব্যবহৃ্ত ইঞ্জিন

**উপরের লিখাটি আমার ‘সহজ করে উড়োজাহাজ’ বই থেকে নেয়া। বইটা আগামী বইমেলায় প্রকাশ হবার কথা রয়েছে। টেকটিউনসের জন্য কিছুটা পরিবর্তন করে লিখলাম। যদি টেকটিউনসে এই লিখা বই বের আগেই প্রকাশের জন্য কপিরাইটজনিত কোন সমস্যা হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে এডমিন প্লিজ আমাকে জানাবেন। উল্লেখ্য যে এখানে(অনলাইনে) প্রকাশের ব্যাপারে আমার পাবলিকেশন্স থেকে অনুমতি নেয়া আছে।

Level New

আমি সেতু। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 16 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 47 টি টিউন ও 466 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

আছি কম্পিউটার আর ইন্টারনেটকে সাথে নিয়ে।ভালোবাসি নতুন আর আনকোরা সফটওয়ার নিয়ে কাজ করতে।ভালো লাগে হার্ডওয়ার নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে।পড়ছি বুয়েটে।কাজ করছি টেকনোলজি টুডে'র সহকারি সম্পাদক হিসেবে।কম্পিউটার-এর জগতে শুধু ঘুরেই বেড়াচ্ছি গত প্রায় ১২/১৩ বছর ধরে।কম্পিউটার নিয়েই কাজ করছি ৮/৯ বছর ধরে।জড়িত আছি বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সাইট-এর সাথে।মোটামুটি দেশীয় কম্পিউটারের সবক্ষেত্রেই নজর রাখতে...


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

বেশ কিছু দিন পর আপনার শিক্ষনীয় টিউনটি পেলাম। ধন্যবাদ , সেই সাথে পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা।

    Level New

    ধন্যবাদ।
    আপনারা চাইলে বইয়ের বাকী অংশ আরো ২/৩ খন্ডে ভাগ করে টেকটিউনে শেয়ার করতে পারি।

eid mubarak & thanx for this tune

জি ভাই নিশচিনতে আপনার বাকিটুকু শেয়ার করেন।আর ভাই এই ইদের আগাম শুভেচছা।

Level 0

অসাধারন। বস উইকিপেডিয়ায় এই লেখাটা দেওয়া যায় কিনা দেখবেন একটু? “উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ইতিহাস” ভাল কোন লেখা খুজে পেলাম না।

অসাধারণ। খুবই ভাল লেগেছে আপনার টিউনটি।
ধন্যবাদ।

অসাধারন।। উইকি তেও এমন বর্ণনা দেয়া নাই

অসাধারণ! এই পোস্ট স্টিকি হয়নাই আগে ভাবাই যায়না।

এতদিন পর এসে লেখাটি নির্বাচিত করা হল !!!!!!! অসাধারন লেখা । ভাই আপনার পরের লেখাটার জন্য অপেক্ষা করলাম ( অবশ্য আগে করেছেন কি তা জানি না) । ধন্যবাদ।

অসাধারন এক টিউন। এত দিন চোখে পড়েনি।

অসাধারন এক টিউন

খুব সুন্দর হয়েছে। একদম অসাধারন টিউন। এরকম টিউন ই তো চাই…………আর হ্যা অসংখ্য ধন্যবাদ এই সুন্দর টিউন উপহার দেওয়ার জন্য।

Level 0

very informatics . thnaks

অনেক পরিশ্রমে সাজানো গোছানো টিউন। অসংখ্য ধন্যবাদ।

খুব সুন্দর হয়েছে । আমি ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণীতে এ থাকতে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এক বইয়ে অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট এর উড়োজাহাজ তৈরি সম্পর্কে পড়েছিলাম । বইটিতে তাদের ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন কার্যাবলী খুব সুন্দর করে গল্প আকারে দেওয়া ছিল । বইটি আমার কাছে খুব সুন্দর লেগেছে । আমার মনে হয় আপনাদের কাছেও বইটি ভাল লাগবে । আপনারা ইচ্ছে করলে বইটি কালেকশন করে পড়ে নিতে পারেন ।

Level 0

অসাধারন এক টিউন। সাজানো গোছানো ।
অসংখ্য ধন্যবাদ।

ভাল লাগল।

Level 0

priote nilam.thanks