মনে পড়ে স্পাইডারম্যান সিনেমার সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য; যেখানে ডক্টর অক্টোপাস নিজের শরীরের সাথে সংযুক্ত ৪ টা "হাতের" সাহায্যে স্পাইডারম্যানের সাথে মারামারি করতে করতে উঠে যাচ্ছে অট্টালিকার দেয়াল বেয়ে? কিংবা সেই ৪ টা যান্ত্রিক হাতকে একসাথে চালনা করে দ্রুত সম্পন্ন করছে জটিল যন্ত্রাংশ জোড়া লাগানোর কাজ | তার ভাবনার সাথে সাড়া দিয়ে ওই কৃত্রিম হাতগুলো কিলবিল করে নানারকম কাজ সম্পন্ন করে যাচ্ছে |
কিংবা surrogate সিনেমার কথা? যেখানে আসল মানুষ শুয়ে থাকে যান্ত্রিক ক্যাপসুলের মধ্যে; তার বদলে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে হুবহু মানুষের মতই দেখতে কৃত্রিম মানুষ | আসল মানুষ সেই ক্যাপসুলে শুয়ে শুয়েই নিঁখুতভাবে চালনা করছে সেই যান্ত্রিক মানুষদের | সেই যান্ত্রিক মানুষরা যেখানে যাচ্ছে, যা করছে, যা শুনছে সব বুঝতে পারছে, শুনতে পারছে, দেখতে পারছে সেই ক্যাপসুলে শুয়ে থাকা আসল মানুষরা | সমস্ত পৃথিবীতেই তখন আর আসল মানুষরা আর কোনো কাজ না করে ঐভাবে surrogate দের সাহায্যে পৃথিবী চালায় | আর ভয়ংকর বিপদ নেমে আসে মানব প্রজাতির ওপর | সেটা অবশ্য আলাদা প্রসঙ্গ |
এই ধরনের আরো অনেক সিনেমা রয়েছে | কিন্তু এই সব সিনেমারই যে ধারণার উপর ভর করে অগ্রসর হয়েছে সেটা হলো মানুষের মস্তিস্কের সাথে যান্ত্রিক কম্পিউটারের যোগাযোগ বা সমন্বয় সাধন | অর্থাৎ, মানুষ যা যা ভাববে, সেই ভাবনাগুলো সিগনাল হিসাবে নেবে কম্পিউটার আর সেই নির্দেশাবলী অনুসারে চালাবে কোনো কৃত্রিম যান্ত্রিক system | মানুষ সেই সিস্টেমটা কে যেভাবে চালাতে চাইবে ঠিক সেভাবেই চলবে সেটা | তার জন্য মানুষটা কে নড়াচড়া করতে বা কথা বলতে হবেনা | শুধু ভাবলেই হবে মনে মনে |
এই ধারণার পেছনে আছে খুব সাধারণ একটা মূলনীতি | মানুষের মস্তিস্কের কার্যপ্রণালীও তড়িত-চুম্বকীয় সিগনালের ওপর নির্ভরশীল আর কম্পিউটারেকেও চালনা করে সেই তড়িত-চুম্বকীয় সিগনাল | অবশ্য নিখুঁত ভাবে বলতে গেলে মানুষের মস্তিস্কে তড়িত-রাসায়নিক প্রভাবও আছে |
মানুষের মস্তিস্কের গঠনগত একক হলো নিউরন (বিস্তারিত জানার জন্য https://www.techtunes.io/reports/tune-id/84234) | এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনে তড়িত তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে মস্তিস্ককে চালনা করে | যেকোনো মানবিক অনুভূতিই ধরা যাকনা কেন, সেটা আসলে মস্তিস্কের ভেতরের ইলেকট্রিক সিগনালের প্রবাহের ফলেই ঘটে থাকে |
এবার কল্পবিজ্ঞানের ধারনাতে যদি এই প্রবাহকে কম্পিউটারের ইনপুট হিসাবে দেয়া যায় তাহলে ওই কম্পিউটার ওই ইনপুট সিগনালের সাহায্যে কোনো রোবটিক সিস্টেমকে চালাতে সক্ষম | আবার একইভাবে উল্টোটাও সম্ভব | অর্থাৎ, ধরা যাক আমরা যখন কিছু দেখি তখন কি ঘটে | আমাদের চোখের ভেতর দিয়ে আলো প্রবেশ করে সেই আলো রেটিনাতে পড়ে | রেটিনার পেছনের আলোকসংবেদী স্নায়ুকোষ সেই আলোকসম্পাতকে ইলেকট্রিক সিগনালে পরিনত করে পাঠায় মাথার ভেতরে | নিউরন থেকে নিউরনে সেই সিগনাল প্রবাহিত হয়ে মস্তিস্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে গিয়ে পৌছায় আর তার ফলে সৃষ্টি হয় দর্শনের অনুভূতি | এবার কোনো ক্যামেরা থেকে পাওয়া আলো যদি কম্পিটারের সাহায্যে ইলেকট্রিক সিগনালে পরিনত করে কোনভাবে সেই তরঙ্গ পৌছানো যায় কোনো অন্ধ মানুষের মস্তিষ্কের সেই বিশেষ অঞ্চলে, তাহলে অনায়াসেই সেই মানুষটি চোখ না থাকা সত্বেও দেখতে পাবে বাইরের পৃথিবী |
কতটা বাস্তবতা আছে এই ধারণার পেছনে? কতটা বিজ্ঞানভিত্তিক এই কাল্পনিক ভবিষ্যতের ধারণা? দেখা যাক |
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই কৌতুহলুদ্দীপক ধারণা নিয়ে পৃথিবীর গবেষণাগারে জোরেশোরে কাজ চলছে | মানুষের মস্তিষ্কের সাথে কম্পিউটারের এই সমন্বয়কে বলা হচ্ছে Brain - Computer Interface বা সংক্ষেপে BCI (এর সঠিক বাংলা করা এই মুহুর্তে সম্ভব নয় বলে এই লেখার পরবর্তী অংশে এটাকে BCI বলেই লেখা হবে) | দেখা যাক এই BCI কতটা সম্ভাবনাপূর্ণ, এর সীমাবদ্ধতাই বা কোথায়, কতটা প্রভাব ফেলতে পারে এটা মানবজীবনে |
সত্যিকারের Brain - Computer Interface নিয়ে কাজ শুরু হয় ১৯৭০ এর দিকে University of California Los Angeles এ | কিন্তু এর সূত্রপাত হয়ে গেছিল ১৯২৪ সালে, যখন বিজ্ঞানী Hans Berger আবিষ্কার করেন মানব মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের কার্যকলাপ | তিনিই সেই তড়িত সংকেত মাপা বা সনাক্ত করার জন্য EEG (electroencephalography) অর্থাৎ "ইলেক্ট্রো-এনসেফালো-গ্রাফি" উদ্ভাবন করেন | যদিও তার যন্ত্র অনেক কাঁচা ছিল কিন্তু সেই যন্ত্রের সাহায্যেই তিনিই প্রথম মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ রেকর্ড করেন |
একটু ব্যাপক ভাবে বলতে গেলে BCI আসলে Neuroprosthetics (নিউরো-প্রস্থেটিকস) এর অন্তর্গত | Neuroprosthetics এ মানুষের ক্ষতিগ্রস্থ বা বিনষ্ট স্নায়ু/স্নায়ুতন্ত্রের বদলে কৃত্রিম স্নায়ু ব্যবহার করে বিভিন্ন সংবেদী অঙ্গকে মেরামত করা | পার্থক্য হলো, Neuroprosthetics এ শরীরের যেকোনো স্থানের স্নায়ু নিয়ে কাজ করা হয় আর BCI শুধু মস্তিষ্কের তরঙ্গ নিয়েই কাজ করে | কিন্তু বর্তমানে BCI গবেষণা এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে এই শব্দ দুটো একই অর্থবহ হয়ে উঠেছে |
আগেই বলা হয়েছে এই BCI এর ধারণা এসেছে মানব মস্তিষ্কের মূল কার্যনীতি থেকে | মস্তিস্ক অসংখ্য নিউরনের সমন্বয়ে গঠিত | আর প্রতিটি নিউরন পরস্পরের সাথে সংযুক্ত Axon আর Dendrites দ্বারা | যখনই আমরা কিছু অনুভূতি পাই বা কোনো নড়াচড়া করি বা কিছু মুখস্থ করি; আমাদের নিউরনগুলো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে | ওই বিভিন্ন কাজের অনুভূতিগুলো ছোট ছোট ইলেকট্রিক সিগনাল হিসাবে প্রবাহিত হতে শুরু করে নিউরন থেকে নিউরনে; ঘন্টায় প্রায় ২৫০ মাইল গতিতে! প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যেকোনো তড়িত সংবহন তন্ত্রের মতই কাজ করে এই নিউরন গুলো | একেকটা নিউরনে আলাদা আলাদা তড়িত বিভব থাকে, আর এই বিভব পার্থক্যের ফলেই এই নিউরন থেকে আরেক নিউরনে তড়িত সংবহন হয় |
ফেরা যাক মূল প্রসঙ্গে | তড়িত প্রবাহের সময় তড়িত ক্ষরণের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই নিউরন গুলো কারেন্টের তারের মতই কুপরিবাহী একধরনের পাতলা চাদর দ্বারা আবৃত থাকে; যাকে বলা হয় Myelin Seath | কিন্তু সুরক্ষা আবরণী দিয়ে আবৃত থাকা সত্বেও কিছু কিছু তড়িত প্রবাহ ক্ষরিত হয়ে যায়ই | বিজ্ঞানীরা একে বলেন "escaped electric signal" | বিজ্ঞানীরা এই ক্ষরিত প্রবাহ বিশ্লেষণ করে বের করেন এরা মস্তিস্কের যে অঞ্চল থেকে আসছে সেটা কিভাবে এই প্রবাহের সাথে সম্পর্কিত | এবং এই সম্পর্কের সাহায্যেই BCI এর ধারণা বাস্তব করা সম্ভব বলে মনে করা হয় |
BCI এর সবচেয়ে বড় সমস্যা এটি নিজেই | অর্থাৎ, মানুষের মস্তিস্ক থেকে ক্ষরিত ইলেকট্রিক সিগনাল ধরা হবে কি করে? এর আপাতত সবচেয়ে সোজা সমাধান হলো EEG (electroencephalography) | এখানে বিশেষ ধরনের তড়িত গ্রাহক বর্তনী বা electrode ব্যবহার করা হয় | এই গ্রাহকগুলো মাথার খুলির সাথে আটকানো থাকবে আর ভেতরের ইলেকট্রিক সিগনাল ধরার চেষ্টা করবে | যেহেতু মানুষের শক্ত পুরু খুলির ভেতর থেকে ওই ক্ষীন প্রবাহ ধরতে পারা খুবই কঠিন তাই ওই electrode গুলোকে হতে হবে ভীষণ সংবেদী |
এছাড়াও যদি EEG electrode গুলোকে সরাসরি মস্তিষ্কের gray matter এর মধ্যে প্রতিস্হাপন করা যায় কিংবা EEG electrode গুলোকে খুলির ভেতরের দিকে মস্তিষ্কের সংস্পর্শে স্থাপন করা হলেও অনেক জোরালো সিগনাল পাওয়া সম্ভব | অবশ্যম্ভাবীভাবেই এই পদ্ধতির অনেক ঝামেলা আছে | এর জন্য মস্তিস্কের সার্জারী হতে হবে অত্যন্ত উন্নত | electrode র মান হতে হবে অন্যরকম যাতে ওটা জীবন্ত স্নায়ুর সংস্পর্শে এসে নিজেকে বা ওই স্নায়ুকোষকে নষ্ট না করে ফেলে |
এই সমস্যা ধরা না হলে বাকি নীতিটা খুব সরল | ওই electrode গুলো নিউরনের সুক্ষ্ম বিভব পার্থক্য ধরবে, সেটাকে বর্ধিত (amplify) করবে, কম্পিউটার ইনপুট এর জন্য তৈরী করবে আর নির্দিষ্ট সিস্টেমে পাঠিয়ে দেবে | অথবা উল্টো দিক থেকে হলে বাইরের সিস্টেম থেকে পাওয়া ইলেকট্রিক সিগনালকে নিউরনের জন্য তৈরী করে পাঠিয়ে দেবে মস্তিস্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে |
BCI গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে সেটা হলো, এমন একটা যন্ত্র বের করা যেটা মানুষের ভাবনার মাধ্যমে চলবে | হয়ত কোনো ভিডিও গেম বের করা যেটা ভেবে ভেবে খেলা যাবে বা টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোলার যেটা দিয়ে ভেবে ভেবে টিভি বন্ধ করা যাবে, "আওয়াজ বাড়ুক" ভাবলেই টিভির শব্দ বেড়ে যাবে!
আরো বৃহত্তর ক্ষেত্রে এটার আরো দারুন দারুন সম্ভাবনা রয়েছে | ধরা যাক কোনো মানুষের কনুই এর কাছের কোনো নার্ভ নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তার মস্তিস্ক থেকে আসা ইলেক্ট্রনিক আদেশ হাতের বাকি অংশে যেতে পারছেনা, ফলে মানুষটা হাতটা নড়াচড়া করতে পারছেনা | এবার যদি তার কনুই এর কাছে BCI নিয়ন্ত্রিত electrode বসিয়ে দেয়া হয় যেটা নষ্ট স্নায়ুর জায়গাতে বসে দুপাশের সুস্থ্য স্নায়ুর সাথে সংযোগ সাধন করবে; তাহলে মানুষটা এবার যখন ভাববে যে হাত নাড়াতে হবে, তখন সেই সিগনাল মস্তিস্ক থেকে এসে আগের মতো আর কনুই এর কাছে থেমে না থেকে হাতের বাকি অংশে সঞ্চালিত হবে; আর মানুষটা অনায়াসে হাত নাড়াতে পারবে |
কিংবা ধরা যাক ওই মানুষটার কনুই এর কাছে থেকে কাটা পড়ে গেছে দুর্ঘটনার ফলে | এবার ওই কনুই এর সাথে একটা BCI নিয়ন্ত্রিত robotic arm লাগিয়ে দেয়া হলো | এবার মানুষটা যখন হাত টা নাড়াতে চাইবে, তখন সেই সিগনাল এসে পৌছাবে রোবটিক অংশের BCI র কাছে | BCI এর software জানে এই সিগনালটা হাত নাড়ানোর সিগনাল | সেটা তখন অনায়াসে রোবটিক আর্ম টা কে নাড়াতে শুরু করবে (terminator সিনেমার কথা মনে পড়ছে?) | ব্যাপারটা শুনতে সরল মনে হলেও এর পেছনে অনেক জটিল ঘটনা রয়ে যাচ্ছে | সব মানুষের হাত নাড়ানোর সিগনালের প্রাবল্য সমান নয় | এক্ষেত্রে ওই BCI র মধ্যে কিছুটা হলেও self teaching algorithm থাকতে হবে |
এবার প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়েছে কি না পরীক্ষাগারে |
১৯৯৯ সালে, University of California, Berkeley র গবেষকদল বেড়ালের মস্তিষ্কের থ্যালামাসে (মস্তিষ্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি মস্তিষ্কে আগত সমস্ত ধরনের সিগনালকে সমন্বয় করে) EEG electrode বসিয়ে তার থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বিড়াল যা দেখছিল সেটাকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেন | ছবিতে বোঝা যাচ্ছে তাদের সফলতার পরিমান |
২০০০ সালে Duke University, Durham, North Carolina র অধ্যাপক Miguel Nicolelis একটা পরীক্ষা চালান বিশেষ এক প্রজাতির বাঁদরদের নিয়ে | পরীক্ষাধীন এই বাঁদরদের দিয়ে একটা joystick controlled robotic arm চালানো হয় | অর্থাৎ, প্রথমে বাঁদরদের হাতে দেয়া হয় একটা জয়স্টিক | বাঁদররা সেটা নাড়ালে সেটার সাথে সংযুক্ত একটা robotic arm সেই সংকেতে সাড়া দেয় | পরীক্ষার পরের ধাপে এরপর বাঁদরের হাতে জয়স্টিকটা থাকে ঠিকই কিন্তু সেটার সাথে আর robotic arm টার কোনো যোগাযোগ থাকেনা | তার বদলে ওই robotic arm এর সাথে সংযোগ সাধন করানো হয় বাঁদরের মাথায় লাগানো electrode এর সাথে | এবার বাঁদর যখন জয়স্টিক নাড়াচ্ছে তখন তার মাথার ভেতরে এটার জন্য সংকেত তৈরী হচ্ছে; সেই সংকেতটা গ্রহণ করছে বাঁদরের মাথায় লাগানো EEG electrode আর চালনা করছে robotic arm টা কে |
এই ধরনের পরীক্ষা মানুষকে নিয়েও চালানো হয়েছে | যেখানে BCI সংযুক্ত করে মানব মস্তিস্ক আর একটা কম্পিউটার মনিটরকে | মানুষ ভেবে ভেবে কম্পিউটার স্ক্রীন এর cursor টা কে ডানে, বাঁয়ে, ওপরে. নিচে সরাতে সক্ষম হয় | এবং অনেক চেস্টার পর একটা মোটামুটি বৃত্ত আঁকতেও সক্ষম হয় | শীঘ্রই হয়ত আমরা দেখতে পাব নতুন android application ; যেটা ব্যবহার করে কেউ ভেবে ভেবেই SMS লিখে ফেলবে |
BCI গবেষণার সবচেয়ে সহজ এবং বহুলপ্রচলিত প্রমান হলো Cochlear Implant (ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট) |
মানুষের কানে যখন কোনো শব্দ ঢোকে তখন সেই শব্দ তরঙ্গ কানের ভেতরে অনেক ছোট ছোট প্রত্যঙ্গের মধ্যে দিয়ে গিয়ে Cochlea নামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সাহায্যে প্রবেশ করে auditory nerve (শ্রবণ স্নায়ু) এ | কোনো কারণে হয়ত দেখা যায় কোনো মানুষের কানের কোনো বিশেষ অংশ নষ্ট হয়ে গেছে অথচ শ্রবণ স্নায়ু ঠিক আছে | যার ফলে শ্রবণ স্নায়ু সিগনাল পায়না বলে মানুষটা শুনতে পায়না | ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট এ ওই নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশকে bypass করা হয় BCI এর সাহায্যে | বাইরের থেকে আসা শব্দের সংকেত খারাপ অংশকে এড়িয়ে পৌঁছে যায় auditory nerve এ | মানুষটি শ্রবণ ক্ষমতা ফিরে পায় |
ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে বিশ্ব জুড়ে এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট পদ্ধতি ব্যবহার করছেন ২২০০০০ জন মানুষ
অন্ধ মানুষের ক্ষেত্রে ঘটনাটা আরেকটু কঠিন হয়ে দাড়ায় | মানুষের "দর্শন" ব্যাপারটা শ্রবনের থেকে অনেক বেশি জটিল প্রক্রিয়া | কৃত্রিম চোখ এখনো মানুষের আসল চোখের ধারেকাছেও আসতে পারেনি | তাই এক্ষেত্রে BCI অনেকটাই অসহায় | তবে পরীক্ষা সফল নয় এটা মোটেও বলা যাবেনা | হয়ত নিঁখুত নয়, কিন্তু visual BCI সক্ষম হয়েছে অন্ধ মানুষকে বাইরের জগত দেখাতে |
এই পরীক্ষা প্রথম করা হয় ১৯৭৮ সালের দিকে | কৃত্রিম চোখ হিসাবে এখানে ব্যবহার করা করা হয় চশমা বা সানগ্লাসের ওপর বসানো খুদে ক্যামেরা | আর পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা করে visual BCI |
Jerry নামে এক ব্যক্তি বড় হওয়ার পর অন্ধ হয়ে যান | তার অপটিক নার্ভ গুলো অবশ্য ঠিকই ছিল | বিজ্ঞানী William Dobelle আর তার দল জেরির মাথাতে একটা single array BCI বসান যাতে ৬৮ টা EEG ছিল | আর একটা বিশাল আকারের ২ টন ওজনের একটা mainframe computer ব্যবহার করে জেরির মস্তিষ্কে "আলো ছাড়া আলো দেখার অনুভূতি" জাগাতে সক্ষম হন যেটাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলা হয় phosphenes |
আমরা প্রায় সবাই কখনো না কখনো এই phosphenes দেখেছি | আশ্চর্য লাগছে? মাথায় চোট লেগে গেলে অনেক সময় চোখের সামনে সাদা সাদা ফুটকি নাচতে দেখেনি আমরা? অথবা চোখ বন্ধ অবস্থাতে জোরে জোরে চোখ চুলকানোর পর বা কোনো কারণে চোখের ওপর জোরে চাপ লাগার ফলে আমরা দেখিনি যে অন্ধকারে সাদা সাদা ফুটকি চমকে চমকে উঠছে? এটাই সেই phosphenes
William Dobelle এর দল অবশ্য পরে এই vision system কে বহনযোগ্য করে দেন | এটার সাহায্যে আসলে jerry বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন অবস্থানে ওই ফুটকি দেখতে পান | অনেক প্র্যাকটিসের পর ওই ফুটকির অবস্থান থেকে ওটা আসলে কি বস্তু সেটা নির্ধারণ করতে শেখেন তিনি |
২০০১ সালে এই ভিশন সিস্টেম ব্যবহার করে jerry একটা ঘরের মধ্যে একটা দেয়ালে টাঙানো টুপি সনাক্ত করে, হেঁটে গিয়ে সেটাকে নামাতে সক্ষম হন এবং অন্যদিকে থাকা একটা মানুষ-পুতুলের (mannequin) অবস্থান সনাক্ত করে সেটার মাথায় টুপিটা পরিয়ে দিতেও সক্ষম হন | এর জন্য তার নাম Guinness Book of Records এও ওঠে |
তারপরে প্রকৌশলের উন্নতির সাথে সাথে পরীক্ষাধীন অন্ধ মানুষের "বহির্জগত" অনেক পরিষ্কার হয়েছে |
এই পরীক্ষার ভলান্টিয়ারদের 2nd generation এর একজন হলেন New York এর বাসিন্দা Jens Naumann | অবশ্য এই ভলান্টিয়াররা paid, অর্থাৎ তাদের নিজেদের ব্যয় বহন করতে হয় নিজেদের ওপর পরীক্ষা চালাতে দেয়ার জন্য | এদের ১৬ জনের দলে মধ্যে তিনি প্রথম সফল 'গিনিপিগ' | তাদের সময়ে ব্যবহৃত BCI এর মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কে phosphenes টা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠলো | তারা যেটা দেখতে পেলেন সেটাকে বিজ্ঞানীরা বলেন "The Starry-night effect" | তার মস্তিষ্কে সফল অস্ত্রপচারের পরই তিনি research institute এর parking lot এ ধীরে ধীরে হলেও গাড়ি চালাতে সক্ষম হন |
তিনি এই ব্যবস্থার সাহায্যে এখন New York এর subway তেও ঘুরে বেড়াতে পারেন! যদি কল্পবিজ্ঞানের বাস্তবতার কথা জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে এর থেকে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে!?
মজার ব্যাপার হলো, "Star trek : The Next Generation" সিনেমা/সিরিয়ালে অন্ধ ইঞ্জিনিয়ার অফিসার Geordi La Forge যে ধরনের কাল্পনিক চশমা পরেছিলেন, বর্তমানের Jens Naumann এর ব্যবহার করা BCI visual system এর সাথে এর ভীষণ মিল রয়েছে! এর কারণ অবশ্য এটা বোধহয় যে, ঐরকমের অনুষ্ঠানের নির্মাতারা বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলেই ঐসব design করে থাকেন |
BCI সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য জানার আগে একটু জেনে নেয়া যাক যে এর সামনে কঠিন বাধা গুলো কি কি :
১. এখন BCI গবেষণার প্রস্তরযুগ চলছে বলা যায় | এখন এটুকুই ধরে নেয়া হয় যে, "মস্তিস্কে ঘটিত সমস্ত প্রক্রিয়া আসলে ইলেকট্রিক সিগনাল মাত্র" | প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরনের সমন্বয়ে তৈরী যে মস্তিষ্কের ভেতরে নিরন্তর বিদ্যুত, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, নানারকমের অনুঘটকের অসাধারণ লীলাখেলা চলছে; বিস্ময়কর রকমের জটিল network এর এই মস্তিস্ক সম্পর্কে উপরোক্ত ধারণা নেহাতই মোটা দাগের | কিন্তু পরীক্ষার স্বার্থে এইরকম সরলীকরণের প্রয়োজন আছে বৈকি | মস্তিষ্কের কাজ পুন্খানুপুন্খ ভাবে না বোঝা পর্যন্ত BCI system সম্পূর্ণ হবেনা | আর সেই দিন এখনো অনেক দেরী |
২. electrode গুলো এখনো খুব জোরালোভাবে মস্তিষ্কের সিগনাল গ্রহণ করতে সক্ষম নয় | অনেক রকমের বাধারুপী সিগনাল মূল সিগনালকে নষ্ট করে দিতে পারে | যেমন EEG যখন হাতের নড়াচড়ার সিগনাল গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তখন ভলান্টিয়ার যদি চোখ পিটপিট করে (করবেই) তাহলে এটার কারণে উদ্ভূত সিগনাল, মূল সিগনালকে distorted করে দেবে | BCI এখনো তৈরী নয় এই পার্থক্য ধরার জন্য | হয়ত সময়ের সাথে সাথে, কারিগরির উন্নতির সাথে সাথে আরো নিখুঁত হবে এই ব্যবস্থা; কিন্তু এখনো পর্যন্ত BCI দ্বারা ব্রেন সিগনাল গ্রহনের ব্যাপারটা ঝড় বৃষ্টির সময়ে ফোনে কথা বলার মতই অস্পষ্ট |
৩. এরপর আসছে যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা | এখন তাও অনেক ভালো | সেই শুরুর দিকে EEG electrode গুলো যে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত থাকত সেগুলো বিশাল বিশাল আকারের, ঘর জোড়া mainframe computer | এখন হয়ত কম্পিউটার অনেকই ছোট হয়েছে, হয়েছে wireless ; কিন্তু এখনো ব্যবহারকারীকে যে কম্পিউটার বয়ে বেড়াতে হয় টার ওজন কমবেশি ১০ পাউন্ড | সময়ের সাথে সাথে তাল মেলানো ছাড়া কিছু করার নেই | ভবিষ্যতে কম্পিউটার আরো ছোট, হালকা আর বহনযোগ্য হয়ে উঠবে |
এবার একটু দেখা যাক, কারা BCI নিয়ে আরো কি কি কাজ হচ্ছে |
Neural Signal নামের একটা speech system নিয়ে গবেষণা চলছে বোবা মানুষদের কথা বলার জন্য | এই পরীক্ষাতে electrode বসানো থাকে মস্তিষ্কের সেই অঞ্চলে যেটা কথা বলা পরিচালনা করে (Broca's Area) | আর BCI কম্পিউটারের সাথে আরো যুক্ত থাকে sound speaker | অনেক training এর পর কোনো বোবা মানুষ এই system এর সাহায্যে ইংরেজি ভাষার ৩৯ টা phonemes (বিস্তারিত এখানে) ভাবতে পারে এবং BCI কম্পিউটার ও স্পিকারের সাহায্যে কথা বলতে পারে |
NASA ও এইধরনের একটা পরীক্ষামূলক সিস্টেম তৈরী করেছে | তারা অবশ্য সরাসরি মস্তিস্ক থেকে সিগনাল না নিয়ে গলা ও মুখের কম্পনের সিগনাল গ্রহণ করেছে BCI এর ইনপুট হিসাবে | এর সাহায্যে তারা google এ "NASA" শব্দটি "ভেবে ভেবে" লিখতে এবং search করতে সক্ষম হয়েছে |
Cyberkinetics Neurotechnology Systems নামের এক কোম্পানি BrainGate নামের একটা neural interface system বাজারেও ছেড়েছে | এই সিস্টেমের সাহায্যে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা wheelchair চালাতে, কৃত্রিম প্রত্যঙ্গ চালনা করতে বা cursor সরাতে সক্ষম হবে |
জাপানি গবেষকরা যে সিস্টেমটা বের করেছেন সেটা তারা সহজে বুঝে যাবেন যারা GAMER বা AVATAR সিনেমাটা দেখেছেন | পার্থক্য এটাই জাপানি গবেষকরা এটা প্রয়োগ করেছেন online এ | online এ তারা একটা virtual জগত বানিয়েছেন | যারা user, তারা ভেবে ভেবে ওই জগতে নিজেদের profile avatar টা কে চালনা করতে পারবেন | তারা এই online জগতের নাম দিয়েছেন Second World!
প্রশ্ন জাগতেই পারে : মস্তিষ্কের ভেতরে বসানো chip এ বাইরে থেকে ইলেকট্রিক সিগনাল পাঠিয়ে কেউ যদি কারো ভাবনা চিন্তা পরিচালিত করতে শুরু করে? কোনো অন্ধ মানুষের BCI system কে bypass করে কেউ যদি তার ইচ্ছা মতো ভিসুয়াল সিগনাল পাঠায়ে, তাহলে ওই অন্ধ মানুষটাকে নিজের ইচ্ছা মতো যা খুশি দেখানো সম্ভব হতেই পারে?!
উত্তর হলো, এটা এখন পর্যন্ত সম্ভব না | তবে ভবিষ্যতে যে "cerebral hacker" (নামটা আমারই দেয়া) গোষ্ঠী যে বেরোবেনা, সেটা হলফ করে বলা যাচ্ছেনা! সেটা সত্যি হলে গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকবেনা | কাউকে "সম্মোহন" করা বা কারো গোপন চিন্তা জেনে ফেলার মতো ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটতে শুরু করবে | দেখা যাক, ভবিষ্যত কি বলে | অপেক্ষা ছাড়া তো গতি নেই |
তথ্যসূত্র ও আরো বেশি বেশি জানার জন্য এই লিঙ্ক গুলোতে ঘুরে আসুন :
http://computer.howstuffworks.com/brain-computer-interface.htm
http://faculty.washington.edu/chudler/facts.html
http://en.wikipedia.org/wiki/Brain%E2%80%93computer_interface
http://bme.sunysb.edu/labs/wlin/research/ArtificialVision.html
http://news.bbc.co.uk/2/hi/science/nature/606938.stm
আমি অনুপ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 6 টি টিউন ও 144 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
অসাধারণ টিউন । আপনার টিউন টি মনোনীত হোক